আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাঠের শরীর

স্বপ্নবাজ। একটা রাতের রংধনুর স্বপ্ন দেখি...। -কিঙ্কর আহ্সান কাঠের শরীর কিঙ্কর আহ্সান ডুবটা দেবার সময় বোঝা যায়নি এত দ্রুত নিঃশ্বাস শেষ হয়ে যাবে। হওয়ার কথাও না। জহর পাকা ডুবুরি।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে অনেকটা সময় সে থাকতে পারে জলের নিচে। তবে আজ এমন কেন হচ্ছে বোঝা যাচ্ছেনা। নিঃশ্বাস বেশিক্ষন বন্ধ রাখা যাচ্ছেনা। অনেকক্ষন হল চেষ্টা করে যাচ্ছে জহর। কাজ হচ্ছেনা।

মেজাজ খারাপ হয়। বুক ভর্তি বাতাস নিয়ে সে চলে যায় জলের নিচে। কিন্তু জল তাকে গিলতে চায়না। দমে টান পড়লেই ভুস করে মাথা তুলতে হয়। জল তাকে ঠেলে দেয় উপরের দিকে।

আশেপাশের ডুবুরিরা সবাই বিরক্ত তার ওপর। কাজের সময় এমন ঝামেলা পছন্দ নয় কারো। রাত নেমেছে। সন্ধ্যের আতুর ঘর থেকে বের হয়ে আকাশটার দখল নিতে আধারের সময় লাগেনি খুব একটা। তবে মস্ত বড় চাঁদটার জন্যে খুব একটা সুবিধে করতে পারছেনা আঁধার।

চাঁদের আলোর রং এখন ডিমের হালকা কুসুমের মতন হলদেটে। তাকিয়ে থাকলে নেশা ধরে যায়। আজ অবশ্য জহরের এমনিতেই নেশা চড়েছে। কাজে নামার আগে কিঞ্চিত মদ্যপান করা হয়েছে। তাই হয়তো ফুসফুস ভর্তি বাতাস নিয়েও জলের নিচে থাকা যাচ্ছেনা বেশিক্ষন।

জহরের মনটা ভালো নেই আজ। মাথাটা জলের ওপর নিয়ে একটু জিরিয়ে নেয় সে। বুক ভরে নেয় নিঃশ্বাস। মাথাটা ঝিমঝিম করে। চেনা সন্ধ্যা নদীটাকে অচেনা মনে হয়।

বর্ষাকালে সন্ধ্যা নদীর জল বেড়ে যায় অনেক। টইটম্বুর জল। সে ঘোলাটে জলের নিচে লুকানো থাকে সুন্দরী কাঠ। সে কাঠ বড় দামী। রাজ রাজাদের কাঠ।

বহু দুরের শহরে এ কাঠ বিকোয় ভালো দামে। সুন্দরী কাঠ দিয়ে তৈরি পালঙ্কের চাহিদা বড় বেশি। স্বরূপকাঠি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সন্ধ্যা নদীটা। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ খাট-পালঙ্ক বানানো,স-মিলে কাঠ কাটা,বিক্রি এসব কাজের সাথে জড়িত। তারা একটা সময় চরম অর্থকষ্টে দিনযাপন করলেও, এখন সময় পালটেছে।

কাঠের চোরাচালান থেকে ভালোই পয়সা পায় লোকগুলো। যাদের তিনবেলা ঠিকমতন খাবারের জোগাড় নিয়ে চিন্তে করতে হত, তারা এখন দামী ঢেউটিনের চারচালা ঘর তুলেছে। অবিবাহিতরা বিয়ে করছে আর বিবাহিতরা সাধ করে আরও দু চারখানা বউ এনেছে ঘরে। খাওয়া,পড়ার চিন্তা চলে গেলে বিয়ে করার বিলাসিতাটা মানায়। প্রশাসন সুন্দরী কাঠ কাটা ও বিক্রি নিষিদ্ধ করলেও লাভ হয়নি তাতে কোন।

কে শোনে সরকারী মানুষের কথা! তারা তো আদেশ দিয়েই খালাস। রুটি রুজি সবতো এই কাঠেরই ওপর। তাই এসব বড় বড় মানুষদের কথায় কান দেয়না কেউ। দিনের বেলা সন্ধ্যা নদীতে সুন্দরী কাঠ ভরা কোন নৈাকা দেখা যায়না। প্রশাসনের লোকেরা দিনমান ঘুরেও পায়না কাঠের কোন হদিশ।

