আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হেফাজতে ইলেকট্রিসিটি

রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ ও প্রতিপালনে জাতি হিসেবে আমরা বরাবরই কিছুটা উদাসীন। এর প্রমাণ যেমন দেখা যায় আমাদের কাজেকর্মে, তেমনি আমাদের চলনে-বলনে। “সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল” বলে একটা প্রবচন আমরা অনেকেই শুনেছি, যার কোন বিদেশী সংস্করণ কেউ শুনেছে বলে মনে হয় না, কারণ অন্যান্য দেশের মানুষ বুঝে সরকারী সম্পদ মানেই দেশের মানুষের শ্রমের অর্থে অর্জিত সম্পদ। তাছাড়া, “আল্লার মাল আল্লায় দিবে” এরকম কথাও একমাত্র এদেশেই শোনা যায়, অথচ একসময় এ অঞ্চলেই প্রচলিত ছিল যে, “অবহেলায় কুবেরের ধন-ও ফুরিয়ে যায়”। স্রষ্টা তার সৃষ্টির সেরা জীবের জন্য সব সৃষ্টি করে দিয়েছেন ঠিক, তবে এসব প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সম্পদের উপযোগিতা নির্ভর করে মানুষের সদিচ্ছা ও কর্মফলের উপর।

আমাদের দেশে হরতাল, অবরোধ, সমাবেশ, রাজনৈতিক কোলাহলের সময় আমরা অহরহ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সম্পদের ক্ষতিসাধন অবলোকন করি। রোম যেমন একদিনে হয়নি, তেমনি মানুষের এরকম সহিংস ও “নিজের পায়ে কুড়াল মারা স্বভাব”-ও একদিনে হয়নি। দেশে নানান রকম অপরাধ ও অন্যায় সংগঠনের পর আমরা বিচারের দাবি নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ও বিচার নিয়ে কতৃপক্ষের নানান ছলছাতুরি দেখি; কিন্তু “প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ-ই ভাল” এই মনমানসিকতা নিয়ে কেউ এগিয়ে এলেই তাকে নানারকম কুরুচিপূর্ণ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। দেশের মানুষকে বোঝাতে হবে এই দেশ আমাদের সবার, দেশের ক্ষতি মানেই সবার ক্ষতি। হরতাল-বিক্ষোভে আমরা দেখি যানবাহন ও অন্যান্য সম্পদ বিনষ্টের এক ভয়াবহ চিত্র।

মূল্যবান প্রাণহানি তো আছেই। অনেক সময় মহাসড়কের পাশে বিশালকায় পক্ষপাতহীন বৃক্ষকেও বিনাদোষে বলি হতে হয়। আমি নিজের চোখে সাধারণ এক দিনে রাস্তার আইল্যান্ডের শোভাবর্ধনকারী গাছগুলোকে মিছিলের আগ্রাসী মানুষের ক্ষোভের বলি হতে দেখেছি! এই তো গেল সহিংস মানুষ কতৃক সম্পদ বিনাশের কাহিনী। এই সহিংসতার পিছনে নীরব ভূমিকা পালন করে জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণের পিছনে আমাদের সকলের চরম উদাসীনতা। বিদ্যুত-পানি-গ্যাস-জ্বালানী ও ভোজ্য তেল শুধু কিছু মূল্যবান প্রাকৃতিক ও জাতীয় সম্পদ নয়, এদের পরিমাণ প্রকৃতিতে সীমিত, তৈরী প্রচুর ব্যায়সাপেক্ষ, বিশ্বের আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটপরিবর্তনের প্রধান নিয়ামক এরা, বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রধান প্রভাবক-ও এরা এবং সর্বোপরি পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে এরাই মূল ভূমিকা পালন করে।

