আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা সাহিত্যের নিষিদ্ধ কিছু কবিতা ................

বালক ভুল করে পড়েছে ভুল বই , পড়েনি ব্যাকরণ পড়েনি মূল বই আনন্দময়ী আগমনে কাজী নজরুল ইসলাম আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূতি আড়াল? স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল। দেব –শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী? মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি। ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা, মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা। তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে রক্ত-তৃষার ’ময়-ভুখা-হু’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে। - অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা, আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।

দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা। .. ’ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি! কবি দন্ডিত হন তাঁর সম্পাদিত ধুমকেতুতে(১৯২২, ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যা) প্রকাশিত ’আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির জন্য। কবিতাটি ছাপার জন্য কবিকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারা অনুসারে এক বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। কারাদন্ডের সময় নজরুল কে প্রথম প্রেসিডেন্সী জেলে নিয়ে যাওয়া হয় তারপর কারাদন্ডের পর তাঁকে আলিপুর জেলে দীর্ঘদিন আটক রাখা হয়। এই জেলে থাকা কালিন সময়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ’বসন্ত ’ নাটকটি নজরুল কে উৎসর্গ করেন।

কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায় ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য। যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য আলাওলের ঐতিহ্য কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য ও কবিতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে পলাশপুরের মকবুল আহমদের পুঁথির জন্য রমেশ শীলের গাথার জন্য, জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য। যারা প্রাণ দিয়েছে ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল নজরুলের “খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি। ” এ দুটি লাইনের জন্য দেশের মাটির জন্য, রমনার মাঠের সেই মাটিতে কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত। রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোনো ছেলের বুকের রক্ত।

আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা রমনার সবুজ ঘাসের উপর আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে। এক একটি হীরের টুকরোর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন বেঁচে থাকলে যারা হতো পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ যাদের মধ্যে লিংকন, রকফেলার, আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল শতাব্দীর সভ্যতার সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ, সেই চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে আমরা সেখানে কাঁদতে আসিনি। যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে আমরা তাদের কাছে ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ। আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে। আমরা জানি ওদের হত্যা করা হয়েছে নির্দয়ভাবে ওদের গুলি করা হয়েছে ওদের কারো নাম তোমারই মতো ওসমান কারো বাবা তোমারই বাবার মতো হয়তো কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার নিভৃত কোনো গাঁয়ে কারো বাবা মাটির বুক থেকে সোনা ফলায় হয়তো কারো বাবা কোনো সরকারি চাকুরে।

তোমারই আমারই মতো যারা হয়তো আজকেও বেঁচে থাকতে পারতো, আমারই মতো তাদের কোনো একজনের হয়তো বিয়ের দিনটি পর্যন্ত ধার্য হয়ে গিয়েছিল, তোমারই মতো তাদের কোনো একজন হয়তো মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়বার আশায় টেবিলে রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল। এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল সেই সব মৃতদের নামে আমি ফাঁসি দাবি করছি। যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে তাদের জন্যে আমি ফাঁসি দাবি করছি যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্যে ফাঁসি দাবি করছি যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে। আমি তাদের বিচার দেখতে চাই। খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে শাস্তিপ্রাপ্তদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।

পাকিস্তানের প্রথম শহীদ এই চল্লিশটি রত্ন, দেশের চল্লিশ জন সেরা ছেলে মা, বাবা, নতুন বৌ, আর ছেলে মেয়ে নিয়ে এই পৃথিবীর কোলে এক একটি সংসার গড়ে তোলা যাদের স্বপ্ন ছিল যাদের স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার, যাদের স্বপ্ন ছিল আণবিক শক্তিকে কী ভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায় তার সাধনা করার, যাদের স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশিওয়ালার’ চেয়েও সুন্দর একটি কবিতা রচনা করার, সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ সেখানে হাজার বছর পরেও সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ। যদিও অগণন অস্পষ্ট স্বর নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করবে তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘণ্টা ধ্বনি প্রতিদিন তোমাদের ঐতিহাসিক মৃত্যুক্ষণ ঘোষণা করবে। যদিও ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাতে—বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে তবু তোমাদের শহীদ নামের ঔজ্জ্বল্য কিছুতেই মুছে যাবে না। খুনি জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত কোনো দিনও চেপে দিতে পারবে না তোমাদের সেই লক্ষদিনের আশাকে, যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব ন্যায়-নীতির দিন হে আমার মৃত ভাইরা, সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে তোমাদের কণ্ঠস্বর স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে ভেসে আসবে সেই দিন আমার দেশের জনতা খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাবেই ঝুলাবে তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে। চট্টগ্রাম, ১৯৫২ বাংলাকে রাষ্টভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে চট্টগ্রামে সর্বদলীয় রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

এই কমিটির আহবায়ক ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী এবং যুগ্ন আহবায়ক ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং এম এ আজিজ। ৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারীতে চট্টগ্রামের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষনের খবর আসে চট্টগ্রামে অবস্থানরত কেন্দ্রীয় রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সাংবাদিক-সাহিত্যিক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের কাছে। জ্বর ও জলবসন্তে আক্রান্ত ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা এম এ আজিজ তাই আহবায়ক হিসাবে কাজ করছিলেন।

গুলিবর্ষনের খবরটা শোনার পর তিনি রচনা করেন “কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” নামের কবিতা। অসুস্থতার জন্য মাহবুব উল আলম চৌধুরীর হাতে লেখার ক্ষমতা ছিলো না তখন। তিনি বলে যাচ্ছিলেন কবিতার পংক্তিগুলো আর সহকর্মী ননী ধর তা লিখে নিলেন। এটি হলো একুশের প্রথম কবিতা। আন্দরকিল্লায় কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে কবিতাটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশের দায়িত্ব নিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস।

উদ্দেশ্য ছিলো সারারাত প্রেসে কাজ করে পরদিন সকালে গোপনে পুস্তিকাটি প্রকাশ করা। এক ফর্মার এই পুস্তিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছিলো শিরোনাম “কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” এবং নিচে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নাম। প্রকাশক হিসাবে নাম ছিলো কামালউদ্দিন খানের এবং মুদ্রাকর হিসাবে প্রেসের ম্যানেজার দবিরউদ্দিন আহমদের। শীতের রাতে যখন কম্পোজ ও প্রুফের কাজ প্রায় শেষের দিকে তখন পুলিশ সুপার আলমগীর কবীরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ প্রেসে হানা দেয়। প্রেসে উপস্থিত কর্মচারীদের বুদ্ধিতে লুকিয়ে যান খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস এবং রক্ষা পায় সম্পুর্ণ কম্পোজ ম্যাটার।

পুলিশ তন্ন তন্ন করে খোঁজ করে ও কিছুই পেল না। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের কর্মচারীরা গোপনে পুস্তিকাটির প্রায় ১৫ হাজার কপি বিক্রয় ও বিতরনের জন্য মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের কাজ শেষ করে। ঢাকায় গুলিবর্ষনের প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারী সমগ্র চট্টগ্রামে সাধারন ধর্মঘট পালিত হয়। লালদিঘি ময়দানে বিকাল ৩টায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভার জনসমুদ্রে “কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” কবিতাটি আবৃত্তি করেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতা শুনে বিক্ষুব্ধ জনতা শ্লোগান দেয় “চল চল ঢাকা চল, খুনি লীগশাহীর পতন চাই”, “লীগ নেতাদের ফাঁসি চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই”।

এর কয়েকদিন পরেই সেসময়কার মুসলিম লীগ সরকার কবিতাটি বাজেয়াপ্ত করে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।