আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হয়তো তোমারই জন্য (পর্ব - ২)

পাশেই বসে আছে দিপ্রা । এতোদূর থেকে ছুটে এসেছে মেয়েটা শুধু আজকের এই দিনটির জন্য। অথচ আমি পারিনি। নাকি ও যেটা করেছে সেটা পাগলামী আর আমারটাই বাস্তব। এই হিসাব কে মিলাবে! তবে প্রতিটি মুহুর্ত অনেক আনন্দে ভরে দিতে হবে যেন ও কোন কষ্ট না নিয়ে ফেরে।

- কি ভাবছো? - কিছু না , তুমি কি ভাবছো? - ভাবছি জীবন একেই বলে। কাল কোথায় ছিলাম আর আজ কোথায়। কেমন যে স্বপ্নের মতন মনে হচ্ছে। দাঁড়াও তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখি। ...বলেই ও আমার চুল ধরে টানতে শুরু করল।

-তুমি যে কিনা! কবে বড় হবে, বলো তো?- তোমার কাছে? কোনদিনই না। - মাথা দুলাতে দুলাতে ছোটদের মত করে বলছে। দেখলেই কেমন মায়া লাগে আর ওকে কিনা আমি কত কষ্ট দেই। গাড়িতে ভাল সিডি রাখনা কেন? কি হৈ হুল্লোর মার্কা গান রেখেছো। দাঁড়াও তোমাকে একটা গান শোনাই।

আইপডে কিছুক্ষন খুটাখুটি করল তারপর বলল - পেয়েছি..এমনভাবে বলল যেন বিশ্ব জয় করেছে। আমার হাসি পেল । এতো ছেলে মানুষি যে করতে পারে মেয়েটা! হয়তো তোমারই জন্য হয়েছি প্রেমে যে বন্য, জানি তুমি অনন্য..... অদ্ভুত সুন্দর একটা গান , মনটা অন্যরকম ভাল লাগায় ভরে গেল। -শ্রীকান্ত,তাই না? - হুম্ , তবে অরিজিনাল মান্না দে। শোননি আগে? .. না বোধক মাথা নাড়ালাম।

- তা শুনবে কেন? সারাদিন শানিয়া শুনলে কি আর এসবের খোঁজ থাকে। কবে যে বড় হবে! বলে ও নিজেই হাসতে লাগল। ও হাসলে রিনি- ঝিনি একটা সুর খেলা করে এতোদিন শুনেছি আজ দেখছি আমি অবিভূত হয়ে দেখছি। খরগোশের মতন ছোট ছোট দাঁত। - শোন , এই গানটা যেদিন মন থেকে গাইবে সেদিন ভাববো তুমি আমাকে অনেক পছন্দ কর।

...জানি, এখন যদি কথা বাড়াই মন খারাপ করবে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম - কই যাবে বল? - আজ সারা রাত ঘুড়বো। আর মাঝে মাঝে খেতে নামব। - যেভাবে স্নো পড়ছে মনে হয়না না সম্ভব হবে। তার থেকে সামনে একটা তার্কিশ রেস্তোরা আছে ওখানে যাওয়া যাক, কি বল? .. ও বাধ্য মেয়ের মতন মাথা নাড়াল।

ওর এই ব্যাপারটা আমার ভাল লাগে। কোন কিছু যদি ধীরে ধীরে বোঝানো যায় সেটা বোঝে। কিন্তু আমারই ধৈর্য্য থাকেনা। খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, কিছুই খাচ্ছেনা - কি হল মন খারাপ? - না ব্যাক পেইন করছে - হুম্ , করবেই তো। এতোটা পথ জার্নি করে এসেছো।

রেষ্ট করে রাতে বের হলেই হতো। কথাতো শুনবেনা , বলবে ঝাড়ি দিচ্ছি। কোন কথাই বলছে না। - কি হলো মন খারাপ করে দিলাম নাকি? ..মাথা নেড়ে না বোঝাল। - চল এখন বাসায় যাই, পরে ভাল লাগলে বের হব, ঠিক আছে? বাইরে বের হয়ে জেদ ধরেছে কিছুক্ষন হাঁটবে।

কি আর করার ! দাঁড়াও , একটু অন্যরকম কিছু করি। ভয় পেলাম, আবার শুরু হয়ে গেছে, তবে মন্দ লাগছে না। - শোন, তুমি গাইতে জান না, আমিও না সো একটা গান ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকলে ভালই লাগবে,কি বল? আমার জবাবের অপেক্ষা না করে বলল - এবার একটা হিন্দি হয়ে যাক। প্রচন্ড শীতের সন্ধ্যা, সাথে উড়িয়ে নেয়া বাতাস। আমরা দুজন হেঁঠে চলছি, কারও মুখে কথা নেই।

ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়েছে - লাগ যা গালে কে ফির ইয়ে হাছি রাত হো না হো শায়েদ ফিরছে জানমমে মে মুলাকাত হো না হো.... সত্যি অন্যরকম একটা ব্যাপার! ওর দ্বারাই সম্ভব এমন আবহ তৈরী করা। আমার খুউব ইচ্ছে করছে ওর হাতটা ধরে হাঁটতে। বলেই ফেললাম - তোমার হাতটা কি একটু ধরতে পারি? ..ও আমার দিকে তাকাল । মনে মনে একটু ঘাবড়ে গেলাম। কে জানে কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে।

- একটু ধরলে না ধরাই ভাল। সারাজীবনের জন্য ধরলে না হয় ভেবে দেখতাম... বলে হাসতে লাগল। আমার নিজের উপরই রাগ হল। কেন যে ওর মতন সহজ করে সবকিছু বলতে পারিনা। ...ও হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

আমরা দুজনে হেঁটে চলছি অজনার পথে। মনে মনে গাইছি - এই পথ যদি শেষ না হয়...... আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আমার এই দুই রুমের অগোছানো সংসারটাকে গুছিয়ে দেবার জন্য কি কষ্টটাই না করছে! বাইরে থেকে ফিরেই নেমে পড়েছে এই কাজে। আচ্ছা, সব বাঙ্গালী মেয়েরাই কি এমন নাকি, যার মধ্যে বন্ধু- প্রেমিকা- মা'র সমন্বয়!!! আমার আগে একটা সম্পর্ক ছিল এখানকারই একটা মেয়ের সাথে। সবকিছু শেয়ার করেছি তিন বছর কিন্তু কিছুদিনের পরিচয়ে ও আমাকে যে মায়ার বাঁধনে বেঁধেছে এমন অনুভূতি আমার আগে কখনও হয়নি।

...কই গেল আবার! খুঁজতে গিয়ে দেখি কিচেনে। - কি করছো? - কি আর করব। তোমার সবকিছুতো গুছানো তাই একটু এলোমেলো করছি। কি খাবে বল? -কেন রাঁধবে নাকি! তাহলেই হয়েছে। ....আমি একটু মজা করলাম।

- ডোন্ট ওরি,তোমার থেকে ভাল হবে। - হুম্, কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে আমি করব আজ তোমার জন্য। তুমি না সব সময় আমার রান্না খেতে চাইতে। - চাইতাম কিন্তু এখন চাইছিনা। যাও তুমি টিভি দেখ।

আমি এদিকটা শেষ করে আসছি। ...এক রকম জোড় করেই আমাকে কিচেন থেকে বিদায় করল। আমার ভয় করছে মেয়েটা অসুখ না বাধিয়ে বসে। আসার পর থেকে একটুও রেস্ট করেনি, তেমন কিছু মুখেও দেয়নি। আমি জানি ও খুউব ক্লান্ত আর ওর একটা বাজে অভ্যেস হচ্ছে নিজের কষ্টগুলো কখনও শেয়ার করেনা।

কি যে করি ওকে নিয়ে। অবশেষে সকাল হয়েছে। সারারাত একফোটাও ঘুমাতে পারিনি। এই সকালটার জন্য অপেক্ষা করছি। দিপ্রার চোখে চোখ রাখতে পারবনা।

ওর মুখোমুকি হবার আগে কিছু একটা করতে হবে। কি করছে ও । দরজাটা আস্তে করে খুললাম - এক পাশ করে মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। কি নিস্পাপ মুখ! চোখের কোলে পানি জমে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারা রাত কেঁদেছে।

আমি নিজেই এর জন্য দায়ী। বাসা থেকে বের হলাম । অনেকগুলো কাজ করতে হবে। কোনটা আগে করব,বুঝতে পারছিনা। মাথা কাজ করছে না।

সবদোষ আমার । .... কাল রাতে ও জেদ ধরল সারারাত গল্প করবে। খাওয়া শেষে বসেছি, সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল । কিন্তু কখন যে কি হয়ে গেল, যার জন্য আমাদের দুজনার কেউই প্রস্তত ছিলাম না। দিপ্রাও বাঁধা দেয় নি।

জানি, ও বাঁধা দিবে না , যদি আমি কষ্ট পাই। কিন্তু আমি তো জানি ওর মধ্যে কি ঝড়টাই না বয়ে গেছে। ওর আদর্শে - মূল্যবোধে চরম আঘাত লেগেছে। একথা ও কোনদিনই বলবেনা কিন্তু মনে মনে ভেঙ্গে পড়বে। আমি সেটা হতে দিবনা।

ওয়াইট চ্যাপলে যেতে হবে সাদেক ভাইয়ের কাছে, কে জানে উনি পারবেন কিনা? যেভাবেই হোক ম্যানেজ করতেই হবে। ওদিকে ঘুম থেকে উঠে আমাকে না দেখে দিপ্রা টেনশন করবে কিন্তু আমি এখন ওর সামনে পড়তে চাচ্ছি না । আজ পথও দেখি শেষ হচ্ছে না , ছুটির দিনেও এখানটায় জ্যাম বেধে আছে। ...অবশেষে সাদেক ভাইকে পাওয়া গেল। উনি আশ্বাস দিলেনন যেভাবেই হোক ম্যানেজ করবেন।

