আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আয়না

এটা আমার জন্য অনেক সুখকর যে, আমি এখন ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে নিজেকে আসক্তিমুক্ত রাখতে পারছি। পরিবার ও পেশাগত জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক আনন্দের। ... ব্লগে মনোযোগ দিতে পারছি না; লিখবার ধৈর্য্য নেই, পড়তে বিরক্ত লাগে।

রাত দশটা। দোহার চান্দের বাজার থেকে রিক্সা করে আমরা যাচ্ছি নারিশা পশ্চিম চরে।

আমার বাম পাশে আমার মেঝ শ্যালক ফিরোজ মিয়া। গাঁয়ের পথ। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই এখানে গভীর রাত্রি নেমে আসে। তার ওপরে রাস্তায় বিদ্যুৎ নেই, কেবল কিছু দূর পর পর দু-একটি দোকান-ঘরের সামনে নিচু পাওয়ারের বাল্ব ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জ্বলতে দেখা যায়, কিংবা হারিকেনের মুদু আলো বেড়ার ফাঁক গলে চোখে পড়ে। দোকান পাট বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

যৌবনে রাতে একা পথ চলতে গিয়ে গান গাইতাম, কণ্ঠে তখন যৎসামান্য সুধা ছিল। ফিরোজের সাথে দু-একটা টুকিটাকি কথা বলার পর গান ধরলাম। এমন নির্জন আঁধারে নীরব চরাচরে আমার কণ্ঠে যেন বাড়ন্ত যৌবনের সেই সুধা ঝরে পড়লো। মনে মনে পুলকিতবোধ করি, কণ্ঠে আমার এখনো গান আছে, দুঃখ করি কেন, এখনো যৌবন ফুরিয়ে যায়নি! খালি গলার গানে একটা আলাদা মাধুর্য্য আছে, তা শুনতে হয় একেবারে নিরালা দুপুরে যখন গাছের পাতা নড়ে না, গভীর রাত্রে যখন সমস্ত চরাচর নিঝুম থাকে। রেডিওতে আমি একদিন মোস্তফা জামান আব্বাসীর খালি গলায় গাওয়া গান শুনেছিলাম- মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না.....গান গাওয়ায় কোন তাড়াহুড়ো নেই, বাদ্যযন্ত্রের ডামাডোল নেই, তাল মেলানোর কোন বাধ্য-বাধকতা নেই, একেবারে প্রাণের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা নির্যাসময় গান, কেবল প্রাণের তাগিদে গাওয়া।

সেই গান শুনে আমি আমার বালক-বয়সে ছুটে গিয়েছিলাম- অতি ভর দুপুরে বর্ষায় আড়িয়াল বিলের মাঝখান দিয়ে আমি আমার ছোট কোষা নৌকাটিকে বেয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আর মনের আনন্দে দরাজ গলায় টেনে টেনে গাইছি... আমার সোনার ময়না পাখি কোন্ বা দোষে গেলি ছাইড়া রে দিয়া মোরে ফাঁকি রে, আমার সোনার ময়না পাখি... আমার বড় শ্যালক আবুল হাসানের বিয়ে। আজ বৌভাতের দিন ছিল। বিয়েতে নানান রকমের আনুষ্ঠানিকতা আছে। দুলাভাইদের ছাড়া নাকি আবার সেই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা যায় না। তো, শ্যালক-বর শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে, তার সঙ্গে আমাকেও যেতে হবে।

কন্যা-পক্ষের আত্মীয়-স্বজনেরা বেলা তিনটার দিকে এসে খাওয়া-দাওয়া ও বাদবাকি আনুষ্ঠানিকতা সারলেন। আছরের পর মেয়ে-জামাই সহ বিদায় নিলেন। নিয়মানুযায়ী ঐ সময়েই আমার যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন এ বাসায় প্রচুর ঝামেলা, তা না মিটিয়ে আমার পক্ষে বের হওয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল। সমাধানও বের করা হলো, এ বাড়ির যাবতীয় কাজ-কর্ম শেষ হলেই রাত ন-দশটার দিকে আমি ও-বাড়িতে যাব।

এবং বলে রাখি, ও-বাড়িতে আমার দ্বারা যেসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হবে তা নাকি আবার রাত দশ-এগারটার আগে শুরুই হবে না। আরো বলে রাখি, আমার বিয়েতে এ সবের কোন ঝামেলা হয়নি, কারণ আমরা পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম, তার ঝাল মিটাতে অনেক কাঠ-খড় পোহাতে হয়েছিল, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেখার কোন সুযোগ মেলেনি। আমার সাত শ্যালক, চার শ্যালিকা। বড় শ্যালকের সদ্য বিয়ে হলো। তিন শ্যালিকার বিয়ে হয়েছে আগেই।

ছোট শ্যালিকার বয়স ন-দশ বছর। রাতে এতদূর একা যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ বহুবিধ, রাত-বিরাতে ভূতের ভয় তো সবারই থাকে, তার চেয়ে চোর-ডাকাতের ভয়ই বেশি। গাঁয়ের মানুষ সরল সোজা বলে কি আর তাঁদের মধ্যে চোর-ডাকাত নেই নাকি? একা না যাওয়ার আরো একটা কারণ, এবং প্রধান কারণটা হলো, ও-বাড়ির সবাই নতুন আত্মীয়, সবাই অপরিচিত, গিয়ে উঠবো নিঝুম রাতে, আমার করণীয় কর্তব্য শেষ হলে সবাই যে যার মত চলে যাবে। আমার জন্য অতি মনোরম একটা শয্যা হবে তাও জানি, কিন্তু আমি তো আর বোবার মত মুখ বন্ধ করে থাকতে পারবো না, দম আটকে আসবে।

আমার জন্য একজন কথা বলার সঙ্গী চাই। কে যাবে আমার সাথে? যাকেই ধরি সেই বলে কাজের চাপে সে গত কয়েক রাত ঘুমোতে পারেনি, আজ না ঘুমোলে নির্ঘাত মারা যাবে। অথচ আমি জানি, বিয়ে উপলক্ষে গত দু-সপ্তাহ ধরে যে ছেলেটি রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মাথায় নিয়ে গরুর মত খেটেছে সে ফিরোজ। ওকে দেখে আমার খুব মায়া হচ্ছিল, ঘুমে ঢুলুঢুলু ক্লান্ত চোখে সে তাকাচ্ছিল, কথাগুলো জড়িয়ে আসছিল। ওকে বলতে সাহস হলো না।

