আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী টকশো (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

প্রথম পর্ব : Click This Link ‘এবার বইমেলায় আদব-কায়দার সহজ পাঠ নামক আপনার যে-বইটি আসছে, তার বিষয়বস্তু কী?’ ‘মানবপ্রকৃতির বেসিক কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছি আমি; এই যেমন ধরো, মেয়েরা একটু হেসে কথা বললেই কেনো কাৎ হয়ে যায় ছেলেদের পৃথিবী? ঠোঁট বাঁকা করে হৃদয়ে দাগ কাটা হাসি কীভাবে হাসে সুন্দরী কমলা? মেয়েদের লিপস্টিকমাখা লাল ঠোঁট দেখে ছেলেদের জিভে কেনো পানি আসে? কোথায় এর উৎপত্তিস্থল? মেয়েদের ঠোঁট আর ছেলেদের জিভ এ-দুয়ের মাঝে কিসের যোগসূত্র?’ ছদের উদ্দিন মোহম্মদ ভূঁইয়া যখন কথা বলেন মেয়েটি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে, ভেঙে ভেঙে পড়ে, এটি আমার ভাল লাগে; কিন্তু মেয়েটি যখন কথা বলে ছদের উদ্দিন মেয়েটির দিকে হা-করে তাকিয়ে থাকে এটি আমার ভাল লাগে না, কেমন বোকা বোকা মনে হয় ছদের উদ্দিনকে। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে মেয়েটি হাসেও, হাসি তার ঠোঁটে লেগেই থাকে, ঝলমলে হাসি; ছদের উদ্দিনের বিষণœ কথায়ও মেয়েটি হাসে, এটি আমার ভাল লাগে, আমি গাধা নই যে সব সময় কাউকে হাসিখুশি থাকা দেখতে আমার ভাল লাগবে না। মেয়েটি এমনভাবে তার সুন্দর দাঁত বের করে হাসে, তাকে একজন ডেন্টিস্ট বলে মনে হয়, কিন্তু সে ডেন্টিস্ট নয়; মেয়েটির কথা এমন মনোমুগ্ধকর যে তাকে কথার যাদুকর বলে মনে হয়, কিন্তু সে কথার যাদুকর নয়; মেয়েটি এমনভাবে তাকায়, তার চোখের যে গভীর দৃষ্টি, তাকে একজন দৃষ্টিবিজ্ঞানী বলে মনে হয়, কিন্তু সে দৃষ্টিবিজ্ঞানী নয়। সে এসব কিছু নয় বলে আল্লাতালাকে আমি ধন্যবাদ দিই—তাকে আল্লা এ-সবের জন্যে তৈরি করেন নি, এই টিভির বাক্সের জন্যেই তৈরি করেছেন; কিন্তু মন খুলে ধন্যবাদ আমি দিতে পারি না, মনের মাঝে একটি চাপা দুঃখ আছে—কেনো আল্লা তাকে সিনেমার নায়িকা করলেন না? আমি তার বৃষ্টি ভেজা নাচ-গান থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, সমুদ্র স্নান থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। অবশ্য আগের চেয়ে মেয়েটিকে এখন আমার আরো ভাল লাগে; স্বামীর সঙ্গে তার গেল মাসে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, শুনে খুশিতে নেচে উঠেছে আমার মনপ্রাণ, খুশিতে লক্ষ-কোটি বার শহীদ হয়েছি আমি, আবার বেঁচে উঠেছি; মেয়েটির সঙ্গে আমার বিয়ে না হোক, মেয়েটির সঙ্গে আমি না ঘুমাই, অন্য কেউ মেয়েটির সঙ্গে ঘুমোচ্ছে এটি ভাবতে আমার ভাল লাগে না, মনে হয় লক্ষ বছর ধরে আমি নরকের অগ্নিকুণ্ডে জ্বলছি; নিজেকে নরকের অগ্নিকুণ্ডে জ্বলতে দেখলে কারো ভাল লাগতে পারে না।

