আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পারভেজ সাহেব ও লোড শেডিং!!!!

It is too much tough to lead a very simple life ব্যস্ত নগরী, তার পরও কেন জানি থেকে থেকে নিরবতা কাজ করে। মাগরিব শেষ হল কিছুক্ষন। শহরের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী বিদ্যুৎ ছুটি নিয়েছে। বারান্দায় বসে আছেন পারভেজ সাহেব। বারান্দাটা মোটামোটি বড়, আজকাল এত বড় বারান্দা দেখা যায় না আধুনিক বাড়িগুলোতে।

পুব আকাশ থেকে প্রায় পূর্ণ চাঁদ এর আলো ঠিকরে পরছে, সেই আলোতেই বসে বসে চা খাচ্ছেন আর সারাদিনের দেখা অদেখা রাজ্যে ভ্রমন করতেছেন তিনি। অভ্যাসটা তার অনেক দিনের। সারাদিনের কার্যক্রম রিভিউ করেন প্রত্যেকদিন, যেন জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে এটি। আজ সারাটাদিন যেন কেমন গেছে! সব কিছু আছে আগের মতই, কিছুই বদলায়নি, কিন্তু কেমন যেন একটা শুন্যতা কাজ করেছে সারাটা দিন। বার বার মনোযোগ পালিয়ে গেছে কাজ থেকে, যেন অঘোষিত লুকোচুরি খেলায় মত্ত।

চোখ ও কেমন যেন বিদ্রোহ শুরু করেছে। কোন কিছুই দেখতে দেয় না ঠিক মত, চোখের মনি বার বারই যেন দৃষ্টির কেন্দ্র বিন্দু বলদাচ্ছে, ঘোলা করে দিচ্ছে সব। ঢাকা বিশ্ববিদ্দালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অফিস সহকারি সে। তার দিন শুরু হয় মোবাইল ফোন এর এলার্ম এর শব্দে, ঘুম থেকে উঠে হাড়িতে ভাত বসিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। খাওয়া শেষ করে, বের হয়ে যায় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

আগারগাও বাস স্টপেজে দড়িয়ে থাকে বাস এর অপেক্ষায়, কি দীর্ঘ সে প্রতিক্ষা, হঠাৎ যখন বাস দৃষ্টি গচর হয় তখন যেন মনে হয় ঈদ এর চাঁদ উঠেছে। অসহনীয় যানজট এর কারনেই হয়ত ২ মিনিট আগে বাস দেখতে পেয়ে এতটা আনন্দ হয়। ছোট বেলা থেকেই সে মানুষের কর্মকাণ্ড দেখে মজা পায়। এই বয়সেও সে অভ্যাস বদলায় নি। মানুষ গুলো কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, সবাই ভাবে যে অন্যরা তাকে কেয়ার করবে, তার কথা শুনবে, তাকে প্রাধান্য দিবে, বিপদে তার শরনাপন্ন হবে। পারভেজ সাহেব ভেবে অবাক হয়, সৃষ্টির এত বুদ্ধিমান প্রানিও কিভাবে প্রতিনিয়ত নির্বোধ এর মত কাজ করে যায়। সে যাকে ভাবে যে তার কেয়ার নিবে, তার কথা একবারও চিন্তা করে না, তারও তো কেয়ার এর প্রয়োজন হতে পারে নাকি? তারও তো একি ধরনের চাহিদা আছে, সেও তো চায় তাকে কেউ প্রাধান্য দিক, তাকে কেউ ডাকুক। সে না হয় নাই হল, কোনো কারন বশঃতও যদি সে অন্যের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয় তাকে কত কথাই না শোনা লাগে, সামনে অথবা পিছনে। কত অকৃতজ্ঞ, নিষ্ঠুর এই মানব জাতি।

বাস স্টপেজে নীল শার্ট পরা লোকটা অল্প বয়স্ক একটা ছেলেকে কি যেন শোনাচ্ছিল, খুব সম্ভবত তার ডিপার্টমেন্টে তার ক্ষমতা, প্রভাব সম্পর্কে, ছেলেটার যে বিন্দু মাত্র আগ্রহ ছিল না তার কথা শোনার তা ওর মলিন মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছিল, কিন্তু লোকটা কত নির্বোধ, ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারছে না। পারভেজ সাহেবের মনে একটু মায়া জাগল ছেলেটার জন্য, আহারে বেচারা, দিন এর শুরুতেই এক প্রকার মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যথা সময়ের কিছু আগেই অফিসে পৌছালেন তিনি। সিগনেচার করে নিজের টেবিল এ গিয়ে বসলেন। মনোযোগ দিলেন নিজের কাজে।