কিন্তু ও যখন দেখলো আমি অসহায়, বেশ বেকায়দায় পড়ে গেছি, সে নিঃশব্দে উঠে জামা গায়ে দিয়ে এসে বললো, চলেন যাই। আরে আরে লোকটা পইড়া যাইব তো, এই ভাই- এই- আমি চমকে ওঠি। লোকটা বলতে থাকে, উনারে ধরেন, উনি তো ঘুমাইতেছে, পইড়া যাইব, ধরেন ভাই- লোকটার কলকাকলিতে ফিরোজ মিয়ার ঝিমুনিভাব কেটে গেছে, মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে সে ডান-বামে তাকায়। খালি গলায় গান গাইতে গাইতে কখন থেমে গিয়েছিলাম মনে নেই। তবে মনে মনে এক অতীত দিনের ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম, টেরই পাইনি কখন মোল্লা বাড়ির হলের বাজারে চলে এসেছি।

এ বাজারটি সম্প্রতি সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছে। দোকান পাটের সংখ্যাও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য-সামগ্রী এখন এ-বাজারে পাওয়া যায়। শুধু কাছের মানুষই নয়, অতি দূর-দূরান্ত থেকেও আজকাল মানুষ এ-বাজারে সওদা করতে আসে। আঞ্চলিক কথায় লোকে বলে, হলের বাজারটির এখন অনেক 'আমোট' হয়েছে।

এই আমোট হওয়ার কারণেই রাত দশটা-এগারটা পর্যন্তও এ-বাজারের দোকান পাট খোলা থাকে, লোকজনের আনাগোণা থাকে। প্রতি দোকানে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে, পুরো রাস্তা ও বাজার জুড়েও অন্যান্য নিরাপত্তা বাতি জ্বলে। ফলে আমরা যখন বাজারের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনো বাজারটি আলো ঝলমল ছিল। বাজার পেরিয়ে আবার আমরা অন্ধকারে ডুবে গেলাম। আগে এ অংশের পূবদিকটা জুড়ে বিরাট 'বাগ' ছিল, সন্ধ্যা হতেই এখান দিয়ে হাঁটতে গেলে গা ছমছম করতো।

সেই বাগের গাছপালা কেটে তার মাঝখানে বসতি স্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। আগের মত জায়গাটি অত ভূতুড়ে নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো, ভূতে বিশ্বাস করি না ভালো কথা, কিন্তু ডাকাতে কেউ কখনো অবিশ্বাস করেছেন বলে শুনিনি। রিক্সা চলছে খটখট শব্দে, পেটের ভিতরে জ্বলতে থাকা হারিকেনটাকে মনে হয় যেন কাঁদছে। মাঝে মধ্যে রিক্সাওয়ালা এই জনমানবহীন রাস্তায়ও টুন শব্দ করে বেল বাজিয়ে ওঠে। অন্ধকারে চারদিকের গাছপালায় সেই শব্দ বহুক্ষণ পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

বলতে ভুলে গেছি, যে লোকটা ফিরোজের ঘুমের জন্য আঁতকে উঠে আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন, তাঁকে একবিন্দু ধন্যবাদও জানানো হয়নি। কিন্তু সেজন্য এখন আর আমার কোন অনুশোচনা নেই। কেবল মুখ দিয়ে গুঁটিকতক শব্দ উচ্চারণ করলেই ধন্যবাদ কিংবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ সম্পূর্ণ হয় না, মুখ-মুণ্ডলের অভিব্যক্তি থেকেই হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। আমাদের আঁতকে ওঠা অভিব্যক্তি দেখেই লোকটা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর প্রতি আমরা সবিশেষ কৃতজ্ঞ; তাঁর অভিব্যক্তি থেকে আমার এই অনুমান হয়েছিল। লোকটার প্রতি মনে মনে অতিশয় শ্রদ্ধাবনত ও কৃতজ্ঞ হলাম।

কি সরল আর দরদিয়া এ মানুষগুলো! বিগত বিশটি বছর ধরে আমি জনাকীর্ণ শহরে-বন্দরে কত ঘুরেছি, হাজারো বিপদের মধ্য দিয়ে পার হয়ে এসেছি, এমন করে কেউ কোনদিন একটু দরদমাখা সাবধান বাণী উচ্চারণ করেনি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে তার আসন্ন বিপদের সময় সাবধান করে দেয়। সাবধান থাকা উচিৎ। লক্ষ্য করি, ফিরোজ আবারো ঝিমুচ্ছে। রিক্সা থেকে পড়ে গেলে যে একটা অতি ভবাবহ বিপদ ঘটে যেতে পারে এতখানি আশংকা আমার মনের মধ্যে ছিল না, তবে পড়ে গিয়ে হাত-পা-ঘাড় ভাঙ্গাটা বিচিত্র হবে না, এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে সেটা সামলে ওঠাই হবে তখন মহাবিপদ।

অতএব, সাবধান থাকাই ভালো। সারাদিন যে খাটুনিটা ফিরোজ খেটেছে, ওর প্রয়োজন ছিল মেয়ে-পক্ষ বিদায় নিয়ে চলে যাবার সাথে সাথে শরীর এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। ওর প্রস্তুতিও তেমনই ছিল। কিন্তু আমার জন্য আর সেটা হতে পারেনি। রিক্সার ঝাঁকুনিতে ফিরোজ মিয়া ভারসাম্য হারিয়ে হঠাৎ সামনে ঝুঁকে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে চেতনা পেয়ে স্থির হয়ে বসে।

