আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন ডা. মিলন

সমাজকর্মী (আজ ২৭ নভেম্বর শহীদ ডাঃ মিলন দিবস। ১৯৯০ সালের এইদিনে স্বৈরাচারি এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনের এক উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন ডা. শামসুল আলম খান মিলন। শহীদ ডা. মিলনের রক্তদানের মধ্য দিয়ে সেদিনের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা ও গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাসনের অবসান হয়।

বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের প্রতি। ডাঃ মিলনের সংগ্রাম ও চিন্তাগুলোকে জানার জন্য মিলন দিবস উপলক্ষ্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের লেখাটি ব্লগ বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম। ) নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের শহীদ ডা. মিলন। কিন্তু সেটা দূর থেকে চেনা। ভেতরের মানুষটি কে ছিলেন, কেমন ছিলেন, কতটা জীবন্ত ছিলেন_সেটা বাইরের লোকের জানার কথা নয়।

কে ছিলেন এই প্রাণবন্ত নবীন চিকিৎসক, রাজপথে যিনি প্রাণ দিলেন? বন্ধুরা বলছেন, তিনি আসলে ছিলেন একজন শিল্পী, সব কিছুকে যিনি সুন্দর করে তুলতে চাইতেন। ডায়েরি লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, অভ্যাস ছিল প্রবন্ধ লেখার। ভালোবাসতেন বই পড়তে, সব রকমের বই। কবিতা আবৃত্তি করতেন। উৎসাহ ছিল খেলাধুলায় : ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল_সব খেলতেন।

মেডিক্যাল কলেজে ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে অত্যন্ত ঈর্ষণীয় যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। গান ভালোবাসতেন, খুশি হতেন বন্ধু পেলে, প্রেমিক ছিলেন কৃষ্ণচূড়ার, খুব পছন্দ করতেন সাইকেলে ঘুরে বেড়াতে। শিল্পের সঙ্গে পরিবেশের একটা দ্বন্দ্ব অনিবার্য। কেননা পরিবেশ হচ্ছে বিশৃঙ্খলা, বিকৃত, অবয়বহীন; ওদিকে শিল্প চায় শৃঙ্খলা, চায় সৌন্দর্য, চায় সুগঠন। শিল্পীকে তাই প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় বিরূপ পরিবেশের বিরুদ্ধে।

ডা. মিলনকেও তা করতে হয়েছে। পদে পদে। কিন্তু তিনি কোনো অবস্থাতেই আপস করেননি। আত্মসমর্পণ তো প্রশ্নাতীত। অতি অল্প বয়স থেকে তাই পরিবেশের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব।

কিশোর বয়সে ডা. মিলনকে দেখি পাড়ায় সংঘ গড়েছেন, যার তিনি কখনো সাহিত্য সম্পাদক, পরে বয়স বাড়লে উপদেষ্টা। দেখতে পাই অভিনয় করছেন মঞ্চে, খেলছেন গিয়ে মাঠে, উদ্যোগ নিচ্ছেন দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের। মেডিক্যাল কলেজে এসে যোগ দিয়েছেন ছাত্র আন্দোলনে। যখন মিছিল থাকত রাস্তায়, মিলন তখন ঘরে থাকতেন না। হরতালের দিন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা তাঁর স্বেচ্ছা কর্তব্যকর্মের মধ্যে ছিল।

চিকিৎসা করতেন আহতদের। পুঁজিবাদ ও আমলাতন্ত্রের রাক্ষস-খোক্কস শাসিত সমাজে দরিদ্র মানুষরা মানুষ থাকে না, এমনকি বিত্তবানেরাও সুযোগ পায় না মনুষ্যত্বের চর্চা করার। তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পরস্পর থেকে। একে অপরের খবর রাখে না। কেবল নিজেরটা দেখে আর কারোটা না দেখে।

বলাই বাহুল্য, ডা. মিলন তা দেখতেন না। মিলন সবার কথা ভাবতেন। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ছিলেন, কিন্তু ভাবতেন রোগীদের কথাও। যেখানেই থেকেছেন, কী ছাত্রজীবনে, কী কর্মজীবনে_সব মানুষকে আপন করে নিয়েছেন। অধীনস্থ কর্মচারী তাঁকে পছন্দ করতেন, যে বৃদ্ধা রান্না করতেন তিনি তাঁর জন্য বিশেষভাবে রাঁধতে ভালোবাসতেন।

মিলন এলে উজ্জ্বল হয়ে উঠত আশপাশের মানুষ। যেজন্য নির্বাচনে তাঁকে হারানো যেত না। ছাত্রসংসদের নির্বাচনে জিততেন, শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জিতেছেন, চিকিৎসক সমিতির নির্বাচনেও জিতেছেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক। চিকিৎসক হন রাজনীতিবিমুখ, রাজনীতিক খবর রাখেন না শিল্প-সাহিত্যের, ব্যবসায়ী কেবল টাকাই চেনেন, গান চেনেন না; গায়ক গান বোঝেন, রাষ্ট্র বোঝেন না।

