আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নস্টালজিয়া

কবে যাবো পাহাড়ে... কবে শাল মহুয়া কণকচাঁপার মালা দেব তাহারে.... ১৯৯২ সালের কোনো একদিন। বর্ষাকালের প্রথম বর্ষণ। সকাল থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা, আর মাঝেমধ্যে গুড়ুগুড়ু ডাক। তারে ধোয়া কাপড় মেলে দিয়ে গৃহিণীরা খুব তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন বাইরে; বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা মাটিতে পড়ামাত্র চিলের মত ছোঁ মেরে কাপড়গুলো তুলে নিয়ে আসবেন ঘরে। গরু-বাছুরদের আজ গোয়ালঘর থেকে বের করা হয়নি, হাঁস-মুরগীও আজ গৃহবন্দী।

গ্রামের নাম বানিয়াজুরী, আমার বয়স তখন ছয়। ক্লাস টু’তে পড়ি। আমার মায়ের মত মা কপালে থাকলে স্কুল কামাই করা অসম্ভব। এতটুকুন বয়সেই মেঘলা দিনে আমার মন উদাস উদাস হয়। উদাস না ছাই, স্কুল কামাইয়ের বাহানা দরকার।

কোনো লাভ হয়না, স্কুল যেতেই হয়। দুপুরবেলায় যখন স্কুল থেকে ফিরেছি, ততক্ষণে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এসেছে, বৃষ্টি নামলো বলে! নাওয়া-খাওয়া ভুলে জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করছি। শেষ পর্যন্ত নামলো সেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি। আমি আম্মুর কাছে আবদার করলাম, বৃষ্টিতে ভিজবো। আমার সাথে সাথে আমার ছোট ভাইও একই সুরে গান ধরে।

আম্মু তার স্বভাবমতো একটা রামঝাড়ি দিলো। তবে খানিক পরেই বললো, “বৃষ্টিতে ভিজে কি করবা? শুধু বাইরে গিয়ে হাঁ করে বৃষ্টির পানি খাবা? তার চেয়ে একটা কাজ করো। ফুটবলটা নিয়ে যাও। আর ওয়াহিদ ভাইয়াকে ডেকে দেখো আছে কিনা...” এর পরে হয়তো আম্মু আরো কিছু বলছিলো, তবে সেটা শোনার জন্য বসে থাকিনি। এক ছুটে বাইরে।

বৃষ্টিতে ফুটবল খেলার জন্য ঘাস-ঢাকা মাঠের চেয়ে কর্দমাক্ত উঠোন অনেক বেশি শ্রেয়। তাই, আমরা কাদা-প্যাঁচপ্যাচে উঠানে নামলাম। কিসের খেলা, কিসের কী? মিনিটে দু’বার আছাড় খাওয়া, আর খিলখিল করে হাসা। একটা খেলা আবিষ্কার করলাম- একবার আছাড় খেয়ে পিছলে বেশ কিছুদূর চলে যাওয়া যায়। এর পর থেকে ইচ্ছে করে আছাড় খাচ্ছি, আর পিছলে ছেঁচড়ে উঠোনের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছি।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আম্মু আমাদের তামাশা দেখছিলো আর মিটিমিটি হাসছিলো। মোটামুটি দশ বছর পরের আরেক বর্ষাকাল। ঢাকার মোহাম্মদপুরে রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের একটা মাঠ। বৃষ্টি পড়ছে, মাঠ পুরো কাদা-পানিতে মাখামাখি। আমরা হাফপ্যান্ট আর খালি গা, কেউ কেউ স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে।

সবাই খালি পায়ে খেলছে। আমি গোলকীপার। গোলপোস্টের সামনে একগাদা পানি; ওখান থেকে কেউ শট নিলে গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে কিছুই দেখা যায় না। তাই, কেউ বল নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকলে আমি আগে থেকেই গিয়ে তার সাথে ধাক্কা লাগাচ্ছিলাম। রেফারী নেই, কাজেই ফাউলের বালাই নেই।

আমিও কোনো আহামরি খেলোয়াড় নই, বরং খেলতে পারিনা বলেই গোলকীপার হয়েছি। তবে নাদুস নুদুস মোটাসোটা শরীরের একজন লোক তার দিকে ছুটে আসছে দেখে বেশিরভাগ প্লেয়ারই বল ছেড়ে দিয়ে নিজের গা বাঁচানোর চেষ্টা করে। একটা সময় খেলা শেষ হলো। একেকজনকে দেখে মনে হচ্ছে সুইয়ারেজ লাইনের সুইপার, এইমাত্র কোনো একটা ম্যানহোল পরিষ্কার করে এলাম। একটা ছোট্ট পানির কল, সেটাতে হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি করে সবাই নিজেদের হাত-পা ধুলাম।

আমার পা ধুতে গিয়ে খেয়াল করলাম, পায়ের তালু কেটে রক্ত ঝরছে। সেটাকে রুমাল দিয়ে বেঁধেছেঁদে বাসায় ফিরলাম। বাসায় এসে নিজের ময়লা কাপড় নিজের ধুতে হয়েছিলো। তারপর সারা গায়ে ব্যাথা, ঠান্ডা-কাশি লেগে একাকার অবস্থা। তবে, সেদিন না খেললে আজকের এই মেঘলা দিনে একেলা ঘরে বসে নস্টালজিক হবার কোনো উপলক্ষ খুঁজে পেতাম না হয়তো।

এখন ২০১১ এগারো সাল। আমি যুক্তরাষ্ট্রের ছোট্ট একটা ইউনিভার্সিটি টাউনে আমার ছোট্ট এপার্টমেন্টে বসে আছি। আজকের দিনটাও মেঘলা। তাপমাত্রা ১০ এর নীচে নেমে যাচ্ছে অহরহই। ছুটির দিন।

কোনো কাজ নেই। সব দরজা-জানাল বন্ধ করে ঘরে বসে আছি। ছোট্ট জানালা দিয়ে আকাশ দেখলে আকাশটাকেও বড় ক্ষুদ্র মনে হয়। সেই ক্ষুদ্র বর্গাকৃতি ফ্রেমের আকাশে কিছু কিছু মেঘ ভেসে ভেসে আসছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে। আজকালের মধ্যে বৃষ্টি হবার কথা, সেটারই জোর প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে চারপাশে।

মনটা আজও কোথাও হারিয়ে যেতে চাইছে। আজকেও ফুটবল খেলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। আজকেও পাড়া মাথায় তুলে বর্ষা উদযাপন করতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে একটা রিমোটের রিওয়াইন্ড বোতাম চাপতে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।