আমি দেখি সমূহ বিপদ। এখনো অর্ধেক রাস্তা বাকি, অর্থ্যাৎ আরো প্রায় আধঘন্টা রিক্সায় বসে কাটাতে হবে। কখন কোন্ অন্ধকারে ঘুমের ঘোরে কাত হয়ে সে রাস্তার এক ধারে পড়ে যায় তার ঠিক নেই। আমি আমার বাম হাতটি ওর কাঁধের ওপর উঠিয়ে দিলাম। ওকে শক্ত করে ধরে বললাম, এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাও।

আর পড়ার ভয় নেই। কিছুক্ষণ পর আমার মনে হলো, আমিও তো কম ক্লান্ত নই। যেভাবে ফিরোজের গলা ধরে আছি তাতে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। ঝাঁকুনির তালে তালে আমিও ঘুমিয়ে পড়তে পারি। কি সাংঘাতিক বিপদ, দেখা যাবে আমরা দুজনেই ঘুমোচ্ছি, এক সময় দুজনেই হুড়মুড় করে রিক্সা থেকে পড়ে গেছি।

রাত্রিবেলার এই নির্জন রাস্তায় আমাদের উদ্ধার করার কেউ নেই। ভাবলাম কথা বলাবলি করি। মুখ সচল থাকলে ব্রেইন জেগে থাকবে, ব্রেইন জেগে থাকলে ঘুম আসবার সুযোগ থাকবে না। বললাম, ফিরোজ, বউটা কেমন হলো? ভালো। সে জড়ানো স্বরে টেনে টেনে জবাব দেয়।

দশ গাঁয়ের ঝাড়া না? তাই? তোমাদের গ্রামে এমন সুন্দরী মেয়ে আর কেউ আছে? তাহলে তো খুবই ভালো। বউয়ের কথাবার্তা কেমন? মিষ্টি না খুব? চলবে? ফিরোজের গলা আরো জড়িয়ে যায়। সে বলে, এখনো কথা শুনিনি। বলো কি, বউ তোমার সাথে কথা বলেনি? কথা বলবে কি, আমার সাথে তো এখনো দেখাই হয়নি। কি বলো, এখনো দেখাই হয়নি? ফিরোজ চুপ করে থাকে।

আমি ডাকি, ফিরোজ। উম্ম। ফিরোজের গলার স্বর অস্পষ্ট হতে থাকে। আবার ডাকি, ফিরোজ- ফিরোজ- ফিরোজের নাকডাকা শুরু হয়। আমি আর ওকে বিরক্ত করি না।

ঘুমাক। ওকে রিক্সার পিছনে ঠেঁস দিইয়ে আমার হাতের ওপর ওর মাথা রাখি। ফিরোজ ঘরঘর করে নাক ডাকতে থাকে। ঘুমের বোধ হয় আবেশন শক্তি খুব তীব্র। ফিরোজের নাকডাকার শব্দে আমার মধ্যেও একটা ঘুমের পূর্বাভাস টের পাই।

ঘুম যেন কিছুতেই না আসে সেজন্য কি করা যায়? হ্যাঁ, রিক্সাওয়ালার সাথে কিছু গাল-গল্প করলে কেমন হয়? আসলে এতক্ষণ যা বলেছি তা হলো বর্তমান গল্পের পটভূমি। আমরা কেবল গল্পের মূল অংশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। বলতে পারেন যে ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়া হলো। আমার এ গল্পটি জনৈক ছাত্রের পরীক্ষার খাতায় 'নৌকাভ্রমন' রচনা লেখার মত হয়ে গেল। গল্পটা হয়তো আপনারা সবাই জানেন, তবুও বলছি, কারণ, কে জানে, কেউ কেউ হয়তো ওটি আজ নতুন শুনবেন।

ছাত্রটি 'গরু' রচনা মুখস্ত করেছিল, দুর্ভাগ্যবশত পরীক্ষায় এসেছিল 'নৌকাভ্রমন'। 'নৌকাভ্রমন' রচনা কমন পড়েনি তাতে কি? তাদের এক পাল গরু আছে, সে প্রায়শই নদী-তীরে গরু চড়াতে যায়। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়, নদী-তীরে গরু চড়াতে গিয়ে ছোট বড় বিভিন্ন আকারের অনেক নৌকা সে দেখেছে। লাল, নীল, বাদামী রঙের পাল তোলা হয় সেসব নৌকায়। তার অনেক সাধ হয় নৌকায় চড়তে।

কিন্তু আফসোস, তার বাবার কোন নৌকাই নেই। বুদ্ধিমান ছাত্রটি এভাবেই 'নৌকাভ্রমন' রচনা লিখে দেয় পরীক্ষার খাতায়। ব্যস, 'নৌকাভ্রমন' রচনা লেখা তার সার্থক হলো। তবে শিক্ষক এ রচনা পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিলেন তা ঠিক, কিন্তু অধম ছাত্রের এতখানি শ্রমের কথাটি উপলব্ধি করে একটি নম্বর দিয়েছিলেন। এত লম্বা একটা ভূমিকা দিয়ে খুবই অল্প পরিসরে মূল গল্প সাঙ্গ করে দেয়ায় পাঠক সেই 'নৌকাভ্রমন' রচনার কৌশলটি আজ নতুন করে উপভোগ করতে পারবেন।

তবে যদিও সেই ছাত্রের মত আমি নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করছি, তথাপি এই বৃহদাকার গল্পের পেছনে আমার শ্রমের কথা ভেবে নিশ্চয়ই আপনারা এই অধম গল্পকারকে অন্তত একটি নম্বর দিবেন বলে আমি আশাবাদী। কারণ আপনারা সবাই অতি সদাশয়, নিষ্ঠুর কেউ নন। ভাইজানের নাম কি? আমি রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করি। জ্বি, ফজর আলী। রিক্সাওয়ালা ক্লান্ত স্বরে ছোট করে জবাব দেয়।

বাড়ি কোথায়? ঝিনাইদহ। আমি অবাক হই। এটা ঢাকা জেলার দোহার উপজেলা। একটা গ্রামাঞ্চল। গ্রাম থেকে মানুষ শহরে যায়।

