আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পহেলা বৈশাখঃ ধর্ম - বর্ন নির্বিশেষে সার্বজনীন একটি উৎসবের দিন

জন্মের প্রয়োজনে ছোট ছিলাম এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি পহেলা বৈশাখ আসছে। বাংলা নববর্ষ ১৪১৯। আমরা সবাই উৎসবে মেতে উঠব সেই দিন। রঙ্গের মেলায় ভরে যাবে সারা দেশ। কিন্তু এই পহলো বৈশাখ উদযাপনের পেছনেও আছে কিছু ইতিহাস।

পহেলা বৈশাখ উদযাপন এর সূত্রপাত বাংলা সনের প্রবর্তন এর মধ্য দিয়ে। আর বাংলা সন প্রবর্তন হয়েছিল মোঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর এর হাত দিয়ে। মোঘল আমলে দিন গননা করা হত আরবী বা হিজরী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। আর আরবি বা হিজরী ক্যালেন্ডার এর হিসাব হয় চাঁদ এর উপর ভিত্তি করে। কিন্তু বিপত্তি টা বাধে কৃষি থেকে কর তোলা নিয়ে।

কৃষি কাজ তো আর চাঁদ এর উপর ভিত্তি করে হয় না। কৃষি কাজ হয় আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে। তখন সম্রাট আকবর ক্যালেন্ডার সংস্কারের আদেশ দেন এবং এমন একটি ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের নির্দেশ দেন যাতে করে কৃষি কর পরিশোধের নির্দিষ্ট একটি দিন তারিখ বের করা সম্ভব হয়। তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত পন্ডিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফাতেউল্লাহ সিরাজী হিজরী ক্যালেন্ডার ও হিন্দু সৌর ক্যালেন্ডার এর সমন্বয়ে একটি নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করেন যার নাম ছিল "ফসলী সন" বা "কৃষি বছর"। ১০ মার্চ ১৫৮৪ সালে এই ক্যালেন্ডার টির যাত্রা শুরু করলেও গননা শুরু হয় সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসার দিন থেকে অর্থ্যাৎ ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ সাল।

পরবর্তীতে এই ক্যালেন্ডার টিই নাম পরিবর্তিত হয়ে বাংলা বছর বা বঙ্গাব্দ হিসেবে চালু হয়। এখানে একটু বলে রাখা ভাল এই ক্যালেন্ডার টিতে লীপ ইয়ার এর কোন সুযোগ ছিল না। আমরা জানি যে পৃথিবীর পরিক্রম গতি ৩৬৫ দিন, ৫ ঘন্টা, ৪৮ মিনিট ও ৪৭ সেকেন্ড। যার দরুন ৪ বছর পর ১ দিন এর যে অসঙ্গতি ছিল তা রয়েই গেল। সেই অসঙ্গতি দূর করার জন্য বাংলাদেশ এর বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী এবং লেখক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর নেতৃত্বে ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬ সালে বাংলা ক্যালেন্ডার টি সংস্করন করা হয়।

এই ক্যালেন্ডারটি পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে কার্যকর করা হয় যা এখনো চলছে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের শুরু হয় ওই "ফসলী সন" বা "কৃষি বছর" চালু হওয়ার সাথে সাথেই। সম্রাট আকবের নিদের্শে চৈত্র মাসের শেষ দিন টি ধরা হয় সমস্ত খাজনা পরিশোধ এর শেষ দিন হিসেবে। পহেলা বৈশাখ থেকে নতুন বছরের গননার দিন ঠিক করা হয়। তাই সে দিন নির্দেশ দেওয়া হয় সকল ব্যাবসায়ীদের পুরোনো হালখাতা বন্ধ করে নতুন হালখাতা খুলতে এবং ব্যাবসায়ীদের সাথে যাদের সম্পর্ক তাদের সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য আমন্ত্রন জানাতে ও মিষ্টি মুখ করাতে।

এছাড়াও মেলা ও উৎসবের আয়োজন করে সকলের মাঝে নতুন বছরের আমেজ ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এটাই দেশব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে এবং পহেলা বৈশাখ সার্বজনীন একটি উৎসবে পরিনত হয়। বাংলাদেশ এ আনুষ্ঠানিক ভাবে ছায়ানটের গান দিয়ে বৈশাখ বরনের পেছনে রয়েছে স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশীদের প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ। ১৯৪৭ এর পর পাকিস্তান সরকার সব সময় চেয়েছে বাঙ্গালী সংস্কৃতি কে দমন করতে। এক সময় পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত সাহিত্যকর্ম নিষিদ্ধ ঘোষনা করে।

