আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উদ্বোধনের আগেই লন্ডন অলিম্পিক বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে বিরল সম্মান

হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ অলিম্পিকের এবারের আসর বসছে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে । ব্যানার, ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে চারদিক । ক্রীড়াবিশ্বকে স্বাগত জানাতে মুখিয়ে আছে স্বাগতিক শহর লন্ডন । আগামী ২৭ জুলাই সন্ধ্যায় সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত । বাঙালি-অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের স্টার্টফোর্ডে অলিম্পিকের মূল মঞ্চ ।

বাড়ির আঙিনায় উৎসব, তাই বর্ণিল হয়ে উঠেছে বাঙালিপাড়া । তবে মাঠে গড়ানোর আগেই এই অলিম্পিক বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে বিরল সম্মান । এবারের অলিম্পিক আয়োজনে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে আছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশিরা । রোকসানার হাতে মশালঃ আট হাজার সৌভাগ্যবান মশালবাহীর হাত হয়ে যুক্তরাজ্যের নানা প্রান্তে ছুটে চলেছে অলিম্পিকের শান্তির মশাল । যে কেউ চাইলেই অলিম্পিকের ঐতিহ্যবাহী মশাল বাহক হতে পারেন না ।

বাহকের থাকতে হয় বিশেষত্ব । যুক্তরাজ্যের নানা প্রান্তে আলোচিত নয়জন ব্রিটিশ বাংলাদেশি অলিম্পিক টর্চ বহনে সম্পৃক্ত হয়ে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস । এদেরই একজন রোকসানা । ২১ জুলাই লন্ডনের গ্রিনউইচ এলাকায় অলিম্পিক মশাল হাতে দৌড়াবেন ব্রিটিশ কিকবক্সিং চ্যাম্পিয়ন বাঙালি তরুণী রোকসানা বেগম । তিনি বললেন, ‘আমি আনন্দিত; মুখিয়ে আছি মশাল হাতে নেওয়ার জন্য ।

টর্চ হাতে পাওয়া বিশাল সম্মানের । ইচ্ছা আছে যে অলিম্পিক টর্চ নিয়ে দৌড়াব, সেটি নিয়েই বাংলাদেশে যাব । ’ অলিম্পিক স্মারকমুদ্রার নকশাকারঃ লন্ডন অলিম্পিক নিয়ে পাঁচ পাউন্ড সমমানের স্মারকমুদ্রা বের করার প্রস্তুতি নেয় ব্রিটিশ মুদ্রা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান দ্য রয়েল মিন্ট । স্মারক মুদ্রার নকশার জন্য যুক্তরাজ্যের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আয়োজন করা হয় উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার । বিজয়ী হয়ে ব্যাপক আলোচিত হন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি তরুণ সায়মান মিয়া ।

কয়েক হাজার নকশার মধ্য থেকে নির্বাচিত হয় তাঁর নকশাটি । সায়মান বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী । তাঁর নকশা করা অলিম্পিক ২০১২ সালের স্মারকমুদ্রাটি এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীজুড়ে । সায়মান বলছিলেন, ‘স্থাপত্যশৈলী নিয়ে পড়াশোনা করছি, ড্রয়িং বরাবরই পছন্দের । স্কুলের একজন শিক্ষক প্রতিযোগিতাটি সম্পর্কে জানিয়ে অংশ নিতে বললেন ।

তার পরও বিষয়টি আমার মাথায়ই ছিল না । এক মাঝরাতে হুট করে আমার ঘুম ভেঙে গেলে নকশাটি আমার মাথায় আসে । দেরি না করে পেনসিল দিয়ে একটু সাজিয়ে রেখেছিলাম । আবার ভুলে বসি । ভাগ্যিস, শেষতক জমা দিতে পেরেছিলাম ।

মুদ্রার নকশা নিয়ে আমার ভাবনায় প্রাধান্য ছিল ব্রিটিশ স্থাপত্যের সঙ্গে ক্রীড়ার নিবিড় সমন্বয় ঘটানো । মুদ্রার নকশায় স্থান পেয়েছে ব্রিটেনের নান্দনিক স্থাপত্যকর্ম বিগ বেন, লন্ডন আই, সেন্ট পল ক্যাথিড্রেল ইত্যাদি । এদিকে নকশা জমা দেওয়ার পর আর কোনো খবর নেই, আর এমনটা হবে, সে তো জানাই ছিল । প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি ঘরের মানুষ ছাড়া কাউকে বলিওনি । এরপর আসে চমক ।