আর এ কিনা সেই দূরের ঝিনাইদহ থেকে এখানে এসেছে? তা-ও আবার রিক্সাচালকের কাজে? ভাবলাম, হয়তো এখানে কোন আত্মীয় স্বজন আছে। হয়তো সেই দরিদ্র আত্মীয় স্বজনের সাথেই সে এখানে দিন গুজরান করে। জিজ্ঞাসা করি, বিয়ে করেছেন? সে উত্তর দেয়, জ্বি। ছেলেমেয়ে কয়টা? পাঁচটা। আমি ভীষণ অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি, পাঁচটা? সে খুবই ক্লান্ত স্বরে উচ্চারণ করে, জ্বি।

ছেলে কয়টা আর মেয়ে কয়টা? ছেলে নাই। পাঁচটাই মাইয়া। আমি আশ্চর্য হয়ে এই কন্যাদায়গ্রস্ত রিক্সাওয়ালার কথা ভাবতে থাকলাম। পাঁচ সন্তানের জনক রিক্সাচালক, এর সংসার কিভাবে চলে? তাকে জিজ্ঞাসা করি, নিজের রিক্সা, নাকি মহাজনের? মহাজনের। দিনে কত টাকা আয় হয়? মহাজনের পঁচিশ টাকা বাদে সত্তর-পঁচাত্তর থাকে।

রিক্সাওয়ালা উত্তর দেয়। রিক্সাওয়ালার জন্য আমার খুব মায়া ও দুঃখ হয়। ঘরে তার পাঁচ সন্তান ও স্ত্রী। এই প্রবাসে তার নিজেরও আছে থাকা-খাওয়ার খয়-খরচা। পঁচাত্তর থেকে নিজের খাওয়া খরচা বাদ দিলে থাকেই বা কত? আরো একটা কারণে এর প্রতি আমার খুব মায়া হলো।

রিক্সাচালকের কাজ নিতান্ত কষ্টকর কাজ, মানবিক দিক থেকে বিচার করলে বিবেক কখনো একজন মানুষের দ্বারা অন্য মানুষকে আরামে বসিয়ে টেনে নেয়া সায় দিবে না। তারপরও সামাজিক বিচারে রিক্সাওয়ালারা খুব একটা সম্মানজনক পেশাধারী নয় বলেই আশা করি সবাই একমত হবেন। এতদূর থেকে এ লোক যখন মাস শেষে বাড়ি ফিরবে, তার পরনে প্যান্টশার্ট থাকবে, কাঁধে বা হাতে একটা ব্যাগ ঝুলবে। মেয়েগুলো আব্বু এসেছে, আব্বু এসেছে বলে দৌড়ে ছুটে আসবে। বাবার হাত থেকে দ্রুত ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে অতি উৎসাহে চেইন খুলবে, ভিতরে কত কিছু আছে, চূড়ি, আলতা, ফিতা! ওদের বাবা বিদেশ থেকে চাকুরি করে দেশে ফিরেছে, ওদের আনন্দ আকাশ ছুঁয়ে যাবে।

ওরা কোনদিনই জানবে না ওদের এই দুঃখী বাপজান কোন চাকুরিওয়ালা নয়, একজন হতভাগ্য রিক্সাওয়ালা, রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে মাস শেষে চাকুরের বেশে বাড়ি ফেরে। জিজ্ঞাসা করি, এতগুলো বাচ্চা নেয়া কি ঠিক হয়েছে? ওরা কি করে? কারো বিয়ে হয়েছে? রিক্সাওয়ালার মুখ তো আর অন্ধকারে দেখা যায় না, তবে সহজেই বুঝলাম আমার কথায় সে নিঃশব্দে হাসছে। বললাম, মেয়েদের বিয়ে-শাদি হয়নি? না ভাইজান। বড় মেয়ের বয়সই হলো মাত্র বার বছর। পরেরটা দশ বছর, তিন নম্বরটা আট বছর, চার নম্বরটা ছয় বছর।

সবার ছোট যেইডা ওর কেবল দশ মাস বয়স। বাড়িতে কি জমি জমা আছে? জমি জমা থাকলে কি আর রিক্সা বাই নাকি? খালি বাপ দাদার কালের এক টুকরা বাড়ি আছে। ঘরদোর কয়টা? একটা। শনের ঘর। বাড়িতে টাকা পয়াসা কি রকম দেন? কোন মাসে এক হাজার, কোন মাসে বারশো।

একটু বেশি খাটতে পারলে দেড় হাজারও দেই কোন মাসে। এতে কি সংসার চলে? এতে কি আর সংসার চলে নাকি? তো আপনার বউ-বাচ্চারা বাঁচে কি খেয়ে? পরের বাইত্তে কাম কইরা খায়। আমি স্তমিভত হয়ে যাই। একেবারে নির্লিপ্ত কণ্ঠে সে এ কথাটি বললো, তার একটু লজ্জা হলো না, দ্বিধা হলো না; তার কণ্ঠে কোন জড়তা নেই। আমি বলি, তাহলে তো কোন অসুবিধাই নেই।

আপনি এখানে রিক্সা চালান, বাড়িতে বউ অন্য বাড়িতে কাজ করে। মেয়েগুলোকে স্কুলে দেন তো? না স্যার। (সে আমাকে প্রথম স্যার ডাকলো। কেন জানি না)। বড় দুইটা দুই বাড়িতে থাকে, বউ পাশের বাড়িতে দিন খাটে।

কোন ঝামেলা নাই। আমার একটু রাগ হলো। এ ব্যাটা ছাগলে বলে কি, নিজের সত্রী, দু-মেয়ে পরের ঘরে কাজ করে খায়, আর বলে কি কোন ঝামেলা নেই? সএী মেয়েদেরকে পরের ঘরে কাজ করতে দেয়াটা খুব সম্মানের কাজ? বললাম, ঝামেলা নেই শুনে খুব ভালো লাগছে। মেয়েদের কি বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে নেই? সে বলে, আল্লাহর মাল আল্লাই দেখবো। আমি ভিতরের রাগ চেপে বলি, আপনার এতগুলো বাচ্চা নেয়া যে ঠিক হয়নি তা কি এখন বুঝতে পারছেন? পারবো না ক্যান? হাড়ে হাড়ে এখন টের পাইতাছি।