আমি সবসময় নিয়মিত বিরতিতে বিদ্যুত-পানি-গ্যাস-জ্বালানীর অপচয় রোধে বিভিন্ন বিরচন লিখে যাই, এজন্য অনেকে হয়তো আমাকে পাগল ভাবেন, অনেকে বিরক্ত-ও হন। কিন্তু সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক সব সংকটের হয়তো কখনো না কখনো সমাধান হবেই এবং তা কিছু মানুষ চেষ্টা করলেই সম্ভব, কিন্তু বিদ্যুত-পানি-গ্যাস-জ্বালানীর মত জাতীয় সম্পদ রক্ষার জন্য দেশের প্রতিটি মানুষের সুষ্ঠু পদক্ষেপের কোনই বিকল্প নেই। বিদ্যুত-পানি-গ্যাস-জ্বালানী এগুলো মূলত বিবিধ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রূপ, যা উতপাদনে বা প্রক্রিয়াজাতকরণে রাষ্ট্রের বিশেষ কতৃপক্ষ নিয়োজিত থাকে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের কাজ শুধু মিতব্যায়িতা ও সতর্কতার সাথে এসব সম্পদের সদ্ব্যবহার করা। আজ আমি আমার দেখা বিদ্যুত অপচয়ের কিছু উদাহরণ বলব।

বিভিন্ন কাজে আমাকে প্রায় সময় আন্দরকিল্লা বা চকবাজারের (চট্টগ্রাম) প্রিন্ট-ফটোকপির দোকানগুলোতে যেতে হয়। খুবই দুঃখের সাথে বলতে হয়, অন্যান্য অনেক ব্যবসার মত এই প্রিন্ট-রিলেটেড ব্যবসার সাথেও সংশ্লিষ্ট থাকে প্রচুর অল্পশিক্ষিত মানুষ, যারা অর্থউপার্জন ছাড়া জগতের বাকি সব বিষয়কে নিরর্থক মনে করে। তাদের দোকানে কাস্টমার থাকুক না থাকুক, সবসময় প্রচুর সংখ্যক প্রয়োজনের অতিরিক্ত লাইট তো জ্বলেই, তার উপরে অধিকাংশ সময় বিনা কারণে ডেস্কটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার, ফটোকপি মেশিনের মত বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ সচল থাকে। এসব অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশে “ওয়ান-টাচ অন-অফ সুইচের” কোন সদ্ব্যবহারই আমাদের দেশে হয় না!! আমি কিছু বললে তারা যুক্তি দেখায় তারা নাকি এর জন্য সরকার ও বিদ্যুত কতৃপক্ষকে টাকা দিচ্ছে! এসব মানুষ বিদ্যুত নামক পণ্যটিকে পোশাক বা খাদ্যদ্রব্যের মত একান্ত ব্যাক্তিগত ভোগ্যদ্রব্য বলেই মনে করে। লোডশেডিং-এর মৌসুমে তারা অতিরিক্ত টাকা খরচ করেই জেনারেটরের লাইন নিয়ে তাদের এই বাদশাহী অপব্যয় চালিয়ে যায়! এবার আমি বলতে চাই, চট্টগ্রামে আমার দেখা হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর খানদানী বিদ্যুত-ভোগের কথা।

বিশেষ উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, চকবাজার-গুলজার মোড়ের কেন্দ্রস্থলের সেই বড় রেস্টুরেন্টটির কথা। দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রায় ১৮ ঘন্টা এই রেস্টুরেন্টটি খোলা থাকে। এই ১৮ ঘন্টার মধ্যে সুপরিসর রেস্টুরেন্টটি শুধুমাত্র ৮ থেকে ১০ ঘন্টা “হাউজফুল” থাকে। আচ্ছা, সন্ধ্যা-রাতের কথা বাদই দিলাম, দিনের যেসময়গুলোতে কাস্টমারে পরিপূর্ণ থাকে না, ঐ সময়গুলোতেও রেস্টুরেন্টটির সব লাইট ও ফ্যান সচল থাকে। আমি একবার ম্যানেজারকে এই ব্যাপারে ফ্রি উপদেশ দেওয়াতে সে আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল যেন আমি এক পাগল; এরপরে বয়দেরকে বলার তো প্রশ্নই উঠে না! দিনের সামান্য কিছু অতিরিক্ত সময় অতিরিক্ত কিছু লাইট-ফ্যান জ্বালালে হয়তো বা দেশে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না, কিন্তু দেশের হাজার-হাজার রেস্টুরেন্ট/দোকান/অফিসের মালিক-কর্মচারীদের মানসিকতা যদি এইরকমই হয়, তবে দেশে দশটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করলেও বিদ্যুত ঘাটতি পূরণ হবে না! এবার বলতে চাই ২৬ মার্চ আমার নিজের চোখে দেখা দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক ইন্ডাস্ট্রির বিদ্যুত ব্যবহারের ইতিবৃত্ত।

