আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রকৃত আহলে সুন্নাত কারা?

আসুন আমরা ২টি ভারী বস্তু আল্লাহর কুরান ও রাসুলের(সাঃ) পরিবারকে(আঃ) অনুসরন করি। View this link আহলে সুন্নাতগন হলেন সুন্নাত ধ্বংসকারী অত্র অধ্যায়ে আমি সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ব্যাখ্যা করতে চাই যার প্রতি বিবেচনা করলে কোন সত্যসন্ধানী অমুখাপেক্ষী হতে পারে না, যেন নির্দ্বিধায় এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে যারা নিজেদেরকে ‘আহলে সুন্নাত’ বলে থাকেন, বাস্তবে নবী (সা.)-এর সুন্নাতের সাথে তাদের কোন সম্পর্কই নেই এবং নবী (সা.)-এর সুন্নাতের মধ্যেকার এমন কোন জিনিষ তাদের কাছে নাই যা আলোচনা হতে পারে। কেননা তাদের অথবা সাহাবা ও খোলাফায়ে রাশেদীনদের মধ্যেকার তাদের পূর্ব পুরুষদের নীতি সর্বপরী নবীর সুন্নাতের বিপরীত ছিল। এমনকি তারা হাদীসগুলিকে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, হাদীস লেখার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন এবং বয়ান করতেও নিষেধ করে দিয়েছিলেন, আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতগণ তাদেরই ভালবাসার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অনুসন্ধান করে থাকেন। (বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য অধ্যয়ন করুন আমারই পর্ববর্তী বই “ফাসয়ালু আহলুয যিকির”)।

যদিও আমি এই কথার ব্যাখ্যা করে দিয়েছি। কিন্তু এর পিছনের সেই ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করা জরুরী, যা নবী (সা.)-এর সুন্নাতের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং শাসকগণ কর্তৃক নিজেদের বিদআত ও ইজতিহাদ এবং সাহাবাগণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দ্বারা পরিবর্তন করার জন্য করা হয়েছিল। প্রাথমিক যুগের শাসকগণের কর্মকান্ড ১। এমন মিথ্যা হাদীস রচনা করল যা তাদের মাযহাবগুলির পক্ষে হয় এবং নবী (সা.)-এর সাধারণ সুন্নাত ও হাদীস লেখার বিরুদ্ধে ছিল। যেমন মুসলিম তার সহীহতে হোদাব বিন খালিদ আল-আজদী হতে, হাম্মাম যায়দ বিন আসলাম হতে এবং তিনি আ’তা বিন ইয়াসার হতে এবং তিনি আবু সাঈদ খুদরী হতে রেওয়ায়েত করেছেন যে, রাসুল (সা.) বলেছেন- “আমার কোন কথা লিপিবদ্ধ করবে না, আর যে ব্যক্তি কোরআন ব্যতীত আমার কোন কথা লিপিবদ্ধ করে ফেলেছে সে যেন তা মুছে ফেলে, তবে হ্যাঁ, আমার হাদীস বয়ান করাতে কোন ক্ষতি নেই”।

(দ্র: সহীহ মুসলিম, খন্ড-৮, পৃ-২২৯, কিতাবুয যোহদ ওয়ার রিকায়েক, বাব- আত্তাস্সুব্তু ফিল হাদীস ওয়া হুকমে কিতায়াতুল ইল্ম)। উক্ত হাদীসটি রচনা করার উদ্দেশ্যই ছিল হযরত আবু বকর ও হযরত উমরের কর্মকান্ডগুলোকে জায়েজ ঘোষণা করা। কেননা তারা অনেক সাহাবাগণ কর্তৃক জমাকৃত নবী (সা.)-এর হাদীসগুলিকে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটা তো স্পষ্ট যে উক্ত হাদীসটি খোলাফায়ে রাশেদীনদের যুগ শেষ হওয়ার পরে রচনা করা হয়েছে। কিন্তু রচনাকারীগণ কিছু বিষয়াবলী থেকে অজ্ঞ ছিলেন।

যেমন- (ক) রাসুলুল্লাহ (সা.) যদি উক্ত হাদীস বলে থাকতেন তাহলে সেই সকল সাহাবাও উহার উপর আমল করতেন যারা রাসুল (সা.)-এর হাদীস লিপিবদ্ধ করে ফেলেছিলেন এবং সেগুলিকে হযরত আবু বকর ও হযরত উমরের আমলের পূর্বেই মুছে ফেলতেন, যা রাসুল (সা.)-এর ওফাতের কয়েক বছর পর আগুনে পুড়িয়ে দিলেন। (খ) উক্ত হাদীসটি যদি সত্য হত তাহলে প্রথমতঃ হযরত আবু বকর ও দ্বিতীয়তঃ হযরত উমর উক্ত হাদীস দ্বারা যুক্তি প্রদর্শন করতেন যাতে হাদীসগুলির লেখনী এবং সেটিকে পুড়িয়ে ফেলার কর্ম/পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যেতেন। তারা এবং তাদের সম্মুখে সাহাবাগণও ওজর উপস্থাপন করতেন, যারা ভুলক্রমে হাদীসগুলি লিখে ফেলেছিলেন। যদি উক্ত হাদীসটি সত্য হত তাহলে হযরত আবু বকর ও উমরের জন্য সেই সমস্ত হাদীসগুলিকে মুছে ফেলা ওয়াজিব ছিল নাকি পুড়িয়ে ফেলা? (গ) উক্ত হাদীসকে যদি সত্য বলে স্বীকার করে নেয়া হয় তাহলে হযরত উমর বিন আব্দুল আজীজের যুগ হতে অদ্যাবধি সমস্ত মুসলমানই গোনাহ করেছেন। কেননা তারা সেই কর্মটিই সম্পাদন করেছেন যেটা থেকে রাসুল (সা.) নিষেধ করেছিলেন।

