আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আয়না (গল্প)

নিজের সম্পর্কে লেখার কিছু নেই । সাদামাটা । আয়না দিব্যি ফুরফুরে বাতাস নিয়ে রোদ্দুরটা ঢুকে পড়ে জানালার ফাঁক গলে। গতকাল রাত্রিরেও মেঘবৃষ্টির কমতি ছিলোনা। আফিস থেকে ভিজে ভিজে হয়ে ফিরেছিলো শফিক।

রিজিয়া তখন রান্নাঘরে ভেজা কাঠে ধূঁয়ো ওঠা চুল্লীতে আগুন ধরাতে ব্যস্ত। ‘এই শুনছো, কোথায় গেলে । গা মোছার একটা কিছু নিয়ে এসো শিগ্‌গীর। ’ শফিকের চীৎকার কানে যেতেই রিজিয়া সাড়া দিয়ে ঘরে এসেছিলো । ‘আহ্‌ হা, কি চেহারাটাই না হয়েছে তোমার! আয়নায় একবার দেখো’ শফিকের চোখ থমকায় রিজিয়ার দিকে ফিরে।

‘কার চেহারা আমার না তোমার’ রিজিয়া পাল্টা প্রশ্ন করে। ‘ঝড়ো বকের মতো চেহারা, আয়নায় নিজের চেহারাটাই একবার দেখো বরং’ বলতে বলতে একটা গামছা এগিয়ে দেয় রিজিয়া । একবার কি ভেবে নিজেই মুছিয়ে দিতে থাকে শফিকের মাথাটা । ‘তোমার চোখটি যে ফোলা ফোলা, পানি ঝরছে । কাঁদছিলে নাকি আমার জন্যে?’ টিপ্পনী কাটে শফিক গামছার আড়াল থেকে।

চোখের সামনে হাত ওঠানামার তালে তালে বুক জোড়াও দুলছে রিজিয়ার । একদম চোখের সামনে নাকের কাছটাতে । একটা কেমন ভেজা ভেজা গন্ধ যেন নাকের ভেতর দিয়ে একদম মাথার তালুতে গিয়ে ঠেকে । চোখ দিয়েই বুঝি ছোঁয়া যায় ঐ জিনিষ । ‘বেশ ভালোই’ , শফিকের গলায় নেশার আমেজ ।

‘কি ভালো?’ প্রশ্ন রাখে রিজিয়া । ‘না, বলছিলাম তোমার চেহারাটা আয়নায় একবার দেখইনা। ’ পাশ কাটায় শফিক । একবার আড়চোখে আয়নার দিকে তাকিয়েছিলো রিজিয়া । লম্বা প্রমান সাইজের আয়না ।

সকাল বেলা ঘুমটা ভাঙ্গতেই গেল সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে রিজিয়ার । শুয়ে শুয়ে চোখ মেলতেই আয়নায় ছাপ ফোঁটে চোখের । একবারে লাগোয়া আয়নাটা । শুতে বসতে ছায়া পড়ে তাতে । বাতাসের সাথে সাথে নরোম রোদ্দুরটাকে ঘরে ঢুকতে দেখে কাঁথার ভেতরের ওম্‌টুকুকে আরো একটু আকড়ে ধরে রাখে সে ।

একটু জড়িয়ে ধরতে সাধ যায় পাশে শুয়ে থাকা লোকটাকে । ধরবে নাকি ? নাহ্‌ থাক! ওরকম আস্কারা দিলে মানুষটা বিছানা ছেড়ে উঠতেই চাইবেনা । দেরী করে ফেলবে বাজারে যেতে আর তাতে দেরী হয়ে যাবে অফিসে । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিজিয়া । সেই উঠতি বয়সের রংমাখা স্বপ্নগুলো কোথায় কোথায় যে গেল ! বাবাকে হারিয়ে গ্রামে মামার কাছেই মানুষ রিজিয়া ।

মানুষ হওয়া না বলে বড় হয়ে উঠেছে বললেই ভালো হোত। ঝোপে-ঝাড়ে যেমন কোনও আদর যত্ন ছাড়াই এক একটা লতাগাছ বেড়ে ওঠে লক্‌লকিয়ে তেমনি । সেখান থেকেই কি স্বপ্নের রংয়েরা জলে ধুঁয়ে ধুঁয়ে ফিকে হতে শুরু করেছে ! জানেনা সে । সে গ্রামেরই ছেলে শফিক। ভদ্র আর লাজুক বলে পাত্র হিসাবে খুব একটা খারাপ নয়।

মামার ইচ্ছেতেই বিয়েটা হয়েছে। ছেলে একটা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট অফিসে হিসাব রাখার কাজ করে, মাসান্তে বেতন । তেমন একটা টাকাকড়ি নেই । হতে কতোক্ষন । বউয়ের ভাগ্যে অনেক সময় ছেলেদের কপাল খুলে যায়।

