আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সরকারের নমনীয়তা কি কোনো দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ!

সরকারের নমনীয়তা কি কোনো দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ! ফকির ইলিয়াস ========================================== আর কতো রক্ত চায় একাত্তরের পরাজিত সেই হায়েনারা? তারা পুলিশ হত্যা করছে। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীকে জিম্মি করে লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। দেশের রেললাইন বারবার উপড়ে ফেলছে। বাস-ট্রাক পুড়িয়ে দিচ্ছে। বাসে যারা যাত্রী হয়, এরা সাধারণ মানুষ।

তাদের কী অপরাধ? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। হ্যাঁ, জবাব জানেন বেগম খালেদা জিয়া। তার ক্ষমতা দরকার। তার তনয় তারেক রহমান ওমরাহ করতে গিয়েছেন। তার সাথী কারা হয়েছেন, তা আমরা পত্র-পত্রিকায় পড়েছি।

তারেক রহমানের সৌদি আরবে সাথী হয়েছেন, ওমরাহ পালনে তার সঙ্গীদের তালিকায় রয়েছেন এক সময়ের হাওয়া ভবন খ্যাত বিতর্কিত ব্যক্তিরা। এ বিতর্কিতরা হলেন- তৎকালীন হাওয়া ভবনের মুখপাত্র আশিক ইসলাম, তারেকের পিএস মিয়া নুরুদ্দীন অপু, হাওয়া ভবনের কর্মকর্তা আখতার আহমেদ বেলায়েত, সাজ্জাদুল সিরাজ তালুকদার ওরফে জয়, ডা. আমানসহ আরো অনেকে। ওই সময়ের বিতর্কিত সাবেক কয়েকজন সংসদ সদস্যও ওই তালিকায় রয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে। তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য তৈরি হচ্ছেন। তা বুঝতে কারো বাকি থাকার কথা নয়।

এই যে প্রস্তুতি চলছে, এর বিপরীতে বর্তমান সরকার কী করছেÑ তা মানুষ জানতে চাইছে। মানুষ জানতে চাইছে, আর কতো প্রাণ গেলে এদেশে সেই একাত্তরের হায়েনাদের প্রেতাত্মারা ক্ষান্ত হবে! বিএনপির গুলশানের কার্যালয়ে গুলি করা হয়েছে। এটা কে করেছে? তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার বলতে পারবে না, এটা বিরোধী দলের ক্যাডাররাই করেছে। যদি করেই থাকে, ওদের পাকড়াও করা হচ্ছে না কেন? বিএনপি, একাত্তরের পরাজিত রাজাকারদের ঘনিষ্ঠ মিত্র, তা কারো অজানা নয়।

রাজাকার কাদের মোল্লার আপিলের শুনানি যখন শুরু হয়েছে, তখন বিএনপির আইনজীবীরা কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা দেশবাসী দেখেছে। তারা একাত্তরের সকল যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি চান বিনা শর্তে। এটাই তাদের মুখ্য চাওয়া। এর সঙ্গে কোনো আপোস তারা করবেন না। বেগম জিয়ার এই যে ‘আপোসহীন’ মনোভাব তার বিপরীতে সরকার কী করছেÑ তা জানতে চান দেশের মানুষ।

গণজাগরণ মঞ্চের আয়োজকরা এক কোটিরও বেশি মানুষের স্বাক্ষরসহ স্মারকলিপি দিয়েছেন স্পিকারকে। এই যে মানুষের আকাক্সক্ষা, তার কী মূল্যায়ন করছে মহাজোট সরকার তা জানতে চান দেশের মানুষ। বছর যতোই গড়িয়ে যাক না কেন, নাৎসিদের বিচার হতে পারলে বাংলাদেশের রাজাকারদেরও বিচার হওয়া দরকার। যা এই সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারও বটে। তাই আর কতো রক্ত দিয়ে এই দাবি পূরণ করতে হবে তা জানতে চাইছে এদেশের মানুষ।

হরতাল এই দেশে একটি মারাত্মক রাজনৈতিক-সামাজিক ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। কোনো দেশের সত্যিকার উন্নয়ন চাইলে সে দেশে হরতাল চলতে, চালাতে দেয়া যায় না। ৪২ বছর বয়সী বাংলাদেশে হরতাল আদৌ প্রয়োজন কিনা তা নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমরা জানি, আওয়ামী লীগ মনে করে তারা যদি ক্ষমতা হারায়, তবে এই হরতালকে তাদেরও হাতিয়ার হিসেবে দরকার। কিন্তু দেশের সত্যিকার উন্নয়ন চাইলে আইন করে হরতাল বন্ধ করা যাবে কিনা তা ভেবে দেখা উচিত।