আর সর্বপ্রথম হলেন হযরত উমর বিন আব্দুল আজিজ যিনি ওলামাগণকে হাদীস জমা করা এবং লিপিবদ্ধ করার হুকুম দিয়েছিলেন। বুখারী ও মুসলিম উভয়েই উক্ত হাদীসকে সত্য গণ্য করেছেন। সুতরাং তারাও গোনাহগার হলেন, কেননা তারা রাসুল (সা.) হতে হাজারো হাজার হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। (ঘ) উক্ত হাদীসটি যদি সত্য হত তাহলে সেই ‘জ্ঞান নগরীর দরজা’ হযরত আলী হতে কিভাবে লুকিয়ে থাকল, যিনি নবী (সা.)-এর হাদীসসমূহকে সেই সহীফার মধ্যে সংকলন করেছেন যার দৈর্ঘ ছিল ৭০ গজ। আর যার নাম হল ‘সহীফাতুল জামেয়াহ্’ (এই সহীফা সম্পর্কে ইনশা আল্লাহ্ শীঘ্রই বর্ণনা দেয়া হবে)।

২। বনী উমাইয়ারা এই কথার প্রতি সমগ্র শক্তি প্রয়োগ করেছিল যে, রাসুল (সা.) দোষ-ক্রুটি মুক্ত ছিলেন না। বরং তিনিও অন্যান্য লোকের মত মানুষ ছিলেন, তাঁর দ্বারাও ভুল-ভ্রান্ত্রি হত এবং সঠিক কর্মও সম্পাদিত হত। সুতরাং এ ব্যাপারে তারা কয়েকটি হাদীসও বয়ান করে থাকে। আসলে উক্ত হাদীসগুলি রচনা করার উদ্দেশ্যই ছিল এই যে, নবী (সা.)’ও নিজের রায় অনুপাতে ইজতিহাদ করতেন।

বিধায় ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তাঁর দ্বারাও ভুল-ভ্রান্তি হত যেগুলোকে কিছু কিছু সাহাবা সংশোধন করে দিতেন। যেমন ‘তাবিরুন নখল’ (খেজুর গাছে পরাগায়ন করা) এবং ‘হিজাবের’ (পর্দার) আয়াত নাযিল হওয়ার ঘটনাটি স্বাক্ষী আছে অথবা মুনাফিকদের জন্য ‘ইস্তিগফার’ করা, বদর যুদ্ধের বন্দীদের নিকট থেকে ‘ফিদইয়াহ্’ গ্রহন করা। আর এমনই নাজানি কত ঘটনা আছে যেগুলিকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতগণ তাদের সহীহ কিতাবগুলিতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তারা মুহাম্মদ (সা.)-কে রাসুল স্বীকার করেন না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রতি আমার নিবেদন যে- রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে তোমাদের আকীদা-বিশ্বাস ও মাযহাব যদি এমনটাই আছে, তাহলে এই দাবী কেন কর যে, “আমরা তাঁর সুন্নাতের সাথে সম্পৃক্ত আছি”, অথচ রাসুল (সা.)-এর হাদীস ও সুন্নাত তোমাদের এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের নিকট অরক্ষিত এবং অজ্ঞাত, লেখনী অবস্থাতেও তো নাই। [কেননা নবী (সা.)-এর হাদীসের সংকলন ও লিখন তো উমর বিন আব্দুল আজিজের যুগে অথবা তার পরে হয়েছে।

অথচ ইতিপূর্বেকার খলিফা ও শাসকগণ তো হাদীসসমূহকে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন এবং সেগুলি লেখা আর বয়ান করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন]। এই সমস্ত দূর্বল ধ্যান-ধারণা ও মিথ্যা আবর্জনাকে বাতিল করা আমাদের জন্য ওয়াজিব হয়েগেছে। ইনশা আল্লাহ আমরা আপনাদের সিহাহ সিত্তা এবং অন্যান্য কিতাবসমূহ দ্বারাই আপনাদের কথাকে রদ করে দিব (তাজ্জবের কথা তো ইহাই যে, আহলে সুন্নাতগণ অনেক হাদীস নিজেদের কিতাবগুলিতে লিখেছেন অথচ সেগুলি যে মিথ্যা তার খন্ডনও সেই কিতাবগুলিতেই মওজুদ আছে। আবার তারচেয়েও তাজ্জবপূর্ণ কথা তো এই যে, তারা মিথ্যা হাদীসের উপর আমল করে থাকেন আর সহীহগুলোকে পরিত্যাগ করে থাকেন)। ইমাম বুখারী তার সহীহর ‘কিতাবুল ইলম’-এ এবং বাব কিতাবাতুল ইলমে আবু হুরায়রা হতে রেওয়ায়েত করেছেন যে তিনি বলেন, নবী (সা.)-এর সাহাবাদের মধ্যেকার কারোরই আমার চেয়ে অধিক হাদীস মুখস্ত ছিল না।

কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন আমরুর আমার চেয়ে অধিক মুখস্ত ছিল। কেননা তিনি লিখে রাখতেন, আমি লিখে রাখতাম না। [দ্র: সহীহ বুখারী, খন্ড-১, পৃ-৩৬, বাব-কিতাবাতুল ইল্ম] উক্ত রেওয়ায়েত দ্বারা এই কথা বুঝে আসে যে, নবী (সা.)-এর সাহাবাদের মধ্যে কিছু লোক তাঁর হাদীসগুলি লিখে রাখতেন। আর আবু হুরায়রা যখন নবীর মুখে শুনেই ছয় হাজার হাদীস বয়ান করেছেন, তাহলে আব্দুল্লাহ বিন আমরু বিন আ’সের নিকট তো তার চেয়েও অনেক বেশী হাদীস থাকার কথা কারণ তিনি লিখে রাখতেন। সুতরাং আবু হুরায়রাও এই কথা স্বীকার করেছেন যে, আব্দুল্লাহ বিন আমরু বিন আ’স আমার চেয়ে অধিক হাদীস মুখস্ত রেখেছেন কারণ তিনি লিখে রাখতেন।