রিজিয়ার ভাগ্যের জোরেই হয়তো এ অবস্থাটা থাকবেনা চিরকাল। বিয়ের পরে যখোন সে এই টিনের বাড়ীটাতে আসে তখোন এটার শ্রী এমন ছিলোনা । একটুকরো উঠোনে স্তুপাকার ছিলো জঞ্জালের ভুত আর শেওলা ধরা স্নানের ঘর । মাকড়সার জালে জালে ঘেরা কালিঝুলি মাখা ঘরখানাকে দেখে মনে হয়েছিলো, এ কোন প্রেতপুরীতে এলো সে। শহরে সে কোনদিন আসেনি।

শহরের একটা আলাদা সুন্দর ছবি আঁকা ছিলো তার মনে। সেটা মিললোনা দেখে ভেতরে ভেতরে ধাক্কা। এঁদো পঁচা গলি পেরিয়ে তবে এ বাড়ীটাতে আসতে হয়েছে তাকে। ভাড়াও কম নয়। দু হাযার টাকা।

তাও নাকি মালিকের সাথে জানাশোনা ছিলো বলে রক্ষে। নইলে এই ঘরই তিন, সাড়ে তিনে রফা হোত। কোমরে আঁচল জড়িয়ে বালতি বালতি পানি ঢেলে, লাঠির মাথায় ঝাটা বেঁধে সব পরিষ্কার করেছিলো সে। দু’তিন বার আড়শোলা আর ইদুরের ভয়ে আৎকে উঠে জড়িয়ে ধরেছিলো শফিককে। শফিক তখোন মুখ টিপে টিপে, হেসে হেসে নরোম একটা শরীরের উষ্ণতা চেটেপুটে নিচ্ছিলো নিজের শরীর দিয়ে।

ছিটকে আবার তখোনি সরে এসেছিলো রিজিয়া,‘অসভ্য’। আর হেসেছিলো মিটিমিটি । ‘বাহ্‌, আমি আবার অসভ্য হলাম কি করে । এই এত্তোবড় ধিঙি মেয়ে তুমিই তো এই দিনে দুপুরে আমার গায়ে লাফ দিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলে । আর দোষ হলো কিনা আমার।

’ শফিক মুখখানাকে কাঁচুমাচু করে দোষস্খালনের নকল চিহ্ন ফুটিয়ে তোলে তাতে । রিজিয়া তাতে আরো একপ্রস্থ হেসে নিয়েছিলো। আরো পরে যখোন সন্ধ্যে ধীরে ধীরে রাতের ছায়া হয়ে জড়িয়ে নিচ্ছিলো ঘর-গৃহস্থালী, নতুন পাতা বিছানায় বসে শফিকও তাকে জড়িয়ে নিয়েছিলো বুকের ভেতর। বলেছিলো, ‘আসলে তোমার মন খুব ভালো । যারা এভাবে ঘরদোর পরিষ্কার রাখে তাদের মনটাও পরিষ্কার হয় ।

তোমার মুখটাও সুন্দর, সেটাই বলে দেয় তোমার মনটা খুব ভালো। ’ ‘মুখ দেখে তুমি মন বুঝতে পারো !’ অবাক হয়েছিলো রিজিয়া । ‘পারি এবং এই মূহুর্তে তুমি কি চাইছো তাও’ বলেই শফিক তাকে নিয়েই উল্টে পরেছিলো বিছানায়। এলোমেলো করে দিয়েছিলো সবে পাতা বিছানাটাকে। গরুর মতো জাবর কাটতে কাটতে স্মৃতি রোমন্থনের প্রক্রিয়াটা চালু রেখেই বিছানা ছাড়ে রিজিয়া।

আলতো একটু চিমটি কাটে শফিকের নাকে। নাকটা তেমন খাড়া নয়। বরং একটু ভোতা টাইপের। ছড়ানো পাটার নীচে বড়বড় ছিদ্র। তখোনি তুলনাটা আবার মনে পরে তার।

শফিকের বন্ধু ইমরানের নাকটা, দারুন! লম্বা টিকালো। মেয়েবেলায় ইতিহাসের বইয়ের ছবিতে দেখা গ্রীক দেবতাদের মতো। প্রায়ই ইমরান আসে এখানে। দু’বন্ধু মিলে আড্ডা দেয়। সে ও শরিক হয় তাতে কখনো কখনো।

কল্পনায় শফিকের নাকটা একবার ইমরানের নাকের সাথে বদল করে শফিকের নতুন চেহারাটা ভাবতে চেষ্টা করে রিজিয়া। শফিকের চেহারাটা ভেসে ওঠেনা মনের আয়নাতে। বারবার আর একটা চেহারার আদলই ফুঁটতে থাকে সেখানে। চকিতে একবার আয়নায় নিজের মুখটা দেখে নেয় সে। আয়নার চোখে চোখ পড়তেই সারা শরীরটাই কেমন ঝিঝি করে ওঠে তার।

