আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পহেলা বৈশাখ

প্রিয় মাধবীলতা... সেদিন তিনজনে একসাথে মিলে ঘুরব এমনটাই মনে মনে ভেবেছিল ওরা তিনজন তবে এই জীবনে যা যা আগে থেকে ভাবা হয় তার বেশিরভাগ ই হয়ে উঠে না চারপাশের নানাবিধ কারণে। তারপরেও আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকে অনেকটা সময় জুড়ে। কখনো কখনো মন না চাইলেও মনকে মানাতে হয় কেননা জীবনের স্বাভাবিক ঘটনাগুলো মেনে নেওয়াটাই উত্তম। আর তাই মাধব যখন জানতে পারল পহেলা বৈশাখের ছুটিতে তামান্না বাড়ি যাবে ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে তখন তাকে এই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে হল। আর যাই হোক তামান্নাকে ভাইয়ের বিয়ে মিস করতে তো বলা যায় না।

তামান্নার ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ওদের তিনজনের একসাথে পহেলা বৈশাখে বেড়ানোর পরিকল্পনাটিকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিল। অবশ্য তামান্না চলে গেলেও মাধব ও আকাশী ইচ্ছা করলে পহেলা বৈশাখের সকালটা একসাথে কাটাতে পারত তবে আকাশীর স্বামী ও সন্তানের কথা মাথায় রেখে সেই সম্ভবনাটাও মাধব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। তামান্না অবশ্য মাধবকে ভাইয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিল কিন্তু মাধবের পক্ষে একান্তই ঢাকার বাইরে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মাধব যেতে পারবে না বলে জানিয়েছে। তবে মাধবের আবার যেতেও ইচ্ছা করছে তবে বিয়েতে উপস্থিত থাকা তার উদ্দেশ্য নয় বরং তামান্নার সাথে পহেলা বৈশাখে সময় কাটানোটাই মূখ্য কারণ। শুক্রবার দুপুর থেকেই মাধবের মন টা উশখুশ করছিল আর তাই মা কে বলে রাতের ট্রেনে মাধব লালনের শহরে রওনা হল।

তামান্নাকে সে কিছুই জানায়নি, সকালে পৌঁছে ফোন দিবে বলে ঠিক করে রেখেছে। এর আগে মাধব মাত্র একবার পহেলা বৈশাখ ঢাকার বাইরে কাটিয়েছে, সেবার সাথে মা ছিল। এবার একা একাই তবে সকাল হলে তো আর একা নয়। তামান্নার বাড়িতে নতুন অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হবে আর যেহেতু বিয়ে বাড়ি সেহেতু বাড়িতে লোকে লোকারণ্য থাকাটাই স্বাভাবিক। রাতের ট্রেন ভ্রমনটা মন্দ হল না, কিছু সময় গান শুনে আর কিছু সময় ঘুম দিয়ে সে ভোর ৫ টা ৩০ এ লালনের শহরে পৌঁছাল।

মাধব তো ঠিকানা জানে না আর এত সকালে তামান্নাকে ফোন দেওয়া ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই কিছু সময় পার করল সে, তারপর তামান্নাকে ফোন দিলে সে ঘুম ঘুম চোখে ফোন ধরল, তামান্না কিছু বুঝে উঠার আগেই মাধব তাকে জিজ্ঞাসা করল কুষ্টিয়া শহর থেকে ওদের বাড়িতে কিভাবে যেতে হবে, তামান্না যেন বিশ্বাস ই করতে পারছিল না মাধব এখন কুষ্টিয়াতে অবস্থান করছে, অতঃপর বুঝতে পেরে তামান্না মাধবকে ওদের বাড়িতে আসার রাস্তা বলে দিল। ফলাফল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মাধব তামান্নাদের বাড়িতে অবাক করে দেওয়া এক অতিথি। বাড়ির মানুষজন একটু অবাক হল বটে তবে খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা মাধবকে বিয়েতে আসা অন্যান্য অতিথিদের মতই সাদরে গ্রহণ করে নিল। মাধব সকলের সাথে নতুন বছরের প্রথম দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করল। তামান্নার আব্বা-আম্মাকে সালাম করল।

