আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সহযাত্রী (ইত্তেফাক ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত গল্প)

ঠান্ডা মাথায় পুরো বিষয়টি আগাগোড়া ভালো করে ভেবে দেখলো ইমন। না, কোনো খুঁত নজর পড়ছে না। কোথাও এমন কোনো আলামতের নজির নেই যা থেকে এ ঘটনার সঙ্গে তাকে জড়ানো যায়। অনেকবার ভেবে, অনেক যত্ন করে, অতি সাবধানে সবদিক বিবেচনা করে, সব রকম ভুল এবং অসতর্কতার সম্ভাবনা মাথায় রেখে ছক কাটা হয়েছে। যেমনটি ভাবা হয়েছিলো, ঘটনাপ্রবাহ এখন পর্যন্ত সেভাবেই চলছে।

কোথাও কোনো বিচ্যুতি নেই। ঠোটের কোনে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে ইমনের। পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বের করে চিমটি কেটে একটি শলাকা তুলে ঠোটে গুজে দেয়। আজকাল জার্নিতে কোনো শান্তি নেই। সব জায়গায় নো স্মোকিং।

দুরপাললার কোনো ভ্রমন এখন আগের মতো উপভোগ্য নয়। একটু অস্থিরতা নিয়ে দ্রুত টান দেয় সিগারেটে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাস ছেড়ে দেবে। একবার বাস ছাড়লে আগামী তিন-চার ঘন্টার মধ্যে আর থামাথামি নেই। পরের স্টপেজ হাইওয়ের পাশে কোনো রেস্টুরেন্ট।

এর আগ পর্যন্ত ধোয়া টানা বন্ধ। সিগারেটের শেষ অংশটা পায়ে পিষে বাসের সিড়িতে পা রাখে ইমন। অসাবধানে কাঁধের ছোট্ট ব্যাগের হুক আটকে যায় তার পেছন পেছন বাসে উঠতে থাকা যাত্রীর পাঞ্জাবির বোতাম ঘরে। মুহুর্তেই ফড়াৎ শব্দ করে পাতলা সিল্কের পাঞ্জাবির অনেকটা ছিঁড়ে যায়। ব্যপারটা এতোই আচমকা ঘটে, দুঃখ প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলে ইমন।

মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নেয়, মাফ করবেন। একদমই বুঝতে পারিনি। ছিছি, কি বিচ্ছিরিভাবে ছিড়ে গেল আপনার পাঞ্জাবিটা। ইমনের কন্ঠে ক্ষমা প্রার্থনার আšতরিক সুর। তার কথা শুনে স্মিত হাসে মাঝ বয়সী লোকটা।

বেশ অবাক হয় ইমন। এমন ঘটনার পরতো লোকটির ক্ষেপে উঠার কথা। এমনকি তেড়ে মারতে আসাও বিচিত্র নয়। আর সেখানে কিনা লোকটা হাসছে। আপনি লজ্জা পাবেন না।

ব্যপারটাতো আর আপনি ইচ্ছে করে ঘটাননি। এটা সামান্য একটা দুর্ঘটনা। মন খারাপের কিছু নাই। উল্টো ইমনকেই সাšতনা দিচ্ছে লোকটা। যাক বাবা, এ যুগেও তাহলে এমন মানুষ আছে! ইমনের মনে পড়ে সিরাজগঞ্জ হাইস্কুলের দ্বীন ইসলাম স্যারের কথা।

স্কুলে অন্য শিক্ষকরা যেখানে ছিলেন ছাত্রদের কাছে মুর্তিমান আতঙ্ক, দ্বীন ইসলাম স্যার সেখানে যেন দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। ছাত্রদের সঙ্গে ছিলো তার অšতরঙ্গ সম্পর্ক। মৃদুভাসী এই শিক্ষককে কেউ কখনো রাগতে দেখেনি। যে যতো বড় অপরাধই করুক না কেন, সেই অপরাধীকে নিঃশর্ত ক্ষমা করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো এই শিক্ষকের। চলতি বাসে বসে প্রায় দুই যুগ আগের স্কুলের দিনগুলোর কথা ভেবে স্মৃতিকাতর হয়ে উঠে ইমন।