ছিঃ লজ্জা - লজ্জা ! স্নানের ঘরে ঢুকে যায় সে। হাতমুখ ধুঁয়ে চা আর বাসী রুটি তেলে ভেজে আনতে আনতে তার শ্যামলা রঙয়ের মুখের জমিনে লালচে আভা ছড়াতে থাকে। আড়চোখে একবার আয়নায় নিজের চেহারাটা আবারও দেখে নেয় সে। লম্বা একটা ফাটল আয়নাটার গা জুড়ে কোনাকুনি হয়ে আছে। ভাঙ্গা আয়নাটা এখন আর তার নতুন নতুন ভাবখানা ধরে নেই।

অথচ চার মাসও বয়স পেরোয়নি আয়নাটার। আগে পিছে করে দাঁড়িয়ে, একটু খাটো হয়ে কিম্বা ঘাড় উঁচু করে ফাটলটাকে এড়িয়ে তবেই আসল চেহারাটা দেখতে হয়। নয়তো ফাটলের উপর চেহারার ছাপ পড়লে কিম্ভুত কিমাকার দু’টুকরো মুখের ছবি ফোঁটে তাতে। কেমন বিচ্ছিরি লাগে দেখতে। চোখদু’টো ঘেন্নো ইদুরের মতো কুঁতকুঁতে দেখায় কখনও।

কখনও বা একটা চোখ ছোট আর একটা শাকচুন্নীদের মতো গোলাকার হয়ে যায়। নিজের চেহারাটার উপর তখন একটা ধাক্কা খেতে হয়। শফিককে ঠেলে উঠিয়ে দেয় রিজিয়া। রিজিয়ার হাত থেকে গামছাটা তুলে স্নানের ঘরটাতে ঢোকে শফিক। একটুকরো সংসার দু’জনার।

বিয়ের পর দেড় বছর কেটে গেছে। প্রথমদিকে, প্রথমদিকে কেন এখনও টেনেটুনে চালাতে হয় সংসার। এ নিয়ে রিজিয়া কখনও দুঃখবোধে জর্জরিত হয়নি। একটু আক্ষেপ কি ছিলো না ! হয়তো। নিজের সংসারে হাড়িকুড়ি ছাড়া বাহুল্য তেমন আসবাব নেই বলতে গেলে।

কেবল বিলাসী ঐ সস্তা আমকাঠের ড্রেসিং টেবিলটা ছাড়া। তাও আবার এখোন আয়নাটা ভাঙ্গা। নিজের স্বামীর জন্যে, যে এই মূহুর্তে এই সস্তা ভাঙ্গা বাড়ীর ভাঙ্গা স্নানের ঘরে মুখ ধূঁয়ে নিচ্ছে তোলা পানিতে ; তার কষ্ট হয়। দিনমান অফিস শেষে ঘরে ফিরলে ঐ লোকটার মুখ দেখে কেমন একটা মায়া জমতে থাকে তার বুকের ভেতর। গ্রামের মেয়ে সে, লেখাপড়াও বড় একটা হয়নি।

‌এখনও আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি শহরের মতো । স্বামীর যত্নটাকেই এখনও স্ত্রীর একমাত্র কর্তব্য বলে জানে। তার কষ্টগুলো বুঝতে পারে বলে শফিক কতোদিন বলেছে, ‘বাড়ীতে পাঠানো টাকার অংকটা কমিয়ে দেই কি বলো রিজু। ’ রিজিয়া না না করেছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে বাবা-মাকে টাকা না পাঠালে আরশী পড়শীরা তো বলতেই পারে, ছেলে বউ পেয়ে মজে গেছে।

এতে তার যেমন তার স্বামীরও তেমনি কলঙ্ক হবে। স্বামীকে কারো কাছে ছোট হতে দিতে চায়না সে। তাই শফিকের প্রস্তাবে রাজী হয়নি। সংসার তো চলছে। তার উপর শফিকের বন্ধু ইমরান এটা সেটা নিয়ে আসে।

কোনও কোনও দিন থলে ভর্তি বাজার নিয়ে এসে হামলে পড়ে - ভাবী, এই দেখুন একটা রুইমাছ চোখে পরলো তাই নিয়ে এলাম। ধনেপাতা দিয়ে ঝোল ঝোল করে রাধুন তো ভাবী। কতোদিন খাইনে। রুইমাছের ভর্তাও কিন্তু আমার খুব ভালো লাগে। রিজিয়া লজ্জায় সিটিয়ে যায়।