একটা বড় টেনশন থেকে রিলিফ পাওয়া যাকে বলে। এখন আবার আরেক জায়গায় ছুটতে হবে । একদিক থেকে ভালই হয়েছে সারাদিন ব্যস্ত থাকা যাবে। দিপ্রা থেকে পালিয়ে বেড়ানোর ভাল উপায়। কিন্তু ও যদি ভাবে যে ওকে আমি এড়িয়ে চলছি, তাহলে আবার কি করে বসে কে জানে।

ফোন করে জানিয়ে দেই। ..রিং বেজে চলছে কিন্তু ও পাশে কেউ ধরছেনা। কি হল কে জানে! আবার ঘুড়ালাম। অনেকটা সময় পর ধরল। - কি করছো? - তুমি কোথায়?- হঠাৎ করে একটা কাজে আটকা পড়ে গেছি।

প্লীজ তুমি রাগ করোনা আমার আসতে রাত হবে। - ঠিক আছে.. বলে ফোনটা রেখে দিল। কি বুঝলো কে জানে! ....রাত আটটা বাজে। সবকিছু প্রায় গুছিয়ে ফেলেছি। এখন শুধু সাদেক ভাইয়ের ফোনের অপেক্ষায় আছি।

ভাবছি আবার যাব নাকি উনার ওখানে কিন্তু উনিতো বলেছেন ম্যানেজ করে ফোন দিবেন। কখন থেকে পার্কের কাছে বসে আছি। বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের পথ, বাসায় যেতে সাহস হচ্ছে না। ফোনটা বেজে উঠল। হুম্ সাদেক ভাই।

ছুটলাম আবার ওখানে । এই সেই করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। আমাকে দেকে দিপ্রা বলল- তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কোন সমস্যা? - না, একটু কাজ ছিল - যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। জানি, সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। ..আমি যে সারদিন কিছু খাইনি ও বুঝলো কি করে! ও যে কিভাবে বুঝতে পারে, আমি পারি না।

মুখ ফসকে বের হয়ে গেল- খাইনি যে জানলে কি করে? -এই মাত্র গরম করেছি। খেয়ে নিও আমার ঘুম পাচ্ছে। ..দাঁড়ালো না। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি জানি ও নিজেও কিছু খায়নি কিন্ত বললে শুনবেনা এখন।

জেদী মানুষদের নিয়ে এই এক প্রবলেম। কথা না বাড়িয়ে আমি চটপট খেয়ে নিলাম। ওর রান্নার হাতও বেশ চমৎকার। ভালই হয়েছে আমার জন্য। ....রাতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি।

সকালে দিপ্রার ডাকে ঘুম ভাঙলো। - নাও চা খেয়ে নাও, আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে,তোমার আফিস মিস করে কাজ নেই, আমি একাই চলে যেতে পারব। - এটা কি বললে তুমি ! আমার খুউব মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। - শোন কথন, সেই রাতে যা ঘটেছে তার জন্য নিজেকে অপরাধী ভেবনা। আমার সায় না থাকলে নিশ্চয়ই তুমি আগাতে পারতে না।

সো ওসব ভেবে নিজেকে কষ্ট দিওনা। ...ও রুম থেকে বের হল। পাগল চটেছে। আমিও তৈরী হবার জন্য উঠে পড়লাম। এয়ারপোর্টে আমরা দুজন।

কোন কথা নেই। - তুমি গাড়ী আনলে না কেন?এতোটা পথ অফিসে যেতে কষ্ট হবে না?-তোমার জন্য না হয় একটু কষ্ট করলাম। - মানে কি?- এখন বলছি না - ঠিক আছে যখন খুশি বলো। আমি যাই সময় হয়ে গেছে। ভাল থেকো - তুমিও।

আমি চেয়ে আছি ওর দিকে । কচি কলাপাতা রঙের সাথে হালকা কমলা রঙের কাজ করা কামিজ,পিঠে ছড়িয়ে আছে রেশমী চুল। কি অপূর্ব দেখাচ্ছে ওকে!!!! মনে মনে কি ভাবছে কে জানে। যাই দেরী করা চলবে না। এর মধ্যে সাদেক ভাইয়ের ফোন।

টিকেট ম্যানেজ করে দেবার জন্য উনাকে আবার ধন্যবাদ দিলাম। ফোনটা রেখে ফরমালিটিস শেষ করে লাউন্জে এলাম। কিন্তু কই গেল আমার রেশমী চুড়ি। অবশেষে পাওয়া গেল এক কোনায় মাথা নীচু করে বসে আছে। জানি, এখন দুচোখে বৃস্টি ঝড়াচ্ছে।

পাশের চেয়ারটাতে বসেছি ও টেরই পায়নি। পকেট থেকে রিং টা বের করলাম। ওর কানের কাছে খুউব ধীরে ধীরে বললাম - will you marry me? দিপ্রা অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। যেন স্বপ্ন দেখছে। ওর এই অপলক চেয়ে থাকা আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলাম!!!! (চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।