আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পহেলা বৈশাখ এবং শাহবাগী জারজেরা

আমার একটা নতুন নাম হয়েছে। শাহবাগী । আমার একার না। একসাথে অনেকের । প্রথমদিকে শুনতে ভালো লাগতো না ।

পীরতন্ত্রের ছোঁয়া আছে । আমপুরী,জামপুরী ইত্যাদির মত । মুরীদ শ্রেণীর নাম এমন হয় । আমি কারো মুরীদ না । তবে শুনতে শুনতে এখন আর খারাপ লাগে না ।

মনে মনে বলি, হোয়াটস ইন নেম ! আসলে আমি সলিড শাহবাগীও না। আন্দোলনের কারণে শুধু যাই না। জায়গাটে ঘুরতে ভালো লাগে। যতক্ষণ জোশ থাকে ততক্ষণ থাকি । গলা চড়াই।

লাকীর ফুলে ওঠা গলার রগের দিকে তাকিয়ে থাকি । তারপর একা হাঁটতে থাকি । চারুকলা আর পাবলিক লাইব্রেরীর ভিতরে,বাইরে,আশেপাশে । হাঁটার সময় "অবতার" ভাবে থাকি। জেতাবনের সন্ন্যাসীরা নাকি আশেপাশের অস্তিত্ব বুঝতে নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে করতো ।

আমি চেষ্টা করি । খুব একটা কাজ হয় না । ভীড়ে ধাক্কায় হাড় মাংস তার অবস্থান বারবার মগজে জানান দেয় । কেউ কেউ অবাক হয়ে তাকায় । আমার মুখভঙ্গির কারণে বোধহয় ।

নিজেকে অদৃশ্য মনে করে যে পুলক অনুভব করি তা আশেপাশের মানুষ আমার চোখেমুখে দেখতে পেয়ে বিভ্রান্ত হয় । পকেটে হাত ঢুকিযে হাঁটা আমার অভ্যাস । শীতেও ,গ্রীস্মেও। সম্ভবত অভ্যাসের ঋতুবৈচিত্র্য নাই । তবে সময়টা বসন্তের চলছে ।

কৃষ্ণচূড়ায় লাল ভাব । পাবলিক লাইব্রেরীর বাইরে বসা জোড়া গুলোর কৃষ্ণদের ও লাল লাল গাল । হাতে তরুণীর হাত । লাইব্রেরীর সিঁড়িতে বসে থাকি । দেখি ।

কি একটা হয় । মেয়েটা টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয় । তবে মিনিটখানেক পরেই আবার গভীর আবেগে মেয়েটা ছেলেটার হাত জড়িয়ে বসে থাকে । শাহবাগের রাস্তায় নানা খাবারের দোকান । বের হয়ে এসে পাঁচ টাকার বাদাম চিবুতে চিবুতে চারুকলার দিকে হাঁটতে থাকি ।

তিন সদস্যের পরিবার গুলো বেশি দেখা যায় । মাঝখানে ছোট্ট সন্তানকে রেখে দুপাশে হাঁটেন বাবা মা । নতুন দম্পতির সংখ্যাও অনেক । তারা কথা কম বলে । একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে।

মুখে মুখে পড়ে দুর্লভ ভাঁজ । চারুকলার ভেতরে কয়েকটা চক্কর দিয়ে বের হয়ে আসি । জাগরণের গান চলছে । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বক্তৃতা করছেন । সবাই ঝাঁকড়া চুলের।

সুন্দর কাটছাঁট চুলের শিক্ষকেরা সাধারণত এসব কর্মসূচীতে আসেন না । কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনি । এর মধ্যে খালি গায়ে একদল ছোট ছেলে মূল মঞ্চের দিকে দৌঁড়াতে থাকে । গায়ে রঙে লেখা বাংলাদেশ । কারো গায়ে মানচিত্র বা পতাকার ছবি ।

কয়েকটা ক্যামেরা দ্রুত ছবি তুলে নেয়। আন্দোলনকারীদের কয়েকজন তাদের আদর করে । কিছুক্ষণ শূন্যে লুফালুফি করে । ওরাও আনন্দ পায়। তারপর আবার ওরা ছুটোছুটি করতে থাকে ।

আমার গায়ে ধাক্কা খেল একজন। এভাবেই আমার এই জারজদের সাথে পরিচিতি হয় । প্রথমে নাম শুনে আমিও চমকে গিয়েছিলাম। এটা নাম হয় নাকি?এটা কি গালি নয়?ওরা হাসতে হাসতে জানালো ওদের সবার নাম জারজ । সবাই প্রায় একই বয়সের।

ছয় সাতজন । মেডিকেলের পাশে কোন এক রাতে ওদের জন্ম হয়েছে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে লোকজন এ নামে ডাকে । জারজ শব্দের অর্থ ওরা জানে না । বাবা মা বা পরিবার কি তাও বোঝে না ।

ওরা একটুতে হাসে । সে হাসি সংক্রামক । ওদের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । ওরা সবাই ভাই অথবা বন্ধু । একসাথে খায় ,একসাথে ঘুমায়।

একসাথেই অনাহারে থাকে । আজকাল ডাস্টবিনের খাবারও সহজলভ্য নয় । তবে শাহবাগে ওরা ভালো আছে । নিয়মিত আসে । নিয়মিত খাবার পায় ।

আইসক্রীম কিনে দিয়ে ভাব জমাই । প্রতিদিনই কিছুক্ষণ ওদের সাথে সময় কাটাই । ওরা আমার কাছে ওদের গোপন আড্ডার স্থান ফাঁস করে দেয় । নাম দেয়ার চেষ্টা করেছি। নেয় না।

সবার এক নাম । কিন্তু কিভাবে যেন যাকে ডাকি সেই বুঝে যায় । স্লোগান শেষে চা হাতে ওদের অপেক্ষা করি । ওরা আমার চেয়ে ব্যাস্ত । তবে নিরাশ করে না।

দেরিতে হলেও একবার দেখা করে । গল্প করি । ওদের কিছু খাবার কিনে দেই । আজ পহেলা বৈশাখ । জারজের দল খুব ব্যাস্ত ।

ভালো খাবারের বিশাল সম্ভাবনা। আমি যাচ্ছি তাদের সাথে দেখা করতে । নতুন কিছু জামা আর পান্জাবী কিনেছি । তাড়াতাড়ি দিয়ে দিই । কে জানে,অচিরেই আমিও হয়তো এদের পাশ দিয়ে অনুভূতিশূন্য হেঁটে যাওয়া ভদ্রলোক হয়ে পড়বো ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।