তারই প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ১৯৬৫ সালের পহেলা বৈশাখে রমনায় ছায়ানট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত "এসো হে বৈশাখ এসো এসো" গান টি দিয়ে নতন বাংলা বছরকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বরন করে নেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে এটিই হয়ে ওঠে একটি জাতীয় উৎসবে এবং বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি চিহ্ন ও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্দ অংশ হিসেবে। এখানে অবশ্য আমরা কম বেশি সবাই একটা তথ্য ভুল করে থাকি। সেটা হল রমনার যে গাছটির নিচে ছায়নটের বর্ষবরন উৎসবটি হয়ে থাকে তা আসলে কোন বট গাছ নয়, এটি একটি অশ্বথ গাছ। যদিও এখনো সবাই এটাকে রমনা বটমূল বলেই চিনে ও বলে।

তখন পহলো বৈশাখ উদযাপনের সাথে "মঙ্গল শোভাযাত্রা" হত না। মঙ্গল শোভাযাত্রার সূত্রপাতও হয় আরেকটি প্রতিবাদের অংশ হিসেবে। ১৯৮৯ সাল। সৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। একই সাথে সামরিক সরকারের দমন পীড়ন বেড়ে গিয়েছিল বহুলাংশে।

শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনকে নেমে এসেছিল নানা রকম প্রতিবন্ধকতা। চারুকলার তরুণ শিক্ষার্থীরা তখন এই দুদর্শা থেকে বের হওয়ার জন্য পথ খুঁজছেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন জয়নুল উৎসবে ঢাক বাজিয়ে, নানা রকম প্রতিকৃতি নিয়ে আনন্দ করবেন। বিশাল বিশাল তুলি, রং প্লেট তৈরি করা হয়েছিল। সেসব নিয়ে নেচে-গেয়ে সবাই এক হয়ে গিয়েছিলেন।

এই আয়োজন সফল হবার পর সিদ্ধান্ত হলো পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হবে। সে বছরই অর্থ্যাৎ ১৯৮৯ সালে প্রথমবার ঢাকায় আনুষ্ঠানিক ভাবে শোভা যাত্রা বের করা হয়। যার নাম থাকে "আনন্দ শোভাযাত্রা"। ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর পরই এই শোভা যাত্রাটি বের হয়। এর পর থেকে প্রতি বছরই বর্ষ বরনের অংশ হিসেবে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়।

১৯৯৬ সালে এই আনন্দ শোভাযাত্রাটি "মঙ্গল শোভাযাত্রা" নাম দেওয়া হয় এবং এখনো এই নামেই শোভাযাত্রাটি বের হচ্ছে। ঢাকার বাইরে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা / আনন্দ যাত্রা হয় যশোরে ১৯৮৬ সালে। অথ্যার্ৎ ঢাকায় প্রচল হওয়ার আগে। সে সময় চারুপীঠ নামের একটি সংগঠন বর্ষ বরনের অংশ হিসেবে পহেলা বৈশাখে যশোরে এই শোভা যাত্রাটি বের করে। যতদুর জানা যায় চারুপীঠ এর সেই আয়োজনের উদ্যোক্তা মাহবুব জামাল শামীম ঢাকা চারুকলায় মাষ্টার্স এ ভর্তি হওয়ার পর ১৯৮৯ সালে যশোরের সেই আনন্দ শোভা যাত্রার আদলে ঢাকায় বের করা হয় প্রথম আনন্দ শোভা যাত্রা।

যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে যোগ করে আরেকটি নতুন মাত্রা। পহেলা বৈশাখের আনন্দের ছোঁয়া পাহাড়ের গায়েও লেগেছে। এই দিন ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা যৌথ ভাবে "বৈসাবি" নামে উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এ উৎসবেই অনুষ্ঠিত হয় মার্মদের পানি উৎসব। পান্তা ইলিশ দিয়ে নাস্তা সেরে মেয়েরা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি ও ছেলেরা পাঞ্জাবী পড়ে পহেলা বৈশাখ বরন অনুষ্ঠানে যাওয়া আজ আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বাংলাদেশ এর এটি একমাত্র অনুষ্ঠান যেটিতে কোন ধর্মীয় ব্যবধান নেই, কোন গত্রীয় পার্থক্য নেই। এই অনুষ্ঠন সকলের। যারা এতে ধর্মীয় রঙ চড়াতে চান তারা যেন পহেলা বৈশাখের ইতিহাস টা একটু পড়ে দেখেন। হিন্দু ধর্মের রীতি নয়, একজন মুসলমান শাসকের উদ্ভাবন আজকের এই "পহেলা বৈশাখ"  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।