স্কুল জীবনে দুরšতপনা আর দুর্ধর্ষ দুষ্টুমির জন্য কুখ্যাত ছিলো সে। স্কুলের শিক্ষকদের নানাভাবে নাজেহাল করে একধরণের বিকৃত আনন্দ পেতো ইমন। অবশ্য সে জন্য কম মাশুল গুনতে হয়নি। স্কুলের স্যারেরা কতোগুলো জালিবেত ইমনের পিঠে ভেঙ্গেছেন তার হিসেব রাখা কঠিন। তবে দ্বীন ইসলাম স্যারের ক্ষেত্রে ছিলো আলাদা হিসাব।

এই শিক্ষককে আগাগোড়াই সম্মান জানিয়ে এসেছে সে। সব সময় স্বভাববিরুদ্ধ ভালো ব্যবহার করেছে সে এই স্যারের সঙ্গে। বাসে উঠার মুহুর্তে এমন একটি ঘটনা ঘটায় কিছুটা চিšতায় পড়ে ইমন। উপর থেকে যতোই আধুনিক, স্মার্ট, প্রগতিশীল আর সংস্কারমুক্ত মনে হোক না কেন, আসলে ভেতরে ভেতরে ইমন ভয়ানক কুসংস্কারে বিশ্বাসী। ঘর থেকে বেরুবার মুখে কখনো খালি জগ বা ঝাড়– দেখলে সেটাকে অশুভ বলে মানে।

আজ বাসে উঠার মুখে এই ঘটনাটিও তাই ইমনকে চিন্তায় ফেলে দেয়। এ ঘটনার সুদূরপ্রসারী কোনো প্রতিক্রিয়া আছে কিনা সেই হিসেব বিচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইমন। নাকের সামনে এগিয়ে আসা রোগা হাড় জিরজিরে একটি হাত চিšতার ব্যঘাত ঘটায়। টিকেট। হাতের মালিকের গলা শোনা যায় এবার।

মনে মনে বিরক্ত হয় ইমন। তবে সেই বিরক্তিটুকু চেপে পকেট হাতড়ে টিকেট বের করে লোকটির হাতে ধরিয়ে দেয়। এসব এসি বাসের টিকেট চেকারদের আজকাল নানা কায়দা হয়েছে। ফুলহাতা সার্টের সঙ্গে গলায় টাই বেধে চিবিয়ে চিবিয়ে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। এদের আবার বাসের কন্ডাকটার বলা বারণ, বলতে হয় সুপারভাইজার।

আপনের সিটতো ডি ফোর, এইখানে সবছেন কেন? নিজের সিটে গিয়া বসেন। ইমনের বিরক্তি এবার বিষ্ময়ে রুপ নেয়। আরে, বলে কী! বাসের অর্ধেক সিটই যেখানে খালি সেখানে কে কোথায় বসলো সেটা নিয়ে এই ব্যটার মাথা খারাপ কেন? আর ইমনের পাশের সিটেই একেবারে গ্যাদা একটা বাচ্চা নিয়ে আপাদম¯তক বোরখায় ঢাকা এক মহিলা বসা। একটু পরপরই বাচ্চাটা ট্যা ট্যা করে কেঁদে উঠছে। আর প্রতিবারই বোরখায় ঢাকা মা প্রবল বেড়ে বাচ্চাকে ঝাকাতে থাকে কান্না থামানোর জন্য।

এতে বাচ্চাটির কান্না না থেকে বরং আরো বেড়ে যাচ্ছে। এই মহিলার পাশে বসলে বাচ্চার ট্যা ট্যা কন্নার পাশাপাশি বাচ্চাকে ঝাকানোর সময় কনুইয়ের দু-চারটি গুতো উপরি হিসেবে যুটবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব ভেবেই পেছন দিকের এই ফাকা সিটটাতে বসেছে ইমন। বাসের টাই পরা সুপারভাইজারকে সে কথাই বোঝানোর চেষ্টা করলো। তাল গাছের মতো লম্বা রোগা সুপারভাইজার আগে থকেই কুজো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।