এই দেশে যারা জঙ্গি মতবাদী, তারা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এমন কী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে ঘায়েল করার জন্য হরকাতুল জিহাদ নামের সংগঠন তৎপর রয়েছে বলে গ্রেপ্তারকৃত হুজিরা গোয়েন্দাদের বলেছে। তারপরও সরকার কেন সাঁড়াশি অভিযানে নামছে না, তা দেশের মানুষ অনুধাবন করতে পারছেন না। মনে রাখতে হবে, বিদেশী অনেক সংস্থা আগেই জানিয়েছে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর বাংলাদেশকে মৌলবাদী জঙ্গিরা উর্বর ভূমি হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতার সুযোগে ওরা এই কাজটিই সম্পন্ন করতে চাইছে।

তাদের জঙ্গিবাদী পেশি দেখাতে চাইছে। জঙ্গিবাদের ধারা একটাইÑ রাষ্ট্রক্ষমতা চাই। না হয় কাউকেই শান্তিতে থাকতে দেবো না। আজ ডানপন্থী যারা এই জঙ্গিবাদীদের মাথায় তুলেছেন, একদিন জঙ্গিরা তাদেরই টাই-স্যুট খুলে নেবে। কিংবা মাথায় ঘোমটা পরিয়ে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করবে।

বিশ্ব ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দেয়। আমরা জানি এসব জানার পরও বাংলাদেশের ডানপন্থীরা বলবেন, বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি নেই। যে মহলটি আজ বারবার সেনাবাহিনীকে এগিয়ে এসে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে নেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে, তাদের দলের জন্ম ব্যারাকে। এই সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যই পনেরো আগস্টের নির্মম হত্যাকা- ঘটিয়েছিল। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সরাসরি সামরিক শক্তির উৎস থেকেই রাজনৈতিক পরিচয় পেয়েছিল।

কিন্তু দেশের মানুষ সামরিক শাসনকে মেনে নেননি। তারা মেনে নেননি, ওয়ান-ইলেভেনও। তাই বাধ্য হয়েই দেশকে গণতন্ত্রের পথে চালিত করতে হয়েছে। দেশের মানুষের বিজয় হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না, বিশ্ব প্রেক্ষাপটের পরিক্রমা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে মাথা ঘামাবে।

কারণ রাজনীতির উদ্ভূত সমস্যা, রাজনীতিকদেরই সমাধান করতে হবে। কিন্তু তারা যদি ব্যর্থ হন, তারা যদি আলোচনা করে সমস্যা সমাধান করতে না পারেন, তাহলে অবস্থা কেমন হবে তা দেখতে আরো কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। না, মহাজোট তার মেয়াদের আগে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে এমন কোনো সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি না। বিএনপি-জামাত ছাড়েনি। বরং ইয়াজউদ্দিন সরকার গঠন করে আবার ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া ছিল হাওয়া ভবন।

তাহলে আজ মহজোটকে হটানোর কথা বলা হচ্ছে কেন? দেশ তো ‘বাংলাভাই-শায়খ রহমানের’ দাপটের সময়ের কথা ভুলে যায়নি। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে বলেই একাত্তরের হায়েনারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, শিক্ষা ক্ষেত্রের ব্যাপক উন্নতি, চিকিৎসার অগ্রগতি, সর্বোপরি মানুষের হাতে কিছু না কিছু টাকা এসে সচ্ছলতা দিয়েছে। এই উন্নতি তো খাটো করে দেখার নয়। হ্যাঁ, যারা এই দেশে লেভেল প্লেইং ফিল্ডের কথা বলছেন তারা মূলত রাজাকার-আলবদরদের মুক্তি চেয়ে, ওদের নিয়েই নির্বাচন করতে চাইছেন।

তা বাংলাদেশের মানুষ কতোটা মেনে নেবেÑ আদৌ মেনে নেবে কিনা তা দেখার বিষয়। এদিকে সরকার আসলে কতোটা সাহস ও শক্তি নিয়ে এগোচ্ছে, তা ও হতাশ করছে দেশের মানুষকে। খবর বেরিয়েছে, দেশের ৮৪ জন ব্লগারের নামের তালিকা নাকি প্রকাশ করেছে সরকার পক্ষ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নাস্তিকতাবাদী লেখালেখি করেন কিংবা করেছেন। কোনো ধর্মকে আঘাত করে লেখা, কোনো প্রকৃত লেখকের কাজ বলে আমি মনে করি না।