এতে কোন সন্দেহ নাই যে, আরো অনেক সাহাবা নবী (সা.)-এর হাদীসগুলিকে লিখে রাখতেন। কিন্তু আবু হুরায়রা তাদের আলোচনা হয়তো এ জন্য করেন নি যেহেতু তারা এ কথার জন্য বিখ্যাত ছিলেন না যে নবী (সা.)-এর অনেক হাদীস তাদের মুখস্ত আছে। হাদীসের উক্ত হাফেজগণের মধ্যে আমি হযরত আলী ইবনে তালিব-কেউ যুক্ত করছি। যিনি মিম্বর থেকে ‘আল-জামেয়াহ্’ নামক সহীফার পরিচয় দিয়েছিলেন। উক্ত সহীফাতে নবী (সা.) হতে বর্ণিত সেই সমস্ত হাদীস মওজুদ ছিল যেগুলির প্রয়োজন মানুষের ছিল।

উক্ত সহীফা আহলে বাইতের ইমামগণ একে অপরের নিকট থেকে ‘মীরাস’ হিসাবে পেয়ে আসছেন এবং তাঁরা প্রায়শঃই উক্ত সহীফা থেকেই হাদীস বয়ান করে থাকেন। ইমাম জাফর সাদিক বলেন যে, “আমার নিকট একটি সহীফা আছে যার দৈর্ঘ ৭০ গজ। ইহা হল রাসুল (সা.)-এর শ্রুতলিপি। যেটিকে ইমাম আলী নিজ হস্তে লিখেছেন। সকল হালাল ও হারাম এবং যে জিনিষের মানুষের প্রয়োজন হতে পারে তার সবকিছুই এতে লিপিবদ্ধ আছে।

সমস্ত ঘটনাই এমন কি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম বিষয়াবলীও এতে লিপিবদ্ধ আছে”। [দ্র: উসুলে কাফি, খন্ড-১, পৃ-২৩৯] স্বয়ং বুখারী তার সহীহতে উক্ত সহীফার আলোচনা করেছেন যা কয়েকটি অধ্যায় বিশিষ্ট হযরত আলীর নিকট ছিল। কিন্তু যেমনটি বুখারীর স্বভাবই ছিল সবকিছুতে কাট-ছাট করে বর্ণনা করা। বিধায় উক্ত সহীফা সম্পর্কেও তিনি কাট-ছাট করে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং সেটির অনেক বৈশিষ্ট ও বিষয়াবলীকে বাদ দিয়েছেন। বুখারী বাবে ‘কিতাবাতুল ইলম’-এ শাব্য়ী হতে এবং তিনি জহীফাহ্ হতে রেওয়ায়েত করেছেন যে, আমি আলীকে আরজ করলাম, “আপনার কাছে কি আর কোন কিতাব আছে”? তিনি উত্তরে বললেন, “আল্লাহর কিতাব ও সেই অনুভূতি যা তিনি একজন মুসলমান পুরুষকে দান করেছেন, তা ছাড়াও এই সহীফা আছে”।

আমি জানতে চাইলাম, “এই সহীফাতে কি আছে”? তিনি বললেন, “এতে আকল (বিবেক) এবং কয়েদ হতে মুক্তি এবং কাফেরের বদলায় মুসলমানকে হত্যা করা হবেনা, লিপিবদ্ধ আছে”। [সহীহ বুখারী, খন্ড-১, পৃ-৩৬] বুখারীতেই অনত্র আ’মেশ ইব্র্রাহীম তামিমী এবং ইব্রহীমের পিতা হতে রেওয়ায়েত করা হয়েছে যে, আলী বলেন, “আমার নিকট আল্লাহর কিতাব আর এই সহীফা ব্যতীত কিছুই নেই যেখানে নবী (সা.)-এর হাদীস লিপিবদ্ধ আছে”। [সহীহ বুখারী, খন্ড-২, পৃ-২২১; সহীহ মুসলিম, খন্ড-৪, পৃ-১১৫] অন্য একটি বাবে বুখারী ইব্রহীম তামিমী এবং তার পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, “আলী (রা.) আমাদের মাঝে ইঁটের মিম্বর থেকে খোৎবা দিচ্ছিলেন এবং তাঁর কাছে একটি তরবারী ছিল যার মধ্যে সহীফাটি ঝুলানো ছিল। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম আমার নিকট আল্লাহর কিতাব এবং এই সহীফা ব্যতীত আর অন্য কোন কিতাব নাই যেটাকে পাঠ করা হয়”। [সহীহ বুখারী, খন্ড-৮, পৃ-১৪৪] বুখারী সাহেব ‘আল জামেয়াহ্’ নামক কিতাব সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদিকের কাওলটিকে নকল করেন নি যে, “এতে সকল হালাল ও হারাম, মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়াবলী এমনকি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষদ্রতম বিষয়াবলীও এতে লিপিবদ্ধ আছে।

ইহা হল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শ্রুতলিপি যেটিকে হযরত আলী নিজ হস্তে লিখেছেন”। বুখারী এটিকে এক স্থানে অল্প কথায় সেরে দিয়েছেন যে, “এতে আকল (বিবেক সম্পর্কিত কথা-বার্তা) কয়দীর মুক্তি এবং এই কথা লেখা আছে যে কাফেরের পরিবর্তে কোন মুসলমানকে হত্যা করা হবে না”। অন্যত্র বলেন যে, “এটিকে আলী যখন প্রকাশ করলেন তখন তাতে উটের বয়স সম্পর্কে লেখা ছিল”। অথচ এতে ইহাও লেখা আছে যে ইহা হল মুসলমানদের আশ্রয় স্থল। আবার এতে ইহাও লেখা ছিল যে, কোন জাতির কেউ একজন অলি (অভিভাবক) হয়ে যাবে অথচ তাতে সেই জাতির কোন অনুমতি নাই।