তাই যদি হয় তবে আপনার কি একটু বুদ্ধিমান হওয়া দরকার ছিল না? অর্থ্যাৎ আমি বলছি কি, একটা মেয়ে হলেই কি সবচেয়ে ভালো হতো না। সে বলে, একটা ছেলের আশায় এতগুলো বাচ্চা নিতে হইল। আচ্ছা ধরুন, চারটা মেয়ের পর আপনার একটা ছেলে হলো, তাতে আপনার কি লাভ হতো? সে দুঃখিত স্বরে বলে, বংশের একটা বাতির দরকার না? এখন তো আমার বংশের কেউ রইল না। মেয়েগুলান সব চইলা যাইব শ্বশুর বাড়ি। আমার ভিটার বাতি জালাইব কে? এ কথা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই, এ লোকটি যেমন রিক্সা বাইছে এর পাঁচ নম্বর বাচ্চাটা ছেলে হলে সেই ছেলেটিও তার বাবার মত রিক্সা বাইত।

কারণ কাউকেই সে মানুষ রূপে গড়ে তুলতে পারতো না। মেয়েগুলোকে তো নয়ই, ছেলেকেও পারতো না। আট নয় বছর হলে ছেলেকেও দিয়ে দিত পরের বাড়িতে কাজ করতে। বড় হয়ে হয় কুলি হতো, অথবা কামলা খাটতো, নয় ইট ভাংতো, অথবা বাবার মত রিক্সা বাইত। কিংবা কে জানে, চোর-ডাকাত-বাটপারও হতে পারতো।

বাবা মরে গিয়ে বংশের বাতি জ্বালবার জন্য রেখে যেত একটা চোর। সবাই বলতো, চোরের ছেলে। বাবা চোর না হলেও ছেলেকে ডাকতো চোরের ছেলে। এসব রিক্সাওয়ালার মত লোকেরা মনে করে যে, বংশ রক্ষাই হলো সবচেয়ে বড় কাজ। কেন, মেয়েরা বংশধর না? একটি সুশিক্ষিত মেয়ে রেখে মরা ভালো, নাকি পাঁচটি চোর-ছেলে জন্ম দিয়ে মরা ভালো? এসব এরা বুঝবে না।

এসব বোঝার জন্য শিক্ষার দরকার। আমি রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি তো লেখাপড়া শিখেননি। শিখেছেন? না স্যার। শিখেননি কেন? ফজর আলী সলজ্জ স্বরে বলে, গরীব তো! গরীব হলে বিয়ে করেছেন কেন? বিয়ের সামর্থ্য না থাকলে বিয়ে করা ফরজ হয় না। একটা ঘটনা আছে স্যার।

ঘটনা? কিসের ঘটনা? প্রেমের ঘটনা। ভেরি ইন্টারেষ্টিং! আমি বেশ আগ্রহবোধ করি। এখনো অনেক রাস্তা বাকি। এ ব্যাটা গল্প বলুক। কথা বলছে বলে এর অবশ্য গতি মন্থর হয়ে গেছে।

ফজর আলীর গল্প শুরু হলো। বেশ সাদামাটা, গতানুগতিক প্রেমের গল্প। পাশের বাড়ির যুবতী মেয়ে রহিমার সাথে ফজর আলীর প্রেম হয়েছিল। ফজর আলী পরের বাড়িতে দিন-মজুরি খেটে খাওয়া মানুষ, সে একজন কামলা। রহিমার বাবা একজন হা-ভাতে কৃষক, তার পরও পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া জানা রহিমাকে বিয়ে করার কথা ফজর আলী কল্পনাও করতে পারে না, রহিমার জন্য সে যোগ্য পাত্র নয়।

প্রতিদিন পরের বাড়িতে কামলা খেটে মা আর দুই বিবাহযোগ্যা বোনের সংসারই চালাতে পারে না, তার ওপরে নিজের বিয়ের কথা ভাবে কি করে? কিন্তু প্রেম তো আর ধনী-গরীবের মাঝে অসমতা মানে না। রহিমা গর্ভবতী হয়েছিল। ঠিক ঐ সময়ে তার বিয়েটা হয়ে গেল অন্য পুরুষের সাথে। মনের দুঃখে উদাসীন ফজর আলী দেশ ছাড়লো। ফরিদপুরের ভিতর দিয়ে সে চরভদ্রাসন এল, তারপর পদ্মা পাড়ি দিয়ে চলে এল দোহারে।

শিমুলিয়ার মজিদ মাঝির বাড়িতে সে রাখালের কাজ নিল। পরের বাড়িতে রাখালী করে তো আর জীবন পার করা যাবে না। বছর দুই পর শিমুলিয়ায় একটা ইটের ভাটা হলো। সহৃদয় মজিদ মিয়া তাকে সেই ইটের ভাটায় কাজ দিয়ে দিলেন। ফজর আলী বহুদিন সেই ইটের ভাটায় কাজ করেছিল।

একদিন সেই ইটের ভাটাটিও বন্ধ হয়ে গেল। ফজর আলী দোহার ছাড়লো না। এখানকার মানুষগুলো খুউব ভালো, তার আফসোস, তার জন্ম এখানে হলো না কেন! ইটের ভাটা বন্ধ হবার পর ফজর আলীর হাত-পা গুঁটিয়ে যায়। কিন্তু পেট তো আর বন্ধ থাকে না। সে রিক্সা ধরলো।

এই হলো ফজর আলীর প্রেমের গল্প, একেবারে সাদামাটা। তবে সামান্য; বৈচিত্র্য আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা এমন একটি গল্প কিংবা উপন্যাস আছে। উপন্যাসের নাম আমার মনে নেই। তবে আমার ভুলও হতে পারে, হয়তো এমন কোন গল্প কেউ লিখেননি, ফজর আলীর গল্পটিকেই মনে হয়েছে হয়তো আগে কোথাও এমন ঘটনার কথা শুনেছি।

বলতে পারেন, যে-বিষয়ে একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক গল্প লিখে গেছেন, আমি সেই একই বিষয়ে লিখছি কেন? অতি স্বাভাবিক প্রশ্ন। উত্তরে বলবো, গল্প মূলত দুটি বিষয়েই সবাই লিখে থাকেন, হয় মিলনের, না হয় বিরহের। এর বাইরে প্রেমের গল্প হয় না। তবে একেকটি ঘটনা একেক রকম। ফজর আলীর প্রেমেরও তদ্রূপ একটা ঘটনা আছে।