সম্ভবত বাসের ছাদে মাথা ঠেকে যাওয়ার ভয়ে। এবার আরো কিছুটা কুজো হয়ে ইমনের দিকে ঝুকে আসে। তার মুখ থেকে আসা দুর্গন্ধে নাড়িভুড়ি উল্টে আসে ইমনের। না স্যার, আমাদের বাসের নিয়ম হচ্ছে যার যেই সিট নম্বর সেখানেই বসতে হবে। বাস খালি গেলেও প্যাসেঞ্জাররা সিট বদলাতে পারবে না।

আরে, মগের মুললুক নাকি। বাসের সিট খালি থাকলেও আমি আমার ইচ্ছেমতো সিটে বসতে পারবো না? এটাই নিয়ম। দরকার হইলে চিটাগাং গিয়া বাস থেইকা নাইমা যাইয়েন। ইচ্ছা হইলে পৌছানোর পর অফিসে আমার নামে অভিযোগ দিয়েন। কিন্তু এখন নিজের সিটে গিয়া বসেন।

আরো কয়েকবার সুপারভাইজারকে বোঝানোর চেষ্টা করে ইমন। কিন্তু এই বান্দা পাথরের মতো শক্ত মুখ করে বার বার বাস কোম্পানির উদ্ভট নিয়ম আউড়ে যায়। ছোটবেলার পাড়ার আদুভাই বক্করের কথা মনে হয় ইমনের। এরকমই তাল গাছের মতো লম্বা ছিল বলে পাড়ায় সবাই তাকে ডাকতো ঢ্যাঙ্গা বক্কর বলে। ঢ্যাঙ্গা বক্কর প্রতিবছরই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয় আর নিয়ম করে ফেল করে।

তার অবসর বিনোদন ছিলো পাড়ার ছোট ছেলেদের ধরে ধরে মার দেওয়া। ইমনযে কতোবার এই বক্করের হাতে নাজেহাল হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। অবশ্য বক্করের এধরনের মামদোবাজির জবাবা একদিন ইমনরা কয়েকজন মিলে বেশ ভালোভাবেই দিয়েছিলো। সন্ধ্যার পর একদিন স্কুল মাঠে তারা কয়েকজন মিলে চালের ব¯তায় মুড়ে বক্করকে আচ্ছামতো পিটিয়ে ছিলো। এই সুপারভাইজারের ঘাড় ত্যাড়ামি দেখে আজ অনেক বছর পর বাসের বক্করের কথা মনে পড়ে গেল।

এক ঘুসিতে সুপারভাইজারের পিরামিডের মতো ত্রিভুজাকৃতির নাকটাকে সমান করে দেওয়ার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করে ইমন। একরাশ বিরক্তি মনে চেপে নিজের সিটে গিয়ে বসে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। সামনে অনেক বড় কাজ পড়ে আছে। এখন কোনো খুচড়ো ঝামেলায় জড়ানো যাবে না।

নির্দিষ্ট পাতাটি ছিড়ে নেয়ার পর সুপারভাইজারের ফেরত দেয়া টিকেটটা পকেটে রাখতে গিয়ে চমকে উঠে ইমন। পাঁচশ টাকার নোটগুলোতে প্যান্টের এই পকেটেই থাকার কথা, কিন্তু নেইতো! তন্নতন্ন করে এ পকেট-সে পকেট হাতড়েও এক তাড়া নোটের কোনো হদিস মিললো না। মনে কোনে একটা সন্দেহ উঁকি দেয়। বাসের দুই সারি সিটের মাঝে সরু পথটি দিয়ে আসার সময় এক লোক হুমড়ি খেয়ে তার উপর পড়েছিলো। এটা তারই কাজ নয়তো! নানান চিšত ইমন কিছুটা অন্যমনষ্ক ছিলো বলেই ওই এই পকেট মারার সুযোগ পেয়েছে ব্যটা।