একাংশ বিকশিত হয়, সর্বাংশকে বিকল করে দিয়ে। ডা. মিলন কেবল যে বিচ্ছিন্ন হতে অস্বীকার করেছেন তা নয়, খণ্ডিত হতেও অস্বীকার করেছেন। তিনি তাঁর পেশাকে অবহেলা করেননি, যেমন অবহেলা করেননি রাজনীতিকে। বই পড়তেন, পাঠচক্র গড়ে তুলতেন, আবার ঠিক একই উৎসাহে ও উদ্দীপনায় মিছিলে যেতেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভে আগ্রহী ছিলেন, যেমন আগ্রহী ছিলেন লেখায়, ছিলেন স্নেহপ্রবণ বাবা এবং দায়িত্বসচেতন স্বামী।

এতসব কাজকে একসঙ্গে মেলানো নিশ্চয়ই সহজ কাজ ছিল না। হতেই পারে না। কিন্তু মিলন করেছেন, সব কিছুকে মিলিয়ে একজন পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেছেন। মিলনের ব্যক্তিগত শত্রু বেশি ছিল না। কমই ছিল, কেননা তিনি কারো প্রতি বিদ্বেষ রাখতেন না, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গেও বন্ধুর মতো আচরণ করতেন।

তাঁর হাসিমুখ ম্লান হতো কদাচিৎ। মিলনের আসল শত্রু ছিল রাক্ষস-খোক্কস নিয়ন্ত্রিত ওই ব্যবস্থাটা। হ্যাঁ, যে পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন, তার হাতেই নিহত হলেন শেষ পর্যন্ত। পরিবেশ জিনিসটা একটা অগোছালো প্রত্যয়। নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, তাঁর শত্রু ছিল স্বৈরাচারী ব্যবস্থা।

এই শক্তির হাতেই ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, প্রকাশ্য রাজপথে। মিলন হত্যার জন্য দায়ী সরকারের পতন ঘটেছে নব্বইয়ে; কিন্তু আজও সেই হত্যাকারীদের বিচার হলো না! কেন হলো না এর উত্তর সচতেনমহলের জানা আছে। কিন্তু বিচার তো হতেই হবে। আসলে গণতন্ত্র তো শুধু ভোট নয়, এমনকি নির্বাচিত সরকারও নয়, গণতন্ত্রের জন্য একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাও চাই, যে ব্যবস্থায় জনগণই হবে সকল ক্ষমতার উৎস ও অধিকারী। আমাদের সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথাটা আছে।

থাকবেই, কেননা তা এসেছে মুক্তিযুদ্ধে জনগণের বিজয়ের ভেতর থেকে। কিন্তু সংবিধানের ওই অংশটিই লঙ্ঘিত হয়েছে এবং হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই তো সংগ্রাম মানুষের। আজকের নয়, অনেক কালের। ব্রিটিশ শাসনের ২০০ বছর দেশ শাসন করেছে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্র, পাকিস্তানি শাসনের ২৪ বছর শাসন করল পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র, যাদের উভয়ের বিরুদ্ধে মানুষকে লড়তে হয়েছে প্রাণপণে।

ব্রিটিশ আমলাতন্ত্র আমাদের জালিয়ানওয়ালাবাগ উপহার দিয়েছে, পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র দিয়েছে গণহত্যা; এসব অতীতের ঘটনা। কিন্তু তাদের সরিয়ে এতটা আসার পরও স্বাধীন বাংলাদেশেও ডা. মিলনের মতো একজন চিকিৎসককে যদি স্বৈরাচারের হাতে প্রাণ দিতে হয় এবং সেই স্বৈরাচারের পতনের পরও যদি আসামিরা গ্রেপ্তার না হয়, তাহলে কী বুঝব আমরা? ডা. মিলনের স্মৃতিকে অম্লান রাখার কাজ সরকার করবে_এটা হয়তো বেশি আশা করা; কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি হবে না_এই আশাও কি অসংগত? তাহলে কী বুঝতে হবে, ডা. মিলনই ঠিক বুঝেছিলেন, যখন লিখেছিলেন তিনি একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে_'রাজা যায়, রাজা আসে'। তা ডা. মিলনের কাছে ব্যবস্থাটা খুব স্পষ্ট ছিল বৈকি। মিলন রাজনীতিতে ছিলেন, কিন্তু সে রাজনীতি রাজা বদলের নয়, স্লোগানেরও নয়, তাঁর রাজনীতি ছিল সমাজ বদলের। তিনি রাষ্ট্রকে বুঝতেন, সমাজকে চিনতেন, পরিবর্তনের শক্তিটা কিভাবে গড়ে উঠবে, তাও জানতেন।