তবে একটু বৈচিত্র্য তো আছেই যা পরে জানতে পারলাম। একটা মেয়ে অবৈধভাবে গর্ভবতী হলো, তা সারা গাঁয়ে চাপা থাকতে পারলো? ও-মেয়ের বিয়েই বা হলো কিভাবে? আমি ফজর আলীকে জিঞ্চাসা করলাম। এটা কি স্যার চাপা থাকবার কতা? ফজর আলী বলে। সেই বিয়ে টিকলো? জিজ্ঞাসা করি। নাহ্।

ফজর আলী জবাব দেয়। তাহলে? সাত দিনের মাথায় বিয়া ভাইঙ্গা গেল। ওর পেটের বাচ্চার অবস্থা কি হয়েছিল? বাচ্চাটার জন্ম হইল। তারপর? বড় হইল। একটা জারজ সন্তান বড় হলো? হুম্।

আর রহিমার অবস্থাটা কি হলো? আবার বিয়ে হলো? একটা নষ্টা মেয়ের বিয়ে হলো? একটা ঘটনা আছে স্যার। কি ঘটনা বলো তো শুনি। স্লামালাইকুম। তাকিয়ে দেখি আমার বড় শ্যালকের ছোট শ্যালকটি আমাদের জন্য তেমাথার একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আমি আর ফিরোজ গলাগলি ধরে আছি দেখে সে খুব মজা পেয়ে মিটিমিটি হাসছে।

সে অনুযোগ করে বললো, এত দেরি করলেন যে? আমি সালামের জবাব দিয়ে লাইট জ্বেলে ঘড়ি দেখি, সর্বনাশ, এগারটা বেজে গেছে। ভাড়া মিটিয়ে চলে যাচ্ছি। ফজর আলী ডাকলো, স্যার- কিছু বলবে? ফজর আলী কি যেন বলতে চায়, কিন্তু ইতস্তত করছে। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি, কিছু বলবে? ফজর আলী বলে, আমারে একটা চাকরি দিবার পারবেন স্যার? আমি জানি না রিক্সাওয়ালার এ ধারণা কোথা থেকে হলো যে আমি কাউকে একটা চাকুরি দেয়ার ক্ষমতা রাখি। তবে মুখ ফুটে আমার অক্ষমতা প্রকাশ করতে কেমন একটু সংকোচবোধ হতে থাকলো।

আমার সম্বন্ধে লোকটা এত উচ্চ ধারণা পোষণ করে, সেটা ভেঙ্গে দিই কেমন করে? কিন্তু চাকুরির কথায় রিক্সাওয়ালার ওপর আমার প্রচণ্ড রাগও হলো। আমি নিচু লয়ে শুরু করি, তোমাকে চাকুরি দেয়ার আমার কোন ক্ষমতা নেই। আর ক্ষমতা থাকলেও তোমাকে চাকুরি দিতাম না। কেন দিতাম না জানো? তোমাদের মত এই অশিক্ষিত জাতটার একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। একজনের পেট চালাতে পার না, অথচ বছর বছর বাচ্চা উৎপাদন কর।

বংশের বাতি জ্বালবার এত শখ কেন? যদ্দিন তোমাদের এই শখ থাকবে তদ্দিন এই দেশটা দরিদ্র সীমার ওপরে উঠতে পারবে না। শালার তোমাদের মত এই অশিক্ষিত গুষ্টির জন্যই দেশের এই অবস্থা। তেমাথার কোনায় একটা ল্যাম্পপোষ্ট। চিকন তারের মাথায় একটা বাল্ব ঝুলে আছে, একটা কুপি বাতির জোরও এর চেয়ে বেশি, ভোল্টেজ এত নিচে। রিক্সাওয়ালা অপরাধীর মত মাথা নিচু করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু তার চেহারায় কোন অনুশোচনার ছাপ নেই। তার কি কোন অপরাধবোধ নেই? আমার বোধোদয় হয়। একজন রিক্সাওয়ালাকে এভাবে বকাবকি করা ঠিক হয়নি। মুখটা খুব দুঃখিত করে ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে পিঠে হাত রাখি। বলি, আপনি এদেশের (অঞ্চলের) মেহমান।

স্যরি, এরূপ কটূ কথা বলা আমার ঠিক হয়নি। স্যরি- সে হেসে দেয়। আমি আমার মানিব্যাগ খুলে একটা বড় নোট বের করে তার হাতে গুঁজে দিই। ঝিলিক দিয়ে তার চোখে মুখে আনন্দ জেগে ওঠে। আমি চলে যেতে উদ্যত হতেই সে বলে, আমার পরিবারের জন্য দোয়া কইরেন স্যার।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। আমি আবার থামি। বলি, রহিমার গল্পটা আরেক দিন শুনবো, কেমন? ফজর আলী হাসে। বলে, জানবার তো আর তেমন কিছু নাই স্যার। শুধু ছোট একটা খবর- ছোট খবরটা কি? আসলে- ফজর আলী আমতা আমতা করে বলে, আমিই রহিমারে বিয়া করছিলাম।

আমি আশ্চর্য চোখে ফজর আলীর দিকে তাকাই আর ভাবি, নিজের জিনিস নিজের কাছেই এল, তবে বাসি হয়ে উচ্ছিষ্ট অবস্থায় এল। ফিরোজ আমাকে হাত ধরে টান দেয়। মৃদু ধমকের স্বরে বলে, রিক্সাওয়ালাদের সাথে কি যা তা নিয়ে আলাপ করেন! চলেন। শ্যালকের শ্বশুর বাড়িতে এসে দেখি চাঁদের হাট। ঘর ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে, দুয়ার জুড়ে বাচ্চাদের লাফালাফি দাপাদাপি, মনেই হয় না যে এগারটা বেজে গেছে।

