আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাঁচা অনুভূতি

:আসসালামু আলাইকুম ইরফানের মনে নাই কত বছর বয়সে নিশার সাথে তার প্রথম পরিচয় হয়। তিন বছর? সোয়া তিন? নাকি চার? এতটুকু বলতে পারে, তখনো তারা কেউ স্কুলে ভর্তি হয় নাই। দুজনের বাবাই সরকারি কর্মকর্তা। অফিসার্স কোয়ার্টারের একই বিল্ডিংএ আবাস তাদের। ইরফানরা নিচতলায়।

নিশারা দোতলায়। কোয়ার্টারে আণ্ডাবাচ্চাদের অভাব নাই। তবুও তাদের সম্পর্ক একটু আলাদা। সকালে ঘুম থেকে উঠে আগে নাস্তা খাওয়া, তারপরেই দুই দোস্তের সাক্ষাৎ। তারপর সারাদিন ননস্টপ বাঁদরামি।

যথাযোগ্য টিমওয়ার্ক। কোয়ার্টারের রাস্তায় দৌড় প্রতিযোগিতা। পাশের বিল্ডিঙের আঙ্কেলের টম্যাটো খেতের পোস্টমর্টেম। পুকুরঘাটে বসে পানিতে ঢিল মারা। আসলে স্কুলে ভর্তি না হলে অনেক সময় পাওয়া যায়।

তাই করার বিষয়ের অভাব নাই। অবশ্য মতের অমিল মাঝে মাঝে হয়েই যায়। ইরফানের ভালো লাগে খেলনা গাড়ি, বল আর প্লাস্টিকের পিস্তল। নিশার পুতুল আর খেলনা হাঁড়ি-পাতিল নিয়েই উৎসাহ বেশী। মত-পার্থক্য মাঝে মাঝে সহিংসতায় গড়ায়।

কিলাকিলি, খামচা-খামচি, গালি, কান্নাকাটি হয়েই যায়। এক্ষেত্রে ইরফানই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অবশ্য একবার শুরু হয়ে গেলে নিশাকে দুব্বল ভাবার কোন চান্স নাই। মা-বাবারা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন। দুই শত্রু আড়ি দেয়, প্রতিজ্ঞা করে আর জীবনেও কথা না বলার।

কিন্তু সকাল বেলাতেই আবার নূতন করে সম্পর্ক তৈরি হয় তাদের। আবার দিনভর টিমওয়ার্ক। একদিন ইরফানকে একটা ট্রাই-সাইকেল কিনে দেয়া হয়। মহা উৎসাহে রাস্তায় টহল দেয় সে। সারারাত কান্নাকাটি করে নিশাও একটা ট্রাই-সাইকেল আদায় করে নেয় পরদিন।

দুই বন্ধু তাদের বাহন নিয়ে মহড়া দেয় কোয়ার্টারের রাস্তায়- চিপায়। কোয়ার্টারের বিরাট অংশজুড়ে ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝেই গুইসাপ দেখা যায় সেখানে। বিশাল সাইজ, দেখতে টিকটিকির মত। আবার সাপের মত চেরা লকলকে জিবও আছে।

স্টাফরা মহা উৎসবে গুই-নিধন করে আসে। দূর থেকে দেখে দুইজনে, ভয়ে কাছে যায়না। এই নিয়ে গল্প চলে কমপক্ষে তিনদিন। কি মারাত্মক দানব! রমযান মাস আসলে নিশা প্রতিদিনই ইরফানদের বাসায় অতিথি। নিশারা হিন্দু, তাই বলে কি সে ইফতার মিস করবে? কভি নেহি! আবার পূজার সময় আসলে ইরফানও সামিল হয় নিশাদের সব অনুষ্ঠানে।

মণ্ডপের সামনে বসে পুজা-পুজা খেলে নিশার সাথে। বাসায় গিয়ে ওম ওম করে মন্ত্র শোনায়। ইরফানের বাবার শঙ্কা হয়, ছেলে কি হিন্দু হয়ে যাচ্ছে নাকি! মা হাসেন বাবার সন্দেহের কথা শুনে, লোকটার মাথায় যে কি আছে! দিন যায় একদিন করে করে। কোয়ার্টারটা থাকে, বাসিন্দারা বদলায়। এইটা নূতন কিস্যু না।

এখানে সবাই সরকারি কর্মকর্তা। বদলা-বদলী তো লেগেই থাকে। বোঁচকা-বুচকি নিয়ে বিদায় হয় এক পরিবার। ট্রাকভরা মালামাল নিয়ে আরেক পরিবার আসে। ইরফান-নিশা এটাকে জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবেই ধরে নিয়েছে।

একদিন নিশার বাবারও বদলীর অর্ডার আসে। আবারো বোঁচকা-বুচকি ট্রাকে উঠতে দেখে ইরফান। নিশাদের মালপত্র! ছোট্টমনে হিসাবটা অন্যরকম ঠেকে। তাহলে নিশাদেরকেও যেতে হবে? দুই বন্ধুতে অনেক বৈঠক হয়। অনেক কথা হয়।

একসময় যেতেই হয় নিশাকে। কয়েকদিন মন খারাপ থাকে ইরফানের। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয় সে। নূতন বাসিন্দা থেকে নূতন বন্ধু খুঁজে নেয় সে। কিন্তু নিশাকে ভুলে যায় নাই।

এরপর প্রায় দশবছর চলে গেছে। ইরফান অতটা ছোট নয় আর। তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোর সে। প্রচুর পড়াশুনা আর আগ্রহ বয়সের তুলনায় অনেক মাচিউর করেছে তার মগজকে। কমলাপুরে হাঁটছে সে তার লাগেজ নিয়ে।

ডিসেম্বরের ছুটি কাটাতে মা-বাবা আর বোনের সাথে চিটাগং থেকে ঢাকা এসেছে সে। হটাৎ মায়ের চাপা চিৎকার। -বৌদিইইইইই!!!!!! ঘাড় ফিরিয়ে বৌদিটাকে দেখে ইরফান। গোলাটে হাসিমাখা মুখটা কেমন যেন টোকা দেয় মাথায়। সহসা মনে পড়ে যায় তার।

আন্টি! নিশার আম্মু!! হাসা হাসি, কথাবার্তা সব হয়। কিন্তু ইরফানের চোখ খোঁজে আরেকজনকে। ওইতো আঙ্কেলের সাথে হেঁটে আসছে। নাতিদীর্ঘ, মাথায় হুডি জ্যাকেট। নিশা! না, কমলাপুরে সিনেমাটিক কিছু হয় না।

দুই বন্ধু চিৎকার করে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল না। অশ্রু-মাখা হাসিমুখে দৃষ্টিবিনিময় করল না। চোরা-চাহনি বিনিময় হল শুধু। বাকি সবার সাথে হেঁটে হেঁটে টার্মিনালের বাইরে এল ইরফান-নিশা। বড়রা অনেক হাত-টাত নেড়ে বিদায় নিলেন।

তারা দুজন নিলোনা। ট্যাক্সিতে উঠে বসলো ইরফান। মনে চাপা ক্ষোভ। এতদিন পর দেখা, নিশা কোন কথা বলল না? সহসা তার মনে হল, সেও তো বলে নাই কিছু। আসলে দুজনের বন্ধুত্বের কিছু স্মৃতিই কেবল বেঁচে আছে।

অনুভূতিগুলা না। সময়-স্রোতের সাথে লড়াই করে কাঁচা অনুভূতিগুলা টিকতে পারে না। তারা খড়কুটোর মত ভেসে যায় বিস্মৃতির অন্ধকার গহ্বরে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।