যারাও বা পায়,টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয় তাদের। ভোরের দিকে এই কাঠ লুকিয়ে রাখা হয় জলের নিচে। দিনের আলো চোখ বুজলেই একদল দোমরা(চোরাচালান করা কাঠ জল হতে ওপরে ওঠানোর কাজে নিয়োজিত লোকদের স্থানীয় ডাকনাম। ) পাকা ডুবুরীর মতন নেমে পড়ে জলে। তারপর পূব আকাশে সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত চলে জল হতে সুন্দরী কাঠ ওঠানোর কাজ।

রাতের আঁধারে নৈাকোয় করে এই কাঠ পাচার করা হয় দুর-দূরান্তে। জহর এই দোমরাদেরই একজন। দিনভর ঘুমালেও রাত জেগে কাজ করে সে। গতর খাটার ব্যাপারে রয়েছে তার ভাল সুনাম। পরিবারে কেউ নেই জহরের।

বাপ মরেছে অল্প বয়সে। মা’টাও কিছুদিন আগে বসন্ত রোগে ভুগে মারা গেল। এখন জহর একা। তাই একটা বিয়ে করা বড্ড প্রয়োজন। ঘরে একা একা ভালো লাগেনা।

বউ থাকলে না হয় একটু জমত। জহর তাই টাকা জমায়। দোমরার কাজ করে আয় রোজগারও খারাপ হয়না তার। তবে বিয়ের জন্যে অনেক টাকা দরকার। দোমরার কাজ ভালো লাগেনা।

বিয়ে করার পর জমানো টাকা দিয়ে চাষবাষ শুরু করবে সে। ভালো ঘর দেখে বিয়ে করতে হবে। ভালো ঘর ছাড়া ভালো যৈাতুক পাওয়া যায়না। কন্যার বাপগুলা আজকাল খাটাশের মতন আচরন করে। শহুরে মানুষদের কথা শুনে যৈাতুক দিতে চায়না।

এসব কান্ডকারখানায় জহরের মন খারাপ হয়। তার মনখারাপের রোগ আগে। খালি মন খারাপ হয়। লম্বা সময়ের জন্যে ডুব দিয়ে জলের নিচে থাকা যাচ্ছেনা আজকে আর। কষ্ট হচ্ছে খুব।

তারওপর একটু পর পর লুঙ্গির গিট আলগা হয়ে খুলে যাচ্ছে। মহা যন্ত্রনা। একটু শীত শীত লাগে। বড়বেশি আবছা চারপাশটা। কেমন এক ঘোরলাগা মায়াপুরীর মতন।

পাড়ে গিয়ে একটা বিড়ি ধরাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ব্যাপারটা ভালো দেখাবেনা। সবাই কাজে ব্যস্ত। এর মাঝে ওঠা যায়না। উঠলেও দোমরাদের বিড়ির ভাগ দিতে হবে।

ভাগ দিতে সে রাজি নয়। পাশেই ভুশ করে জলের ওপর মাথা তোলে এক দোমরা। কি নিয়ে যেন কথা বলে হাসতে থাকে। জহরের এসব মাথায় ঢোকেনা। চাঁদের আলোয় লোকটার হলদেটে দাত সে দেখতে পায় স্পষ্ট।

দাতের মাঝে কালো কালো দাগ। তামাক খাওয়ার ফল। ওপরের পাটির মাংসের ভাজে লেগে আছে তরকারীর সাদা টুকরো। ঘিন্নে হয়। এসব কি ভাবছে সে।

নিজের দৃষ্টিশক্তির এমন জোর দেখে ভয় লাগে। কি হলো আজ তার। অন্ধকারের ভেতরেও কেন যে সব দেখা যাচ্ছে বুঝতে পারেনা সে। মাথায় ভয়ংকর যন্ত্রনা শুরু হয়। ভয়ংকর।

হাস্নাহেনার তীব্র ঘ্রান তীরের ফলার মতন মাথাটাকে যেন এফোড় ওফোড় করে দেয়। ঘ্রান জহরের সহ্য হয়না। সামান্য আতরও মাখতে পারেনা সে গায়। দম বন্ধ হয়ে আসে। ‘জহর ভাই, কনে আছো?’ কোন এক দোমরা ডেকেই যায় তাকে।