তামান্নার মুখে কোন আওয়াজ নেই, সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না মাধব কিভাবে কিছু না বলে এত দূরে একা একা চলে আসল। মাধব তামান্নার মুখভঙ্গি পাল্টানোর জন্য সবার আড়ালে কি যেন একটা কথা বলল আর তামান্না ফিক করে হেসে বলল, ‘এটা ভাল ছিল’। যাই হোক পহেলা বৈশাখের শুরুটা বিয়ে বাড়িতে মাধবের বিস্ময়কর উপস্থিতির কারণে একটা আলাদা বৈচিত্রের সৃষ্টি করল। মাধব বাসায় মা কে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিল সে ঠিকভাবে তামান্নাদের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে ও তার কোন প্রকার অসুবিধা হচ্ছে না। তামান্নার আম্মা নিজের ছেলের মত করেই মাধবের খেয়াল রাখছেন।

বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত, সকালে সবাইকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ও চার পাঁচ রকমের ভর্তা দেওয়া হয়েছে খাওয়ার জন্য। খাওয়া দাওয়া শেষে মাধব সামান্য সময়ের জন্য বিশ্রাম নিল, তার ইচ্ছা তামান্নাকে নিয়ে আজকের দিনে গ্রাম ঘুরে দেখা বিশেষ করে আজকের দিনে গ্রামে যে মেলাগুলো হয়ে থাকে ওগুলোতে ঘুরে বেড়ানো। বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে আছে মাধব, তামান্নার বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলছে নানা বিষয় নিয়ে, কথা বলতে ভালই লাগছে তবে চিন্তা করছে এর থেকেও বেশি ভাল লাগত যদি তামান্নাকে নিয়ে এখন বাইরে কোথাও বেড়িয়ে আসতে পারত, অনেক্ষণ তামান্নাকে দেখা যাচ্ছে না। হয়ত বাড়ির ভিতরে কাজ নিয়ে ব্যস্ত, হাজার হোক বিয়ে বাড়ির ঝামেলা তো মোটেও কম না কখনো। হঠাত তামান্নাকে এদিকটায় আসতে দেখে মাধব বারান্দা থেকে ভিতরে এসে তামান্নার হাতটা ধরে একটু আড়ালে টেনে নিয়ে আসল।

তামান্না বলে উঠল, এই কি কর তুমি? বাড়িতে কত মানুষ, কে না কে দেখে কি মনে করবে। মাধব বলল, কেঊ কিছু দেখে নি। তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে, আমি কত সময় ধরে বসে আছি তোমাকে নিয়ে বেরোব বলে। তুমি এখনি একটা শাড়ি পড়ে আস। আমাকে তুমি আজকে তোমাদের গ্রাম দেখাবে।

তামান্না জানাল এখন সে পারবে না কেননা বাড়িতে অনেক কাজ, তামান্নার মা একা সামলাতে পারবেন না। মাধবের একটু মন খারাপ হল কেননা যদি ও তামান্নার সাথে না ঘুরতে পারে আজকের দিনে তবে ও কষ্ট করে রাতে ট্রেনে চড়ে এতটা দূর এসেছে কেন। তামান্না মাধবের মন খারাপ হয়েছে বুঝতে পেরে বলল সে বের হওয়ার চেষ্টা করবে তবে এখনি পারবে না বরং বিকালের দিকে বের হবে। মাধব এর পর আর কি বলবে, সে বিকাল কখন হবে সেই জন্যই অপেক্ষা করতে থাকল। মাধব আকাশীকে ফোন দিল।

আকাশী কোথায় জানতে চাইলে সে জানাল সকালে লিপু ও নায়নাকে নিয়ে ও বের হয়েছিল। রমনা, চারুকলা ও টি এস সি ঘুরে কিছুক্ষণ আগে বাসায় ফিরেছে। পহেলা বৈশাখের সকাল টা ওদের ভালই কেটেছে, নায়না নাকি চারপাশের এত মানুষ দেখে ভালই মজা করেছে। মাধব আকাশীকে জানাল ও তামান্নার সাথে পহেলা বৈশাখ কাটাতে কুষ্টিয়া তে এসেছে, একবারে বিয়ে খেয়ে তারপর এসে অফিস করবে। আজ রাতেই যদি চলে আসে তবে এটা ভাল দেখাবে না।

