আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাঁচা ধানের কবর

স্বপ্নবাজ। একটা রাতের রংধনুর স্বপ্ন দেখি...। -কিঙ্কর আহ্সান কাঁচা ধানের কবর কিঙ্কর আহ্সান দুপুরটা ভালোমতো জেঁকে বসতে না বসতেই চারপাশটা আঁধারে ঢেকে যায় এখন। বর্ষাকালের এই এক যন্ত্রনা। দুপুর আর রাতের মাঝখান থেকে সন্ধ্যে আর বিকেলটাকে আলাদা করে ঠাওর করা যায়না।

দোনামোনা করে আসা অল্প কিছুক্ষনের এক বিষন্ন ভোরের দেখা মিলতে না মিলতেই চলে আসে দুপুর। সে দুপুর বড্ড নিরীহ। তাতে নেই সূর্যের আলোর তেজ,নেই পথিকের গলায় পিপাসা জাগানোর শক্তি। এরপরই আকাশ ভারী হয়ে ওঠে অসংখ্য মন খারাপ করা কালো কালো মেঘে। আলোর দেখা পাওয়া তখন মুশকিল।

ইলশেগুড়ি বৃষ্টির সাথে ঝড়ো হাওয়া শুরু হয় প্রথমে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বৃষ্টির বেগ। বর্ষা বাদলায় জনতার হাটে মানুষের ভীড় বড্ড কম হয়। ঝিম মেরে বসে থাকে দোকানদাররা। কেউ কেউ চা আর হাওয়া বিস্কুট খেতে খেতে তাসের আসর জমিয়ে তোলে।

আলমের এসব ভালো লাগেনা। সে দোকানে বসে বৃষ্টিস্নাত বাইরের আকাশ দেখে সময় কাটিয়ে দেয়। বৃষ্টির পাগলামী,বৃষ্টির লুটোপুটি বড্ড ভালো লাগে তার। একটু পরপর দু একটা নছিমন আর ভটভটি হাটে আসলে লোকজনের সমাগম হয়। তখন বিক্রিবাট্টার জন্যে দোকানদাররা তৈরি হয়।

আলমের এসবে তাড়া নেই। তার দোকানে বিক্রি হয় টিন। তাই সবই বাধা খদ্দের। দোকানে তেমন একটা কাজ থাকেনা। চৈাপর দিন বসে শুধু ক্যাশবাক্সের ওপর নজর রাখতে হয়।

আলম তাই ঝিমোয়। ঘুম,জেগে থাকা আর ঝিমানো এর মাঝেই বন্দী হয়ে গেছে তার আটপৈারে জীবন। বৃষ্টিটা ভালোই জমে উঠেছে আজ। বাতাসের বেগ প্রচন্ড। ঝড় না হয় আবার।

বৃষ্টির ছাট আসছে দোকানের ভেতরও। বাতাসের তোড়ে বেসামাল হয়ে উঠছে পড়নের লুঙ্গি। একটু ঠিকঠাক হয়ে বসে জানালা লাগোয়া পেঁপে গাছটার বৃষ্টির জলে ভেজা দেখতে দেখতে মুড়ি আর গুড় চিবোয় আলম। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ঝিমুনির সাথে খাওয়া আর এই বৃষ্টিটা বড্ড ভালো লেগে যায় তার।

চিবানো বন্ধ করে আলম গান ধরে আচমকা। এলোমেলো সুরে কর্কশ কন্ঠে গেয়ে ওঠে, ‘আমার আসমান ভাঙে,জমিন ভাঙে, মরা নদীর শীতল গাঙে, বুকের ভেতর ভাঙা ডানার চলে দাপাদাপি। ’ -ও আলম,যাইবি না বাড়ি ? ডাক শুনে গান থেমে যায় আলমের। জানালা দিয়ে দেখতে পায় মুদী দোকানদার সুলতানকে। সুলতান আলমের চেয়ে বয়সে ছোট হওয়া স্বত্তেও তাকে নাম ধরে ডাকে।

