পাগলাটে ... ধোঁয়াশাপুর্ণ এক চরিত্র ... নিজেকে চেনার ব্যস্ততায় সর্বদা ব্যস্ত ... আমার খুব কাছের(!) এক ফ্রেণ্ডের নাম টিয়া । এই আজিব নামকরনের পেছনে এক আরো আজিব উপাখ্যান আছে । ওর জন্মের সময় বাসার পাশে মরিচ গাছের ঝাঁড় টাইপ কিছু একটা ছিল । সেখানে নাকি ভোরবেলা দুনিয়ার টিয়া পাখি এসে জড় হত মরিচের লোভে । টিয়ার অত্যাচারে টিয়ার দাদি বিরক্ত হলেও দাদাজান খুব ভালবাসতেন পাখি গুলোকে, কাজেই ঝাঁড় গুলোতে কেউ হাত দিত না ।
দাদি শেষমেশ সইতে না পেরে শুভদিন দেখে দাদাজানের অনুপস্থিতিতে মরিচের ঝাড় গুলো ছেঁটে দিলেন । দাদাজান তখনই নাকি ঠিক করেছিলেন তার ছেলের বংশের প্রথম মেয়ের নাম রাখবেন টিয়া । আমার প্রশ্ন হল, যদি টিয়া না এসে প্যাঁচা আসতো, তাহলে ওর নাম কি রাখা হত ?
টিয়ার আম্মার নাম ____ । ডট ডট দিলাম কারন আমার নিজেরও জানা নেই উনার নাম কি । আন্টির সাথে আমার পরিচয় ক্লাস সেভেনে থাকতে, স্কুলের গেটের সামনে ।
টিয়া নিজে থেকেই আন্টির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল কলেজের ফার্স্টবয় হিসেবে । মিথ্যা বলার কারন কি সেটা মাথায় না ঢুকলেও সুফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম । আন্টি পারলে আমাকে বাসায় জায়গীর হিসেবে রাখেন তার ‘গাধী’ মেয়েটিকে মানুষ করার জন্য । পরে টিয়ার কাছে জেনেছিলাম, “ফার্স্টবয়” জিনিসটা নাকি মেয়েদের মায়েদের কাছে লিপস্টিক বা নেইল পলিশের মতই গুরুত্বপূর্ন বস্তু । আন্টির সাথে পরিচয়ের এখন প্রায় তিন বছর হতে চলল ।
আমার দৌড় ইতোমধ্যেই আন্টি জেনে গেছেন । টিয়া এস এস সি’তে গোল্ডেন পেলেও ফার্স্টবয় আমি কোন মতে “এ মাইনাস” পেয়েছিলাম । আগে আন্টি তুমি তুমি করলেও এখন তুই তুই করেন । আমার অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না ।
একদিনের ঘটনা, স্কুল ছুটির পর আমি আর টিয়া গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আন্টির অপেক্ষায় ।
আন্টি আসলে ওকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি বাসায় যাবো । এমন সময় টিয়ার কিছু ফ্রেণ্ড ওকে ডাক দিলে ও আবার স্কুলের ভেতরে ঢুকে যায় । তার পরপরই আন্টি আসলেন, এসেই প্রশ্ন,
-“ও কোই?” ।
-আমি বললাম, “তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল । এখন কতিপয় বান্ধবী’র ডাকে সাড়া দিয়ে ভেতরে গেছে” ।
-আন্টি বিস্মিত গলায় বললেন, “এই, তুই আমাকে তুমি তুমি করছিস কেন ?”
-“আমি তো সবসময় আপনাকে তুমি তুমি করেই বলি”।
-“সবসময় তুমি করে বলিস ? সে কি ! আমি তো মনে করি আপনি করে বলিস”।
-“আমি আমার অতীব প্রিয়জনদের তুমি করে বলি । আপনি আমার অতীব প্রিয়জন বলে আমি তোমাকে আপনি না, তুমি করেই বলি”।
আন্টি সম্ভবত আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন ।
টিয়া গেট দিয়ে বেরিয়ে এল । আমি উল্টোদিকে হাটতে শুরু করলাম । মানুষ’কে কনফিউজ করা বেশ সহজ কাজ তো ! জয়তু হুমায়ূন স্যার !!