এই লোকটা তাদের ঘরের খোঁজ রাখে বলেই কি এইসব বায়নাক্কার ছুঁতো ধরে কতোকটা সাহায্য করে যায়, নাকি সত্যি সত্যিই এমনটা দেশী খাবারের লোভ হয় তার। পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে। তাদের বাড়ীতে এইসব দিশি খাবার নিশ্চয়ই খাওয়া হয়না! কে জানে ! ডালের চচ্চরী, কচুশাকের সাথে ইলিশমাছের মুড়ো, শুটকির সাথে বেগুন এমনতরো হাযারো খাবারের বায়না দেয় সে। আবার নিজেই সব জিনিষপত্তর কিনে নিয়ে এক একদিন ঠিক হাজির হয়ে যায়। শুধু কি খাওয়ার লোভ নাকি আরো অন্য কিছু ! অবশ্য বেশ টনটনে ভদ্রতা জ্ঞান আছে, শফিক অফিসে কিম্বা বাড়ীর বাইরে থাকলে কখনও একা আসেনা ।

রিজিয়ার কাছে স্পষ্ট হয়না সব। একটু খুতখুতানি যেন থেকেই যায়। সেই দিন থেকেই এ ঘটনাটা ঘটতে শুরু করেছে যেদিন প্রথম ইমরান আসে এ বাড়ীতে। বাইরের এঁদোগলির মুখে গাড়ীর শব্দ শুনেছিলো সে। তারপরেই শফিক লম্বা মতো, ফর্সা একজনকে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলো।

‘কই গো, গেলে কই একবার এদিকে আসোনা’ শফিক লম্বা করে দিয়েছিলো গলার স্বর । রিজিয়া দুরে ছিলোনা। ভেতরের ঘরে দাঁড়িয়ে দরজার অল্প ফাঁক থেকে লোকটাকে দেখছিলো। ভদ্রলোকের মতো নিপাট চেহারা। লজ্জা কাটিয়ে সামনের ঘরে ঢুকতে তার একটু সময় লেগেছিলো বইকি।

এখোন আর তা লাগেনা। ঘরের মানুষের মতো এখোন তার উপস্থিতি। রিজিয়াও অনেকটা সহজ। পরে খুটিয়ে খুটিয়ে শফিকের কাছ থেকে ইমরানের অনেক কথাই জেনে নিয়েছিলো সে। বেশ পয়সাওয়ালা লোকের ছেলে ।

বাপ ভাইদের পয়সার অহংকার থাকলেও তার সে রকম কোনও অহমিকা নেই। কলেজ জীবনে তো বটেই এমনকি এখোনও বামপন্থী রাজনীতির ছোয়া সে ছাড়েনি। একারনেই হয়তো সাধারন লোকজনের সাথে তার একটা আলাদা বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে ওঠে সহজেই। নইলে কলেজ জীবনের বন্ধু হলেও শফিকের মতো ছা’পোষা লোকের সাথে তার এতো মাখামাখির কোনও কারন থাকার কথা নয়। ইদানীং তার ঘটা যেন একটু বেড়েছে।

তার সম্পর্কে রিজিয়ার যেটুকু ভাবনা আর দুঃখবোধ তা ইমরানের ব্যক্তিগত একটা ব্যাপারে। বউয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তার। কেন, কি বৃত্তান্ত রিজিয়া জানেনা। শফিকও। একথা কেউ নিজে থেকে না বললে জিজ্ঞেস করা যায়না, শোভনও নয়।

‘কই শীগগীর করো, বাজারে যেতে দেরী হয়ে যাচ্ছে’ শফিক তাগাদা দেয়। চুল ঠিক করতে করতে আয়নাটাতে একবার জরিপের দৃষ্টি বুলায় । নাহ্‌ এই আয়নাটা না পাল্টালেই নয়। কি বিশ্রী লাগছে দেখতে! শফিকের গলায় ক্ষেদ ঝরে ‘কেন যে এটাকে তুমি পাল্টাতে চাচ্ছোনা বুঝিনা’ ! রিজিয়া আড়চোখে একবার আয়নাটাকে দেখে, কাঠের নড়বড়ে টেবিলে নাস্তা সাজাতে সাজাতে। ভাঙ্গা আয়নায় শফিকের মুখের ছবি বিশ্রী হয়ে ফুটে আছে।

চমকে ওঠে সে । ঐ কি তার স্বামী ! চিন্তাটাকে দুর করে সে। হোকনা সে ইমরানের চেয়ে দেখতে সুপুরুষ নয়। তার চোখে তো সে ই পুরুষোত্তম। আয়নার ছবি কি সবকিছু বলে ? আয়না ভাঙ্গারও একটা ইতিবৃত্ত আছে।

সেদিন নতুন আয়নার সামনে বসে একটু যত্ন করেই সাজছিলো সে। কপালে রঙ্গিন একটা টিপ্‌ দিতে দিতে গুনগুন করে একটা গানের দু’একটা কলি গাইছিলো। আর শফিক ঘরে ফিরলে কি কি ঘটনা ঘটবে মনে মনে তার ছবি আঁকছিলো। গতদিন একটা সুখবর ছিলো তাদের দু’জনার ছোট্ট সংসারে। অফিসে শফিকের ছোটখাটো একটা প্রমোশন হয়েছে।

