আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাসিক আলকাউসারে সাক্ষাৎকার

হ্যা আমি সেই সত্যবাদীকে সত্যবাদী মনে করি পূর্ণ সাক্ষাৎকার মদীনা রাষ্ট্র না মানার কারণে নয় বনু কুরাইযাকে পাকড়াও করা হয়েছিল বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সংসদসদস্যদের কাছে দায়িত্বশীল বক্তব্য কাম্য মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ প্রশ্ন : যুদ্ধ ও আক্রমণ-নীতির ক্ষেত্রে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ সম্পর্কে কিছু বলবেন কী? উত্তর : যুদ্ধ শব্দ ব্যবহার না করে এক্ষেত্রে ‘জিহাদ’ শব্দ ব্যবহার করলেই ভালো হতো। কারণ কিয়ামত পর্যন্তের জন্য বিশ্বশান্তির দূত রহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জিহাদ এ যুগ বা ঐ যুগের দেশে দেশে বা গোত্রে গোত্রের যুদ্ধের মতো কিছু ছিল না। এসব যুদ্ধ তো হয়ে থাকে সম্পদলাভ, আধিপত্য বিস্তার তথা বিভিন্ন পার্থিব উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে। পক্ষান্তরে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জিহাদ ছিল হয়ত বিজাতীয়দের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার্থে, যাকে পরিভাষায় ‘দিফায়ী জিহাদ’ বলা হয়ে থাকে। না হয় খোদাদ্রোহী গোষ্ঠী কর্তৃক আল্লাহর জমিনে সংঘটিত ফিতনা-ফাসাদ ও জুলুম-অত্যাচার এবং আধিপত্যকে দমন করার জন্য।

এটি হচ্ছে ‘ইকদামী জিহাদ’। কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন স্থানে উভয় প্রকার জিহাদের এ তাৎপর্যগুলো সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে। নমুনাস্বরূপ সূরা বাকারার ২৫১ এবং সূরা হজ্বের ৩৯, ৪০ নং আয়াত দেখতে পারেন। এ কারণেই তাঁর জিহাদের ছিল কঠোর নীতিমালা। ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি এমন কোনো গোত্রের উপর হামলা করতেন না।

ফিতনা-ফাসাদ ত্যাগ করে অনুগত হয়ে কোনো বিধর্মী ইসলামী রাষ্ট্রে থাকতে চাইলে তার জন্য সে পথ খোলা ছিল। আর জিহাদে নিরীহ নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র স্থাপনের পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদী বিভিন্ন গোত্রের লোকদের শুধু সেখানে বসবাস করতেই দেননি; বরং তাদেরকে নিরাপত্তা সনদ প্রদান করেছেন, যাতে এ অঙ্গীকারও অন্তর্ভুক্ত ছিল যে, এ গোত্রগুলোর সাথে অন্য যে সকল গোত্রের সন্ধি আছে তারাও এদের মতো সুবিধা ভোগ করবে। (সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৫০১) প্রশ্ন : গত ৪ মার্চ জাতীয় সংসদে মহাজোটের একজন সংসদসদস্য (মঈনুদ্দীন খান বাদল) মদীনা রাষ্ট্র না মানার অপরাধে বনু কুরাইযার ৬০০ লোকের কল্লা কেটে নেওয়া হয়েছিল-এমন দাবি তুলে ‘বাঙ্গালী উম্মতের বিরোধিতাকারীদের কল্লা কেন কেটে নেয়া যাবে না প্রশ্ন তুলেছেন। একই প্রসঙ্গে তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তার উল্লেখ করা এ তথ্যে কেউ কোনো ভুল ধরতে পারলে তিনি প্রস্তরাঘাতের শাস্তি মাথা পেতে নেবেন।

এ প্রসঙ্গে আপনি কিছু বলবেন কি? উত্তর : কথাগুলো আমি সংবাদপত্রে দেখেছি। যদি কথাগুলো জাতীয় সংসদে না বলা হত তাহলে আমি এর জবাব দিতাম না। কারণ ইসলাম ও বিশ্বনবীর অনুসারীদের এত দায় পড়েনি যে, যে কেউ মনগড়া একটি মন্তব্য করে দিলেই তার উত্তর দিতে হবে। কিন্তু যেহেতু কথাগুলো বলা হয়েছে সংসদের অধিবেশনে এবং সম্মানিত স্পীকার সাহেব কর্তৃক তা এক্সপাঞ্জও করা হয়নি তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে বাধ্য হচ্ছি। প্রথমেই বলে রাখি, ঐ সদস্যের কথাগুলো শুধু অসত্য ও বিভ্রান্তিকর ছিল তা-ই নয়; বরং তা কোনো মুসলমান বা সম্মানিত সংসদসদস্য-সূলভও ছিল না।