ওখানে আমি “হবু প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার” হিসেবে আমার অন্য এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুর সাথে ইনফরমাল ভ্রমণে যাই। আমরা সবাই জানি শিল্প ও বাণিজ্য খাতে বিদ্যুতের ভূমিকা কতটা অপরিহার্য। এবং আমাদের মত সল্পোন্নত দেশে এই খাতে বিদ্যুত পেতে এবং পাওয়ার পরে ব্যবহার করতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই মূল্যবান সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক শিল্প-কারখানাতেই হয়তো কোন নীতিমালা ও সীমারেখা নেই, ঠিক যেমনটি নেই আমার ভ্রমণের এই ইন্ডাস্ট্রিতেও। এই ইন্ডাস্ট্রিটি মূলত একটি “ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক”, অর্থাৎ এখানে বিভিন্নমুখী একাধিক কারখানা গড়ে উঠছে।

আমি এখানে ইতোমধ্যে নির্মিত আনুমানিক ১৪ টি শেড দেখতে পাই, প্রতিটি শেডের দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৩০০ মিটার। এক-একটি শেডে শুধু টিউব লাইট আছে আনুমানিক হাজার-খানেক। আর ভাবতেই অবাক হবেন, রৌদ্যজ্জ্বল সেই দিনটিতেও আমার দেখা ৩টি শেডের প্রায় সবকটি টিউব-লাইট জ্বলছিল, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও! দিনটি সরকারী ছুটির দিন থাকাতে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল কম, যারা ছিল তারা অবাক চোখে দেখেছে- তাদের একজন ইঞ্জিনিয়ার স্যারের ফ্রেন্ড ভ্রমণে এসে কিভাবে একের পর এক অপ্রয়োজনীয়ভাবে জ্বলা লাইটগুলো সাধ্যমত “অফ” করে এসেছে! তারা হয়তো বা আরো অবাক হয়েছে এটা দেখে যে, লাইটগুলো অফ করার পরেও জায়গাগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়নি। আরো উদাহরণ দিতে গেলে রীতিমত উপন্যাস লেখা যাবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের ও রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কতৃপক্ষের উদাসীনতা, পশ্চাদমুখীতা ও নির্লিপ্ততার কথা একটু বলতেই হয়।

নগর পরিকল্পনাবিদেরা চাইলেই প্রতিটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের জন্য “ইলেক্ট্রিক লোড” নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন। তারা চাইলেই বলে দিতে পারেন, কোন ধরণের দোকানে কত বর্গফুটের মধ্যে কতটা লাইট যথেষ্ঠ হবে। সৌরশক্তিকে শিল্পখাতে ব্যাপকভাবে ব্যাবহারের জন্য সরকারী উদ্যোগের অভাব-ও পরিলক্ষিত। “এয়ার-কন্ডিশন যে কাজ করে, একই কাজ ফ্যান-ও সফলভাবে করতে পারে”- এটা বুঝাতে সরকারী দপ্তরগুলোকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তান বুঝতে না চাইলে অভিভাবককে একটু কড়া হতে হবেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.