আলম কিছু মনে করেনা এতে। তার মতন অসহায়,বোকা-সোকা মানুষকে যে কেউ’ই নাম ধরে ডাকতে পারে। এতে অপরাধ নেই। হয়ত কোন একদিন তার বড় ছেলেটাও বাপকে ডেকে বলবে,‘আলমরে, বাজার থোন একখান লাল জামা আইনো। ’ এসব ভেবে আলমের দুঃখ হয়।

দুঃখ হয় নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে। পৈারুষত্বের অভাবের কথা ভেবে। বোকারা নাকি সুখে থাকে। কিন্তু আলমের বড়ই দুঃখ। সবকিছুতে দুঃখ।

-যামু তো। তুমিতো ভিজা একসার মিয়া। জবাবে বলে আলম। -আর কইনো না। এরলাই বৃষ্টি বাদলা ভালা লাগেনা।

বাইর হইলেই শালা ভিজো আর প্যাক কাাঁদায় পা ডুবাইয়া চলো। বাড়িত যাবা কিনা কও। যাইতাছি আমি। -অস্থির হও ক্যান। যামু তো।

তয় বাজার সদাই যে আছিল কিছু। এক গ্লাস পানি খেয়ে মুখের ভেতর লুকিয়ে থাকা মুড়ির অবশেষ গিলতে গিলতে জবাব দেয় আলম। বৃষ্টিটা কমে এসেছে তবে বাতাসের বেগ এখনও প্রচন্ড। -আইজ বাদ দ্যাও। ঘুটঘুইটা আন্দার নামলে বাড়িত যাওন বিপদ।

দিনকাল ভালোনা। দিনকালের ভয় পায়না আলম। কি’ইবা আছে তার। তবে সুলতানের তাড়া দেখে ক্যাশবাক্স গুছিয়ে বাইরে আসে সে। দোকান নিয়ে ভয় নেই।

কর্মচারীরা আরও কিছুক্ষন থাকবে। তারপর দোকান বন্ধ করে যে যার বাড়ির পথ ধরবে। কাঁদা বাঁচিয়ে হাটার চেষ্টা করে দুজন। শীতল বৃষ্টির জলে একটু পরপর কেঁপে ওঠে শরীর। আলো কমে যাওয়ার কারনে আবছা হয়ে আসে দুরের সবকিছু।

তার মাঝেই চোখে পড়ে কয়েকটা জলপিপি ডানা মেলে দিয়েছে উড়াল আকাশে। আলম তাকিয়ে দ্যাখে কাছেই বাতাসের তোড়ে নুয়ে পড়েছে কাঁচা ধানের গাছ। এমন সবুজ চোখে পড়েনা সচরাচর। বৃষ্টির জলে ভিজে আরো বেশী সজীব হয়ে উঠেছে সব। মস্ত এক সবুজ বিছানা।

চাষীর প্রেম,ভালো লাগা,জীবন সব যেন ফুটে উঠেছে তাদের শরীরের পরতে পরতে। এক সময় এ ধানের বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাটি,ধানের ঘ্রান নিয়েই কাটত আলমের সকাল,দুপুর,বিকেল। বাবার ছিল সামান্য চাষের জমি। তাই দিয়েই চলত সাত জনের বড় একটি পরিবার। উপোস থাকতে হত প্রায়ই।

আলমের এসব নিয়ে মাথাব্যাথা ছিলোনা। সে ভালো লাগলে খায় নইলে খায়না। বড্ড উদাসীন এই লোক। বাউল হবার শখ ছিল বড্ড। সুর আর কন্ঠ কোনটাই ঠিক না থাকায় মরে যায় সে ইচ্ছেটা একসময়।

তবে মনের দিক থেকে সাচ্চা বাউল ভাবত আলম নিজেকে। উপোস থাকার কষ্টটা সহজে যাওয়া যেতনা ভুলে। কঙ্কালসাড় মা’টা কাঁদত খুব। কাঁদতে কাঁদতে মরেই গেল একদিন। গরীবের ঘরে একবার মরন আসলে তাকে থামানো ছিল মুশকিল।