সংসদসদস্যদের কাছে দেশের মানুষ আরও দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করে। তার ব্যবহৃত ভাষা ছিল কুরুচিপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘কল্লা কেটে দেয়া হয়েছে’, ‘বাঙ্গালী উম্মত’, ভুল প্রমাণ হলে ‘প্রস্তর মারা হোক। ’ এ দিকটির উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। তবে তার বক্তব্যের বিষয়ে বলতে হয় যে, এটি ছিল সত্যের অপলাপ ও কুরুচিপূর্ণ।

শত কোটি লোকের প্রাণের নবীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে তিনি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মদীনা রাষ্ট্র না মানার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী কুরাইযার ৬০০ লোকের কল্লা ফেলে দিয়েছেন। ’ ইসলামের ইতিহাস ও সীরাতুন্নবীর মোটামুটি খবর রাখেন এমন লোকও বুঝবেন যে, কথাটি মনগড়া। বনু কুরাইযার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে হিজরী ৫ম সনের শেষ দিকে। আর মদীনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রথম হিজরীতে।

এ পাঁচ বছর বনু কুরাইযার লোকজন মুসলমানদের মতো একই সুযোগ-সুবিধা নিয়েই মদীনায় বসবাস করেছে। বরং বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের মদীনা রক্ষার জন্য জিহাদ করতে হলেও তাদেরকে তা করতে হয়নি। কিন্তু মদীনার অন্যান্য ইয়াহুদী গোত্রের মতো বনু কুরাইযার লোকজনও রাষ্ট্রের দেওয়া নিরাপত্তা ও শান্তির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তারা ঐতিহাসিক খন্দক যুদ্ধের সময় কাফেরদের বহুজাতিক বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। বনু কুরাইযার সর্দার শুধু নিজেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়নি; বরং অন্য গোত্রের লোকদেরও এ হীন ষড়যন্ত্রের অংশিদার করেছে।

তারা মনে করেছিল, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবার অবশ্যই কাফের-মুশরিকদের কাছে পরাজিত হবেন। তাই এই গোপন আঁতাত তাদেরকে পরবর্তীতে কাফেরদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি বা তাদের নৈকট্য লাভের সুযোগ করে দিবে। এ কাজটি ছিল তাদের সাথে কৃত চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, গুপ্তচরবৃত্তি, রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং দীর্ঘ ৫ বছর থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের দেওয়া শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। আল্লাহর ইচ্ছায় খন্দক যুদ্ধে কাফির, মুশরিক ও ইয়াহুদীদের বহুজাতিক বাহিনী খোদায়ী আজাবের শিকার হয়ে ব্যর্থ হয়ে ফেরত যাওয়ার পর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বাসঘাতক বনু কুরাইযাকে পাকড়াও করেছেন জিব্রাঈল আ.-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশে। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বনু কুরাইযাকে অবরোধ করে রাখার পর তারা খন্দক যুদ্ধে আহত এবং ঐ সময়ে মদীনায় চিকিৎসাধীন থাকা হযরত সাদ ইবনে মুআয রা.-এর ফয়সালা মানতে রাজি হয়।

হযরত সাদ রা. ছিলেন আউস গোত্রের সর্দার আর এ গোত্রটির সাথে বনু কুরাইযার সুসম্পর্ক ছিল-এ আশায় তারা ঘোষণা করে যে, সাদ ইবনে মুআয তাদের বিষয়ে যে রায় দিবেন তা তারা মেনে নিবে। এরপর তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী আহত অবস্থায় সাদ ইবনে মুআয রা.কে মদীনা থেকে আনা হয় এবং তাদের মেনে নেয়া সালিশ সা’দ ইবনে মুআয রা.-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তাদের শাস্তি নির্ধারিত হয়েছিল। সুতরাং রাষ্ট্র না মানার কারণে বনু কুরাইযার লোকদের হত্যা করা হয়েছিল এ বক্তব্য সম্পূর্ণ অসার। বিস্তারিত জানার জন্য পড়তে পারেন : সীরাতে ইবনে হিশাম ২/২৩৩ থেকে ২৫৪ ও ২/২২০ এখানে এ বিষয়টিও জানা থাকা ভাল, বনু কুরাইযার মনোনীত সালিশ সাআদ বিন মুআয রা. যে ফয়সালা দিয়েছিলেন তা ইহুদীদের ধর্ম-গ্রন্থের মোতাবেকই ছিল। কিতাবুল মুকাদ্দস, (তৌরাত), পঞ্চম খন্ড, দ্বিতীয় বিবরণ; যুদ্ধযাত্রা ২০/১০-১৪ (বি, বি, এস, ঢাকা, বাংলাদেশ, প্রকাশকাল ২০০৬)-এ বলা হয়েছে ১০ ‘‘তোমরা কোন গ্রাম বা শহর আক্রমণ করতে যাওয়ার আগে সেখানকার লোকদের কাছে বিনা যুদ্ধে অধীনতা মেনে নেবার প্রস্তাব করবে।