আমাকে আপ্যায়নের জন্য হৈ চৈ পড়ে গেল। অনেক ময়-মুরুব্বি, মধ্য বয়সী পুরুষ-মহিলার সঙ্গে আলাপ আলোচনা হলো। নতুন সম্পর্ক, মুষ্টিমেয় কয়েক জনকে বাদ দিলে বাকি কাউকেই চিনি না। অনেকে এসে কথা প্রসংগে নিজের পরিচয় দিলেন। যেমন : আমি হাসানের নয়া চাচা শ্বশুর।

(নয়া অর্থ চতুর্থ)। আমি শেফার সবচেয়ে ছোটবোন। (হাসানের বউয়ের নাম শেফা)। আমি হাসানের তৃতীয় ভায়রা ভাই। আমি শেফার সেঝ ভাবী।

শেষমেষ শেফার এক ফুফু এসে বসলেন। বললেন, আমি শেফার বড় ফুফু। ছয় ভাই আর পাঁচ বোনের মধ্যে মাশাঞ্চআল্লাহ্ আমি সবার বড়। বলতে বলতে তাঁর চোখে মুখে গর্বের হাসি ফুটে ওঠে। আমার চোখ বড় হতে থাকে।

এঁরা ভাইবোন মিলিয়ে মোট এগার জন! অবশেষে যা জানলাম তার একটা পরিসংখ্যান দেয়া যাক। শেফারা তিন ভাই পাঁচ বোন। চাচাত ভাইবোনদের মধ্যে এদের সংখ্যা তৃতীয়। জনসংখ্যায় প্রথম স্থান অধিকার করতে না পারায় শেফাদের মনে খুব কষ্ট। চাচাত ভাইবোনদের সংখ্যা মোট একচল্লিশ জন।

ফুফাত ভাইবোনের সঠিক সংখ্যাটা কারো মুখস্ত নেই। তবে একজনে গনতে শুরু করে দিয়েছিল, তেত্রিশ পর্যন্ত গোণা শেষ হলে আমার ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটে। একটা হিসাব বাদ রয়ে গেছে, শেফার তিনজন খালা আছেন। একজন বন্ধ্যা, বাকি দুজনের ছেলেমেয়েদের সংখ্যা এগার। শেফা হাসতে হাসতে একটা সুসংবাদ দিল, ছোট খালার আরো একজন আসছে, পরের মাসে।

শেফার মামাত ভাইবোনদের সংখ্যাটা জানার ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু আমার মাথা ঘুরে গেল। এ তো দেখি ভয়াবহ বিস্ফোরণ। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের এরূপ ভয়াবহতায় এরা কেউ শংকিত নয়, বরং নিজেদের মধ্যে এরা মনোকষ্টে ভোগে, যদি কেউ সংখ্যায় অপরের পিছে পড়ে যায়। আয়নায় নিজেদের চেহারা বোধ হয় আমরা কেউ দেখি না। আমি আত্ম-সমালোচনায় ফিরে আসি।

আমরা পাঁচ ভাই দুই বোন, মোট সাত জন। আমার স্ত্রীরা পাঁচ বোন সাত ভাই, মোট বারো জন। আমরা কেউ ফজর আলীর মত অশিক্ষিত নই। বিদ্যাশিক্ষায় বড় বড় ডিগ্রি লাভ করেছি একটা আরামপ্রদ ও উঁচু বেতনের চাকুরির জন্য। আমার বাবার আট বিঘা জমি আছে।

সাত ভাইবোনের ভাগে মোটামুটি এক বিঘা করে আসে। আমার ঘরে কম পক্ষে দুটি সন্তান হলেও উত্তরাধিকার সূত্রে তারা পাবে আধা বিঘা করে। আধ বিঘা জমিতে আর কয় দিনের ফসল ফলে? খাব কি? হ্যাঁ, খাবারের কোন চিন্তা নেই। বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণ করেছি কৃষক হবার জন্য নয়, চাকুরিওয়ালা হবার জন্য। চাকুরি করে খাওয়াই সবচাইতে সুখকর।

অপরকে দু-চারটে চাকুরি দিতে পারবো, নিজের খ্যাতি ও ক্ষমতায় মানুষ নতশির হবে। যে ভাব দিয়ে গল্প শুরু করেছিলাম, শেষ করলাম নীরস চাছা-ছোলাভাবে। আপনারা ভাবছেন আমি একটা শিক্ষামূলক গল্প রচনা করেছি। কিন্তু শিক্ষা কার জন্য? আমার এ গল্প কোন রিক্সাওয়ালা কোনদিন পড়বে না, অথচ তাদের জন্যই এটা একটা শিক্ষা হতে পারে। তবে আমার ধারণা, ফজর আলীর মত লোকজনেরা শিক্ষার অভাবে ভাগ্য-বিড়ম্বিত হয়।

কিন্তু যাদের শিক্ষা আছে, যেমন আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন, আমার শ্যালকের শ্বশুরবাড়ির লোকজন, এবং আরো অনেকে, এঁরা তো শিক্ষা থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করেন না। আমার স্ত্রীর বয়োজ্যোষ্ঠা চাচাত বোনের গল্পটি বলি। তাঁর স্বামী একটা বেসরকারি সংস্থায় মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনের চাকুরি করেন, যেখানে কোন পেনশন বা মৃত্যু আনুতোষিকের কোন নাম-গন্ধ নেই। তাঁদের প্রথম সন্তান একটি মেয়ে হলো। এর চেয়ে কষ্ট তাঁরা জীবনে আর কোনদিন পাননি।

মেয়েরা কি কোনদিন রোজি-রোজগার করে সংসার চালনার ভার গ্রহণ করতে পারবে? কিন্তু তাঁদের জন্য আরো অধিক দুঃখ জমা ছিল। এক বুক আশা নিয়ে দ্বিতীয় সন্তানের জন্য প্রস্তুতি নিলেন, সেটিও একটি মেয়ে। মনের আশা পূরণ হলো তৃতীয় বারের মাথায়। ঘর আলো করে তাঁদের কোলে ছেলে-শিশু জন্ম নিল। ছেলে-শিশুর কদরই আলাদা।