কিছুক্ষনের মাথায় কয়েকজন ছাত্র এল, সামনে থাকা অফিস সহকারি কে জিজ্ঞাসা করল তাদের ক্লাশটা হবে কিনা, শিক্ষক এখন নাকি পৌছায়নাই। পারভেজ সাহেবকে ও সেই সাথে ছাত্রগুলিকেও অবাক করে দিয়ে অফিস সহকারিটি হঠাৎ এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন যেন ছাত্রগুলা তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই, তার গায়ে চুল্কানি পাতা দিয়ে জোরে ঘষা মেরেছে। পারভেজ সাহেব উঠে দাড়ালেন। সামনে গিয়ে ছাত্রদের অভয় দিয়ে অপেক্ষা করতে বললেন, তিনি স্যার কে ফোন দিলেন, কথা শেষে ছাত্রদের বললেন যে স্যার একটু অসুস্থ আছেন, তিনি আজকের ক্লাস তা নিতে পারবে না, আগামি পরশু দিন ১২ টায় ক্লাস তা নিবেন, ছাত্ররা চলে গেল। একবার ভাবতেছিলেন যে খারাপ ব্যবহার করা লোকটাকে কিছু বলবে, কি যেন চিন্তা করে আর বললেন না, হয়ত যার মাথায় কথায় কি করতে হবে সে বুদ্ধি নাই, তাকে হাজার বুঝালেও কাজ হবে না, গুরুজনরাতো আর এমনেই বলে নাই যে “কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না।

অথবা যার হয়না নয় এ তার হয়না নব্বই এ“। যাই হোক, সময় চ্চলে যাচ্ছে, অফিসের কাজ শেষ, এবার বাড়ি ফেরার পালা। যথারিতি সেই কার্জন হলের সামনে গিয়ে দোতলা বাস এ উঠলেন, সীট পেলেন ডান পাশে জানালার পাশে। বাস ছাড়তে এখনও ১৫ মিনিট বাকি। নিজের অজান্তেই সে চিন্তা জগতে হারিয়ে গেল।

কত বিচিত্র মানুষের মন। কত দ্রুত কত জায়গায় নিয়ে যায় আমাদের, সৃতির আনাচে কানাচে ঘুরে বেরায় সারাটা ক্ষণ। পারভেজ সাহেব জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। রাস্তার অপারে কয়েক জোরা কপোত-কপোতী ফুটপাথে বসে আছে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে, আজ কাল কার পোলাপাইনগুলা কেমন যেন লজ্জাহীন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বড়দের সম্মান জানাতেও জানেনা।

কয়েকটা ছেলেমেয়ে বাস এর নিচেই আড্ডা দিচ্ছে। একটু পরপর হাসির কলরব শোনা যাচ্ছে, এক্টু দূরে আবার উনার ডিপার্টমেন্ট এর একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হেটে যাচ্ছে হাত এ হাত রেখে। সময়ের সাথে সাথে প্রেম নিবেদন এর ধারা বদলালেও আবেগ প্রকাশের ধারা এর কোন পরিবর্তন হয়নি। দেখতে দেখতে পারভেজ সাহেব হারিয়ে গিয়েচিলেন তার কৈশোরে, স্কুল এর সুবর্ণা এর প্রথম হাত ধরার অনুভুতি যেন মুহুরতেই আবার অনুভব করতে শুরু করেছে। তার সেই স্বর্গ অনুভুতিতে বেঘাত ঘটিয়ে বাসটি যেন হঠাৎ চলতে শুরু করলে, দৃশ্যপট পালটাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে তার চিন্তা ধারা।

একটা সময় যেন সব চিন্তা ছেড়ে দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে শুধু দেখা শুরু করলেন। রাস্তার পাশে একটা চা এর দোকান। কয়েকজন ছেলে পেলে চা খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে, না আড্ডা ঠিক বলা যাবেনা, আড্ডাতে যে প্রান থাকে তা ওদের মাঝে নেই। হাতে কলম-স্কেল দেখা যায়, মনে হয় পরিক্ষা ছিল, এরকম মুখের অভিব্যক্তি শুধু পরিক্ষা দেয়ার পরই দেখা যায় ছাত্রদের মাঝে। চা দোকান তার পাশেই দুটো অল্প বয়সী ছেলে, ৭-৮ হবে, জুতা পালিশের বক্স সামনে নিয়ে বসে আছে।

