আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘জল্লাদ’ বাবুলের কষ্টের জীবন

নেত্রকোনা, ৩১ ডিসেম্বর: বিখ্যাত হওয়ার এ উপায় বিদঘুটে বটে, কিন্তু নেত্রকোনার বাবুল মিয়া এভাবেই বিখ্যাত হলেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচিত জল্লাদ হওয়ার খ্যাতিটুকু তার। আর শুক্রবার বিবিসি ইংরেজি বিভাগের ইশিরাজন অনবর্ষন তাকে নিয়ে লেখার পর তার জল্লাদ খ্যাতি ছড়িয়ে গেল দুনিয়াজুড়ে। কিন্তু খ্যাতি যতই থাকুক, বাবুলের নিজের মুক্ত জীবন এখন কাটছে খুবই কষ্টে। একই কাজ।

হত্যা করা। কিন্তু একই যাত্রা দুই ফল মিলেছে বাবুল মিয়ার জীবনে। একজনকে হত্যা করার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করে আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল বাবুল মিয়াকে। অন্যদিকে আদালতের সিদ্ধান্তে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৭ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করে নিজের কারাদণ্ডের মেয়াদ কমিয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কারাগারে তার সদাচরণ।

এসব বিবেচনা করে মেয়াদ পেরোনোর অনেক আগেই তাকে মুক্তি দিয়েছে সরকার। ২২ বছরের কারাজীবন শেষে গত বছর নেত্রকোনায় নিজের গ্রামে ফিরেছেন তিনি। দেশে এখনো কয়েক ডজন জল্লাদ রয়েছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে বাবুল মিয়ার খ্যাতিই বেশি। কারাবন্দী কিংবা সাবেক দণ্ডপ্রাপ্তদের থেকে দেশে জল্লাদ নির্বাচিত করা হয় এবং তাদের দরকারি প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। পুকুর, ধানক্ষেত, বাগান আর বাশঝাড়ে সুন্দর গ্রাম তার।

সেই গ্রামে পরিবার-পরিজন আর বন্ধু-স্বজনের সঙ্গে এখন নিজের জীবনের নয়া অধ্যায় গড়তে চেষ্টা করছেন বাবুল। ১৯৮৯ সালে যখন ১৭ বছরের কিশোর তিনি, তখন গ্রামে সংগঠিত একটি হত্যার ঘটনায় তাকে জেলে পাঠায় পুলিশ। বাবুল বললেন, তিনি হত্যা করেননি। নিজের গবাদিপশুগুলো যত্ন-আত্তি করতে করতে তিনি বিবিসির সঙ্গে কথা বলছিলেন, ‘‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমি জল্লাদ হয়েছি। কারাদণ্ডের সময় জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে বললো যে, যদি আমি জল্লাদ হই তবে প্রতিটা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিনিময়ে আমার কারাদণ্ড দুই মাস কমিয়ে দেয়া হবে।

আমি জেল থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে চেয়েছিলাম, তাই প্রস্তাবটা গ্রহণ করেছিলাম। ’’ মোট ১৭ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে বাবুল মিয়ার হাতে। শেষে এলো বহুকাংখিত মুক্তি। সেই মুহুর্তের স্মৃতিচারণ করে বাবুল বলছিলেন, ‘‘খুশিতে ভেসে যাচ্ছিলাম আমি। ঢাকার মধ্যে দিয়ে যখন আসতেছিলাম তখন মনে হলো এক নয়া দুনিয়া।

শহরটা পুরোপুরি বদলে গেছে। যখন নিজের গ্রামে পৌঁছলাম, এটাও দেখলাম পুরা আলাদা। অনেককেই আমি চিনতে পারি নাই, তারাও আমাকে চিনছিল না। ’’ মনের জোর জেলে তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। কিভাবে মানুষকে ফাঁসিতে ঝোলাতে হয় তা শেখানো হয়েছিল।