তাঁরা ছেলেকে নিয়ে এতই মশ্গুল হলেন যে মেয়েদেরকে যত্ন-আদর করার কথা একেবারে ভুলে গেলেন। আমার স্ত্রী একটু উপদেশ দিল, ছেলে যেহেতু হলো, এবার এখানেই ক্ষান্ত দিন। কিন্তু তার বোন এ কথা শুনলো না। তাঁরা আরো একটি ছেলে চান। কারণ এক ছেলেতে তাঁদের মন ভরেনি।

তবে আল্লাহ্র অশেষ রহমতের কারণে তাঁদের মনের আশা এবারও পূর্ণ হলো, আরো একটি ছেলে পেলেন তাঁরা। ছেলে কোলে করে আমার স্ত্রীর বোন আমার স্ত্রীকে বলেছিল, তোর কথা যদি শুনতাম তবে কি আমার এই সোনার টুকরা ছেলেটা পেতাম? তবে আমি বলতে পারি, তিন হাজার টাকা বেতনে চারটি সন্তান আর নিজেরা মিলে মোট ছয়জন হয়ে এখন তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন 'সোনার' কদর কতখানি। সারাদিন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগেই আছে, নুন আছে তো তেল নেই। ইত্যাদি। ছেলেমেয়েগুলোর শরীরে হাড় জেগে আছে, বাতাসে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা।

এরা কি তাহলে সোনার টুকরা হলো? আমার ভায়রা ভাই ও তাঁর স্ত্রী অল্প শিক্ষিত মানুষ, সোনার টুকরার প্রতি তাঁদের লোভ থাকাটাই স্বাভাবিক। এবার তাহলে একজন শিক্ষিত লোকের কথাই বলি। তিনি একজন মানুষ গড়ার কারিগর, অর্থ্যাৎ শিক্ষক। শিক্ষকতা পৃথিবীর মহত্তম পেশা এবং একজন মহত্তম পেশাজীবীর ঘনিষ্টতম বন্ধু হিসাবে আমি সর্বদা গর্ববোধ করি। তাঁর সঙ্গে যখন হাঁটি, পথে-দেখা-হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ ভক্তি আমাকে বিমোহিত এবং যুগোপৎ ঈর্ষান্বিত করে।

বিয়ে করার দু-বছর পর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়, যেটি একটি মেয়ে। ছেলে বা মেয়ে দুই-ই তাঁর কাছে সমান প্রিয়, এবং রত্ন-তুল্য, অতএব তাঁর ভিতরে কোন আক্ষেপ নেই। পরের বছর অবশ্য পুত্র-সন্তানের জন্ম হয়। আমি বললাম, আল্লাহ্র কাছে হাজার শোকরিয়া, তোর এক ছেলে এক মেয়ে। তোর মত এমন ভাগ্যবান লোক খুব কম হয়।

আমার বন্ধু মুচ্কি হাসে। এরপর দীর্ঘদিন আমাদের যোগাযোগ থাকে না। হঠাৎ পুনর্যোগাযোগ হওয়ার দিনই সে সগর্বে জানালো, তাঁর স্ত্রী অন্ত্বঃসত্তা। আমি কৌতুক করে বলি, নিশ্চয়ই এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল! সে কৌতুক ধরতে না পেরে কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকায়। আমি বলি, যাক, যা হবার হয়ে গেছে।

এবার এই তিনটাকেই মানুষ করার কথা চিন্তা কর। সে অবাক হয়ে বলে, তিনটা কি রে, পেটেরটা নিয়ে চারটা হবে না? আমি বোধহয় মহত্তম পেশার কথা উল্লেখ করে আমার বন্ধুটিকে খুব খাট করে ফেললাম। তাঁর কাছে আমি করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে কিভাবে খাট করা হলো তার একটা ব্যাখ্যা আপনাদের কাছে দেয়া প্রয়োজন। মহত্তম পেশার যতগুলো লোক আমি দেখেছি, শুনেছি তাঁদের কারো অবস্থা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নয়।

অথচ এ পেশার লোকের জন্যই সর্বোচ্চ বেতন ধার্য্য করা উচিৎ। যাক সে কথা, বেতন-ধার্য্যকরণ বিষয়াদি আমার ব্যাপার স্যাপার নয়। শিক্ষক বন্ধুর কথায় ফিরে আসি, সে তার নিযুক্তি অনুযায়ী বেতন পেয়ে থাকে, সেই বেতনে স্ত্রীসহ নিজে খেয়ে বেঁচে কয়টি সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব এটা নিশ্চয়ই তার ভেবে দেখা উচিৎ ছিল। এখন আর আমার বন্ধু পনর বছর পেছনে ফিরে যেতে পারবে না, কিন্তু সদ্য যাদের যাত্রা শুরু হলো এসব কেবল তাঁদের জন্যই প্রকৃত শিক্ষণীয় হতে পারে। আসলে শিক্ষামূলক নয়, আমি একটা প্রেমের গল্পই বলে গেছি।

তবে কি জানেন, সব গল্পই মোটামুটি শিক্ষামূলক, কিন্তু তা থেকে সবার শিক্ষাগ্রহণ এক রকম হয় না। সবাই যে আবার শিক্ষাগ্রহণের জন্যই গল্প পড়েন তা-ও কিন্তু নয়। লেখক গল্পের মধ্য দিয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করেন, পাঠকের কাছে সেই বক্তব্য ভিন্ন অর্থে বোধগম্য হতে পারে, আমার ধারণা সচরাচর তাই হয়। তবে আমি সবিনয়ে জানাতে চাই, আমি কেবল ফজর আলীর প্রেমের গল্পটিই বলতে চেয়েছি। ও একটা দরিদ্র দিন-মজুর।

চরিত্র-স্খলন তার হয়েছিল বটে। তবে বিয়ে করার সামর্থ্য ও সামাজিক মর্যাদা তার ছিল না। সেই ফজর আলী তবু তার স্বামী-পরিত্যক্তা প্রেমিকাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিল। দিন-মজুরেরা এসব পারে। আমি পারবো না।

আপনার নিজের কথাটাও ভেবে দেখুন তো, পারবেন কিনা। ** জুলাই ২০০৩

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।