একে একে এরপর সবাই গেল। বাইরের কারনটা রোগ-শোক হলেও ভেতরের কারন মরন ক্ষিধে। ছোটলোকদের ক্ষিধেটাও একটু বেশি বেশি। আলমের জেদটা চাপে তখনই। রাগ হয় মরনের ওপর।

রাগ হয় সাত আসমানেরও অনেক অনেক ওপরে থাকা ক্ষমতাবান একজনের ওপর। তবুও প্রার্থনা করত সে। প্রতি সকালে চলে যেত বাড়ির কাছের পুকুরটায়। কচু পাতার ওপর কিছু ধান রেখে ভাসিয়ে দিত জলে। বিশ্বাস ছিল তার এ ধান গ্রহন করবে ক্ষমতাবান সেই একজন।

খুশি হয়ে তারপর ভরিয়ে দেবে বাবার ধানের গোলা। ভুল সব। তিনি গ্রহন করেনি কিছুই। জলের ওপর শুধুই এলামেলো ভাবে ভেসেছে প্রতিদিনকার ধান আর কচুপাতা। বাঁচাতে পারেনি আলম কাউকে।

মরে শেষ হয়েছে সব। সব। বাপ,মা,ভাই,বোনগুলো ক্ষিধের জ্বালা থেকে পেয়েছে মুক্তি। মন্দ নয় এটা। রাগ,অভিমান আর জেদের কারনেই আলম তাই সংসারী হয়েছে।

কঠিন সংসারী। -ধান,টান যাইবো এবার সব। যেমন দেহি তাতে মনে কয় ষোল আনা ধানের বারো আনাই নষ্ট হইবো। -যাউক। মরুক গিয়া।

আমার কি। আমি আমার দোহানডা বাড়াইতে পারলেই খুশি। হেরপর বিয়া কইরা সংসারী হমু। এইসব চাষবাসের কাম পোষায় না আমার। আর ধান বেশি হইলেও যা দাম কম হইলেও এক।

এই শালা বাটপার চাষাগো দুকখে দুক্খো পাইয়া লাব নাই। -হুম। সুলতানের কাছ থেকে এমন জবাব পেয়ে কথা আর বাড়াতে ইচ্ছে করেনা আলমের। চুপ করে থাকে সে। মনটা বড় অস্থির আজ।

এমন প্রায়ই হয়। উদাসীন হয়ে যায় সে। লোকে তাই বলে আলমের মাথায় গন্ডগোল আছে। - গোস্সা করলা নাকি মিয়া? তুমিতো আবার চাষার জাত। কথাটা বলে খিকখিক করে হাসে সুলতান।

তার খইনি খাওয়া ময়লা দাতগুলোর দিকে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নেয় আলম। মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে যায়। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সে কথা বলা শুরু করে। -ফসলের তুমি কি বুঝবা মিয়া। ফসল হইল প্রান।

রক্ত। -চেতো ক্যান? হগলে কয় মাথার ব্যারাম আছে তোমার। কতাডা মিছা না। তুমি মিয়া পুরুষ হইলা না। পুরুষ মাইনষের এত মায়া কিসের? একটু বিরক্ত হয়ে বলে সুলতান।

কপালের ভাজগুলো দেখে বোঝা যায় তা স্পষ্ট। -না,চেতুম ক্যান। চেতিনা। সত্তডাই কইলাম। তোমার কথা তুমি কইছো আমি কইছি আমারডা।

-হুম। ডাইনে যামু আমি। থাহো তুমি তোমার ধান লইয়া। -রাগ করলা? -না। তুমারে চ্যাততে দেহি নাই আগে।

ঝড় বাড়বো। যাও তুমি। তাড়াতাড়ি গিয়া ভাত চড়াইয়া দিমু। আমারতো আর বউ নাই। সুলতানের কথাগুলো চুপচাপ শোনে আলম।

বুঝতে পারে খেপেছে সুলতান। নইলে আরো কিছুক্ষনথেকে বকবক করে মাথা ধরাতো। আলমকে ছেড়ে সুলতান অন্য পথ ধরে। প্যাক কাঁদার ওপর দিয়ে দ্রুত হেটে যাওয়ায় প্যাচর প্যাচ শব্দটা কানে বাজতে থাকে বিশ্রীভাবে। আলমের একটা বিড়ি ধরাতে ইচ্ছে করে খুব।