আকাশী মাধবের এমন কুষ্টিয়া সফরের কথা শুনে একটু অবাক ই হলে, তারপর মাধবের এভাবে এক দিনেই ফিরে আসা যে ঠিক হবে না সে বিষয়ে একমত পোষণ করল। অফিস খোলার পর তার মানে শুধু মাসুম সাহেব ও আকাশী অফিস করবে। মাধব ও তামান্নাকে ছাড়া শুধু মাসুম সাহেবের সাথে পুরো দুইদিন আকাশী কিভাবে অফিস চালাবে সেটা নিয়ে অবশ্য আকশী তেমন কিছু ভাবল না। দুপুর গড়িয়ে বিকাল আসলে মাধব বাইরের ঘরে তামান্নার জন্য অপেক্ষা করছিল, কখন সে আসবে আর দুজনে একসাথে ঘুরতে বেরোবে। এসব ভাবতে ভাবতেই তামান্না একটা লাল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে মাধবের সামনে উপস্থিত হল।

তামান্নাকে দেখতে আজ খুব সুন্দর লাগছে, ও এমনিতেই অনেক সুন্দর, তবে আজ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যেই একটু সেজেছে। লাল শাড়ির সঙ্গে কপালে একটা লাল টিপ দিয়েছে আর দু হাতে ছয়টা করে বারটা চুড়ি। -তোমাকে তো বেশ লাগছে। -তাই নাকি, জানতাম না তো, কেউ বলে নি এর আগে। -আরে যে কেউ বলবে নাকি, এখন আমি বললাম।

আর তুমি তো আমার সাথে বের হবে বলেই সেজেছ, সুতরাং আমার বলাটাই কি যথেষ্ট না বল। -সেটা অবশ্য মন্দ বল নি। এখন বল কোথায় যাবে। -আমি কি জানি, তোমার গ্রামে এসেছি, তুমি যেখানে যেখানে নিয়ে যাবে আমি সেখানে সেখানেই যাব। -গ্রামে অনেক গভীর জঙ্গল আছে, কেউ যায় না, যদি সেখানে নিয়ে যাই।

তুমি যদি নিয়ে যেতে পার আমার তো কোন সমস্যা নাই। কথা বলতে বলতেই দুজনে বের হল। গ্রামের রাস্তায় রিকশা নেই, তাই দুজনকে হেঁটে হেঁটেই বেড়াতে হবে। মাধবও লাল পাঞ্জাবী পড়েছে। পাশাপাশি দুজন হাঁটছিল বলে গ্রামের মানুষেরা এক প্রকার লালের ছড়াছড়ি দেখতে পাচ্ছিলেন।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে অবশ্য মোটামুটি সবাই লাল-সাদা মিলিয়েই আজ ঘর থেকে বের হয়েছেন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে গ্রামে একটা বড় মেলা বসেছে। মাধব ও তামান্না সেই মেলাতেই গেল তাদের বৈশাখি বিকেল উদযাপন করার জন্য, মেলাটি তামান্নাদের বাড়ি থেকে খুব বেশী দূরে নয়। মেলায় নানা ধরনের ছোট ছোট স্টল সাজানো। কিছু আছে খাবারের স্টল যেমন পিঠা, চটপটি ও আরো কয়েক ধরনের খাবার।

এছাড়া শাড়ীর একটা ও চুড়ির একটা স্টল আছে। বাচ্চাদের খেলনা দিয়ে সাজানো একটা স্টল সাজানো। কিছু দূরে একজন বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজাচ্ছেন, তার কাঁধে একটা ব্যাগ ঝোলানো যেখানে নানা প্রকারের বাঁশি দেখা যাচ্ছে। মেলায় নাগরদোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছোট থেকে শুরু করে বড় নানা বয়সের মানুষ সেই নাগরদোলায় উঠছেন।