সে কারনেই শফিকের একটু বাড়তি আদর প্রাপ্য হয়েছে তার কাছে। সে আদরের ধরনটা কেমন হবে ভাবতে ভাবতে সাজতে গিয়ে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিলো সে। কাজের ঠিকে ঝি কখন চলে গিয়েছে খেয়ালও ছিলোনা। অন্যমনষ্কতার ফাঁকে ফাঁকে এলোমেলো চিন্তায় জড়িয়ে যাচ্ছিলো সে। অথবা এটাও হতে পারে, চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে অন্যমনষ্কতায় পেয়ে বসেছিলো তাকে।

আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকলেও সে মূলতঃ দেখছিলোনা কিছুই। না নিজের প্রতিবিম্ব, না শফিকের কল্পিত মুখ। তার বদলে মনের আয়নাতে চকিতে ভেসে উঠেছিলো আর একটা মুখ, একটা মুগ্ধ চাহনী। আর সেটা ভেসে উঠতেই তার বুকের ভেতরে গড়ে উঠছিলো আলাদা একটা শহর। যেখানে এঁদোগলি নেই।

মাসকাবারী মাইনের জন্যে তীর্থের কাকের মতো বসে থাকা নেই। বদলে আছে - যাবতীয় প্রাপ্যতা নিয়ে সুখের বহতা এক নদী। তার শরীরটা হঠাৎ শিউড়ে উঠেছিলো তীরবিদ্ধ শায়কের মতো। আর তখোনি, ঠিক তখোনি তার পেছন থেকে শফিকের দুটো হাত তাকে জাপটে ধরেছিলো। ভয়ে নয়, তার নিজের কাছে নিজেই ধরা পড়ে গিয়েছিলো বলে আৎকে উঠে পিছিয়ে যেতে চেয়েছিলো সে।

আর তাতেই তাল সামলাতে না পেরে দুজনেই পড়ে গিয়েছিলো আয়নাটার উপরে। ঐ যেমন আছেনা, একটা ঠুনকো আঘাত অথচ বড় বেশী শক্তি নিয়ে বাজে কখোনও কখোনও তেমনি এইটুকুন ঠুন্‌কো আঘাতে আয়নাটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো । কপালটাও কেটে গিয়েছিলো খানিকটা । আর তাতেই দ্বিখন্ডিত হয়েছিলো তার অন্তরাত্মা । লজ্জা আর অপরাধ বোধে ।

সেই থেকেই একটা অন্যরকম বোধ তার মনটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। মনের মধ্যেই আর একটা মনের হদিশ পেয়ে সে ভয় পেয়েছিলো খুব। তার কপাল কেটেছে। এটা কি তার কলঙ্কের চিহ্ন ! আয়নায় মুখের আদল পড়লেই কেমন এবড়ো-থেবড়ো হয়ে ফুটে ওঠে তার আর একটা মুখ। কুৎসিত, কদাকার।

চেনা যায়না। এই কি তার আসল চেহারা ? নইলে সে ওসব কথা ভাবতে গিয়েছিলোই বা কেন ? হয়তো এটাই তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্য আর এক রিজিয়া । যে রিজিয়াকে সে চেনেনা । সেই অচেনা রিজিয়া ই কি এখন বেড়িয়ে আসতে চাইছে বাইরে ! কোনটি তার আসল চেহারা ? সেদিন থেকে সে আর আয়নাটা সরাতে চায়নি। শফিক বারবার বলা সত্বেও না।

থাক্‌না ওটা। পুরনোদিনের কথা মনে পড়ে রিজিয়ার। বিয়ের পরেও দীর্ঘদিন একটা ছোট্ট গোলমতো সস্তা টেবিল আয়নায় কাজ চালিয়ে নিতে হয়েছে তাকে। স্নান সেরে ভিজে চুলে সেটা সামনে নিয়ে বসলে সবটুকু মুখের আদল তাতে ধরা পড়তো না। বারবার আয়নাটাকে সামনে পিছে করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে হতো।

কষ্ট হলেও স্বামীর অর্থাগমের পরিধি জেনেই সে কোনও বায়না ধরেনি কখনও। যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছে। বরং উল্টোটা ঘটেছে শফিকের বেলাতেই। স্ত্রীর সাজগোজের তেমন আড়ম্বর নেই জেনেও ঐটুকুন একটা আয়নাতে স্ত্রী প্রসাধন সারছে দেখে তার ভেতরের সবল পুরুষটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলো। বড়সড় আয়না সহ মোটামুটি চলে যায় এমন একটা ড্রেসিং টেবিল কিনে দেয়ার কথা বলেছিলো রিজিয়াকে।

রিজিয়াই নিষেধ করেছে। টাকার দিকটা চিন্তা করেই বলেছিলো, যেটা আছে সেটাতেই তো চলছে। নতুনের কি দরকার ? হেসেছে শফিক, ‘জীবনে আয়নারও দরকার আছে রিজিয়া বেগম ! আয়নাতে নিজের মুখখানা দেখলে নিজের ভেতরের মানুষটাকে চেনা যায়। নিজেকে দেখা আর কি ! আর জানো তো, মানুষ সবচেয়ে বেশী ভয় করে কাকে? নিজেকে। নিজের চোখে চোখ রেখে মানুষের সাধ্য নেই সত্যকে আড়াল করে’।