তাঁর মাকে বলেছিলেন তিনি, অধিকাংশ রোগীরই আসল রোগ দারিদ্র্য, চিকিৎসা তাই ওইখান থেকেই শুরু করা দরকার। এ কথা বইতে পাওয়া যায়, মঞ্চে শোনা যায়; কিন্তু অতি আপনজনকে বলতে হলে যে শান্ত প্রত্যয় প্রয়োজন, সেটি সবার থাকে না। ডা. মিলনের ছিল। ডা. মিলন তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, 'প্রাইভেট প্র্যাকটিসে তাঁর আস্থা নেই। কেননা তাতে বিত্তবানদের সেবা করা হয়, বিত্তহীনেরা থাকে অনেক দূরে।

' বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশে যদি একটা মানুষ থাকে, তবে সে মানুষটা হতে চাই আমি। ' এই রকম কথা ঘটা করে বলা কঠিন নয়, লেখাও যায়, কিন্তু নিজের স্ত্রীকে বলতে পারার মধ্যে যে নাটকবিহীন স্থিরবিশ্বাস থাকে, সেটি বড় সুলভ নয়! বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, যেমন ব্যক্তিগত জীবনে, তেমনি সমষ্টিগত ক্ষেত্রে। ব্যবস্থা তাঁকে ক্ষমা করেনি, ক্ষমা করে না, ক্ষমা করা তার স্বভাবে নেই। একজন মানুষকে চিনতে হলে নিয়ম হলো তার শত্রুদের দেখা। নিয়ম মিত্রদের দেখাও বটে।

ডা. মিলনের মিত্র কারা? হ্যাঁ, তাঁর আপনজনরা। তাঁর আত্মীয়, তাঁর বন্ধু_এঁরা; আর তাঁরাও যাঁরা ডা. মিলনের সহযোদ্ধা। এঁরা অতীতে ছিলেন, বর্তমানে আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। যুদ্ধটা একই, যে ব্যবস্থা ডা. মিলনদের বাঁচতে দেয় না তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সব মানুষের মধ্যেই আসলে একজন মিলন থাকে।

এই মানুষটি শিল্পী, এ চায় অন্যের সঙ্গে মিলিত হবে এবং নিজেকে যতটা পারা যায় বিকশিত করবে, খণ্ডিত হবে না, পরিপূর্ণ হবে। কিন্তু যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে আমাদের বসবাস, তাতে ওই কাজটি কিছুতেই সম্ভব হয় না। দারিদ্র্য এসে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। একেবারে শৈশবে। যারা বাঁচে, তারা বিচ্ছিন্ন হয় পরস্পর থেকে, সংকীর্ণ হয়, স্বার্থপর হয়।

আর হয় খণ্ডিত। শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের অনেক গুণ ছিল। সবচেয়ে বড় গুণ যেটি তার নাম আপস করতে অস্বীকার। এই গুণের কারণেই অন্য গুণগুলো বিশেষভাবে মূল্যবান হয়ে উঠেছিল, নইলে নত হয়ে থাকতেন তিনি। যেমন অনেকে থাকেন।

না, মৃত্যুকে আমরা আদর্শায়িত করব না। জীবন অনেক বড়, মৃত্যুর চেয়ে। কিন্তু আমরা তো জীবন্ত নই, এমনকি জীবিতও নই, আমরা অর্ধমৃত। কেবল যে আর্থসামাজিক ব্যবস্থা তা নয়, প্রকৃতিও বিরূপ হয়ে উঠেছে, ওই আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার কারণেই। ঘোরতর আশাবাদীরাও হতাশ হয়ে পড়েন, থেকে থেকে।

ডা. মিলন হতেন না। ডা. মিলন বিশ্বাস করতেন পরিবর্তন আসবেই। একজন দুজনের চেষ্টায় নয়, সমবেত প্রচেষ্টায়। সবাই যে মিছিলে আসবেন তা নয়, কিন্তু সবাইকেই থাকতে হবে সঙ্গে, বাঁচার প্রয়োজনে। ব্যবস্থা না বদলালে অবস্থা বদলাবে না।

ডা. মিলন তাঁর পথ জানতেন, যেমন আজকের ও আগামীকালের মিলনরা জানবেন। তাঁরা চাইবেন সেই সমাজ যেখানে দারিদ্র্য থাকবে না, বিচ্ছিন্নতাও থাকবে না এবং মানুষ খণ্ডিত হবে না, হবে পরিপূর্ণ। ডা. মিলনদের আসলে মৃত্যু নেই। লেখক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ও সমাজবিশ্লেষক  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.