ইহা সত্যকে ধামা-চাপা দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যথায় এ কথাও কি স্বীকার করা যেতে পারে যে, হযরত আলী একটি সহীফার মধ্যে মাত্র চারটি বাক্য লিখে সেটিকে তরবারীতে ঝুলিয়ে রাখবেন এবং যেখানেই খোৎবা দিবেন সেটিকে সঙ্গে রাখবেন আর আল্লাহর পরে সেটিকে দ্বিতীয় ‘মারজা’ (প্রাধান্যশীল) বলবেন, আর বলেন যে, “আমি নবী হতে কোরআন আর এই সহীফা ব্যতীত কোন কিছুই লিপিবদ্ধ করিনি”। আবু হুরায়রার আকল কি হযরত আলীর আকলের চেয়েও বড় ছিল? কেননা তিনি তো না লিখেই এক লক্ষেরও অধিক হাদীস মুখস্ত রেখেছিলেন! আল্লাহর কসম ঐলোগুলির ব্যাপারটিই বড় আজব ধরণের। ইনারা তো না লিখেই সেই আবু হুরায়রার কাছ থেকে এক লক্ষ হাদীস কবুল করে নিলেন, যিনি কেবলমাত্র তিন বছর নবীর সঙ্গে ছিলেন এবং লেখা পড়াও জানতেন না। আর যে আলীকে জ্ঞানের উৎস, সাহাবাদেরকে ইরফানের জ্ঞানদানকারী গণ্য করা হয়, তাঁকেই এমন একটি সহীফার ধারণকারী দেখানো হয়েছে যার মধ্যে মাত্র চারটি হাদীস লিপিবদ্ধ ছিল এবং সেটিকে তিনি রাসুল (সা.)-এর যুগ থেকে নিজের খেলাফত আমল পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়েছেন।

যখন মিম্বরে ওঠেন তখন উক্ত সহীফা তরবারীতে ঝুলতে থাকে? হায় আফসোস! এ সমস্ত কথাবার্তা সরাসরি মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। যদিও বুখারীর এতটুকু লেখনীই সত্যসন্ধানী ও বিবেক সম্পন্ন মানুষদের জন্য যথেষ্ট। বুখারী এই কথা লিখেছেন যে, “এতে আকল সম্পর্কিত কথাবার্তা লিপিবদ্ধ আছে” এই কথাটি স্বয়ং দলীল হয়ে আছে যে, এতে এমন অনেক বিষয়াবলী আছে যা মানুষের আকল ও ইসলামী চিন্তা-চেতনার সাথে সম্পর্কিত। আমি এই কথার প্রতি দলিল স্থাপন করতে চাই না যে উক্ত সহীফাতে কি লিপিবদ্ধ আছে। মক্কাবাসীগণ এর বিষয়ভিত্তিক অধ্যায়গুলো থেকে অবশ্যই অবগত হবেন এবং গৃহবাসীরা গৃহের কথা খুব ভালো করেই জানেন।

আহলে বাইতগণই বলেছেন যে, এতে সমস্ত বিষয়াবলীই মওজুদ আছে যা মানুষের প্রয়োজন হতে পারে। তা হালাল হোক বা হারাম, এমন কি ‘খাদশ’ (সেই জরিমানা যা একটি খুদ্র আচড় লাগানোর কারণে ধার্য করা হয়) এবং ক্ষুদ্রতম বিষয়াবলীও এতে লিপিবদ্ধ আছে। এই আলোচনায় যে বিষয়টি আমাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই যে, সাহাবাগণ নবী (সা.)-এর হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করতেন। আবু হুরায়রার এই বক্তব্য যে আব্দুল্লাহ বিন আমরু নবী (সা.)-এর হাদীসসমূহ লিখতেন এবং তাঁর এই বক্তব্য যে, “আমি রাসুল (সা.)-এর নিকট থেকে কেবল কোরআন আর এই সাহিফা লিপিবদ্ধ করেছি” স্বয়ং এই কথার প্রতি নিরেট দলিল হয়ে আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের হাদীস লেখার বিষয়ে কোখনোই নিষেধ করেন নি। বরং এর বিপরীতটিই সঠিক এবং যে হাদীসটি মুসলিম তাঁর সহীহতে বর্ণনা করেছেন যে, “কোরআন ব্যতীত আমার অন্য কোন কথা লিপিবদ্ধ করবে না আর যদি কেউ কোন কথা লিখে থাকে তাহলে সেটি যেন মুছে ফেলে” কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

এর দ্বারা খলিফাদের সাহায্যকারীরা খলিফাদেরই সমর্থন ও সাহায্য করেছে এবং হযরত আবু বকর ও উমর এবং উসমানকে হাদীসসমূহ পুড়িয়ে ফেলা এবং প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার বিষয়ে মুক্ত বা নির্দোষ সাব্যস্ত করেছে। আবার যে বিষয়টি আমার এই বিশ্বাসকে আরো শক্তি যোগায় যে নবী (সা.) তাঁর হাদীসসমূহ লিখার বিষয়ে নিষেধ করেন নি বরং তা লিখে রাখারই হুকুম দিয়েছিলেন, সেটি হল হযরত আলীর বক্তব্য, যিনি নবী (সা.)-এর খুবই নিকটবর্তী ছিলেন, “আমি নবীর নিকট থেকে কোরআন এবং এই সহিফা ব্যতীত কিছুই লিখি নি”, এটিকেই বুখারীও সঠিক বলে স্বীকার করেছেন। আবার আমরা যখন এর সাথে ইমাম জাফর সাদিকের বক্তব্যকে যুক্ত করি যে, ‘সহিফায়ে জামেয়া’ হল রাসুল (সা.)-এর শ্রুতলিপি, যেটিকে হযরত আলী নিজ হস্তে লিপিবদ্ধ করেছেন। এমতাবস্থায় এর অর্থ দাঁড়াল এই যে, রাসুল (সা.) হযরত আলীকে (হাদীসসমূহ) লেখার হুকুম দিয়েছিলেন। সুধী পাঠকমন্ডলীর আরো সন্তুষ্টির জন্য আমি এ সংক্রান্ত আরো কিছু রেওয়ায়েত উপস্থাপন করছি।