একটা দারুন দার্শনিক মন্তব্য করতে পেরেছে বলে আরো একটু প্রগলভ হয় শফিক, ‘তবে তোমার আয়না না হলেও চলবে। তোমার এই ঘরের পারিপাট্যের মতো, তোমার মুখের মতো , তোমার মনটাও পরিষ্কার । আয়নাতে নতুন আর দেখবে কি’! কি যে ছাইপাশ বলো, প্রতিবাদ করে রিজিয়া। নিজেকে আয়নায় দেখে কি কেউ নিজেকে বুঝতে পারে ? আয়নাতো শুধু মুখ দেখার জন্যে। চুল আঁচড়ানো, কালিঝুলি লাগলো কিনা মুখে এইসব দেখা।

আয়নায় মন দেখে কি কেউ ? সরল বিশ্বাসের কথাই বলেছিলো রিজিয়া। এসব বললেও কষ্ট হতো রিজিয়ার আয়না নিয়ে। ভালো করে মুখটাও দেখা হোতনা কখনও, পুরো শরীরটাতো নয়ই। নতুন বিয়ে, একটুতো সাজিয়ে গুছিয়ে ঠিকঠাক রাখতে হয় স্বামীর জন্যে। ইমরানের দৃষ্টি এড়ায়নি ব্যাপারটা।

ঐটুকু আয়নাতে আপনার চলে ভাবী, প্রসঙ্গ তুলেছিলো একদিন । কেন চলবেনা ? চলে তো যাচ্ছে। রিজিয়ার সহজ সরল জবাব হলেও ভেতরে ভেতরে বিড়ম্বনা| ঐ লোকটার এতো খোঁজে দরকার কি ! ‘হ্যা, চলে তো যায় বোঝাই যাচ্ছে। সত্যিই ভাবী, আপনার তুলনা নেই। কোনও কিছুরই চাহিদা দেখি নেই আপনার।

’ অকপটে বলে যায় ইমরান। ইমরানের কথার অর্থটুকু পরিষ্কার হয়নি তার কাছে। সে কি তার দৈন্যতার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো নাকি সত্যি সত্যিই প্রশংসা করলো ! ঠিক বুঝতে না পেরে সন্দিগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলো সেদিন রিজিয়া ইমরানের চোখে। সেই চোখে কি কোনও প্রত্যাশা দেখেছিলো রিজিয়া সেদিন ? নাস্তা সেরে চটের থলেটা হাতে নিয়ে শফিক বাজারে চলে গেছে । ঘরটাকে গোছাতে গোছাতে ঠিকে ঝিয়ের পানি তোলার শব্দ শোনে রিজিয়া ।

রান্নাঘরে ঢুকে বাসী তরকারী গরম করে রাখে শফিকের জন্যে আর গরম ভাত । সংসারে ঝকঝকে ভাব না এলেও এই মাস চারেক আগে ঝকঝকে একটা আয়না সহ আমকাঠের ড্রেসিং টেবিল এসেছিলো ঘরে । কয়েক মাস অল্প অল্প টাকা জমিয়ে । তাও শফিকেরই ইচ্ছায় । সেদিন তার বন্ধুও সাথে এসেছিলো ।

সেই প্রমান সাইজ আয়নাতে ছবি ফুঁটে উঠেছিলো দু’জনারই । একজন তার স্বামী, নেহায়েৎ মন্দ নয় দেখতে । অন্যজন স্বামীর বন্ধু, সুপুরুষ । হঠাৎ করেই তুলনা করার একটা বদখেয়াল তার মাথায় ঢুকে পড়লো কি করে এটা ভেবে সে অবাকও হয়েছিলো একটু । ওরা চলে যেতেই আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়েছিলো সে এজন্যেই ।

মুখ দেখে কি তার মনের কথাটি পড়তে পারছে সে ! আর তখন থেকেই অন্যরকম একটা চোখে দেখতে শুরু করেছিলো সে আয়নাটাকে । নিজেকেও । ‘ধরো ধরো, হাতটা ছিড়ে যাচ্ছে যে। ’ বাজারের থলেটা রাখতে রাখতে শফিক মুখে শব্দ করে । রিজিয়া অবাক হয় ।

বেশ ভারী দেখতে হাতের থলেটা, সাথে নতুন আর একটা । এই দেখছো কি ? শফিক হাসে - তোমাকে বলিনি আর আমারও মনে ছিলোনা। জানো, আজ ইমরানের জন্মদিন। ওর নিজেরও মনে আছে কিনা কে জানে ! ওকে দাওয়াত করে আজ চমকে দেবো । তাই একটু বেশী বাজার করে আনলাম ।