কিভাবে ফাঁসির মঞ্চ বসাতে হয়, কিভাবে পাটাতনের মতো করে তক্তা বসাতে হয়, কিভাবে ফাঁসির দড়ি ঝোলাতে হয়- এসবই শিখেছেন তিনি। বাবুল বললেন, ‘‘প্রথমবার যখন একজনকে ফাঁসি দিলাম তখন খুব দুঃখ লাগছিল। কিন্তু এতে আমার তো কোনো ব্যাপার নাই- আদালত তাদের আপিল নাকচ করছে। ’’ তার কথা, ‘‘আবেগ দেখাইলে বা মনের জোর না থাকলে আপনি এ কাজ করতে পারবেন না। আমার মনের মধ্যে একটাই চিন্তা ছিল।

আমি যদি এটা করি, আমার কারাদণ্ড কমবে। ’’ মুক্ত হবার এক বছর পরে এখনো জ্বলজ্যান্ত ঘটনার মত সব মনে করতে পারেন তিনি। ‘‘একবার এক দণ্ডপ্রাপ্তকে মঞ্চে ওঠানো হয়, আমাদের একজন তাকে ফাঁসির দড়ি পরাবে। এমন সময় লোকটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। কিন্তু তখনও আমাকে কারাগারের বড় কর্মকর্তার সংকেতের অপেক্ষা করতে হবে।

ঘড়ি যখন রাত বারোটার পর একবার মিনিটের কাটা পেরোবে, ওই কর্মকর্তা তখন তার হাতে থাকা একটা লাল কাপড় ফেলে দেবেন, তারপর আমি যাতা টেনে দেবো। কাঠের তক্তা নেমে যাবে, লোকটা ঝুলে যাবে। একজন ডাক্তার তাকে চেক করবেন, পনেরো মিনিট পর তাকে মৃত ঘোষণা করবেন। ’’ মিডিয়া হিরো এতোগুলো ফাঁসি কার্যকর করা নিয়ে বাবুল কোনো অনুশোচনা করেননি কখনো। বরং একটা ঘটনার জন্য তিনি গর্বিত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যায় অপরাধী সাব্যস্ত করে যাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, ২০১০ এর জানুয়ারিতে তাদের পাঁচজনের ফাঁসি দিয়েছিলেন তিনি। ওই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বাবুল বলছিলেন, ‘‘সেইদিন আমি তাদের ঝোলাতে খুব আগ্রহী ছিলাম, কারণ তারা আমাদের দেশের সবচেয়ে মহান নেতাকে হত্যা করেছিল। ’’ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার সময়ে মিডিয়ায় বেশ আলোচিত হয়েছিলেন তিনি। সংবাদপত্র ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো তাকে নিয়ে আলাদা স্টোরি করেছিল। দেশজুড়ে তখনই পরিচিতি পান বাবুল।

মুক্ত হবার পর তাকে নিয়ে প্রোগ্রাম বানাতে চেয়েছিল একটি টিভি চ্যানেল। কিন্তু সরকারি বাধানিষেধের কারণে তা হয়ে ওঠেনি। কষ্টের জীবন দুনিয়ার যেসব দেশে এখনো ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ৪০০’র বেশি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আরো হাজারের বেশি বন্দী আছেন যাদের জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে অপেক্ষা করছে ফাঁসির দড়ি।

গ্রামে ফেরার পরপরই এলাকার এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে জড়ান তিনি। স্ত্রীর নাম মোসাম্মৎ কবিতা আখতার। শিগগিরই তাদের কোলে সন্তান আসবে। বাবুলের স্ত্রী কবিতা আখতার বলছিলেন, ‘‘প্রথমে আমি ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম যে ওনার পাপ নাই, জেলে উনার চাকরিটুকুই করেছেন।

’’ বাঁধাধরা কোনো কাজ নাই তার এখন। ভাইয়ের খামারে কাজ করেন, তার গবাদিপশুর দেখভাল করেন। পাশের গ্রামে দিনমজুরের কাজও করেন। সবমিলিয়ে মাসে হাজার পাঁচেক টাকা রোজগার হয় তার। বাবুল বলছিলেন, ‘‘অনেক লোকে আমাকে অনেক কাজটাজ অথবা ব্যবসা শুরু করার জন্য টাকা দেবে বলছিল।

কিন্তু কিছুই হয়নি। গত বিশ বছরে সংসার জীবনের খরচ চরমভাবে বাড়ছে দেখতেছি, এই নামমাত্র উপার্জনে কী করে সংসার চলবে তাই ভাবতেছি। ’’ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.