হাকিম তাঁর মুস্তাদরাকে, আবু দাউদ তাঁর সহীহতে এবং আহমদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুস্তাদরাকে এবং দারেমী তাঁর সুনানে আব্দুল্লাহ বিন আমরু হতে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার সম্পর্কে আবু হুরায়রা এই কথা বয়ান করেছেন যে আব্দুল্লাহ বিন আমরু হাদীস লিখে রাখতেন। আব্দুল্লাহ বিন আমরু নিজেই বলেন যে, “আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট যাকিছু শুনতাম সেগুলি লিখে রাখতাম, কিন্তু কোরায়েশরা আমাকে লিখতে নিষেধ করে দিল এবং বললো, তুমি রাসুলের নিকট যাকিছু শুনো তার সবটুকুই লিখে রাখ, অথচ তিনি হলেন মানুষ, তিনি রাগ ও ক্ষোবের মধ্যেও কথা বলে থাকেন আবার শান্ত অবস্থাতেও কথা বলেন!”। আব্দুল্লাহ বলেন যে, আমি সেদিন থেকে হাদীস লেখা বন্ধ করে দিলাম। একদিন আমি রাসুল (সা.)-এর খেদমতে উক্ত ঘটনার আলোচনা করলাম, তখন তিনি (সা.) আমাকে লেখার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, “তুমি লিখে রাখ, সেই সত্মার কসম যার কব্জায় আমার প্রান, আমার জিহ্বা থেকে কেবল হক কথাই বের হয়”। [মুস্তাদরাক, খন্ড-১,পৃ-১০৫] উক্ত ঘটনা দ্বারা আমাদের কাছে এই কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আব্দুল্লাহ বিন আমরু সেই সকল কথাকে লিখে রাখতেন যা তিনি নবী (সা.)-এর নিকট থেকে সরাসরি শুনতেন আর তিনি (সা.) তাকে এ জন্য কখনোই নিষেধ করেন নি।

বরং হাদীস লেখা থেকে তাকে কোরায়েশরা বারণ করেছিল। কিন্তু আব্দুল্লাহ সেই ব্যক্তিবর্গের নাম প্রকাশ করেন নি যারা হাদীস লিখতে বারণ করেছিল। কেননা তাদের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রাসুল (সা.)-এর প্রতি আপত্তি ছিল। সে জন্যই উক্ত বক্তব্যের সম্বন্ধ/উদ্দেশ্য কোরায়েশের দিকে করা হয়েছে। আর ইহা তো স্পষ্ট যে কোরায়েশের অর্থ হল মোহাজেরদের বড় বড় সরদারগণ তথা হযরত আবু বকর, উমর, উসমান, আব্দুর রহমান বিন আউফ, আবু ওবায়দাহ, তালহা ও যুবায়র এবং সেই সকল লোক যারা এদেরকে অনুসরণ করতো।

প্রকাশ থাকে যে, নবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই আব্দুল্লাহকে হাদীস লিখে রাখতে বারণ করা হয়ে ছিল, যাদ্বারা এই ষড়যন্ত্রের গভিরতা অনুমান করা যেতে পারে। আবার আব্দুল্লাহ নবী (সা.)-এর কাছ থেকে কিছু না জেনেই কোরায়শদের কথার প্রতি কেমন করে বিশ্বাস করে নিলেন? এমনই তাদের এই বক্তব্য দ্বারা যে, “রাসুলুল্লাহ (সা.) হলেন মানুষ, তিনি রাগান্বিত অবস্থাতেও কথা বলেন আবার শান্ত অবস্থাতেও কথা বলে থাকেন” -এ বিষয়ে তাদের দূর্বল আকীদারও অনুমান করা যেতে পারে। তারা রাসুল (সা.) সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতেন যে, (মায়াযাল্লাহ্) রাসুল (সা.) মনগড়া কথা বলতেন, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন বিশেষ করে রাগান্মিত অবস্থায়। আর আব্দুল্লাহ বিন আমরু যখন রাসুল (সা.)-কে বললেন যে, কোরায়েশরা আমাকে হাদীস লিখতে বারণ করেছে, তখন তিনি (সা.) বললেন, “তুমি লিখে রাখ! সেই সত্মার কসম যার কব্জাতে আমার প্রান (নিজের পবিত্র মুখের দিকে ইংগিত করে) যা কিছু এখান বের হয় তা কেবল হকই হয়ে থাকে”। ইহা এই কথার প্রতি দলিল বহন করে যে, রাসুল (সা.) জানতেন যে, কোরায়েশরা তাঁর আদালত (ন্যায়বিচার) সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে।

রাসুল (সা.) দ্বারা ভুল-ভ্রান্তি হওয়াকে তারা জায়েজ গণ্য করে এবং তাঁর জিহ্বা দ্বারা মনগড়া কথা-বার্তা বের হওয়া সম্ভব বলে বিশ্বাস করে। সে জন্যই তিনি (সা.) আল্লাহর কসম খেয়ে (নিজের জিহ্বার দিকে ইঙ্গিত করে) বললেন যে, “এখান থেকে যা নির্গত হয় তা হক হয়ে থাকে”। তাঁর এই কথা সম্পূর্ণ রূপে সত্য, কেননা কোরআনের মধ্যে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, “তিনি (রাসুল) নিজের নফসের তাড়নায় কোন কিছুই বলেন না বরং তাই বলেন যা তাঁর প্রতি অহি করা হয়”। [সূরা আন-নজ্ম, আয়াত ৩-৪] রাসুল (সা.) ভুল-ভ্রান্তি হতে নিষ্পাপ এবং বেহুদা কথা-বার্তা হতেও পাক। আমরা দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে বলতে পারি যে এ ধরণের হাদীসসমূহ যা দ্বারা এমন অর্থ প্রকাশ পায় যে, “মুহাম্মাদ রাসুল নন” সেগুলি উমাইয়াদের যুগে রচিত হয়েছে, যা মোটেই সত্য নয়।