১১ যদি তাতে তারা রাজী হয়ে তাদের দরজা খুলে দেয় তবে সেখানকার সমস্ত লোকেরা তোমাদের অধীন হবে এবং তোমাদের জন্য কাজ করতে বাধ্য থাকবে। ১২ কিন্তু তারা যদি সেই প্রস্তাবে রাজী না হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে তবে সেই জায়গা তোমরা আক্রমণ করবে। ১৩ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ যখন সেই জায়গাটা তোমাদের হাতে তুলে দেবেন তখন সেখানকার সব পুরুষ লোকদের তোমরা হত্যা করবে। ১৪ তবে স্ত্রীলোক, ছেলেমেয়ে, পশুপাল এবং সেই জায়গার অন্য সব কিছু তোমরা লুটের জিনিস হিসাবে নিজেদের জন্য নিতে পারবে। শত্রুদের দেশ থেকে লুট করা যে সব জিনিস তোমাদের মাবুদ আল্লাহ তোমাদের দেবেন তা তোমরা ভোগ করতে পারবে।

’’ সংসদের ঐ সদস্য তার বক্তব্যে ‘বাঙ্গালী উম্মত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা একটি ইসলামী পরিভাষার সুস্পষ্ট অবমাননা। ধর্মের ন্যূনতম জ্ঞান আছে এমন লোকও জানে যে, ‘উম্মত’ বলা হয় কোনো নবীর দাওয়াতপ্রাপ্ত এবং অনুসারী লোকদেরকে। যেমন হযরত মুসা আ.-এর উম্মত, হযরত ঈসা আ.-এর উম্মত। অর্থাৎ এটি একটি ধর্মীয় পরিভাষা। কোনো ভাষাভাষী, রাষ্ট্র বা গোত্রের সাথে এটি ব্যবহারের সুযোগ নেই।

সুতরাং বাঙ্গালী উম্মত কথাটি ঠিক নয়, ঠিক শব্দ হবে বাঙ্গালী জাতি বা বাংলাভাষী জাতি। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী ঐ সদস্য মহোদয় নাকি সংসদে চ্যালেঞ্জও দিয়েছেন যে, তার কথা ভুল প্রমাণ করতে পারলে তিনি প্রস্তর নিক্ষেপের সাজা নিতে রাজি আছেন। ইসলামে অবশ্য এ সাজা বিশেষ অপরাধীদের জন্য নির্ধারিত। যাহোক যদি মাননীয় স্পীকারের মধ্যস্ততায় ও বিজ্ঞ ইসলামিক স্কলারদের সালিশীতে ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং ঐ সংসদসদস্য স্বঘোষিত শাস্তি গ্রহণের আয়োজনটি রাষ্ট্র থেকে মঞ্জুর করিয়ে নেন তবে আমি আল্লাহর নামে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। প্রশ্ন : ওই দিনই তিনিসহ আরেকজন সংসদসদস্য বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী? উত্তর : কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, (অর্থ) ‘আল্লাহ এর দ্বারা বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেন এবং বহু লোককে সঠিক পথের সন্ধান দেন।

’-সূরা বাকারা : ২৬ সুতরাং কিছু লোক ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী থাকবেই। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ছিলেন এ কথা চরম বেআদবী। আল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম খোঁজ করবে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না। ’-সূরা আলে ইমরান : ৮৫ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষতার সবচেয়ে হালকা যে ব্যাখ্যা করে তা হল, রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে কোনো ধর্মকে টেনে আনা হবে না। এবার চিন্তা করুন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাষ্ট্র কোন্ নীতিতে চলেছে? তিনি ১০ বছর যাবত কি নিজস্ব আইন-কানুন ও নিয়মনীতিতে শাসন ও বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন, নাকি ইসলামের বিধিবিধান অনুযায়ী করেছেন? নিশ্চয়ই তিনি দ্বিতীয়টি করেছেন।

যদি এটিই হয়ে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতা তবে তো ভালোই। আপনারাও কায়েম করে ফেলুন না সে কালজয়ী আদর্শ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে ইসলামের বিচার ব্যবস্থা ও শাসন পদ্ধতি চালু করতে তো আপনাদের আর কোনো বাধা থাকার....পূর্ণ সাক্ষাৎকার ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।