আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাঃ জনাব মেননের মতামতের সূত্র ধরে কয়েকটি প্রস্তাব

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!! প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে জনাব রাশেদ খান মেনন-কে কোন প্রকার পৃষ্ঠপোষকতার উদ্দেশ্যে এ লেখা নয়। এটাও বলা যেতে তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের কোন কর্মকান্ডকে ইনডোর্স করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও এ লেখায় নেই। লেখাটির একমাত্র আলোচ্য বিষয় হচ্ছে গত শনিবার সাংবাদিক সম্মেলনে মেনন সাহেব দেশের নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সংক্রান্ত যে মতামত দিয়েছেন তার উপর অল্পবিস্তর আলোচনা করা। কোনপ্রকার রাখঢাক না রেখেই প্রথমে স্বীকার করে নেয়া দরকার যে, মেনন সাহেব দেশের নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সংক্রান্ত যে মতামত দিয়েছেন তা আমি সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করি। তবে বিষয়টা এমন নয় যে নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সংক্রান্ত যে মতামত মেনন সাহেব রেখেছেন তা নতুন কিছু।

জনাব মেননের পূর্বেও ইমিডিয়েট পূর্বতন নির্বাচন কমিশনের কমিশনাররা এবং দেশের কোন কোন বুদ্ধিজীবী নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সংক্রান্ত প্রায় একই রকমের মতামত সময়ে সময়ে প্রদান করেছেন। তবে মেনন সাহেবের মতামতটি এ কারণে তাৎপর্য্য বহন করে যে এই প্রথম দেশের কোন সক্রিয় রাজনীতিবিদ নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার বিষয়ে এ ধরণের মতামত সরাসরি প্রদান করলেন। এর বাইরেও জনাব মেনন ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের একজন অংশীদার হওয়ার কারণে তার মতামতটি আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে। উচ্চ আদালতের রায় এবং বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় কেয়ারটেকার সরকার একটি পতিত বিষয়। বিরোধী দল যতোই আন্দোলন করুক না কেন এটা আর ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা দেখছিনা।

আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানীক এবং শক্তিশালী করার তাগিদেই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তির প্রয়োজন আছে। কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থায় গণতন্ত্র হচ্ছে সংসদ ভেঙে দেয়ার পর জাতীয় নির্বাচনের সময়ে দলনিরপেক্ষ কিছু লোকের মাধ্যমে একটি নির্বাচন। এখানে গণতন্ত্র শুধু জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে শুধু জাতীয় নির্বাচনকে বুঝায় না। দেশের সকল প্রতিষ্ঠানকে জনগণের মতামতের অধীনে আনাই সত্যিকারের গণতন্ত্র।

এটার জন্য প্রয়োজন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ। কারণ জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ঐ স্থানীয় সরকারের সাথেই। কিন্তু স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা কোন অবস্থায়ই কেয়ারটেকার সিস্টেমের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এটা শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যখন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ শক্তিশালী হবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতার কারণে স্থানীয় পর্যায়ে এখনও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় টাউট,বাটপার, মাস্তানরাই নির্বাচিত হয়ে আসছেন।

ফলে জনগণ সকল অবস্থায়ই গণতেন্ত্রর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশ নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করেছে, গণতান্ত্রিক সুবিধা ভোগ করছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও সেখানে নির্বাচন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ সে সরকারের থাকেনা। নির্বাচন সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত/ক্ষমতার প্রয়োগ নির্বাচন কমিশনই করে থাকে। আমরা ভিন্নগ্রহের কোন জীব নই।

কাজেই পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক জাতি বা দেশ যে পদ্ধতি অবলম্বন করে গণতান্ত্রিক সুবিধা ভোগ করছে সেখানে আমাদের তা করতে না পারার কোন কারণ নেই। আমরা অবশ্যই তা করতে পারি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার তাগিদে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ এবং নির্বাচনকালীন সরকারের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ বিষয়ক আলোচনাটা তাই বর্তমান সময়ে রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। এ তাগিদ থেকে রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ হিসেবে এ বিষয়ে জনাব মেননের মতামতের সূত্র ধরে আমার ব্যক্তিগত কিছু প্রস্তাব নিম্নে উপস্থাপন করলাম। এক্ষেত্রে জ্ঞান/জানার সীমাবদ্ধতা দয়া করে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