যেমনটি বর্ণিত হাদীসটি আমাদেরকে এই বুঝও দিয়েছে যে, আব্দুল্লাহ বিন আমরু কোরায়শ দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন, তাই তো তাদের কর্তৃক নিষেধ করা মাত্রই তিনি হাদীস লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যেমনটি নিজেই বলেন যে, “আমি হাদীস লেখা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলাম এবং অনেক দিন পর্যন্ত কিছুই লিখি নি”। এক দিন সুযোগ বুঝে রাসুল (সা.) সম্পর্কে সৃষ্ট সন্দেহগুলিকে দূর করার লক্ষ্যে তাঁর (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়েছিলেন। এমনই আরো অনেক লোকের বক্তব্য আছে। অবশেষ অনেকে স্বয়ং তাঁর সম্মুখেই সন্দেহের কথা প্রকাশ করে দিয়েছিল।

যেমন:- “আপনি কি বরহক (সত্য) নবী নন”। [হুদায়বিয়া সন্ধির সময় উমর বিন খাত্তাব বলেছিলেন। দ্রষ্টব্য: বুখারী, খন্ড-৩, পৃ-১২৩] “আপনিই কি সেই ব্যক্তি যে নিজেকে নবী জ্ঞান করে”। [কথাটি আয়েশা বিনতে আবু বকর নবী (সা,)-কে বলেছিলেন। দ্রষ্টব্য: ইমাম গাজ্জালীর কিতাব ‘এহইয়াউল উলুম, খন্ড-২, পৃ-২৯] “আল্লাহর কসম এই বন্টনটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয় নি”।

[আনছারগণের মধ্য থেকে একজন সাহাবী কথাটি বলেছিলেন, দ্রষ্টব্য: বুখারী, খন্ড-৩, পৃ-৪৭] অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা নবী (সা.)-কে বলেছিলেন, “আমি তো আপনার খোদাকে আপনার ইচ্ছার পক্ষ্যে তড়িঘড়ি করতে দেখেছি”। [দ্রষ্টব্য: বুখারী, খন্ড-৬, পৃ-২৪ ও ১৩৮] খুলুকুন আযীম, মেহেরবান ও দয়াবান রাসুল (সা.) অধিকাংশ সময়ে উক্ত সন্দেহসমূহকে এভাবে রদ করেছেন, “আমি (আল্লাহর) হুকুমের দাস”। কখনো বলেছেন: “আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহর জন্য নেকীসমূহ করে থাকি এবং তারই তাকওয়াহ (ভয়) অবলম্বন করে আছি”। কখনো বলেছেন, “সেই সত্মার কসম যার কব্জায় আমার প্রান, আমার জিহ্বা থেকে যা কিছু বের হয় তা হয় সত্য”। কখনো বলতেন, “আল্লাহ, আমার ভাই মূসার প্রতি রহম করুক, তাঁকে এর চেয়েও অধিক কষ্ট দেয়া হয়েছে কিন্তু তিনি সবর করেছেন”।

অতএব, অন্তরে আঘাত দানকারী ঐ সমস্ত কথা-বার্তা যা নবীর নিষ্পাপতার ক্ষেত্রে সন্দেহ প্রকাশ করে এবং নবুয়াতের মধ্যেই সন্দেহ সৃষ্টি করে, সেগুলি কোন সাধারণ ব্যক্তিবর্গ অথবা মুনাফিকরা ব্যবহার করেনি বরং অতীব আফসোসের বিষয় যে উক্ত কথা-বার্তা রাসুল (সা.)-এর বিশিষ্ট সাহাবীদের জিহ্বা থেকেই বের হয়েছে অথবা উম্মুল মুমেনীন বলেছেন। আর এই সমস্ত লোকেরাই হলো ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নেতা’ এবং উত্তম আদর্শ। লাহাওলা ওয়ালা ক্যুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলীয়্যিল আযীম”। আর আমার বিশ্বাস আছে যে, “আমার কাছ থেকে কোরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিপিবদ্ধ করো না” হাদীসটি মনগড়া এবং ভিত্তিহীন। ইহা রাসুলে খোদার হাদীস নয়।

স্বয়ং হযরত আবু বকরও রাসুল (সা.)-এর কিছু কিছু হাদীস লিখে রাখতেন এবং সেগুলিকে তিনি রাসুল (সা.)-এর জামানাতেই জমা করে রেখেছিলেন। কিন্তু খলিফা হবার পর মত পরিবর্তন হয়েগেল এবং কোন একটি বিশেষ লক্ষ্যে হাদীসগুলি পুড়িয়ে ফেললেন। কথাটি সুধী পাঠক ও গবেষকমন্ডলী জানেন। এবার তার কন্যা হযরত আয়শা বয়ান করছেন যে, “আমার পিতা রাসুল (সা.)-এর পাঁচ শত হাদীস জমা করেছিলেন। এক রাতে তার ইরাদা পাল্টে গেল।

কোন সন্দেহ অথবা কোন বিষয়ের কারণে ইরাদা পরিবর্তন হয়েছিল। যখন সকাল হল তখন আমাকে বললেন, হে কন্যা! সেই হাদীসগুলো নিয়ে আস যা তোমার কাছে আছে। আমি এনে তার নিকট সোপর্দ করে দিলাম, তখন তিনি উক্ত হাদীসগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে দিলেন”। [দ্র: কানযুল উম্মাল, খন্ড-৫, পৃ-৩৩৭; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান্নিহায়া; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ, খন্ড-১, পৃ-৫] একদিন উমর বিন খাত্তাব নিজ খেলাফত আমলে খোৎবার মধ্যে বললেন, “তোমাদের কারোর কাছে কোন কিতাব লিখিত থাকলে তা আমার কাছে পৌঁছে দাও। আমি এ বিষয়ে কিছু কাজ করতে চাই।