কারণ প্রত্যেক ধর্মই মীমাংসিত দলিল। তা সংযোজন-বিয়োজনের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে ধর্ম নিয়ে লিখে মানুষকে ক্ষ্যাপানো হবে কেন? অন্যদিকে এরকম কিছু ব্লগারের নাম পরিচয় প্রকাশ করে সরকার তাদেরকে জঙ্গিবাদীদের টার্গেট ও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এর কারণ কী? একটি রাষ্ট্রে আস্তিক-নাস্তিককের সহবাস আগেও ছিল, এখনো আছে। তাহলে ব্লগারদের কাউকে এমন টার্গেটে পরিণত করা হচ্ছে কেন? ব্লগ এখন মুক্ত লেখালেখির মিডিয়ার নাম।

আমেরিকার ব্লগস্পট, ওয়ার্ডপ্রেস, গুগল এখন ফ্রি ব্লগিংয়ের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই স্রোত থামাবে কে? কিভাবে থামানো যাবে? বাংলাদেশে অনলাইনের ওপর নিষেধাদেশ দিলেও প্রক্সি দিয়ে যারা বিভিন্ন ছদ্মনামে ব্লগিং করবে ওদের ঠেকানো যাবে কিভাবে? খবর বেরিয়েছে, কয়েকজন ব্লগারকে আটক করা হয়েছে। তাদের পরিবার-পরিজনকে শঙ্কার মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কেন? দেশে যে রক্তবন্যা বইয়ে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে, তা ঠেকাতে সরকারের নমনীয় মনোভাব কোনো দুর্বলতার অংশ কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। হিন্দুদের ওপর প্রকাশ্যে আক্রমণ, শহীদ মিনার ভাঙচুর, পুলিশের ওপর আক্রমণ, রেললাইন উপড়ে ফেলা, যাত্রীবাহী বাসে যাত্রীসহ আগুন, হরতালের আগেই প্রকাশ্যে ভাঙচুরÑ এমন জঘন্য ঘটনাবলীর পরও সরকার অনেকটা নির্বিকার ভূমিকা নিয়েছে। এ রহস্য মানুষের মোটেই বোধগম্য হচ্ছে না।

অথচ দেশে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। মনে রাখা দরকার সাপের লেজে পা দিলে সাপ ছোবল দিতে ফণা মেলবেই। সেই ফণার নিচে এখন বাংলাদেশ। দেশকে জঙ্গিবাদীদের খপ্পর থেকে বাঁচাতে মহাজোট পারবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। তবে মহাজোটের অন্যতম শরিক প্রাক্তন স্বৈরশাসক এরশাদ গণজাগরণের বিরুদ্ধে যেসব কথাবার্তা বলেছেনÑ তাতে প্রমাণিত হয় এই সেনাশাসক গণমানুষের জাগরণের স্মৃতি এখনো ভুলে যানননি।

ভুলে যাননি, নব্বইয়ের গণআন্দোলনের স্মৃতি। এরশাদকে আমরা না হয় ‘স্খলিত’ বলেই ধরে নিলাম। কিন্তু গণজাগরণের পুরোধা দল ২০১৩-এর গণজাগরণকে কতোটা সম্মান দিতে পেরেছে? নাকি ভোটের রাজনীতির মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছে গণজাগরণের এই চেতনাকে? এ দেশের মানুষ দেখতে চায়Ñ মহাজোট সরকার দেশের স্বার্থরক্ষায় বদ্ধপরিকর কিনা। যদি তাই হয়, তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে হরতাল পুরোপুরি বাতিলের কথা ভাবা হোক। যারা সহিংসতা করছে ওদের দ্রুত বিচার আইনে বিচার করা হোক।

দেশের মানুষের স্বার্থবিরোধী, রাষ্ট্রের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যকলাপকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আওতায় এনে মামলা ও বিচার করা হোক। তা না করা গেলে, আর কোনো কথার মালা সাজিয়েই জঙ্গিবাদী- মৌলাবাদী গোষ্ঠীর আঘাত থেকে দেশকে রক্ষা করা যাবে না। সামনে সময় মাত্র কয়েক মাস। এ সময়ের মাঝে বর্তমান সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে অনেক অর্জনই বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। ------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ// ঢাকা //: শনিবার, ৬ এপ্রিল ২০১৩ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.