আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অচেনা চীনে ৭

ভেনের কথা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম। অনেক কিছু ভাঙ্গার কথা শুনেছি কিন্তু ব্রোকেন ক্লথ? যে মেয়েটা কাপড় নিয়ে গিয়েছিল সে ফিরে এল একটু পরে। হাতে একটা টি সারট। তার কলারের কাছে একটা ছোট্ট ফুটো আমার মত প্রায় কানা মানুষের চোখেই পড়ার কথা না। বললাম অসুবিধা নেই।

তুমি পরিস্কার করতে দাও। পরদিন হ্যান সাহেব এল একটু দেরিতে। গাড়িতে চিন্তিত মনে হল তাকে। যাবার সময় যে কটা নিঊজ পেপার স্টান্ড ছিল সবকটিতেই সে নামলো এবং কিছু না কিনে গজ গজ করতে করতে ফিরে এল। হ্যানের সাথে কথা বলা আর দেয়ালের সাথে কথা বলা সমান।

এদের সাথে কথা বলার জন্যে আমি নিজস্ব একটা পদ্ধতি উদ্ধাবন করেছি। সরা সরি বাংলায় কথা বলি। এতে কোন উপকার হয়তো হয় না, কিন্তু ঠিক বিদেশ বিভুইয়ে আছি মনে হয় না। বললাম কি সমস্যা হ্যান ইশারা ইঙ্গিতে যা বলেত চেয়েছিল তা শোনা গেল ভেনের মুখে। হ্যান কে বলা হয়েছিল আমার জন্যে ইংরেজি খবরের কাগজ খুঁজতে।

এই খোঁজা খুঁজিতেই তার দেরি হয়েছে আমার কাছে পৌছাতে। আমাকে অফিসে নেবার এ পথেও সে আসলে ওই কাজই করছিল। বড় খাটা খাটুনি গেল বারোটা প্রযন্ত। ওদের শো রুমে (ওরা যাকে শো রুম বলে। আমার তাকে শো রুম মনে হয়নি।

বিশাল একটা ঘর জুড়ে বিভিন্ন রকম বায়োডাইজেস্টারের সাচ ডিস্প্লে করা। একদিকে ২টি জেনারেটর। একটি দেয়াল জুড়ে ডায়াগ্রাম আর একপাশে বায়োগ্যাসে জ্বলা বিজলী বাতি। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের সস প্যান, ওয়াটার হিটার। মোট কথা আধাআধি কাজ করার জাত নয় চীনারা বায়োগ্যাসের সম্পূরণ উপযোগিতা পাবার জন্যে ওরা বায়োগ্যাসে ব্যবহারের সরঞ্জামও তৈরি করে ফেলেছে।

(ওরা বলে সাধারণ গ্যাসের তুলনায় বায়োগ্যাসে ইম্পিউরিটিস বা অশোধিত উপাদান বেশি থাকে। বায়োগ্যাসের সম্পূর্ণ উপকারিতা পাবার জন্যে বায়োগ্যাস কাস্টমাইজড সরঞ্জাম ব্যবহার করাই ভাল) এখানেই শুরু হল আমার শিক্ষা জীবন। বলাই বাহুল্য খুব সুখ কর হলনা। একটা টেন মিটার কিউব ডাইজেস্টারের সাচ ডিস্প্লেতে ছিল জোড়া অবস্থায়, কাজ হছে এটাকে সম্পূর্ণ খুলে আবার লাগানো। আমাদেরদেশে এটা মিস্তিরিদের কাজ।

আমার সাথে যারা হাত লাগালো তারা সবাই মিস্তিরি, তবে এদের মধ্যে কেভিন গত বছর সিচুয়ান প্রদেশের একটা য়ুনিভারসিটি থেকে ইংরেজিতে এম এ পাশ করেছে, ভেনের মেজর ছিল বৈদেশিক বানিজ্যে আর লিঊ ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছে তিন বছর আগে। আর একটা কথা বলে রাখি, পিংডি (আমরা যেখানে আছি) কিন্তু শুধুই একটা জেলা শহর প্রাদেশিক রাজধানীও নয়। ঢাকায় থাকার সময় আমাদের কাছে টঙ্গীও কত দূরে মনে হয়। আড়াই ঘন্টা হাতুড়ি বাটাল নিয়ে কাজ করে ঘেমে নেয়ে উঠলাম। এর মধ্যে জেনারেল ম্যানেজার জিয়ানান ওয়াং দুইবার ঘুরে গেছেন।

প্রথম অর্ধেক কাজ হয়ে যাবার পর শীতের দেশের ছেলে ভেন গরমে অস্থির হয়ে ঊঠল। তার নেতৃত্বে এক বিশাল প্যাডেস্টাল ফ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে হাপাতে লাগলাম আমরা সবাই। লিঊ বললো তুমি তো ঘেমে নেয়ে উঠেছো, অভ্যাস নেই মনে হয়। কেভিন বলল ইজ ইউর কান্ট্রি কোল্ড? একটু পরে মিসেস ওয়াং এসে ভেনের সামনে হাত নাড়িয়ে কি সব বলতে থাকলো, ভেন বললো তুমি জামা কাপড় বদলে আসতে পারো এভাবে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। এদের এত খাতির আত্তি দেখে লজ্জা করতে লাগলো।

লাঞ্চের টেবিলে বসলাম বাধাকপি, মাংস আর ভাত নিয়ে। বাধাকপি এরা আমাদের মত কেটে রান্না করে না। বাধা কপি মানে বাধাকপির আস্ত আস্ত পাতা। সাথে একটা ঝোল জাতীয় পদার্থ আছে। চেখে দেখেছি ঝাল নুনের সমস্যা নেই।

