মৃত্যু কি ? মৃত্যুর পরে কি হয়, মৃত্যুতেই কি সব শেষ ? মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষের কাছে এ এক চিরন্তন প্রশ্ন। এ মৃত্যু নিয়ে কঠোপনিষদের একটা গল্প আছে।
বৈদিক যুগে ঋষি ঔদালিক মনষ্কামনা পূরণের জন্য যজ্ঞের আয়োজন করেন। নিয়মানুযায়ী যজ্ঞশেষে ব্রাক্ষ্মণকে দক্ষিণা দিতে হয়। তো ঋষি রোগা, দূর্বল গরুগুলো ব্রাক্ষ্মণদের দান করলেন।
পূত্র নচিকেতা সেটা লক্ষ্য করে ভাবল এ গরু নিয়ে কারও কোন লাভ হবে না, বাবার যজ্ঞে ভাল ফল নাও হতে পারে। এতে সে বাবাকে বলল , 'আমাকে দান কর' । ছেলেমানুষের এ আব্দারকে বাবা প্রথমে পাত্তা দেয় না। কিন্তু পূনঃপূনঃ বিরক্ত করায় তিনি বলে বসলেন,' তোকে তাহলে যমের কাছে পাঠাব'।
পিতৃসত্য পালন করতে পূত্র তখন যমালয়ে যাত্রা শুরু করে।
কিন্তু যমের রাজ্যে পৌঁছে দেখে যম বাড়িতে নেই, ফলে বালক যমালয়ের বাইরে অবস্থান করে। তিনদিন পরে যম বাড়ি ফিরে দেখে বাড়ির বাইরে অভূক্ত ব্রাক্ষ্মণ বালক বসে আছে। এতে যমের মনে দয়া হয়, যম তাকে তিনটি বর দানের আশ্বাস দেন।
নচিকেতার প্রথম বর, তার বাবা যেন তার উপরে রাগ না করে, তাকে ভালবেসে গ্রহণ করে। যম সেটা মন্জুর করে বলল, তথাস্তু।
দ্বিতীয় বরে নচিকেতা 'অগ্নিহোত্র-বিধি' জানতে চাইল যার দ্বারা সে মর্ত্যের মানুষ হয়েও নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বর্গে অবস্থান করতে পারবে যেখানে যম নাই, দুঃখ নাই । যম বলল তথাস্তু।
তৃতীয় বরে নচিকেতা মৃত্যুর স্বরুপ জানতে চাইল। কবি মোহিতলাল মজুমদারের ভাষায়
" ওগো মৃত্যু কহিয়াছি কামনা আমার
হেরিব স্বরুপ তব ! স্নিগ্ধ কি নির্মল,
করুণ-কোমল কি ভীষণ ভয়াল
হেরিতে বাসনা চিতে। সহস্র জনম জন্মিয়া
মরেছি আমি তবু মনে নাই কেমন তোমার মুখ।
আজ প্রাণময় জাগিয়াছে সেই আশা দেখিব তোমায়। "
যম প্রত্যুত্তরে নচিকেতাকে বলল, অন্য বর চাও। এই বর দেয়া যায় না, বলা যায় না, বুঝানো আরও কঠিন। ধন সম্পদ, যশ-মান চাও এখুনি দিয়ে দিচ্ছি কিন্তু আত্মজ্ঞান এবং মৃত্যুর পরে কি হয় এটা জানতে চেয়ো না।
কিন্তু নচিকেতা তা প্রত্যাখ্যান করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে।
ধন-সম্পদ, আনন্দ-হাসি এসব ক্ষণস্থায়ী জিনিসে সে ভুলতে চায় না।
" ওগো মৃত্যু, জীবনের ঐশ্বর্য আড়ালে
তুমি কেন চিরদিন আছ দাঁড়াইয়া ?
---- উৎসবের আনন্দ-বাঁশরি, মিলনের মন্জুগাঁথা
কেন বা গুমরি ধরে বিদায়ের সূর।
ধরিয়াছ নানা ভোগ সম্মুখে আমার
আছে সুখ তৃপ্তি কোথা?
----এইবার নয়নের মিটাও পিপাসা
আবরণ কর উম্মোচন, জ্যোতিষ্মান। "
যম তখন বলল, তবে তোমাকে শোনাব মৃত্যু রহস্য-কথা। কিন্তু আমার আর তোমার মাঝে কোন আবরণ নেই, চোখের থেকে মায়াজাল সরে গেলে জ্ঞাননেত্রে তুমি আমার অন্তর-বাহির সব দেখতে পাবে।
" শুন নচিকেতা ! -- হৃদয় দূর্বল যার
মলিন, সন্কীর্ণমনা, স্বভাবকৃপণ
সেই নর যুপবদ্ধ পশুর সমান।
মৃত্যুর আঘাত সহে জীবযজ্ঞভূমে।
ভয় তারে ক্ষুদ্র করে-----
বারবার পড়ি মৃত্যুমুখে হয় তার নিত্য অধোগতি। "
আত্মাবান, প্রজ্ঞাবান যে সে আপনাকে আপনি বিলীণ করে দেয়। মরার আগে মরে যায়, যাকে সাধকরা বলে জ্যান্তে-মরা।
বিশ্বপ্রাণে প্রাণ বিলিয়ে সে জাগতিক সুখ-দুঃখের উর্ধ্বে ওঠে যায়। জগতে তার অবস্থান হয় আনন্দ স্বরুপ, আমি মৃত্যু তার ছায়াও মাড়াই না।
" আত্মাবান, প্রজ্ঞাবান যেই
আপনারে আপনি সে দেয় বলিদান।
জগতের যজ্ঞ-যূপে মহোল্লাসে মাতি।
বিশ্বপ্রাণে বিলাইয়া নিজ প্রাণধন
ভুলে যায় হর্ষ-শোক, চির-উপরতি
লভে বীর, সুমহান আত্মার আলয়ে।
এই যজ্ঞ করে যেই জন মৃত্যুজয়ী
হয় সে নিঃশেষে মরিয়া। "
মোহিতলাল মজুমদারের কবিতা ' মৃত্যু ও নচিকেতা ' ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।