আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মূর্খের দেশে কী না সম্ভব!

শিল্প-সাহিত্যের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্ট এই প্রথম নয়। ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর। 1933 সালে জার্মানির বিখ্যাত বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে একসাথে 25 হাজার বই পুড়িয়ে দিয়েছিলেন হিটলার। যার মধ্যে এরিখ মারিয়া রোমার্ক, ফ্রয়েড প্রভৃতির লেখাও ছিলো। এমনকি হিটরারীয় রাজত্বে নিষিদ্ধ ছিলো Heine-এর লেখাও।

সম্প্রতি উচ্চতর আদালত হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ উপন্যাসটিতে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এনে তা সংশোধন করে কর্তৃপক্ষের মনমতো করে প্রকাশ করার আদেশ জারি করে তেমনি এক হিটলারীয় দৃষ্টান্তই পুনঃর্স্থাপন করলো। পুড়াবার যুগ তো নেই, এ তারই এক নতুন সংস্করণ। এ কথা বলছি এই কারণে যে, লেখক যা লিখেছেন তার আবার সংশোধন কী হে? কেউ কি ওজু করে সাহিত্য করতে বসে না-কি? সাহিত্যকে কি ওরা সুতি কাপড় ভেবেছে যে, আইনের ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে ছাপ-সুতারা করবে। হ্যাঁ, স্বীকার করছি উপন্যাসটি ঐতিহাসিক। লেখককেও ইতহাসের দায় নিতে হবে।

আবার ইতিহাস সাহিত্যের একটি বিষয় বটে, কিন্তু যা ইতিহাস তা তো পুরোটা সাহিত্য নয়। ইতিহাসের মূল কাঠামোর মধ্যে লেখকব্যক্তিত্বের ছাপ যদি না থাকে তবে তা সাহিত্য পদবাচ্য হবে কী করে? পৃথিবীতে এমন একটিও ঐতিহাসিক উপন্যাস পাওয়া যাবে কি যেখানে হুবহু ইতিহাসটাই শুধু আছে? তা হলে তো সেটি ইতিহাসগ্রন্থ হয়ে যাবে, সাহিত্য হবে না। একটি লেখা কী হলে সাহিত্য হয়, পশুর চামরা দ্বারা বাধাই করা মোটা মোটা আইন বইয়ে তা কী লেখা থাকে, না বিচারকেরা তা জনেন বা বোঝেন? অবশ্য না বোঝাটা তাদের জন্য দোষের নয়, তাদের কাজের ক্ষেত্র আলাদা। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে নাক গলাতে আসা কেন? লেখক তো আর জামাতীদের মতো অস্বীকার করেননি যে, 1971 কিংবা তৎপূর্ববর্তিকালে আটকোটি মানুষের মধ্যে সকলের একজন হয়েও, সকলের সাথে বাস করেও কি এক অদ্ভুত দায়ে বঙ্গবন্ধু কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন অনন্তকাল ধরে পরাধীন বাঙালির মুক্তির ভার। সে ভার বয়েছেনও আমৃত্যু, আজীবন, ভালোবেসেছেন বাঙালিকে নিজের চেয়ে বেশি, আগলে রেখেছেন বুকে, যাবতীয় ঝড়-ঝঞ্চা থেকে।

একজন পিতার ভূমিকায় তার খুঁত কিছু নেই―অথচ পিতৃহন্তার রক্তের দাগ এখনো আমাদের হাতে, শেওলার মতো, থিক-থিকে, পিচ্ছিল, ঘিন-ঘিনে, তবুও বয়ে বেড়াতে হবে মহাকাল অবধি। এই নির্মম ও লজ্জাজনক বিষয়টাতে অশ্রু ধরে রাখা, আবেগ নিয়ন্ত্রন করা যে কতোটা মুশকিল, হুমায়ুন আহমেদের মতো মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা পিতা হারিয়েছেন তাঁরা ছাড়া তা আর কেউ বুঝবেন না, জেনে রাখুন। তবুও গত ১১ মে প্রথম আলোয় হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিতব্য ‘দেয়াল’ উপন্যাসের দুটি অধ্যায় বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত যে আদেশ দেন তাতে বলা হয়েছে, ‘হুমায়ূন আহমেদ একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। আমরা কোনো আদেশ দিয়ে তাঁকে বিব্রত করতে চাই না।