লোকেরা চিন্তা করল হয়তো ইবনে খাত্তাব হাদীসগুলোকে দেখতে চান যেন সেগুলি একটি পদ্ধতিতে জমা হোক এবং কোন মতবিরোধ যেন না থাকে। সুতরাং তারা নিজ নিজ কিতাব এনে হযরত উমরের হাওয়ালা করে দিলেন এবং তিনি সবগুলোকে পুড়িয়ে দিলেন”। [আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ইবনে সা’দ, খন্ড-৫, পৃ-১৮৮; খতিব বাগদাদীও এই কথাটিই ‘তাক্বলীদুল ইল্ম’ নামক কিতাবে লিপিবদ্ধ করেছেন] অনুরূপভাবে হযরত উমর অন্যান্য শহরগুলিতেও একই হুকুম প্রেরণ করলেন যে, “কারোর কাছে হাদীস সংক্রান্ত কোন বিষয় যদি লেখা থাকে তাহলে সে যেন সেগুলিকে মুছে ফেলে” [সূত্র: জামে’ বয়ানুল ইল্ম, -ইবনে আব্দুল বার]। উমরের বক্তব্য এই কথার প্রতি স্বয়ং দলিল হয়ে আছে যে, সাধারণ সাহাবা হয় মদীনার বাসিন্দা হোক অথবা অন্যান্য ইসলামী শহরের বাসিন্দা হোক, সকলেই রাসুল (সা.)-এর হাদীস জমা করে রেখেছিলেন এবং রাসুল (সা.)-এর জামানাতেই তারা সেগুলিকে কিতাবের আকার দিয়েছিলেন। কিন্তু আফসোস! প্রথমে আবু বকর উক্ত কিতাবগুলিকে পুড়িয়েছেন তারপর উমর অন্যান্য শহরে রক্ষিত কিতাবগুলিকে ধ্বংস করলেন।

[আল্লাহ আপনাদেরকে শান্তিতে রাখুক, নবীর সুন্নাতের সাথে হযরত আবু বকর ও উমরের অপ্রীতিকর ব্যবহারের প্রতি এবং সেই ক্ষতির প্রতি একটু লক্ষ্য করুন যার ক্ষতিপূরণ কখনোই সম্ভব নয়। এই উম্মতে মুসলেমার প্রতি মুসিবাতের পাহাড় ভেঙে পড়েছে। কেননা কোরআনকে বুঝা এবং আল্লাহর আহ্কামসমূহকে জানার জন্য রাসুল (সা.)-এর হাদীসসমূহের উপস্থিতি একান্ত জরুরী। নিজের প্রাণের কসম! যে হাদীসগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে তার সবকটিই সহীহ ছিল, কেননা সেগুলি সাহাবারা সরাসরি রাসুল (সা.)-এর মুখ থেকে শুনে লিখেছিলেন, মাঝে কোন মাধ্যম ছিল না। অথচ পরবর্তীতে সংকলিত হাদীসগুলিতে বেশিরভাগই জাল হাদীস।

কারণ অনেক মুসলমান ঘটনাবলীর বলী হয়ে নিঃশেষ হয়েগিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে যা কিছু লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা জালেম শাসকগণের নির্দেশে লেখা হয়েছে] এই কথাটি কেবল আমিই নয় বরং কোন বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই সত্য জ্ঞান করবে না যে, রাসুল (সা.) সাহাবাদেরকে নিজের হাদীস লিখতে নিষেধ করেছিলেন। বিশেষ করে সেই সত্যতা জানার পর যে, অধিকাংশ সাহাবাগণের নিকট হাদীসের কিতাব মওজুদ ছিল, বিশেষভাবে সেই সহিফা যা হযরত আলীর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল। যার দৈর্ঘ ছিল ৭০ গজ এবং যার মধ্যে সমস্ত বিষয় বয়ান করা হয়েছে, যেটিকে ‘আল-জামেয়াহ্’ বলা হয়। কিন্তু শাসণ ক্ষমতা এবং উহার রাজনীতির দাবীই ছিল ইহাই যেন নবী (সা.)-এর সুন্নাতকে মুছে ফেলা হোক, কিতাবগুলিকে পুড়িয়ে দেয়া হোক এবং বয়ান করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক। আবার তাদের খেলাফতের সমর্থনকারী সাহাবারা তাদের নিদের্শেরই আনুগত্য করতেন, সেগুলিকেই প্রকাশ করতেন।

সুন্নাত মুছে যাবার পর তাদের আনুগত্যকারী সাহাবা ও তাবেয়ীনদের জন্য ইজতিহাদ বির-রায় করা ছাড়া কোন পথ খোলা ছিলনা অথবা তারা হযরত আবু বকর, উমর, উসমানের সুন্নাত এবং মোয়াবিয়া ও ইয়াজিদের সুন্নাত, মারওয়ান বিন হাকাম, আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের সুন্নাত, এবং ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিকের সুন্নাত, সোলায়মান বিন আব্দুল মালিকের সুন্নাতের উপর আমল করত। এভাবেই উমর বিন আব্দুল আজীজের জামানা উপস্থিত হল এবং তিনি আবু বকর হায্মীকে রাসুল (সা.) অথবা উমর বিন খাত্তাবের সুন্নাতকে লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। [দ্র: মোয়াত্তা- ইমাম মালিক, খন্ড-১, পৃ-৫] এভাবে এই কথাটিও আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যে যুগে নবী (সা.)-এর হাদীস লেখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছিল এবং সেটি মুছে যাওয়া এবং সার্বক্ষণিকভাবে বাদ্ধবাধকতার মধ্যে আঁকড়ে থাকার শত বছর পর আমরা বনী উমাইয়ার সাম্যবাদী শাসককে নবীর সুন্নাতকে খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের সাথে সংমিশ্রণ করতে দেখতে পাই। সুতরাং উমর বিন আব্দুল আজিজ রাসুল (সা.)-এর সুন্নাত এবং হযরত উমরের সুন্নাতকে জমা করার নিদের্শ দিলেন, যেন উমর বিন খাত্তাব মুহাম্মদ (সা.)-এর রিসালাতের মধ্যে শরীক (অংশীদার) হয়ে আছেন। আবার উমর বিন আব্দুল আজিজ নিজের যুগের আহলে বাইতের সাথে নবীর হাদীস বিষয়ে কেন যোগাযোগ করেন নি, যাতে তারা সহিফায়ে আল-জামেয়াহ্’র একটি ‘নুসখা’ দিয়ে দিতেন।

