আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্যক্তিত্ব

ছন্দহীন জীবন বড়ই নীরস চুলা থাকলে সহজেই সমস্যাটার সমাধান হয়ে যেতো। ওদের এই তলাটা নতুন করা হয়েছে বলে এই তলায় গ্যাসের লাইন নেই। বুয়া তার বাড়ি থেকে ওদের জন্য খাবার রান্না করে আনে। এখন পর্যন্ত জাইঙ্গাটা শুকায়নি। জাইঙ্গা না বলে ভদ্রভাবে আন্ডারপ্যান্ট বলা যায়।

কিন্তু এত বড় শব্দটা একসময় অনেকে বললেও এখন আবার আন্ডারওয়ার বলে। যদিও আন্ডারওয়ার বলতে গেঞ্জি, জাইঙ্গা, পেন্টি, ব্রা—সবই বোঝায়, কিন্তু দোকানদারদের কাছে আন্ডারওয়ার বললে তারা জাইঙ্গাই বের করে দেয়। শুদ্ধ ভাষায় জাঙ্গিয়া। ক্যালেন্ডারে দেখা যাচ্ছে আজ পৌষের একুশ তারিখ। ভাইভার জন্য বাংলা তারিখটা জেনে নেয়া দরকার।

আরবি তারিখটাও জানতে হবে; কিন্তু চাঁদ আবার ক্যালেন্ডার দেখে ওঠে না। সেজন্য বের হওয়ার সময় গলির মাথায় দেয়ালে লাগানো পত্রিকা দেখে নিতে হবে। পৌষ মাসের একুশ তারিখে শৈত্যপ্রবাহ ভালোই চলছে। সেজন্য জাইঙ্গার এখন পর্যন্ত অর্ধেকও শুকায়নি। অবশ্য ভেতরে পরে নিলে শুকিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

মানুষের শরীরের গরম কম না। কিন্তু সমস্যাটা হলো ভেজা জাইঙ্গা ভেতরে গিয়ে আবার গন্ধ তৈরি করতে পারে। ভাইভা বোর্ডের সামনে গন্ধ নিয়ে যাওয়াটা কোনোমতেই ঠিক হবে না। গ্যাস্ট্রিকের কারণে মুখ থেকে যাতে গন্ধ বের না হয় সেজন্য রাতে মেইন রোডের হাজীর হোটেল থেকে ছোবা নিয়ে এসেছে। গালিবকে বলেছিলো সেন্টটা বের করে রেখে যেতে।

নাহিদের টেবিলেই রেখে সেন্টটা রেখে গেছে গালিব। নাহিদ সেন্ট ব্যবহার করে না। পাঁচ টাকা দিয়ে ডিওডোরেন্টের মিনিপ্যাক কিনে নেয়; তাতেই মাস পার হয়ে যায়। আজকের ভাইভাটা নাহিদের উনিশ নম্বর ভাইভা। সেরকমভাবে ধরলে অবশ্য পাঁচ নম্বর হবে।

বাকিগুলোকে ভাইভা বলা যাবে না এজন্য যে, সেগুলোতে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি; ম্যানেজার শুধু বায়োডাটায় চোখ বুলিয়ে সেটা ফাইলে রেখে কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে। ভাইভার আগের কাজগুলো করেছে ঐসব কোম্পানিতে চাকরি করা আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব। ওগুলোর বেশিরভাগ চাকরিই ছিলো মার্কেটিংয়ের। দুনিয়ায় এখন এত টেলিভিশন, এত পত্রিকা, এত বিলবোর্ড, এত ওয়েবসাইট—এতকিছুর পরেও যারা দোকানদারকে ভালো লাভ দিতে পারবে, মাল ভালো হলে তাদেরটা চলবেই। জাইঙ্গা ছাড়াই প্যান্ট পরে নিলো নাহিদ।

শীতকালে ওটা না পরলেও খুব একটা সমস্যা হবে না। এর ওপর আবার ব্লেজার আছে। ব্লেজারও গালিবের। গালিব আছে একটা ওষুধ কোম্পানিতে। বাড়িতে কোনো টাকাপয়সা পাঠাতে হয় না বলে যখন যা খুশি কিনে ফেলে।

স্যাম্পল আর ফ্রি ওষুধ বিক্রি করে যে টাকা পায়, তা থেকে আবার মাসে দশ হাজার টাকা করে জমায়ও ব্যাংকে। ভালো টাকাই জমেছে মনে হয়। খুব শিগগিরই প্লট কিনে ফেলবে গ্রীন সিটিতে। এবছরের মধ্যেই নতুন বৌ নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠে যাবে। এর মধ্যে নাহিদ নিজের কোনো ব্যবস্থা না করতে পারলে চোখে অন্ধকার দেখতে হবে।

ও যা বেতন পায়, তা দিয়ে ঢাকা শহরের কোনো মেসে থাকতে গেলে পুরোটাই নিজের জন্য খরচ করতে হবে। গালিব এই রুমে একা থাকার জন্য ভাড়া নিয়েছিলো। সেজন্য ভাড়াটা আর নাহিদকে দিতে হয় না। ভাড়া না দেয়া থেকে বেঁচে যাওয়া টাকা আর চাকরিতে যাওয়ার আগে-পরের দুটো টিউশনির টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয়। তা দিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকে ছোট ভাই, বোন আর মা।

