আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিরো, বাঁশি , আমি ইত্যাদি!

পরাঞ্জয়ী... নিরো যখন কাল এলো, তখন রাত সাড়ে চারটা। সাড়ে চারটা রাত নাকি ভোর হবে? ঐ হল আর কি। আমার জানলার সাথেই এক তলা বিল্ডিঙয়ের ছাদ। পুরো ছাদটা জুড়ে ডাল পালা মেলে ছড়িয়ে আছে একটা আমগাছ। যেন আয়েশ করে হাত পা চুয়াত্তর করে শুয়ে আছে।

থোকা ভরে আম না হয়ে প্রতি বোটায় একটা করে আম ঝুলছে। টক খেতে পারিনা বলে চুরি করা হয়না। তাকিয়ে থাকি শুধু। এমন শেষ রাতে ছাদে নিরো কে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে যাই আমি। গরমে জানলা খোলাই রাখি।

রাস্তা ভরতি লাইট আর গার্ডের কথা মনে হলেই ভুত কিংবা চোর দুটোর ভয়ই মন থেকে মালকোচা দিয়ে পালিয়ে যায়। হকচকিয়ে গেলেও খুশি হই ওকে দেখে। ঘুমহীন চোখ দুটো ভীষণ ভাবে কাউকে খুঁজছিল গল্প করবার জন্য। ঘামে ভিজে আছে ওর রেশমের রাজপোশাক। আলখেল্লার মত আজব পোশাকটা খুলে আমার জানলায় ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে বলল "প্রিন্সেস ঘুমাওনি?"।

আমি আয়েশি ভঙ্গীতে মাথাটা তুলে হাতের উপর রেখে বললাম "উহু, গাছের আম গুনছি, ঐ কোণার আম গুলো দেখা যায় না, তাই গুনতেও পারছি না"। স্বভাবসুলভ মুচকি হেসে বলল "কি গরম টাই না পড়েছে তোমাদের দেশে!" আমি ভেংচে বললাম "তবে যাওনা তোমার রোমে ফিরে, কে থাকতে সেধেছে এখানে?"। মুখটা যথাসম্ভব নীচু করে কতকটা বিড় বিড় করে বলল "Qualis artifex pereo" ("What an artist dies in me!")! আমি আবার ভেংচে বললাম "গত প্রায় ২০০০ বছর ধরেই এই এক ডায়ালগ দিয়েই যাচ্ছ! আর শুনতে ভাল লাগেনা বাবা!" এবার মুখ তুলে তাকাল "তুমি বড্ড বেশি বেশি রাগ কর প্রিন্সেস! রাগলে অবশ্য তোমার গালে একটা ঢেঊ জাগে। সেই ঢেউয়ে একটা সুর আছে। তুমি জানো বলেই রাগটা বেশি কর, যাতে তোমার রাগ দেখার লোভে হলেও সবাই চলে গিয়েও ফিরে আসে!" আমি হেসে ঊঠলাম সশব্দে, ভুলে গেলাম রুম মেট ঘুমাচ্ছে পাশে! বললাম " গালের ঢেঊয়ে সুর? সুরটা কেমন গো? তোমার রোম পোড়া বাশির সুরের মত?" ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস নিল সে।

মায়া হল ওর ক্লান্ত চেহারা দেখে। বললাম "সারাদিন রাস্তায় হেঁটেছ বুঝি?"। ও বলল "হ্যা, জানো জুনোলিনা, খালি পায়ে হেঁটেছি আজ সারাদিন। রোদের তাপে রাস্তা যেন পুড়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে খালি গায়ে, খালি পায়ে ৫/৭ বছরের কিছু ছেলে মেয়ে ছুটোছুটি করে পানি, পপকরন কেউ কেউ ফুল বিক্রি করছে।

আমি সুন্দরের পীপাসায় মরি, তাই পানি না কিনে কিনলাম ফুল। টাকা পয়সা নেই তাই সীলমোহর দেবার আংটিটাই খুলে দিলাম। রাজ্য নেই, সিংহাসন নেই সীলমোহরের বাহুল্য দিয়ে কি হবে?" জানলার গ্রীলে রাখা ওর হাতটায় হাত রেখে আমি বললাম "তুমি ২০০০ বছর আগে আত্মহত্যা করছিলে ঠিকই কিন্তু আত্মাটাকে মারতে পারনি। " নিরো চুপ করে থাকে। মুখ ঘুরিয়ে ল্যাম্প পোস্টের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ওর মগ্নতা আমাকেও পেয়ে বসে। বলি" কি দেখছ সোনারাজা?" মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে "আচ্ছা, ল্যাম্প পোস্টের বাংলা কি?"। আমার খটকা লাগল। তাই তো, ল্যাম্প পোস্টের বাংলা তো জানিনা। "ক্যান এর বাংলা দিয়ে কি করবা?" নিরো চোখ পাকিয়ে বলল "প্রিন্সেস লিনা, তুমি গেয়ো ভাষায় কথা বলছ"।