আবার নবী (সা.)-এর হাদীস জমা করার বিষয়ে তাঁদেরকে কেন অনুরোধ করেন নি, যেহেতু তাঁরা নিজের নানাজানের হাদীসের বিষয়ে অন্যান্যদের তুলনায় অধিক জ্ঞান রাখতেন?? সেই হাদীসগুলো দ্বারা কি সন্তুষ্টি অর্জন হতে পারে, যে গুলোকে বনী উমাইয়ার শাসক ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সাহায্যকারীরা সংকলন করেছিল আর যেগুলির উপর কোরায়েশদের খেলাফত নিরভর্শীল ছিল। আর রাসুলে আকরাম (সা.) এবং তাঁর সুন্নাতের বিষয়ে কোরায়শদের আকীদা-বিশ্বাসের অবস্থা তো আমাদের জানাই আছে ! এমন অবস্থার পর বিষয়টি তো স্পষ্টই যে, ক্ষমতাসীন দলটি দীর্ঘকাল ব্যাপী ‘ইজতিহাদ’ ও ‘কিয়াস’ এবং ‘পারস্পারিক পরামর্শে’-র উপরই আমল করেছে। তার পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলটি হযরত আলীকে রাজনীতির অঙ্গন থেকে সরিয়ে তাঁকে দেখেও না দেখার ভান করেছিল। অথচ উক্ত দলের কাছে সেই সমস্ত কিতাবগুলিকে পুড়িয়ে ফেলার পক্ষে কোন দলিল ছিল না, যেগুলিকে স্বয়ং রাসুল (সা.) লিখিয়ে ছিলেন আর সাহাবাগণ তাঁর (সা.) জীবদ্দশাতেই সেগুলি লিপিবদ্ধ করে ছিলেন। একমাত্র হযরত আলী বিন আবি তালিব সেই সহিফাটি সংরক্ষণ করতে থাকেন যেখানে মানুষের প্রয়োজনের সমস্ত বিষয়াবলী সংকলিত ছিল এমন কি ‘আর্শ’ ও ‘খাদশ’ও উপস্থিত ছিল।

আর খেলাফত যখন তাঁর পর্যন্ত পৌঁছাল তখন তিনি সেটিকে তরবারীর সাথে ঝুলিয়ে খোৎবা দেয়ার জন্য মিম্বরের উপর তাশরীফ নিয়ে যেতেন এবং উক্ত সহিফার গুরুত্ব বুঝাতেন। এই কথা ইমামগণের কাছ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রমাণিত যে, উক্ত সহিফা এক ইমামের কাছ থেকে পরবর্তী ইমামের নিকট মীরাস (উত্তরাধিকার) হিসাবে পৌছেছে এবং তাঁরা তাঁদের যুগের অনুসারীদের প্রয়োজনে উক্ত সহিফা হতেই ফতোয়া দিতেন। আর সম্ভবতঃ এ কারণেই ইমাম জাফর সাদিক ও ইমাম রেজা এবং অন্যান্য ইমামগণ বলতেন যে, “আমরা আমাদের রায় অনুপাতে মানুষকে ফতোয়া দেই না। আমরা যদি আমাদের রায় এবং নিজেদের প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষকে ফতোয়া দিতাম তাহলে হালাক হয়ে যেতাম। কিন্তু এই সহিফায়ে জামেয়াহ্ রাসুলুল্লাহর যুগ থেকেই আছে যা আমরা জ্ঞানের অধিকারীগণকে পিতার কাছ থেকে পুত্রকে মীরাস হিসাবে প্রাপ্ত হয় এবং আমরা এটিকে সেভাবেই সংরক্ষণ করি যেভাবে মানুষ স্বর্ণ ও রৌপ্য সংরক্ষণ করে”।

[সূত্র: মোয়ালিমুল মাদরাসাতাইন মুরতুজা আসকারী, খন্ড-৩, পৃ-৩০২] তিনিই বলেছেন যে, “আমার হাদীস হল আমার পিতার হাদীস এবং আমার পিতার হাদীস হল আমার দাদাজানের হাদীস এবং আমার দাদার হাদীস হল ইমাম হুসাইনের হাদীস এবং তাঁর হাদীস হল ইমাম হাসানের হাদীস এবং ইমাম হাসানের হাদীস হল আমীরুল মুমেনীন আলীর হাদীস এবং আমীরুল মুমেনীন আলীর হাদীস হল রাসুল (সা.)-এর হাদীস এবং রাসুল (সা.)-এর হাদীস হল আল্লাহর কালাম”। হাদীসে সাকালায়ন হল ক্রমাগতঃ “তারাকতু ফিকুমুস সাকালায়ন কিতাবাল্লাাহি ওয়া ইতরাতি মা ইন তামাস্সাক্তুম বিহিমা লান তাদিল্লু বা’দী আবাদা” অর্থাৎ “আমি তোমাদের মাঝে দুটি অতীব ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি (এক) আল্লাহর কিতাব (দুই) আমার ইতরাত। যতক্ষণ তোমরা এ দুটির সাথে সম্পৃক্ত থাকবে আমার পর পথভ্রষ্ট হবে না”। [সূত্র: সহীহ মুসলিম, খন্ড-৫, পৃ-১২২ এবং সহীহ তিরমিযি, খন্ড-৫, পৃ-৬২৭)] ইহাই হল সত্য, আর এছাড়া যা কিছু আছে সবই অন্ধকার ও গোমরাহী। নবী (সা.)-এর সঠিক সুন্নাতের সংরক্ষক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী আহলে বাইতে মোস্তফার মধ্যেকার পবিত্র ইমামগণ ব্যতীত আর কেউ নেই।

একথা দ্বারা এই ফলাফলই বেরিয়ে আসে যে, আহলে বাইতগণের প্রকৃত অনুসরিরা রাসুল (সা.)-এর ইতরাতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন এবং তাঁরাই হলেন ‘আহলে সুন্নাত’। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতগণ এমন বিষয়ের দাবী জানাচ্ছেন যা তাদের কাছে নেই আর না তাদের দাবীর পক্ষে কোন দলীল আছে। ওয়ালহাম্দু লিল্লাহিল্লাযি হাদানা লিহাযা..... চলবে..........। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।