প্রায় সমযই তো ও অনেক কিছু নিয়ে আসে । ওকে যে একদিন আলাদা ভাবে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবো সে সঙ্গতি তো এতোদিন ছিলোনা । বিরক্তি, বিরক্তি ! ঐ ইমরান নামের লোকটা না হয় বন্ধু আর বন্ধুপত্নী নিয়ে আদিখ্যেতা দেখায়, দেখাক । স্বামীর বন্ধু, তাই না হয় কিছু বলা যায়না । কিন্তু নিজের ঘরের লোক ঐ লোকটাকে নিয়ে মাতামাতি করেছ দেখেই বিরক্তি ।

শফিক কি কিছু বোঝেনা, ঐ লোকটা এতো বেশী বেশী এখানে আসে কেন ! এটা সেটা আনে কেন ? রিজিয়ার দিকে চেয়ে চেয়ে ঐ লোকের চোখেই তৃপ্তির একটা আমেজ ফুঁটে উঠতে দেখেছে সে অনেকদিন । ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠেছে সে । মনের ভেতরে, নিভৃতে ঐ লোকটাকে নিয়ে তার অবচেতন মনে কোনও চিন্তার খেলা চলছে বলেই কি তার এই কেঁপে ওঠা ! নিজেকে অনেকবার শুধিয়েছে সে । উত্তর পায়নি । শফিকের বলা কথাটি মনে হয়েছে – তোমার মনটা বড় পরিষ্কার ।

ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা ! তার সেই মনে কি অন্যলোকের মুগ্ধদৃষ্টির ছোঁয়া কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে ! দোষ তো ঐ লোকটারই । ঐ লোকের চেহারা, চোখের দৃষ্টি, তাকে সম্মান করার কায়দা সবই তো তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে । সন্ধ্যের পরপরই বারকয়েক আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে নিয়েছে রিজিয়া । শত হোক আজ কারো জন্মদিন । দাওয়াত দিয়ে বাড়ীতে আসতে বলা হয়েছে ।

হোকনা সে স্বামীর বন্ধু, বাইরের লোক তো বটে। একটু ভদ্রস্থ হতে তো হয়ই । নইলে কেউ নিজেকে অপমানিত বোধ করতে পারে । আর তাতে করে আবারো অস্বস্থি । নিজের উপর নিজেরই রাগ হয় তার ।

আজ কি তার নিজেকে অন্যরকম লাগছে ! তির তির করে একটু দ্বিধা আর ভালোলাগার আমেজ বাইছে কি ভেতরে ভেতরে ! ঐ লোকটি তাকে এ কোন বিপদে ফেলে দিয়েছে ? কেন এমনটা হচ্ছে তার ! তার কি এতে কোনো পাপ হবে ! নিজের আপন লোককে ছেড়ে অন্য কারো কথা ভেবে মনের মধ্যে মেঘ গুরু গুরু করা তো পাপ-ই। বাইরে বাতাস নেই কেন ? একটু বাতাস, একটু বাতাস দরকার তার। ‘কি হলো, কই গেলে’ শফিকের গলা ভেসে আসে ‘ঘর অন্ধকার কেন’ ? ‘থাক্‌ থাক্‌, শফিক তুই খামোকা এইসব ঝামেলা করতে গেলি কেন ? ভাবী বেচারীর বেশ পরিশ্রম গেছে হয়তো। ’ আর একজনের গলা ভেসে আসে । ‘আরে আরে, আসতে দেরী হয়েছে বলে ঘর অন্ধকার করে রাখতে হবে ।

কোথায় তুমি?’ অন্ধকারে শফিক গলা বাড়ায় খানিকটা । রাগ, রাগ । প্রচন্ড রাগ হচ্ছে রিজিয়ার নিজের উপরে । নিজের ভেতরেই যুদ্ধ চলে, চলে উকিলের মতো জেরা । একবার এ পক্ষে একবারও পক্ষে ।

কোন পক্ষ জিতলো বোঝা যায়না । ঐ লোকটাকে আজ বেশ দু’কথা না শুনিয়েই ছাড়বেনা সে । আর যেন এমুখো হতে সাহস না পায় । আস্তে আস্তে উঠে এসে লাইটটা জ্বালে । একবার মনে হয় তার, অন্ধকার গেল কি ! ‘এতো কিছু রান্নার দরকার ছিলো না ভাবী ।

আপনার খুব পরিশ্রম গেল। ’ ইমরানের গলায় যেন একটা দরদ ঝরে পরে রিজিয়ার জন্যে। ন্যাকা, খুব তো দরদ ! পরস্ত্রী পেলে ওরকম দরদ সবাই দেখাতে পারে, মনে মনে বলে রিজিয়া । বলা হয়না তার । ‘না না, পরিশ্রম আর কি ।