আমি হেসে বললাম "বাপরে, ঠিক আছে, ঠিক আছে, কেন, এটার বাংলা দিয়ে তুমি কি করবে আমার সোনারাজা?"। নিরো ভ্রু কুচকে বলল "আমাকে সোনারাজা কেন বল, আমি তো ইতিহাসের খলনায়ক। " আমি ওর হাতে চিমটি কেটে বলি "খলনায়কদের প্রতি আমার টান যে একটু বেশি জাননা বুঝি?" "তুমি যেন কেমন! উল্টো বল, উল্টো কর!" আমি বালিশটা বুকের নীচে টেনে নিতে নিতে বলি "তুমি কি খুব সোজা? ২০০০ বছর আগে এক ঘরে পুরুষের পাশে বসিয়ে নারীকেও দাপ্তরিক কাজ করিয়েছ। সেই বুঝি খুব সোজা কাজ ছিল? রোম পুড়িয়ে বাশির সুর তুলেছ সে বুঝি খুব সহজ ছিল?" নিরো হাতটা ছাড়িয়ে নিল, বলল "সে যে সত্য নয় তুমি তা জানো প্রিন্সেস!" আমি আবার বালিশটা মাথার নীচে দিয়ে বলি " জানি গো আমার সোনারাজা। তবে কি জানো, পোড়া গন্ধে বুক ভরে সেই বুকে সুর জন্ম দেবার ব্যাপারটা খুব উপভোগ্য মনে হয় আমার কাছে।

ধ্বংসের আহাজারি শুনতে শুনতে ঘুমোতে যাবার একটা বিকৃত আনন্দ আছে। তুমি কখনো চোখের জল মুখে নিয়ে দেখেছ? লোনা স্বাদের সাথে একটা হৃদয় পোড়া গন্ধ থাকে টের পেয়েছ? হৃদয় না পোড়ালে সে স্বাদ তুমি কেমন করে পাবে? ধ্বংস না করলে কেমন করে জানবে ধ্বংসের আকুতি কেমন হয়? ধ্বংসও তো এক প্রকার শিল্প সোনা রাজা!" বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ নিরো বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। অন্ধকারে ওর চোখে কোন ঘৃনার ছাপ আছে কি না ধরতে পারি না আমি। হঠাতই এক ঝটকায় আমার হাতটা টেনে নেয় সে। বলে ওঠে "জুনোলিনা,আমি তোমাকে একটা নীলমণির আংটি উপহার দিয়েছিলাম।

কোথায় সেটা?" আমি ওর চোখে তাকিয়ে বললাম " যেদিন তুমি আত্মহত্যা করেছিলে সেইদিন সেটা আমি টাইবারের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। এই জন্মে টাইবার যাবার ভাগ্য হয়নি, তাই খুজতে পারিনি! মুখ নীচু করে হাসলাম আমি। আবারও দীর্ঘশ্বাস পড়ল নিরোর! আমার বুকের উপর চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল "কার টি শার্ট বুকে নিয়ে শুয়ে আছ?" আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। বললাম "চুরি করেছি গো! তোমার প্রিন্সেস চুরিও করে!" হেসে বলল "জানি সে কথা। ২ হাজার বছর আগে আমাকেও এমন করেই চুরি করেছিলে তুমি!" আমি টি শার্ট টা হাতে নিয়ে বললাম "এই গন্ধটা নাকে না লাগলে ঘুম আসে না আমার।

খুব দম বন্ধ লাগে! যেমন ছোট বেলায় কেঊ বদ্ধ কুয়োয় পড়ে গেলে বাকি জীবন সে বদ্ধ জাগাকে ভয় পায়, দম আটকে আসে তার, তেমনি দম বন্ধ লাগে! একে বলে ফোবিয়া। " নিরো আমার ক্ষতের ব্যাথা ভুলাতে কথার মোড় ঘুরায়--"পৃথিবী কত এগিয়ে গেছে, কুয়োয় পড়া রোগেরও নাম বের করে ফেলেছে!" ওর বলার ধরনে আমার হাসি পায়! নিরো আমার চোখে চোখ রেখে বলে "তুমি একলা হলেই আমার বাশিতে সুর ওঠেনা কেন বলতে পার লিনা? যেখানেই থাকি টেনে হিচড়ে চলে আসি কেন?"। আমি উত্তর দিলাম না। ওর কেটে ফেলা রগের দাগের উপর হাত বুলাতে বুলাতে বুঝিয়ে দেই, একলা হলে আমি যে তোমাকে ডাকি, সেই ডাক সুর হয়ে তোমার বাশির সুরকে ছাড়িয়ে যায়!" ভোর হয়ে আসে। আলখেল্লাটা গায়ে জড়িয়ে নিরো উঠে যায় চুপ করে।

আমি শুনতে পাই বিড় বিড় করে একটা বাক্য "Qualis artifex pereo" "Qualis artifex pereo"..................আমি ঘুমিয়ে গেলাম। যখন ঘুম ভাঙল তখনো আমার ডান হাতটা জানলার গ্রীল গলিয়ে বাইরে পড়ে আছে! হাতের অনামিকায় একটা রেশমের সূতা জড়ানো! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.