জহর শুনতে পায় কিন্তু জবাব দিতে পারেনা। ঘুম পায় তার। শরীরটা ভারী ভারী লাগে খুব। লোহার মতন ভারী। শীতটাও পড়েছে জাকিয়ে।

বর্ষাকালে এমন শীততো পড়ার কথা না। অন্ধকারের ভেতর জলে দানবের মতন দাড়িয়ে আছে নৈাকা আর ট্রলারগুলো। জলযানগুলোর ভেতরে থাকা কুপির দুর্বল আগুনের শিখা দেখা যায় দূর হতে। ধিমি ধিমি আঁচে জ্বলছে আগুন। জহরের সব কথা মনে পড়ে যায়।

একে একে সব পোকার মতন মাথার ভিতর এসে ভর করে। কুটকুট করে কামড়ায়। এমন রাতে কুপির আলোতে মোমেনার মুখটা বড় মায়াবী মনে হত। তিরতির করে লজ্জায় কাঁপত তার চোখের পলক। মুখে ছিলো বসন্তের দাগ।

তারপরও কম সুন্দরী ছিলোনা মেয়েটা। গায়েগতরে যে কোন শহুরে ডবকা নারীর সাথে পাল্লা দিতে পারত সে। সবই ভালো ছিলো মেয়েটার। ভালো ছিলোনা শুধু স্বভাবটা। নইলে মহাজনের ছোট বউ হয়েও কেন নজর দিলো তার দিকে! জহর যুবক ছাওয়াল।

এড়িয়ে যাবার সাধ্য যে তার নাই। মোমেনা গন্ধ মাখা সাবান দিয়ে ধোয়া শরীরটা নিয়ে যখন পাশ ঘেষে বসত তখন দম বন্ধ হয়ে আসত। মনে হত যত বড় ডুবুরী’ই সে হোকনা কেন, মোমেনার মনের নদীতে বেশিক্ষন ডুব দিয়ে সে থাকতে পারবেনা। নিঃশ্বাসেই কুলোবে না। এ নদী, সন্ধ্যা নদীর চেয়েও কয়েকগুন ভয়ংকর।

একবার ডুব দিয়ে তাই আর পাড়েই উঠতে পারলোনা জহর। শহুরে লোকদেরও অবশ্য দোষ আছে। হাস্নাহেনার ঘ্রানে ভরা গন্ধসাবান বানিয়েই তারা যুবক ছাওয়ালদের মাথা খায়। মাথা খেয়ে শেষ করে দেয় সব। শরীরের লোভ কদিন’ই বা থাকে।

জহর তাই এবার ভালোবেসেই ফেলল মেয়েটাকে। তাতেই হলো বিপদ। মোমেনার মতন স্বভাব খারাপ মেয়েও ভালবাসল জহরকে। সেই পৃথিবীর আদিম,পুরনো গল্পের মতন। মহাজনের চোখে না পড়লেও পালাতে চাইল জহর।

তার যৈাতুক দরকার। মোমেনার কাছ থেকে যৈাতুকের কোন আশা নেই। একবাপ কয়বারই বা যৈাতুক দিতে পারে! মোমেনা শুনল না এসব। বিয়ে করার শখ তার। শুনলই না জহরের কথা।

নিল ফাঁস। সুন্দরী গাছে দড়ি পেঁচিয়ে, পড়ল ঝুলে। বোকা মেয়ে জাতি। ফাঁস নেয়ার আগে একটু শলাপরামর্শ করলেও তো পারত। আর মরবি তো মর, সুন্দরী গাছেই কেন ফাঁস নিতে হবে।

রাজ রাজাদের গাছ। টাকার গাছ। এখন ঐ গাছের ধারে কাছেও কেউ যায়না ভয়ে। মোমেনার মত গাছটাও মরল একদিন। পুরো রাত সেদিন হাস্নাহেনার ঘ্রানে ভরা ছিলো গাছটার চারপাশ।

জহর টের পেয়েছিল। মোমেনাকে ভালোবাসে বলেই একা একা রাতে গাছের তলায় গিয়ে বসে থাকত সে। করত বিলাপ। ভয়ে কেউ এদিকে আসত না বলেই বাঁচোয়া। কেউ জানেনি তাদের কথা।

এমনকি মোমেনার পেটে বাচ্চা ছিলো এটাও চাউর হয়নি বাইরে। লোকলজ্জার ভয়ে মহাজন জানায়নি কাউকে। বাচ্চার বাপ খুজতে গিয়েও হয়নি কোন লাভ। ভালোই ছিলো জহর। অনেক ভালো।

তাইতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। তেল চুপচুপে চুল চিরুনি দিয়ে আচড়িয়ে একদিন ঠিক করলো বিয়ে করতে হবে। খুব খেটেখুটে তাড়াতাড়ি করে জমাতে হবে টাকা। কিন্তু মোমেনার এটা সহ্য হলোনা। সহ্য হলোনা সুন্দরী গাছটারও।

তাইতো চৈাপর দিন হাস্নাহেনার ঘ্রান ছড়িয়ে জ্বালিয়ে মারে তাকে। কই থেকে যে আসে এই ঘ্রান। সহ্য হয়না। নাকের সামনে শুকনো মরিচ পুড়িয়ে ধরলেও যায়না। কষ্ট হয়।

যন্ত্রনায় যেন ছিড়ে যায় মাথা। ঘুম ঘুম ভাবটা কাটে জহরের। হাস্নাহেনার ঘ্রানটা নেই এখন। ঢ্যামনা চাঁদটাকে আকাশে দেখতে ভালো লাগে খুব। চাঁদটাকে আজ কাঁচপোকা টিপের মতন মনে হচ্ছে।

মোমেনা মাঝে মাঝে এমন টিপ দিত কপালে। কি সুন্দরই না লাগত তখন তাকে। মুখভর্তি বসন্তের দাগ যেন নিমিষেই যেত উবে। চাঁদের শরীর ভর্তি দুধ সাদা আলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে সন্ধ্যা নদীর জলে। জলের ভেতর থেকে চাঁদের আলো দেখতে বড় অদ্ভুত লাগে জহরের।

দেখতে দেখতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সামান্য বাতাসের জন্যে ফুসফুসটা পাগল হয়ে ওঠে। শরীর ঠেলে বাইরে বের হয়ে আসতে চায়। মোমেনা কি আজই শাস্তি দেবে তাকে! কাঁধের ওপর সুন্দরী কাঠের ভারী গুড়ির অস্তিত্ব টের পায় সে। সেটার ভার বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

জেদই কাল হলো তার। ক্যান যে পানিতে নামতে গেলো! পানিতে নেমেই মাথাটা এলোমেলো হয়ে গেলো। প্রানভরে নিঃশ্বাস নিয়ে পৃথিবীটা আর দেখা হবেনা এটা বুঝে যায় জহর। অনেক ক্ষমতাধর কেউ একজন তাকে চায়না আর পৃথিবীতে। তার শরীরটা সুন্দরী কাঠের মতনই ভারী হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে।

পা গুলো শিকড় হয়ে নদীর অতলান্ত জলেরও নিচে থাকা নরম,ভেজা কাঁদা আকড়ে ধরে। কবরের জন্যে তবে কি মাটি পাবে সে,নাকি জলেরই ওপর পেটফোলা কুৎসিত লাশ হয়ে ভাসতে হবে দিনের পর দিন। জহর মরে যাচ্ছে। এ নিয়ে আক্ষেপ নেই কোন। জলের নিচ থেকে মাথা তুলে চাঁদটাকে আরেকবার দেখবার জন্যেই এ মুহূর্তে তার যত বুক ভর্তি হাহাকার।

কাঁচপোকা টিপটাকে আরেকবার সে দেখতে চায়। আরেকবার দেখতে চায় মোমেনার ডুরে পাড়ের হলদে শাড়ীর আচল,নরম পায়ের পাতা,না দেখা সন্তানের মুখ,বাড়ীর পেছনের পেঁপে গাছটা,পাট শাক,কুপির পোড়া সলতে,সদ্য লেপা বাড়ির উঠোন,গুইসাপ,মাছরাঙা,কাঠাল পাতা,পাটিসাপটা পিঠা আরও যা যা এখনও দেখা হয়নি সব। এক জীবনে কত কিছুই না অদেখা রয়ে যায় মানুষের। কতই রহস্যই না থেকে যায় অজানা। ফুরিয়ে আসছে সময়।

মরে যাওয়ার আগে জহর বলে ‘আফসোস,বড়ই আফসোস। ’ জলের নিচে বলে সে কথা জীবিত কোনো মানুষের কানে এসে পৈাছায় না। কিন্তুু সে ঠিকই শুনতে পায় কোন এক দোমরার ডাক। ‘জহর ভাই, কনে আছো?’ জবাব দেবার জন্য মনটা অনচান করে তার। আনচান...।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।