ভাগ্য ভালো যে, বড় বোন দুটোর বিয়ে ওর আব্বাই দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। এখন একটা বোন আছে; কিন্তু সেটাও কেন যেন তরতর করে বড় হয়ে যাচ্ছে। ছোট ভাই জাহিদ যদি কোনোদিন মাছ ধরে আনে খাল থেকে, তা ছাড়া মাছ খেতে পারার কথা না। হাঁস-মুরগি যা ডিম দেয়, তা দিয়ে মায়ের পান, ওষুধ আর ওদের খাতা-কলম কিনতে হয়—এটাও জানে নাহিদ। এরপরও রেশমা কীভাবে যে বড় হচ্ছে! গতমাসে বাড়ি যাওয়ার পর রেশমাকে দেখে নাহিদের কাছে মনে হচ্ছিলো রেশমা নাহিদের সমান বয়সী।

অথচ কম করে হলেও রেশমা ওর চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। মাঝেমধ্যে চিন্তায় আসে—যদি মেয়েদের সামনে-পেছনের উঁচু অংশ ভেড়ার মতো কেটে ফেললে আবার গজাতো, তাহলে রেশমার ক্ষেত্রে তাই করতো ও। শাকপাতা খেয়ে কে বলেছে সামনে-পেছনে এরকম বড় হতে? ভাইভা বোর্ডে বেশিরভাগই তিনজন থাকে। এখানে আছে পাঁচজন। দুটো করে প্রশ্ন করলেও মোট দশটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

লিখিত পরীক্ষা অবশ্য ভালো হয়েছে ওর। আগে থেকেই এদের লোক ঠিক করা না থাকলে চাকরিটা হয়ে যেতে পারে। প্রশ্ন শুরু হয়েছিলো বামদিক থেকে। একজনের মাঝখানে আরেকজন প্রশ্ন করছে না এরা। ভাইভা বোর্ডে যারা থাকবে তারা একজন প্রশ্ন করলে সাথে সাথে অন্যদের একজন প্রশ্নের লেজ ধরে টান দেবে; অন্যজন টানবে কান ধরে—এভাবে চলতে থাকবে।

কিন্তু এরা তা করছে না। একজনের পর একজন করছে। তবে মাঝখানেরজন বাদ গেলো। বোঝাই যাচ্ছে, ইনি পালের গোদা। সাধারণ প্রশ্নই করছে।

এর মানে দুটোই হতে পারে। যখন কাউকে নেয়ার ইচ্ছে থাকে, তখন সহজ প্রশ্ন করা হয়। আবার না নেয়ার ইচ্ছে থাকলেও দেখানোর জন্য সহজ প্রশ্ন করে। খুব হতাশ লাগছে নিজের ভেতর। সবশেষে পালের গোদা প্রশ্ন করা শুরু করলেন।

নাহিদ সাহেব, আপনি পড়ালেখা করেছেন সমাজকল্যাণে। আউটপুট ম্যানেজার হিসেবে কেন আবেদন করেছেন? প্রথম কারণ স্যার পরিবারের একমাত্র আয়উপার্জনকারী হওয়ায় ভালো বেতনের একটা চাকরি দরকার। আপনারা বিজ্ঞাপনে বেতন উল্লেখ করে দিয়েছেন। দ্বিতীয় কারণ হলো আপনাদের এখানে আবেদন করতে কোনো টাকা খরচ হয়নি। আর একজন ম্যানেজারের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখাটা তার পদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।

আপনি কি মনে করেন আপনি খুব ব্যক্তিত্ববান? এর মধ্যেই একটা মেসেজ চলে এলো মোবাইলে। চেয়ারে বসার পর মোবাইলটা হাতে নিয়ে রেখেছে। মোবাইল কখনোই বন্ধ করে রাখে না ও। বেকার মানুষ, কখন কোন খবর চলে আসে—এই আশায় থাকে সবসময়। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে সাইলেন্ট করে রাখে।

মোবাইলের মেসেজ মনটা খারাপ করে দিতে পারে। সেজন্য সেদিকে নজর না দিয়েই বললো, বাস্তববাদী হওয়ার কারণেই নিজের ভেতর ব্যক্তিত্ব আছে বলে মনে করি আমি। নাহিদের হাতে জয়েনিং লেটার চলে এলো। স্বাক্ষর করে জমা দিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এইচআর সেকশনে এসে স্বাক্ষর করার আগে মেসেজটায় চোখ দিলো।

বাড়ি থেকে মেসেজ পাঠিয়েছে রেশমা। গড়ঃযবৎ রষষ—এটুকুই শুধু লেখা আছে। গড়ঃযবৎ রষষ মানে মা অসুস্থ না। মা মারা গেছে। এখনো মৃত্যু নিয়ে আমরা এই মিথ্যে কথাটা বলি।

রেশমা এখনি সেই মিথ্যে শিখে গেছে। এখন ফোন দিলে আরেকটা মিথ্যে বলবে। হয়তো বলবে, তোকে খুব দেখতে চাইছে রে মা। এখানে দেখতে চেয়েছিলো বললে অবশ্য মিথ্যে আর হয় না। গরিবদের ব্যাপারগুলো এমনই হয়।

যেটা নিয়ে তাদের খুব আশা থাকে, সেগুলো তারা দেখে যেতে পারে না। নাহিদ কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেলো। মেসেঞ্জার এসে বললো, স্যার, আমাদের প্ল্যান ছিলো ভাইভা দিতে যারা এসেছেন, তাদের সবাইকে লাঞ্চ করানো। কিন্তু আমরা সেই ব্যবস্থা করতে পারিনি বলে দুঃখিত। এইটুকু বলে সে একটা খাম ধরিয়ে দিলো।

যাক, ভালোই হয়েছে। বাড়ি যাওয়ার জন্য টাকা চাইতে গালিবের কাছে আবার যাওয়া লাগতো। সেই সমস্যার সমাধান হলো। দ্রুত স্বাক্ষরগুলো শুরু করলো নাহিদ। ব্যক্তিত্ব বজায় রাখতে হবে এখানে।

মোটেও কাঁদা যাবে না। মোটেও না। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৩২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.