টিয়ার সাথে আমার পরিচয়’র ঘটনাও দারুন হিরোয়িক । ক্লাস সিক্সে এসে ও আমাদের স্কুলে এসে ভর্তি হয় । মেয়েদের সম্পর্কে আমার তেমন কোন ইন্টারেস্ট ছিল না কোন কালেই ।
উলটো’টাও পড়তে পারেন । আমার সম্পর্কে মেয়েদের কোন ইন্টারেস্ট ছিল না কোন কালেই । যেখানে অন্যন্য কোন মেয়ের’ই আমার প্রতি কোন আসক্তি ছিল না, সেখানে টিয়ার মত মেয়ের কথা তো ভাবাও পাপ ! টিয়া আসার পর ক্লাসের পোলাপাইন’দের মধ্যে একটা চেঞ্জ প্রকট ভাবে দেখা যেতে লাগলো । যে হ্রদয় প্রথম ডেস্কে বসার জন্য প্রতিদিন মারপিট লাগিয়ে দেয়, সে নিজে থেকেই টিয়া’কে ওই ডেস্ক ছেড়ে দিয়ে ওর পেছনের ডেস্কে গিয়ে বসে । শারমীন’কে নিয়ে সদা ব্যস্ত মানিক এখন পারলে শারমীন’কে এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক দিয়ে বসে ।
আমার টিয়াকে কোন ব্যস্ততা ছিল না, জানতাম ব্যস্ত হয়েও কোন লাভ নেই অযথা সবার টিটকারি কে শুনতে চায় ?
মিড টার্মের পর একদিন টিফিনে ক্যান্টিনে বসে কোক দিয়ে ভিজিয়ে পটেটো ক্র্যাকার্স খাচ্ছিলাম (জিনিসটা একেবারে “অসাম শালা”) । এমন সময় দেখলাম টিয়ার প্রবেশ । সাথে হ্রদয় অথবা মানিক; একটা ছ্যাচ্ছোর’কে আশা করেছিলাম, দেখি কেউ নেই । আমার কি ? আমি “পটেটো ক্র্যাকার্স উইথ কোকাকোলা” নিয়েই খুশি । স্কুল কলেজের ক্যান্টিন সাধারনত বড় ভাই/আপুদের দখলেই বেশি থাকে ।
আমাদেরটাও এর ব্যতিক্রম না । টেনের ভাই’রা ধুমসে আড্ডা দিচ্ছিল তখন । টিয়া ক্যান্টিনে প্রবেশের মিনিট দু’য়েক এর মধ্যেই বুঝে গেলাম আমাদের ক্লাসের মত সিনিয়র ক্লাস গুলোতেও ভালো আলোড়ন তুলেছে ও । সাইফ ভাই, রিসাল ভাই, অমিত’দা সবাই ওকে এটা সেটা বলছিল । আমি স্পস্ট বুঝতে পারছিলাম টিয়ার এগুলো একটুও ভালো লাগছে না ।
তাই নিজেই কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলাম ।
আমি কাছে যেতে যেতে দেখি সাইফ ভাই ওর হাত ধরার চেস্টা করছে, টিয়া বার বার হাত সরিয়ে নিচ্ছে । আমি বুঝলাম না, স্কুলের ভেতর এসব করার সাহস পায় কোথায় এরা ? আমি গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ালাম, নিজেকে তখন পাহাড়ের মত বিশাল লাগছিল । বললাম,
-সাইফ ভাই, ওরে যেতে দ্যান ।
-ওই, তুই আবিরের ছোট ভাই না? তুই আমাগো চিনস না? ফোট এন থে...