ওইতো পেছনের সিটেই বসে আছে শুটকোমতোন সরু গোফের লোকটা। আড়ে আড়ে ইমনের দিকেই তাকাচ্ছে। চেহারায় একটা চোর চোর ভাব। তার পকেট হাতড়ানো দেখে কেমন নার্ভাস হয়ে পড়েছে চোরটা। আচ্ছা, সরাসরি গিয়ে চ্যালেঞ্জ করলে কেমন হয়? মুহুর্তেই চি¯তাটা বাদ দিয়ে দেয়।

মাত্র হাজার পনেরো টাকার জন্য এই হুজ্জোতের কোনো মানে হয়না। বরাবরই জার্নিতে বিভিন্ন স্থানে ভাগ করে টাকা রাখার অভ্যেস ইমনের। বাবা বলতেন, এতে কওে পকেটমার হলেও সব টাকা খোয়া যাবে না। এই উপদেশের সুফল এখন পুরোপুরি টের পাচ্ছে ইমন। তাছাড়া, নিজেকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয়, কোনো রকম ঝামেলায় জড়ানো যাবে না।

যা হওয়ার হয়েছে। মনের তিক্ত ভাবটা ভুলে যাওয়ার জন্য সিটটাকে পেছনে হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে। একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। দু চোখের পাতা এক করার সঙ্গে সঙ্গেটড পকেটে রাখা সেলফোনটা কেঁপে উঠে। অহনার ফোন।

হ্যালো, সব কিছু ঠিকঠাক আছেতো? কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করে ইমন। হু। ফোন করেছো কেন? একা একা কেমন ভয় ভয় লাগছে, কিছুতেই ঘুম আসছে না। একটা সিডেটিভ খেয়ে নাও। আর শোন, তোমাকে কতোবার বলেছি, এখন কয়েকদিন এমন রাতবিরাতে হুটহাট আমাকে ফোন করবে না।

পরিস্থিতি ঠান্ডা না হওয়া পর্যšত আমাদের অনেক বেশি সাবধান থাকতে হবে। নাও, এখন শুয়ে পড়ো। সকাল ১০টার দিকে আমি ফোন করবো। গুডনাইট জান, লাভ ইউ। পাশের সিটের বোরখাওয়ালীর কান বাঁচিয়ে শেষের কতাটা নীচুস্বরে বলে ফোন রেখে দেয় ইমন।

বাসের সিটে হেলান দিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে। নানা রকম চিšতা খেলতে থাকে মনে। অহনার সঙ্গে পরিচয়টা ইমনের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। নাকি দুর্ঘটনা? আরিফের বিয়ের দিন প্রথম অহনাকে দেখা। নববধুর সাজে।

প্রথম দেখায় প্রেম- এই জাতীয় স¯তা সেন্টিমেন্টে কখনোই বিশ্বাস করেনি ইমন। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রেই ব্যপারটা ঘটে গেল। অনুষ্ঠানের পুরো সময়টাতে এক মুহুর্তেও জন্যও অহনার উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি ইমন। তার গভীর কালো চোখদুটো চুম্বকের মতো আটকে ফেলে ইমনের দৃষ্টিকে। লম্বা একহারা গড়নের অহনার দৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার চেহারার আভিজযাত্য।

বিয়ের আসরে বসে থাকা অহনাকে মনে হচ্ছিলো প্রচীনকাল থেকে উঠে আসা কোনো স¤্রাজ্ঞী, তাকে ঘিরে থাকা বাকি সবাই তার আজ্ঞাবহ প্রজা সামšত। আহনার প্রতি তার এই অমোঘ আকর্ষনটাই আ¯েত আ¯েত রূপ নেয় আরিফের প্রতি তীব্র ঘৃণায়। কেন আরিফের আগে তার সঙ্গে অহনার দেখা হলো না? ওই হোতকা মাথামোটাটার কী যোগ্যতা আছে অহনার মতো একজন অপ্সরীকে অধিকার করার? ভেতরে ভেতরে রাগ, ক্ষোভ আর হতাশায় জ্বলে পুরে খাক হয়ে গেলেও সামনাসামনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু এবং বিজনের পার্টনার আরিফের সঙ্গে কোনো রকম ঝামেলায় জড়ায়নি ইমন। এটাই ইমনের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভেতরের অন্ধকারগুলোকে কোনোভাবেই চেহারায় প্রকাশ পেতে দেয় না।