‘বলা হয়ে থাকে কবিতা জীবনের মৌলক চাহিদার মধ্যে একটি; এটি কী আপনি সমর্থন করেন? মানবজীবনে কবিতার কী প্রয়োজন?’ ‘কবিতা হলো এমন এক জিনিস যা জংধরা ও ময়লা মন পরিস্কার করে। কবিতা বেঁচে থাকার স্বাদ জোগায়। কবিতার ভেতরে মনুষ্যজীবনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য লুকিয়ে থাকে, পাঠকের কাজ হচ্ছে সেই তাৎপর্যকে আস্বাদন করা। আমি বলবো, কবিতা হলো বিদ্যুতের তৈরি তলোয়ার, যা পশ্চাদমুখি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেঁচে থাকার ঢালস্বরূপ। ঐ যে ওমর খৈয়াম বলেছেন না—‘‘একদিন রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু কবিতা ফুরাবে না, কবিতা হলো অনন্ত যৌবনা’’ কবিতা পাঠ এর মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে আবডেট করাতে হবে...’ এতো কথা ছদের উদ্দিন কোথায় যে পায়, সে-ই জানে; আমার মাথায় কিছুই ঢোকে না।

আমি বিস্ময়ের সঙ্গে চেয়ে থাকি মেয়েটির দিকে; আমি বুঝি না, মেয়েটি এতো সুন্দর কেমন করে হলো? যতই দেখি, দু-চোখ ভরে যায় আমার। মাঝে মাঝে মনে হয় সব মেয়ে আদমের পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি, আর এই মেয়েটি স্বয়ং আল্লাতালার পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি! ‘কেউ কেউ বলে, প্রেমের মরা জলে ডোবে না; আপনার কি তা মনে হয়?’ ‘প্রেম তো হচ্ছে ইয়ে, গভীর জলের পানি; শীতল, একই সাথে আবার গরম; যা ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না; দেখতে হলে চোখ লাগে, এই চোখ সবার থাকে না। আমরা যারা হাই-থটের চিন্তা করি...’ আমার ভেতর থেকে আবার একটি পশু বেরিয়ে আসে, (সব মানুষের ভেতরেই নাকি একটা না একটা পশু বাস করে) ইচ্ছে হয় উদ্দিন মোহম্মদকে একটা লাথি মরি; কিন্তু তা আমি করতে পারি না; আমার অজানা নয় যে—তিনি, উদ্দিন মোহম্মদ, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্ধকার ও অজস্র জঞ্জালের মাঝে একখণ্ড হীরের টুকরো, আমাদের এই ভূখণ্ডের আধুনিকতার উজ্জ্বল নক্ষত্র। ‘ইদানিং কী পড়ছেন?’ ‘পড়ার তো তেমন একটা সময় পাই না, প্রচুর লিখছি, লেখার উপাদানের জন্যে দর্শন বিষয়ে কিছু বই পড়ছি, এটি খুবই মজার জিনিস। জগতের সব বিষয়ের উপর জ্ঞান লাভ করা যায়; আমার মনে হয় রাস্তায় যারা ওষুধ বিক্রি করে দর্শনের উপর তাদের ডিগ্রি আছে, না হয় অমন জ্ঞানগর্ভ লেকচার দেয় কীভাবে? জগতে এমন কোনো বিষয় নেই, যে-সম্পর্কে তাদের অগাধ পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর পাওয়া যায় না।

তাছাড়া দর্শনের উপর পড়াশুনা থাকলে বিয়ে বাড়িতে বেশ কাজে লাগে, যেমন সত্য কী? সুন্দর কী? ভাল কী? মন্দ কী? ন্যায় কী? এরকম বিভিন্ন ধাঁধা তৈরি করা যায়; কেউ কোনো উত্তর দিলে, নিঃসঙ্কচে তা প্রত্যাখান করে উল্টো হাজারটা যুক্তি খাড়া করা যায়। আবার ঘরে বসে একটু প্রাকটিস করলে বিতর্ক-প্রোগ্রামে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যেতে পারে। এর সম্ভাবনাময় নানা দিক আছে। ’ ‘এ-যাবৎকাল যত লোকের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে, কাকে মহৎ মানুষ বলে মনে হয়েছে?’ ‘বাল্য বয়সে আমার খেলার সাথী রহিম ও রুব্বান, আমার এ-জীবনে তাদের মত মহৎ মানুষ আর কোথাও দেখি নাই। আমি তাদেরকে যা বলতাম, তারা তা-ই করতো, দক্ষিণ দিকে যেতে বললে দক্ষিণ দিকে যেত, উত্তর দিকে যেতে বললে উত্তর দিকে যেত।