জেনারেল ম্যানেজার কেও দেখলাম লাইনে দাঁড়িয়ে খবার নিতে। জেনারেল ম্যানেজার বলে একেবারে যে খাতির নেই তা নয়। মেনুতে তরমুজ ছিল। হং তার দুটি ফালি একটা প্লেটে করে তার সামনে রেখে গেল। আরও একজন হঙ্গের খাতির পেল সে হচ্ছি আমি।

ওয়াং সাহেব উঠে গিয়ে একটি তরমুজ রেখে এলেন, তার দেখা দেখি আমিও রেখে আসবো ভাবছিলাম, সেটা আর হল না। হঠাত হং প্রায় চেচিয়ে ঊঠল, দিস মিট ইউ ডোন্ট ইট। আমি পাতে প্রায় নিয়ে ফেলেছি, হঙ্গের কথায় সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে, আমি পাছে লোকে কিছু বলে ব্যমোয় ভুগছি। (কামিনী রায় কি আমার মত লোকার কথা ভেবেই কবিতাটা লিখেছিল?) ভেন আস্তে আস্তে বলল প্লিজ লিভ দিস প্লেট। আই ফ’গট ট্টু টেল, টু দে উই ঈটিং পোরক।

বাধাকপি তখন শেষ হয়ে গিয়েছে ক্ষুধা মরেনি। ধীরে সুস্থে দুই ফালি তরমুজ শেষ করে প্লেট নিয়ে ঊঠে গেলাম। আজ আর ভেনের কথায় হংকে দিয়ে ধোয়াবার জন্যে প্লেট রেখে গেলাম না। কোম্পানির মালিক ওয়াং সাহেবই (জেনারেল ম্যানেজার) যখন প্লেট ধুতে যাচ্ছে আমি তো কোন ছার! চায়ের আসর। লাঞ্চের পর আজও চারিদিক নিশ্চুপ।

কালকের মত একই জায়গায় চায়ের আসর বসেছে। সাথে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে সমানে। ধূমপায়ীদের স্বর্গরাজ্য চীন। পরিস্কার পরিচ্ছনারতার তেমন কোন বাড়াবাড়ি আছে বলে মনে হয়নি, সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠার সময় সিড়িতে সিগারেটের বাট পড়ে থাকতে দেখেছি। হোটেলের লবি, বাস স্টপ, হাট বাজারে তো কোন ব্যাপারই নয়, লিফটের মধ্যেও একজনকে সিগারেট খেতে দেখেছি।

তবে এই ধুমপায়ীদের বেশির ভাগেরই বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, চল্লিস পেরুনো চালশেরাও আছে এ দলে । তবে তরুন্দের দেখিনি। তাদের মধ্যে ধুমপানের প্রবণতা কম। কে এফ সি, স্কাইপ, ইন্টারনেট তাদের প্রিয় শব্দ। সিঙ্গাপুরের মত এখানেও ড্রাইভাররা ছাড়া সাধারণ মানুষ রাস্তা ঘাট খুব একটা চেনে না।

চেনার দরকার মনে করে না। মোবাইলেও তো ইন্টারনেট আছে, ঠেকে গেলে সার্চ দাও। আমারও চায়ের তেষ্টা পেয়েছিল, কামিনী রায়কে দূরে ঠেলে দাঁড়িয়ে গেলাম চায়ের টেবিলের সামনে। ঊঠে সিগারেট বাড়িয়ে দিলেন মিঃ লি; তিনি কোম্পানির বড় পদে আছেন। জেনারেল ম্যানেজারের দুই ধাপ নিচে তার অবস্থান।

সিগারেট না নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পড়লাম। চীনারা বড় কাপে চা খায়না। আয়োজনটি জম্পেশ। একটা আধা গোল কাঠের টেবিল সামনে নিয়ে বসেন হোস্ট, বাকিরা বসে অর্ধ বৃত্তাকারে তাকে ঘিরে। একটি কেটলিতে গরম হতে থাকে পানি।

মেজবান প্রথমে ছোট ছোট চায়ের বাটি গরম পানি দিয়ে অন্যদের সামনে দেন। তারপরে আর একটা টি পটে চায়ের পাতা ফেলেন, পানি ঢালেন এর পর একটু পর পর ভরে দিতে থাকেন অতিথিদের পেয়ালা। চায়ে দুধ চিনি কিছুই থাকে না। গরমও তেমন নয়। তবু তো চা! চায়ের আসরে তুমুল হাসি তামাসা চলছে লি সাহেব এক টানা কথা বলে একটু থামেন।

শেষের দিকে তার তার কথা গুলো দ্রুত লয়ে হতে থাকে, এর পর তিনি হো হো করে হাসতে থাকেন। আমি নিরবে বসে থাকি। হাসি ঠাট্টা আমাকে নিয়ে হচ্ছে কি না তাও জানিনা। শেষ পর্যন্ত ধন্যবাদ দিয়ে উঠে পড়লাম। আসরের অন্যরা বলল বা-য়ো।

চীনাদের মধ্য যারা ইংরেজি জানেই না তারাও দুই একটি শব্দ শিখে রাখে যেমন থাঙ্কে (থ্যঙ্ক ইউ), বা-য়ো ( বাই)। দেড়টার সময় আবার কাজে লেগে গেলাম। ভেন বলল কাল আমরা কাছের একটা গ্রামে নিয়ে যাবো তোমাকে দেখো কিভাবে বায়োগ্যাস আমাদের কাজে লাগছে। প্রস্তাবটা লোভনীয়। চাইনিজ গ্রাম দেখার ইচ্ছে ছিল আগে থেকেই।

(অসমাপ্ত) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।