দ্য রয়েল মিন্টের কর্মকর্তা কেভিন ফোন করে বলেন, আমার আঁকা নকশায় তৈরি হবে লন্ডন অলিম্পিকের স্মারকমুদ্রা !’ ১৯৫৫ সালে ব্রিটেনে আসেন সায়মানের বাবা আরজু মিয়া । চার ভাইবোনের পরিবারে গর্বিত মা পিয়ারা খাতুন সায়মানের সাফল্যে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘পূর্বপুরুষের মাটির গল্প শুনেই তারা বড় হয়েছে । আমার সন্তানের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশিদের মুখ উজ্জ্বল করবে বলে জানি; আমি খুবই খুশি । ’ ১০ বছর বয়সে শেষবার বাংলাদেশে গিয়ে থাকলেও ভাটা পড়েনি দেশের প্রতি টান । বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আত্মবিশ্বাসী হয়ে সায়মান জানান, ‘সুযোগ পেলে দেশে গিয়ে কাজ করার প্রচণ্ড ইচ্ছা আছে আমার ।

’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খুদে শিল্পীদের একজনঃ নয় বছর বয়সের চঞ্চলপ্রাণ সৌগত প্রিয়ম, যাকে অলিম্পিকের বিশালত্ব বোঝাতেই পারছেন না তার মা মিনাক্ষী দাশ । এ নিয়ে কথা হয় প্রিয়মের সঙ্গে । সে বলে, ‘আমাদের স্কুল থেকে ৩০ জন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছি । অনেক বন্ধু বেড়ে গেছে, তাই রিহার্সেল করতে ভালো লাগছে । ’ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, ‘নিজের ইচ্ছামতো কিছু করতে পারলে আরও ভালো লাগত ।

’ সন্তানের গর্বিত মা মিনাক্ষী বললেন, ‘আমার ছেলেই জানে, কী করে নির্বাচিত হলো । অলিম্পিক যেন ওর কাছে কোনো বিষয়ই নয় ! বিশ্বাস করি, একদিন অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার বিষয়টি ওর মনকে আরও বড় করবে । ’ প্রিয়মের মতো আরও প্রায় ৯০ জন বাঙালি কিশোর, তরুণ-তরুণী লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের নানা পরিবেশনায় অংশ নিচ্ছে, মহড়ায় ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আকরাম খানঃ সারা বিশ্বে অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এক অন্য রকম আবেদন থাকে । খেলার বাইরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি কিংবা টেলিভিশনে দেখার জন্য মুখিয়ে থাকে কোটি কোটি মানুষ ।

আর তাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কেমন হবে, এই নিয়ে চলে নানা জল্পনা-কল্পনা । লন্ডন অলিম্পিকে স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করবে ৮০ হাজার সৌভাগ্যবান দর্শক । আর বাইরে টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা ইন্টারনেট-টিভিতে চোখ রাখবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ । এমন আয়োজনেও বাঙালির বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ - উচ্চমানের একক পরিবেশনার ভারটি এক বাংলাদেশির কাঁধেই চাপিয়েছেন লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মূল পরিকল্পনাকারী, অস্কারজয়ী নির্মাতা ড্যানি বোয়েল । লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কোরিওগ্রাফি মাথায় রেখে নানা নৃত্য প্রযোজনা দেখে বেড়াচ্ছিলেন স্লামডগ মিলিয়নেয়ার ছবির এই পরিচালক ।

অবশেষে তাঁর সেরা পছন্দ নামী নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি আকরাম খান । আকরাম বললেন, ‘ড্যানি বয়েল আমার কোম্পানির প্রযোজনা ভার্টিক্যাল রোডের প্রদর্শনী দেখেন। এর কিছুদিন পর অফিসে ফোন করে দেখা করতে চান । এক সন্ধ্যায় আমাদের দেখা হয় । আলাপচারিতার শুরুতেই বললেন, অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কোরিওগ্রাফি করে দিতে হবে ।

এর সঙ্গে অবশ্যকরণীয় শর্ত হলো, আমাকেও নাচতে হবে । বিস্মিত হই, একটু ভেবে চিন্তা করে বলি, পুরো অনুষ্ঠানের কোরিওগ্রাফি করতে পারব না । তবে নিজের একক পরিবেশনায় অংশ নেব বলে তাঁকে নিশ্চিত করি !’ বিশেষ কী করবেন, অলিম্পিকে এমন প্রশ্নে আকরাম বলেন, ‘অলিম্পিকে আমার পরিবেশনার দায়িত্ব একান্তই আমার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন ড্যানি । বাংলাদেশ নিয়ে "আমার দেশ" প্রযোজনাটিও দেখতে এসেছিলেন ড্যানি বয়েল । দেখে তিনি বললেন, 'তোমার নৃত্যশৈলীর জন্য তাকিয়ে আছে বিলিয়ন দর্শক ।