এই গুনটির জন্য অতীতেও অনেক ব্যপাওে সুবিধা পেয়ে এসেছে; এবারও তার এই গুনটাই সাফল্যে পৌছাতে সাহায্য করেছে। অহনার কৃপাদৃষ্টি তার উপর পড়তেই ছক কাটতে শুরু করে ইমন। সকলের সন্দেহের দৃষ্টি বাঁচিয়ে কিভাবে আরিফকে সরিয়ে দেয়া যায় এ নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে ক্রমাগত ভেবেছে। প্রায় এক ডজন আইডিয়া থেকে অনেক যাচাই-বাছাই করে পরিকল্পনা চূড়াšত করা হয়েছে। একেবাওে নিখুঁত পল্যান।

এমন একটি অসাধারণ পরিকল্পনার জন্য নিজেকেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে হয় ইমনের। অবশ্য অহনার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাই পরিকল্পনাটিকে বা¯তবে রূপ দেয়া সম্ভব হতো না। গত পরশু ব্যবসার কাজে চায়না গিয়েছে আরিফ। ইমনেরও সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটা অযুহাত তুলে কাটিয়ে দিয়েছে।

সেদিন রাতেই চায়নার হোটেল এসেছে সেই কাঙ্খিত ফোন। কোটেল রুমে মৃত পাওয়া গেছে আরিফকে। কীভাবে মৃত্যু হলো, প্রাথমিক তদšেত তা জানা যায়নি। এর পরের অংটাই ছিলো সবচেয়ে কঠিন। ইমনের ভয় ছিলো, অহনা পুরো বিষয়টি ঠিকঠাকভাবে সামলাতে পারবে কিনা।

কারণ এরপর পরিকল্পনাটির সফলতার পুরোটাই নির্ভর করছে অহনার উপর। লক্ষী মেয়েটা দারুনভাবে সব সামলেছে। দুঃসংবাদটি পেয়ে সতী সাধ্বী স্ত্রীর মতো অধিক শোকে (!) পাথর হয়ে গেছে। কোনো কান্নাকাটি নয়, কোনো বিলাপ-আক্ষেপও নয়। একেবারে নির্বাক।

অহনার এই পার্ফমেন্সে দারুন খুশি ইমন। বরং কান্নাকাটি করতে গেলেই বিপদ হতে পারতো। মায়াকান্না সহজেই ধরা পড়ে যায়। এর আগে ইমনকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে মালমশলা যোগারে। সাভারের বেদেপল্লী থেকে বিষধর জাত গোখরার বাচ্চা আনাটাই ছিলো সবচেয়ে কঠিন কাজ।

বাকিটা ছিলো খুবই সহজ। আরিফের হ্যান্ড ব্যাগের মতো হুবুহু একটা ব্যগ কেনা। গোখরা সাপ ভরা ব্যগটিকে আরিফের হ্যান্ড ব্যাগের সঙ্গে পাল্টে দেয়ার কাজটি করেছে অহনা। ব্যাগবন্দি সাপটি অপরিচিত এবং অস্বস্তিকর পরিবেশে ভয়ে, আতঙ্কে আর ক্ষোভে ফুসে ছিলো আগে থেকেই। প্রথম সুযোগেই এক ছোবলে শরীরের সবটুকু বিষ ঢেলে দিয়েছে শত্রুর গায়।