(১) জাতীয় সংসদের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৫ বছর। সংসদ ভেঙে দেয়ার মতো কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে সংসদ সদস্যদের ৫ বছরে সে পদে থাকাটা নৈতিক অধিকার। কাজেই জাতীয় নির্বাচন সংসদের মেয়াদ শেষ হবার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়াই যুক্তিযুক্ত। যদি সংসদ বর্তমান থাকা অবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল থাকার কারণে তিনি যে সুবিধা পান তা সুষ্ঠু নির্বাচনে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। (২) সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পরে নির্বাচনকালীন সরকার সে সময়ে শুধু সরকারের দৈনন্দির কাজসমূহ দেখাশুনা করবেন।

সরকারের অত্যাবশ্যক সেবাখাত ব্যতিত অন্যকোন খাতে উন্নয়নের নামে নতুন করে অর্থ ব্যয়/মঞ্জুরী করা যাবেনা। সরকারের মন্ত্রীবর্গ কেবলমাত্র সরকারী কাজের সময়ে প্রাপ্য প্রটোকল পাবেন। নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য প্রার্থী বা নাগরিকরা যে সুবিধা পান কেবলমাত্র ততটুকুর জন্য বিবেচিত হবেন। (৩) প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সময়ে অনুসারিত সার্চ কমিটি ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে কাজ করতে পারে। এটিকে আইনে পরিণত করা যেতে পারে।

প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করে অন্যান্য সাংবিধানীক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সমন্বয়ে এ সার্চ কমিটি গঠিত হতে পারে। সার্চ কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হতে পারেন এমন ব্যক্তিদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করবেন। রাষ্ট্রপতি এ তালিকা হতে নিজের বিবেচনায় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং ব্যক্তিবর্গকে নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দিবেন। নির্বাচন কমিশন গঠনে সরকার তথা নির্বাহী বিভাগের কোন ভূমিকা থাকবেনা। (৪) নির্বাচন কমিশনে কমিশনারদের সংখ্যা কত হতে পারে তা বর্তমান আইনে উল্লেখ নেই।

এটা নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। কারণ অনেক সময় দেখা যায় (যেমনটা গত বিএনপি সরকার করেছিল) সরকার তার মতের বাইরের কমিশনারদের কাছ থেকে কমিশনকে নিয়ন্ত্রণে আনার নিমিত্ত নিজের পছন্দসই যতজন ইচ্ছা কমিশনার নিয়োগ করেন। কমিশনের আকার সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্চনীয়। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সুবিধা হবে। (৫) জাতীয় নির্বাচনের সময়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের সকল কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হবে।

(৬) স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে (শুধুমাত্র নির্বাচনকালীন সময়ে) নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের নিমিত্ত সরকারের যে সমস্ত বিভাগকে নিজের আওতায় নেবার প্রয়োজন বোধ করবে সরকার তা হস্তান্তরে বাধ্য থাকবে। (৭) নির্বাচন সংক্রান্ত যেকোন অনিয়ম, দুর্নীতির ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। এসব বিষয় প্রচলিত আদালতের আওতামুক্ত হবে। প্রচলিত আদালতের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে দেখা যায় সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সে নির্বাচনের অনিয়ম, দুর্নীতির মামলাগুলোর কোন সুরাহা হয় না। নির্বাচন কমিশন আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসব অভিযোগের সুরাহা করবে।

(৮) প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারগণ কমিশন হতে অবসরের পরে প্রজাতন্ত্রের অন্য কোন পদের জন্য বিবেচিত হবেন না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে আমি বিশ্বাস করি যে, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী এবং অব্যাহত রাখার স্বার্থে উপরোক্ত বিষয়সমূহ অনতিবিলম্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরী। তবে এগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন সরকার এবং বিরোধীদলের বিচক্ষণতা ও পারস্পরিক সহনশীলতা। তবে সবার আগে প্রয়োজন উভয়ের মাঝে সে অহংবোধ ও ছাড় না দেওয়ার যে প্রবণতা বিরাজমান তা ত্যাগ করা। অবশ্য তাঁরা যদি তা করতে ব্যর্থ হন তবে জনগণের সাথে সাথে নিজেদেরও ক্ষতি করবেন।

১/১১ এর অভিজ্ঞতা তাঁরা নিশ্চয়ই এতো তাড়াতাড়ি ভুলেননি। সে কারণেই আরেকটি ১/১১ নিশ্চয়ই ওনারা চাইবেন না। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.