’ লেখকের শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে তাঁর প্রতি প্রতি আদালতের এই করূণা কিংবা তাঁর উপন্যাসে ইতিহাস বিকৃতির যে অভিযোগ আনা হয়েছে সে যে কতোটা যৌক্তিক প্রশ্ন তা নিয়ে নয়। প্রশ্ন হলো, এর ভার কি আদালতের? সেখানকার কর্তাব্যক্তিদের এই বিষয়ে জ্ঞানের বা মূল্যায়নের দৌড়ই বা কতোটুকু? সাহিত্য বিচারের ভার যদি শেষ পর্যন্ত আদালতের উপর ন্যাস্ত হয় তাহলে আগামীতে সাহিত্য ও সাহিত্যিকের ভবিষ্যত ভেবে শঙ্কিত হবার কারণ ঘটে না কি? আবার এমন তো নয় যে, এই বিষয়টা যাঁরা বুঝবেন তেমন সমঝদার শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর অভাব আছে বাংলাদেশে! তাঁদের সাহায্য নিয়ে এই বিষয়টার সমাধান করলে সেটিই অধিক যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য হতো না-কি? ইতিহাসের সত্যতা রক্ষার ভার না হয় আদালত নিল, কিন্তু লেখকের স্বাধীনতার ভার নেবে কে? লেখকের লেখা বিচারের ভার কি আদালতের না-কি পাঠকের? মূর্খের দেশে কী না সম্ভব! লেখকের সাধীনতা না থাকলে লেখক বাঁচে না। লেখক না বাঁচলে সাহিত্য বাঁচে না। সাহিত্য না বাঁচলে জাতি বাঁচে না, বাঁচবে না। একজন সত্যিকারের শক্তিমান লেখক একটি জাতির জন্য স্তম্ভ স্বরূপ।

লেখকের জন্য কেন স্বাধীনতা অত্যাবশ্যক সে কথা বলতে গিয়ে ই. এম. ফরস্টার বলেছেন, তিনটি কারণে তিনি লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। এক. লেখককে পুরোপুরি বোধ করতে হবে তিনি স্বাধীন। তা না হলে ভালো কিছু রচনার প্রেরণাই তিনি পাবেন না। তিনি যদি নির্ভয় হতে পারেন, মনে মনে আত্মস্থ হতে পারেন, সহজ হতে পারেন ভেতরে ভেতরে, একমাত্র তখনই তার জন্য মহৎ সৃষ্টির অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। দুই. আবার উপর্যুক্ত স্বাধীনতা লেখকের জন্য প্রাথমিক শর্ত।

কিন্তু লেখক ও শিল্পীর আরো কিছু চাই। আর তা হলো, লেখক যা বোধ করছেন অন্যকে তা বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে। তা না হলে তাঁর অবস্থা হবে বদ্ধমুখ বোতলের মতো। লেখক শূণ্যে বিহার করতে পারেন না। পাঠক না হলে তাঁর চলে না।

তিন. পাঠকের পাড়ার স্বাধীনতা থাকতে হবে। তা না হলে তাদের অনুভব করার শক্তি চিরকালের জন্য চাপা পড়ে যাবে। তারা থেকে যাবে অপরিণত—চিরimmature. তাছাড়া লেখক বিষয়ে বাল্মীকি মুণি তো বলেছেনই, ‘তাই সত্য যা রচিবে তুমি/ ঘটে যাহা সব সত্য নহে’। তাহলে...? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।