মাধব ও তামান্না দুজনে একসাথে নাগরদোলায় চড়ল, কতদিন পর এই নাগরদোলায় চড়া তা মাধব নিজেও মনে করতে পারে না। মেলা থেকে মাধব তামান্নাকে একটা নীল শাড়ি, এক ডজন নীল চুড়ি ও এক পাতা নীল টিপ কিনে দিল। মাধব যদিও বাঁশি বাজাতে পারে না তবু তার একটা বাঁশি কেনার শখ হলে তামান্না মাধবকে একটা বাঁশি কিনে দেয়। মাধবের খুব ইচ্ছা করছিল তামান্নাকে বাঁশি বাজিয়ে শুনাতে তবে কি আর করা বাঁশি তো আর সে বাজাতে পারে না তাই গুন গুন করে গান গাইতে লাগল। মেলায় অবশ্য এমনিতে গান ও বাজছিল।

মাকসুদের ‘মেলায় যায় রে’ গানটা এখন এসব মেলাতেই বেশী বাজে। মেলা থেকে বের হয়ে আর কোথায় যাওয়া যায় সেটাই মাধব তামান্নাকে জিজ্ঞাসা করল। তামান্না বলল ওরা নদীর ধারে যেতে পারে, সন্ধ্যার আগ দিয়ে এই সময়টায় ওখানে ভাল সময় কাটবে। দুজনে মিলে আবারো নদীর ধারে বসার জন্য হাঁটা শুরু করল। যেতে যেতে অনেক কথাই হল ওদের।

মাধব তামান্নার বাড়ির মানুষদের ভূয়সী প্রশংসা করল ওকে এভাবে আপ্যায়ন করার জন্য। তামান্না বলল ও নিজেও অনেক খুশি হয়েছে মাধব ওদের বাড়িতে এসেছে বলে। কথা বলতে বলতে একটা সময়ে ওরা নদীর ধারে এসে বসল। -আমি শুক্রবার সকালে বাসে উঠলাম আর তুমি বাসে উঠলে রাতে। তুমি তো আমার সাথে সকালে এলেই পারতে।

-আসলে আমি বুঝতে পারি নি, তুমি রওনা হওয়ার পর যখন আমার সাথে কথা বললে তখন বুঝতে পারলাম পহেলা বৈশাখের এই দিনটায় তুমি আমার থেকে অনেক দূরে থাকবা আর তাই কোন কিছু না ভেবেই তোমার সাথে আজকের দিনটা কাটানোর জন্যই আমার এভাবে চলে আসা। - এইটা কি ছিল? - কি ছিল তা কেমন করে বলব, আমি জানি নাকি আর সবকিছু জানতে হয় নাকি। - সেটাই, এসেছ ভালই করেছ। বিয়েশাদি খেয়ে আমার সাথে একসাথে যেও। -মাথা নষ্ট নাকি, তুমি যাবা আট দিন পর, আমি এখানে আট দিন কি করব? - থাকবা আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে।

- সেটা তো হবে না বন্ধু, আমি বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে পরশু রাতে বাসে উঠব। - দুজন এমনিতেই দুইদিন অফিস করব না, মাসুম তো মাথা নষ্ট করে ফেলবে আর যদি শুনে দুজনে একসাথে আছি তাহলে একেবারে আকাশে বাতাসে হৈ হৈ রব উঠবে। - ঠিক আছে তুমি পরশু রাতেই যেও। -চল, এখন বাসায় যাই, দেরী হয়ে যাচ্ছে। বাসার সবাই চিন্তা করবে।

- ঠিক আছে চল তাহলে। সন্ধ্যার পরপর ওরা দুজনে বাসায় ফিরল। রাতে দুজনেই আকাশীর সাথে ফোনে কথা বলল। আকাশী সব শুনে বলল, ‘ইস আমি মিস করে ফেলছি, মাধবের মত আমি ও চলে আসলে ভালই হত, তিনজনে মিলে ঢাকায় ঘুরতে চেয়েছিলাম, সেটা না হয় কুষ্টিয়াতেই হত, মন্দ হত না’। মাধব ও তামান্না দুজনেই আকাশীর কথায় সায় দিল।

আমাদের জীবনে নানা ধরনের গল্পই থাকে, সেসব গল্পের মাঝ থেকে মাধব, তামান্না ও আকাশীর বৈশাখের প্রথম দিনের এই মন কেড়ে নেওয়া গল্পটি পাঠক হৃদয়কে সত্যিকারেই ছুঁয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।