আমি তাদের বিয়ে দিয়েছি, সাজিয়েছি, গোসল করিয়েছি, খাইয়েছি; ওরা আমার খুব আদর ও সোহাগের ছিল। ক্লাশ থ্রিতে আমি ফেল করলে আমার মা রাগ করে সব পুতুলের সঙ্গে রহিম ও রুব্বানকেও ফেলে দেয়; এটি আমার জীবনের এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। ’ ‘তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী? কারো কী জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা দেখতে পান—আমি বলতে চাচ্ছি, আপনার কি মনে হয় এই তরুণদের ভেতরে কারো অমরত্বের স্বাদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে?’ ‘তরুণরাই ভবিষ্যতের মা-বাপ এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারুণ্যের উচ্ছাসের দংশনে জন্ম নিতে পারে নতুন ইতিহাস, তরুণরাই ইতিহাসের জন্মদাতা। ভাগ্যক্রমে আমি পৃথিবীতে তাদের আগে এসেছি বলে দু’টি কলাগাছ হলেও আমি তাদের চেয়ে বেশি দেখেছি; সেক্ষেত্রে একজন মুরুব্বি হিসেবে আমি বলতে পারি, বেকনের সেই বিখ্যাত উক্তি—জ্ঞানই শক্তি—এই অমৃত বাণী সকাল-বিকাল দশবার করে আবৃত্তি করতে হবে তরুণদের; এটি লিখে মাদুলির ভেতরে ভরে সব সময় গলায় পড়ে থাকলে আরো ভাল উপকার পাওয়া যাবে।

’ ‘আমাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে, এবার স্যার বিদায় নিতে হবে; আপনি আপনার পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?’ ‘আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে বই হচ্ছে বেঁচে থাকার একমাত্র হাতিয়ার, বইয়ের কোনো বিকল্প নাই; আর কবিতাকে পূজো করতে হবে, কবিতার মধ্যেই রয়েছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের আলো। ’ ‘কষ্ট করে আপনার অতি মূল্যবান সময় থেকে আমাদেরকে এই সময়টুকু দেয়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ;’ উদ্দিন মোহম্মদের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলে, তারপর সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এবং সন্মানিত দর্শক ও শ্রোতাবৃন্দ এতোক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্যে আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। একজন নতুন অতিথি নিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার এই সময়ে আবার হাজির হবো আপনাদের প্রিয় ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী টকশো’তে। সে-পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই থাকুন। ’ টিভি অফ করে আমি বিছানায় গেলাম।

কারো কারো উপপত্নী থাকার কথা আমি শুনেছি; এই মেয়েটিকে দেখলে মনে হয় আমারও উপপত্নী থাকলে কেমন হতো? পত্নী থাকার কথা মনে হতে পারত, যেহেতু আমি বিয়ে করি নি; কিন্তু এটি ভাল লাগে না, কেমন যেন মরা মরা মনে হয়; আর উপপত্নী, ভাবতেই রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে শিহরিত হয়ে উঠি আমি, দুলে উঠে আমার হৃৎপিণ্ড; আমার মনে হয় না ‘উপপতœী’র মত এরকম মধুর শব্দ পৃথিবীতে আর আছে! পরক্ষণে চোখে অন্ধকারের কুয়াশা নেমে আসে—বালক বয়সে আমি বই পড়তাম, সে-সময় আমার বয়স আঠার/বিশ বছর হলেও, আমি বালক বয়সই বলে থাকি; কথায় আছে না—চুল পাকিলে লোকে হয় না বুড়ো। সে-সময় গাধার মত আমি অনেক বই পড়েছি; বইতে সবকিছু এত বাঁকা করে কেনো দেখা হয় বুঝি না—এই যে, এখন চাইলেই মেয়েটিকে আমি উপপত্নী হিসেবে পাব না, মেয়েটি চাইলেও না; তাহলে আমাকে বিবাহিত হতে হবে, এই সেকেলে চিন্তা আমি করতে পারি না, মধ্যযুগের অন্ধকারে আমি পড়ে থাকতে পারি না। এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমে ভেঙে আসছে আমার চোখ। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছি, ঘুমিয়ে পড়ছি আমি; আমি কি ঘুমিয়ে পড়ছি না? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।