এমন তো কিছু করিনি । আজ আপনার জন্মদিন, সে কারনেই হয়তো খানিকটা বেশী হয়ে থাকবে’ । রিজিয়ার গলার স্বরে স্বাভাবিকতাটুকু উধাও । ভেতরে ভেতরে একটা সাপের মতো ক্রুদ্ধতা ফুঁসতে থাকলেও মুখে ভদ্রতার মুখোশটাকে ধরে রাখতেই হয় তাকে । ইমরানের চোখমুখে কেমন যেন একটা বিষাদের ছায়া ঘনাচ্ছে দেখতে পায় সে ।

সে কি, নিজের কথা বলতে পারছেনা বলে ? বন্ধুর সামনে বন্ধুপত্নীকে কিছু একান্ত আপন কথা বলতে না পারার যন্ত্রনা ! - ভাবী, আপনাকে একটা কথা বলি । হাত থেমে যায় রিজিয়ার, প্লেট গ্লাস টেবিলে সাজাতে সাজাতে । কি বলবে লোকটা ! বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকে যেন । এতো সাহস হো’ল কোথ্থেকে ? এতোদিন তার প্রশ্রয়ের ফল কি? সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ইমরান বলতে থাকে - আমাকে এতো যত্ন করে অনেকদিন খাওয়ায়নি কেউ । আর জন্মদিন পালন করার তো প্রশ্নই ওঠেনা ।

আপনি হয়তো জানেন না, আমার ঘর-সংসার হয়নি । আমিই হয়তো করতে পারিনি । কেন পারিনি সেকথা থাক্‌ । আমার একটা ছোট বোন ছিলো জানেন ! আমার খুব আদরের । পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলো নিজের পছন্দে ।

স্বামীর সাথে থাকতো আমাদের বাসার কাছেই । আমিই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম, অন্তত চোখের সামনে থাকুক, এই ভেবে । নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে বলে বাড়ীর অন্য সবাই এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতো । আমি প্রতিদিন একবার করে ওর কাছে যেতাম । ওকে আমি চোখ ভরে দেখতাম ।

কি হাসিখুসি আর প্রানবন্ত ছিলো, অভাব অনটনের মাঝেও । ও জানতো, আমাদের বাসার সাহেবী খাবার, কেতা-দুরস্থতা আমার পছন্দ নয় । আমার পছন্দের জিনিষ নিজে রান্না করে খাওয়াত, ঠিক আপনার মতো । কোন চাহিদা ছিলো না ওর । না স্বামীর কাছে, না আমাদের কাছে ।

প্রায়ই আমি নিজেই বাজার-টাজার করে ওকে রাগিয়ে দিতাম । গাল ফুলিয়ে ও কি বলতো জানেন’ ? শুনতে শুনতে শরীরটা শক্ত হয়ে যাচ্ছিলো রিজিয়ার । বুকের ভেতর একটা কষ্ট, একটা রাগ মিলিয়ে প্রচন্ড ভাঙনের আওয়াজ পাচ্ছিলো সে । -বলতো, “ভাইয়া কে তোমাকে এসব আনতে বলেছে ? আমি কিন্তু রাগ করলাম । আমি এসব ছাইপাশ রাঁধতে পারবোনা বলে দিলাম।

” বললেও সে ঠিক ঠিক আমার পছন্দ মতো রান্না করতো । আমি চেয়ে চেয়ে তার কপট রাগের ভালোলাগাটুকু দেখতাম’ । একটু চুপ হয়ে যায় ইমরান । আর তার চোখের ভেতর একটা ব্যথা গজিয়ে উঠছে দেখতে পায় রিজিয়া । ‘আপনার বোন ছিলো, বললেন কেন ?’ স্থির হয়ে যাওয়া থেকে রিজিয়া একটু যেন নড়ে ওঠে ।

-ও আর নেই । ক্যান্সার ধরা পড়েছিলো, সময় দেয়নি । -ওঃ … .. রিজিয়ার যেন আর কিছু বলার থাকেনা । এতোক্ষন চুপচাপ দু’জনের কথা শুনছিলো শফিক । এবারই মুখ খুললো – তোর বোন আছে, তার বিয়েও হয়েছে একথা জানি।

কিন্তু ও যে নেই তাতো জানিনা । খাওয়া থামিয়ে একটু সময় নেয় ইমরান । ঘুরে বসে শফিকের দিকে । ‘তোর জানা দরকার, আমি তোর বাসায় এতো বেশী বেশী আসি কেন । ভাবী হয়তো আমাকে লজ্জাহীন ভেবে বসে আছেন ।

আমি তোদের মধ্যে আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বোনটির সংসার খুঁজে পাই । ভাবীকে দেখলে আমার সেই বোনটির কথা মনে পড়ে আর আমি তাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি’। বাতাস কি থেমে গেছে একদম ? শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন রিজিয়ার ? সে কি মরে যাচ্ছে ? লজ্জায় ? নিজের অজান্তেই তার চোখদু’টো স্থির হয় আয়নাটার উপর । একটা লম্বা ফাঁটলের দাগ সেখানে । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।