হোটেল রুমে ব্যাগে হাত ঢোকানোমাত্রই তীব্র দংশনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আরিফ। আর সহজাত প্রবৃত্তিতে বিষধর শরিসৃপ বৈরী পরিবেশ ছেড়ে বেরিয়ে এসে হোটেল কক্ষের অন্ধকার কোনো একটি কোনকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে। এ কারনেই আরিফের মৃত্যুর কারনটি প্রাথমিক অবস্থায় বোঝা দুষ্কর। ঘটনাস্থল থেকে হাজার মাইল দুওে বসে থাকা ইমন কিংবা অহনাকে এই হত্যার সঙ্গে জড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব না। আরিফের বড় ভাই আর বোনজামাই ডেডবডি আনার জন্য চায়না যওয়ার বন্দোব¯ত করছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে থাকা কিছু পণ্য খালাসের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ছুটতে হচ্ছে ইমনকে। এই অবস্থায় অহনাকে একা রেখে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না। এসি বাসের আরামদায়ক শীতলতা আর পথের মৃদু ঝাকুনিকে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলো ইমন। পাশের সিটে বাচ্চাটির ট্যাট্যা কান্নায় ঘুম ছুটে যায়। পাশ ফিরে আবারও ঘুমানোর আয়োজন করে।

গত কয়েকদিনের তীব্র মানষিক চাপের পর একটু বিশ্রাম দারুন দরকার হয়ে পড়েছে। কেমন একটা অস্ব¯িতর জন্য কিছুতেই চোখ বন্ধ রাখা যাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে এক্ষুনি চোখ খুলে কিছু দেখতে হবে। কী যেন একটা দারুন দরকার! সোজা হয়ে বসে এদকি-সেদিক তাকায় ইমন। চোখ পড়ে পাশের সিটে।

মাতা থেকে পা পর্যšত কালো বোরখায় ঢাকা সহযাত্রীর শরীরের একমাত্র উন্মুক্ত অংশ, দুটি চোখ দিয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরিফের দিকে। ওই দৃষ্টির সামনে এক অজানা ভয় আর অস্ব¯িত কুঁকড়ে যায় ইমন। আ¯েত আ¯েত চোখের ভাষা কেমন চেনা চেনা মনে হয়। ওই দুটি তীব্র চোখ যেন ইমনকে কোনো অশুভ বার্তা দিচ্ছে। সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকে ইমন।

সহযাত্রী এবার আ¯েত আ¯েত নেকাব সরায়। পাথরের মতো মুখটা দেখে কী একটা কথা মনে পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ছেনা ইমনের। এই মুখ আগে কোথায় দেখেছে? হঠাৎ করেই অনেকগুলো ঘটনা একসঙ্গে মনে পড়ে যায়। ইউনির্ভার্সিটি থেকে পাশ করার পর কয়েক বন্ধু মিলে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো। সেখানে ছুটা কাজ করতো কুসুম।

অত্যšত কৌশলে ধীরে ধীরে কুসুমের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে ইমন। যখন অন্য বন্ধুরা বাড়ির বাইরে থাকতো, বেশিরভাগ সময় নানা উছিলায় বাড়িতে একা থাকতো ইমন। উদ্দেশ্য, কুসুমকে পটানো। বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া সুদর্শন যুবক ইমন সহজেই গরীব মেয়ে কুসুমকে কব্জা কওে নেয়। একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো খবরটা জানায় কুসুম, সে প্র্যাগনেন্ট।

ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। অ্যাডভান্স স্টেজ। বিয়ের জন্য ইমনকে চাপ দেয় কুসুম। সুচতুর ইমন ঘাবড়ে গেলেও বুদ্ধি হারায় না। অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে একটা অখ্যাত ক্লিনিকে এমআর করানোর জন্য কুসুমকে নিয়ে যায় ইমন।

পরীক্ষার পর হাতুড়ে ডাক্তার জানায় রোগীর জীবন সংশয় হতে পারে। মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে গর্ভপাতে রাজি করায় ইমন। বিপর্যয় যেটা আশঙ্কা করা হয়েছিলো, সেটাই ঘটে। অপারেশন টেবিলেই মৃত্যু হয় কুসুমের। ইমন আর সেই হাতুড়ে ডাক্তার একসঙ্গেই ক্লিনিক ছেড়ে পালায়।