ঠিক বসে আছে বলা যাবে না, রীতিমত দেয়াল এ হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েছে বলা যায়, মুখটা মলিন, পরস্পরের সাথেও কথা বলছে না। হয়ত ঘুম নয়ত পলিশ করার জন্য কোনো জুতার অপেক্ষায় আছে। বাস চলছেতো চলছেই। হঠাৎ, একটা বড় গাছের পাশে দাঁড়ানো সাদা লম্বা পাঞ্জাবি পরা একজন বুড়ো লোক পারভেজ সাহেবের দৃষ্টি কেড়ে নিল। লোকটার দুহাত ছিল উপরের দিকে, গাছটার দিকেই ফেরান মুখ, কিন্তু গাছের দিকে তাকিয়ে নেই সে, দেখে মন হচ্ছে যেন গাছের পাতার ফাক দিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে।

একাগ্র মনে দোয়া করে যাচ্ছে, কেন দোয়া করছে জানেনা পারভেজ সাহেব। এখন কোনো নামাজের ওয়াক্ত বলেও মনে হচ্ছে না। তবুও লোকটার একাগ্রতা দেখে নিজের মনের অজান্তেই বলে ফেলল “আল্লাহ, তুমি লোকটার দয়া কবুল করো। “ হঠাৎ এ লোকটা চলে গেল দৃষ্টির বাইরে, লোকটাতো যায়নি, বাসটা এগিয়ে গেছে। আস্তে আস্তে ঘুমের মায়ায় জড়িয়ে গেলেন, মায়া ছিন্ন করতে পারলেন না তিনি।

ধরা দিলেন ঘুমের কাছে। আলোক দীপ্তি মুছে গেল তার দৃষ্টি থেকে, হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেছে ঝাকুনিতে অথবা শব্দে, তার পর ও ঘুমের গভিরতা কমাতে পারে নাই কিছুই, যতই হোক, সারাদিন দিন এর কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি যেন পেয়ে বসেছে, অবশ্য বাড়ি ফেরার আগেই কিছুটা চাঙ্গা যে হতে চায়না ঠিক তা নয়। যাই হোক, জাত্রা শেষ হল, বাস থেকে নেমে একটু হেটে রিকশা নিবে, এমন সময় রাস্তার ধারে দেখে এক জন বুড়ো মহিলা রাস্তায় শুয়ে আছে। কান্না করতেছিল সে, সবাই বলে যে অরা অভিনয় করে, তারপরও কেন যেন পারভেজ সাহেব ওদের প্রতি মায়া অনুভব করে, কাছে যেতে মনে চায়, সবই আপেক্ষিক ব্যাপার, কারন, কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও করার উপায় নাই, কারন সে যে অন্য কাজে ব্যস্ত। শেষমেষ রিক্সা ঠিক করতে গেল, অনেক গুলা রিক্সাওয়ালার মাঝে একজনের চেহারা তার নানা এর মত মনে হওয়ায় কয়েকজন কে পার হয়ে তার রিক্সাতেই উঠতে গেল।

দাম জিজ্ঞাসা করলে বলে “২০ তাকা ভাই”। এই “ভাই” সম্বোধনটা নানা সুলভ হওয়ায় পারভেজ সাহেব আরো আবেগ প্রবন হয়ে পড়ল। একটা সময় এই রিক্সা যাত্রাও শেষ হল। বাসায় পৌছালেন। ছোট্ট বাবু টা আবু বলে কোলে লাফিয়ে উঠল।

এই বাবু টাকে নিয়েও অনেক চিন্তা তার, কি হবে, কি করবে, এই কলুষিত সমাজ ব্যবস্থায় টিকে থাকতে পারবেতো, নাকি হাল ছেড়ে ভেসে যাবে কাল স্রোতে! আর কতশত চিন্তা মাথায় ঘুরে। হায়রে মাথা, কি যে আছে এর ভিতরে! কিভাবে পারে এভাবে সারাদিন বিরামহিন চলতে! হঠাৎ চাদের আলো কমে এলো মনে হয়, বাইরে একটু আনন্দ ধ্বনিও শুনতে পাওয়া গেল...ও হ্যাঁ, বিদ্যুৎ চলে আসছে। এবার তো বাসার ভিতরে যেতে হয়, সৃতি রিমোন্থন এর সময় শেষ। সবাই যেখানে লোড শেডিং নিয়ে ত্যক্ত বিরক্ত, সেখানে পারভেজ সাহেবের কাছে এই লোড শডিং এর একটা ঘন্টা খুবই কাম্য। কারন এই একটা ঘণ্টাই সে নিজের মত ভাবতে পারে, নিজেকে সময় দিতে পারে, হাজার ঝামেলার মাঝে নিজেকে সময় দেয়া হয়ে উঠে না, এই লোড শেডিং এর একটা ঘন্টা তাই অনেক মূল্যবান পারভেজ সাহেব এর কাছে।

অনেক আপন, অনেক আকাঙ্ক্ষিত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.