ধোয়ার জন্যে নয় বিড়ির আগায় জ্বলে থাকা আগুনটার জন্যে। এ আগুনটা মাঝে মাঝে তার শরীর গরম করে। যখনই পুরনো অতীত চারপাশ থেকে এসে তার মাথাটা পিষে ফেলতে চায় তখনই আলমের শরীর কাঁপতে থাকে শীতে। তখন প্রয়োজন হয় আগুনের। সবকিছু ছারখার করে দেওয়া আগুনের।

প্রচন্ড মাথা ব্যাথা আর শীতে কাবু হয়েও টলতে টলতে বাড়ির কাছাকাছি চলে আসে আলম। পাকের ঘরের(রান্না ঘর) পেছনে জংলামতো জায়গা। বুনো আগাছায় ভর্তি চারপাশটা। পড়তি আলোর ভেতরেও আলম আবছা আবছা দ্যাখে চুলোর পাশে বসে তার সদ্য ন্যাড়া হওয়া ছেলেটা সর্দি মুছসে। বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করেনা একদমই।

ইচ্ছে করে পালাতে। শেষবারের মতন একবার বাউল হওয়ার চেষ্টা করতে। মাটির ঘ্রান নিয়ে মাটির গান করতে। কিন্তু সংসার,বাজারের দোকান,দুধেল গাই,দোচালা টিনের বাড়ি,খোপ ভর্তি মুরগি,বউ মরিয়ম,ছেলে খোকন আর ছোট্ট মেয়েটা যার নাম ঠিক করা হয়নি এখনও তাদের মুখগুলো ভেসে ওঠে মনে। মায়া এসে শিকল পড়িয়ে দেয় পায়ে।

যে ঝড় সে চালাতে চেয়েছিল নিজের জন্যে বাইরের জড়ো হাওয়া এসে তা যেন থামিয়ে দিতে চায় এক লহমায়। হঠাৎই ছোট মেয়েটার কান্নার শব্দ শুনতে পায় আলম। ডাক ছেড়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে মেয়েটো। ছোট্ট শরীরটায় কান্নার সে কি তেজ! বড় মিষ্টি এ কান্নার আওয়াজ। বড় মায়া,বড় আদর এ কান্নায়।

প্রবল সন্তানক্ষুধায় শিকড় গজিয়ে যায় আলমের। তার উদাসীন হওয়া হয়না। বাড়ি ছেড়ে পালানো হয়না। আলম বাড়ির ভেতরে ঢোকে। পাকের ঘরে জ্বলে থাকা ছোট্ট একটা কুপির আলোর শিখা কিশোরীর চোখের পলকের মতন তিরিতির করে কাঁপে।

গাড় অন্ধকারের ভেতরেও সে সামান্য আলোয় চোখ ধাধায়। মেয়েটার কান্না থেমেছে। মরিয়ম জেগে উঠে হয়ত মেয়েটাকে নিয়েছে কোলে। মুখে গুজে দিয়েছে স্তন। আকাশের অবস্থা ভালোনা।

বাড়ছে বাতাসের বেগ। ঝড় হবে বোঝা যায়। সব চাষীর সর্বনাশ হবে আজ। মাটিতে মিশবে কাঁচ ধান। কঁ াচা ধানের শোকে দুঃখে কষ্টে বিবাগী হবে শত শত মানুষ।

এসব জেনেও আলমকে চুপচাপ থাকতে হবে। পোড়া এক সংসারের লোভ আর মায়ায় সে বিবাগী হতে পারবেনা। পুরনো কথাগুলো মনে পড়ে যায় আলমের। ভেবে ভেবে কান্না পায়। চোখের জল লুকাতে দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকে সে।

ঠিক তখনই কড়াৎ করে বাজ পড়ে কাছাকাছি। ঝড় আসছে। কঠিন ঝড়...। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।