আজ এতোদিন পর এই পাশের সিটে কুসুম বসে আছে। এটা কীভাবে সম্ভব! তীব্র আতঙ্ক আর অবিশ্বাস নিয়ে কুসুমের দিকে তাকিয়ে থাকে ইমন। এই বাসে উঠার পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একে একে মন পড়তে থাকে। সবগুলোর মধ্যে বুক কাঁপানো অদ্ভুত এক যোগসূত্র খুঁজে পায় ইমন। প্রথমে সেই বৃদ্ধ, যার পাঞ্জাবি ছিড়ে গিয়েছিলো।

সেই বৃদ্ধের কাছ থেকে খুব অমায়িক ব্যবহার পেয়েছে ইমন, যার চেহারার সঙ্গে দ্বীন ইসলাম স্যারের অদ্ভুত মিল। অনেক দিন আগে মারা যাওয়া স্যারের মুখটা আজো পরিষ্কার মনে আছে ইমনের। এই স্যারের সঙ্গে সব সময়ই খুব ভালো ব্যবহার করেছে ইমন। সেই মৃত ব্যক্তি কী সেই ব্যবহারেরই প্রতিদান দিলো তাকে? এরপর ঢ্যাঙ্গ বক্কর, যে কিনা সব সময় নাজেহাল করতো ইমনকে। আজোকী সেটাই করলো না? ইমন যখন কলেজে পড়ে তখনই টাইফয়েডে মৃত্যু হয় বক্করের।

পকেট মারের ঘটনাটিও ইমন এখন ঠিক ঠিক মেলাতে পারছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের রুমমেট আশফাকের ট্রাঙ্ক খুলে কতোদিন যে তার টিউশিেনর জমানো টাকা চুরি করেছে ইমন তার উয়াত্তা নেই। আশফাকের ট্রাঙ্কের ডুপ্লিকেট চাবি তার কাছে ছিলো, গাধাটা কখনোই সেটা বুঝতে পারেনি। ‘বাসচাপায় ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু’ শিরোনামে কিছুদিন আগেই আশফাকের মৃত্যু সংবাদটি পড়েছে ইমন। সরু গোফের আশফাকই যে আজ সুযোগ বুঝে ইমনের পকেট থেকে টাকা হাতড়ে নিয়েছে এতে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই।

মৃত ব্যক্তিরা আজকে সবাই অন্যভুবন থেকে এসেছে ইমনের সঙ্গে পার্থিব জীবনের হিসাব চুকাতে। এয়ারকন্ডিশনের শীতলতাতেও দরদর করে ঘামতে থাকে ইমন। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এক ফোটা বাতাসের জন্য ফুসফুস ছটছট করতে থাকে। কুসুমের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায় ইমন।

তীব্র আতঙ্ক নিয়ে চারদিকে তাকায়। প্রতিটি সিটে বসে থাকা যাত্রী নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, যেন পাথর খুদে বানানো। একএকটি মুখের দেি তাকাচ্ছে, আর আতঙ্কে শিউরে উঠেছে ইমন। প্রত্যেকটি মুখই দারুন পরিচিত।

শুধু চালকের চেহারাটি ইমন দেখতে পাচ্ছে না। গভীর মনোযোগে এই মৃত্যুপথের চালক গাড়ি চালাচ্ছে। আতঙ্কেও শেষ সীমায় পৌছে বিস্ফোরিত চোখে ড্রাইভিয় সিটের দিকে তাকিয়ে থাকে ইমন। চালকের পেছন দিকটা তার খুবই পরিচিত। ইমনের ধারণাকে নির্ভুল প্রমান করে দিয়ে চালকের আসন থেকে ধীরে ধীরে তার দিকে মুখ ঘোরায় আরিফ।

অন্য সবার মতো পাথর চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কাঁচের মতো মসৃন পথ ধরে তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাসটি। ক্রমেই গতি বাড়ছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।