-ভাই, ওর সাথে কিছু করলে আপনাদের সানডে মানডে এক হয়ে যেতে পারে ।
-ওই পোলা, ওই ! কি করবি তুই আমাগো ?
কি হলো বুঝলাম না, পাশের টেবিল থেকে একটা কাঁচের কোকের বোতল তুলে ধাম করে মেরে দিলাম সাইফের মাথায় । রিসাল, অমিত ভাই পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো, উলটো ঘুরেই দিল দৌড় । আমি রক্তমাখা কাঁচের বোতল হাতে নির্বাক দাঁড়িয়ে । টিয়া দেখি পরম নির্ভরতায় আমার হাত ধরলো । ওর চোখে আমার জন্য ভালোবাসা যেন ঠিকরে বের হচ্ছে ।
সামনে কি হবে তা আর আমি ভাবতে চাইছিলাম না তখন । স্বপ্নের পরী এখন আমার পাশে !
ঘটনা এমন ঘটলে তো ভালোই হত । আসলে যা ঘটেছিল তা হচ্ছে –
আমি কাছে এগিয়ে গিয়ে টিয়া’কে বললাম, ‘এই, তোমাকে ফারিয়া ম্যাম ডাকছেন’ । ও আমার দিকে তাকিয়ে ‘ধন্যবাদ’ টাইপ একটা লুক দিয়ে চলে গেল । আমি এবার আস্তে আস্তে ঘুরে সাইফ ভাইদের দিকে তাকালাম ।
ভয়ে আমার পাঁ কাপঁছিল, অস্বীকার করবো না । ক্লাস সিক্সে পড়ে টেনের ভাইদের সাথে পাঙ্গা নেয়া আর ক্লাস টিচার ম্যাম’কে লাভ লেটার পাঠানো একই কথা । আমি পাশের টেবিল থেকে একটা কোকের বোতল নিয়ে আস্তে করে সাইফ ভাইয়ের হাতে দিলাম, আরো দুইটা’র অর্ডার দিয়ে রিসাল ভাইয়া আর অমিত’দার হাতেও কোকের বোতল ধরিয়ে দিলাম । আস্তে করে ক্যান্টিন বয় আকরাম’কে বললাম, “এই তিনটা কোকের বিলও আমার নামে লিখ” । কোকের বোতল হাতে পেয়েও যেন ওদের রাগ কমে না ।
আমি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে সাথে সাথে ৩ টা করে সিঙ্গারা, সমুচার অর্ডার’ও দিয়ে ফেললাম । আকার ইঙ্গিতে ভাইয়াদের আমি যা বোঝালাম তার সারমর্ম হচ্ছে,
“টিয়া আমার খালাত বোন । খালাত হলে কি হবে আপন বোনের মতই । টাঙ্গাইলে নতুন আসছে, কাউকে চেনে না । খালা আমার উপর ওর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন ।
দয়া করে ভাইরা যেন ওকে আর “নজর” না দেয় । ছোট ভাই’য়ের বোন তো আখের মে বোন’হি হোতা হ্যায় না?” আর কোক সিঙ্গারা যে মাঝে মাঝে ভ্যাট হিসেবে পাওয়া যাবে, তাতো বলাই বাহূল্য !
নাহ, বড় ভাইয়া’রা পরবর্তী’তে ওকে আর ডিস্টার্ব করে নাই, ব্ল্যাকমেইল করে পুরি, সিঙ্গারা'ও খায় নাই ।
ওই ঘটনার পরদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি খোদ টিয়া আমার জন্য ওর পাশের সিট রেখে দিয়েছে । চিমটি কাটলাম নিজেকে, স্বপ্ন না, এ যে সত্যি !!! আজও আমরা একসাথেই আছি । টিয়ার মেয়ের নাম কি হবে তা নিয়ে আমার বাবা কিঞ্ছিত টেনশনে আছেন , ভাগ্যিস আমাদের বাসার আশেপাশে কোন গাছ নেই !
[[ সকল ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক ]] ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।