' আমি চেষ্টা করে চলেছি, একেবারে ভিন্ন ধাঁচের নৃত্যকর্ম উপহার দিতে । ’ এনাম আলীর লি রাজ রেস্টুরেন্টঃ দুয়ারে অলিম্পিক। লন্ডনে বেড়ে চলেছে সারা বিশ্বের পর্যটকদের ভিড় । অতিথিদের স্বাগত জানাতে যেমন প্রস্তুত লন্ডন, তেমনি আয়োজকদের চোখ এড়ায়নি অতিথিদের রসনাবিলাসের বিষয়টিও । পূর্ব লন্ডনে বাঙালির প্রাণকেন্দ্র, বাংলাটাউনখ্যাত ব্রিকলেনকে লন্ডন অলিম্পিকের অফিশিয়াল কারি ক্যাপিটাল বা রসনা-রাজধানী ঘোষণা করেছে আয়োজক কমিটি ।

ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট হিসেবে খ্যাত হলেও ব্রিটেনে কারিশিল্পটি মূলত বাঙালিদেরই নিয়ন্ত্রণে । বছরে প্রায় চার বিলিয়ন পাউন্ডের এই বিশাল শিল্পের ৮০ ভাগেরই মালিকানা বাঙালিদের হাতে । শুধু ব্রিকলেনের রাস্তার দুই পাশে কমপক্ষে ৫০টি বাঙালি রেস্টুরেন্ট । শুধু ব্রিকলেনই নয়, যুক্তরাজ্যের নানা প্রান্তে প্রায় ১২ হাজার বাঙালি রেস্টুরেন্ট অতিথি আপ্যায়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন লন্ডন অলিম্পিক কমিটির চেয়ারম্যান লর্ড সাব কো । এদিকে কারি অস্কারখ্যাত ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের প্রবর্তক এনাম আলীর লি রাজ রেস্টুরেন্ট লন্ডন অলিম্পিকে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্ত হয়েছে ।

উজ্জ্বল আয়েশাঃ ২০০৫ সালের ৬ জুলাই । সিঙ্গাপুরে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক আয়োজক কমিটির সভা - কে হবে ২০১২ সালের অলিম্পিক আয়োজক ? সেই ফয়সালা হবে এই সভাতেই । শেষ লড়াইটা লন্ডন আর প্যারিসের মধ্যে । যাকে বলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই । লন্ডনের ১১ জনের প্রতিনিধিদলে আছেন বাঙালি নারী আয়েশা কোরেশী ।

পিনপতন নীরবতা ভেঙে হঠাৎ মিলনায়তনে ঢুকে পড়ল ৩৩ জন শিশু-কিশোর, যাদের পূর্বপুরুষের শিকড় পৃথিবীর নানা প্রান্তের ৩৩টি দেশ । বহুজাতি, নানা ভাষাভাষীর মানুষের শহর লন্ডনের জাতিগত বৈচিত্র্য তুলে ধরতেই তাদের নিয়ে আসা । এ ব্যাপারটা বেশ নাড়া দিল সভার অতিথিদের । আর এরই সুবাদে শেষতক চতুর্থ রাউন্ডে চার ভোট বেশি পেয়ে বিজয়ীর হাসি হাসে লন্ডন । আর এই ৩৩টি দেশের ৩৩ জন শিশু-কিশোরকে হঠাৎ সভায় উপস্থাপন করার আইডিয়া আয়েশা কোরেশীর ।

আয়েশা বললেন, ‘তখন আমি বিবিসিতে কমিউনিটি বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছি । নানা জাতি-বর্ণের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা । হঠাৎ লন্ডন অলিম্পিক আয়োজক প্রতিনিধিদলে কাজ করার সুযোগ হয় । সবার লক্ষ্য একটাই, অলিম্পিক আয়োজন নিশ্চিতকরণ । সিঙ্গাপুরে চূড়ান্ত পর্বে যাওয়ার দুই সপ্তাহ আগে পরিকল্পনা করি, বাচ্চাদেরও সঙ্গে করে নিয়ে যাব ।

’ লন্ডন অলিম্পিক আয়োজনে তার অক্লান্ত শ্রমের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে ব্রিটেনের রানির দেওয়া এমবিই (মেম্বার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার) উপাধিতে ভূষিত হন আয়েশা । আয়েশা এখন লন্ডন অলিম্পিক ডাইভারসিটি কমিটির একজন সম্মানিত উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন । আয়েশা বললেন, ‘আনন্দ পাই এই ভেবে যে অলিম্পিক আয়োজনে আমারও একটু শ্রম মিশে আছে । আর একজন বাঙালি নারী হিসেবে এই বিশাল আয়োজনের অংশ হতে পারাটা আরও বেশি গৌরবের। ' তথ্যসূত্রঃ Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.