আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যে নামেই ডাকো দুগ্গা, ইনান্না বা আনাত ...

অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করে কিন্তু গুছিয়ে লিখতে পারি না ... রক্ষা, নিধন, শক্তির প্রতীক হিসেবে দেবীপুজোর রেওয়াজ চালু রয়েছে প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যেও। এমনকী সাহেবসুবোরাও ‘জয় মা!’ বলেই ডেকে থাকেন। শরৎকালে দুর্গা আসেন বাপের বাড়ি, ধুমধাম করে এখানে তখন তাঁর পুজো হয় চার দিন ধরে। দুর্গার সঙ্গে আসেন তাঁর চার ছেলেমেয়ে। তবে মহাদেব ব্যোমভোলা হলে কী হয়, এ বেলা জ্ঞান টনটনে, দুর্গার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কোনও ব্যাপার নেই, কৈলাসেই ছুটি কাটান নন্দীভৃঙ্গীর সঙ্গে (আঃ, ক’দিন একটু নিশ্চিন্ত)! অবশ্য তাঁকে বাদ দিয়ে আবার দুর্গাপুজো কেমন করে হবে, তাই প্রতিমাশিল্পীরা চালচিত্রের চুড়োয় মহাদেবের ছবিটা আঁকতে ভোলেন না।

এই অবধি না হয় ঠিকই আছে। দুর্গা সপরিবারে, যে যাঁর বাহনে চেপে কৈলাস থেকে বাংলায় চলে আসতেই পারেন, কিন্তু মরা মোষ আর তার থেকে বেরিয়ে আসা অসুরটাকে আধমরা অবস্থায় এতটা রাস্তা টানতে টানতে নিয়ে আসার কারণটা কী? কোথায় বচ্ছরকার দিনে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসার সময় মেজাজটা ফুরফুরে থাকবে তা নয়, রণরঙ্গিণী মূর্তিতে চোখ পাকিয়ে দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র বাগিয়ে আসা, এটা কী রকম ব্যাপার? আর বাপের বাড়িটা যেন হিমালয়ে বলেই শোনা যায়, তা হলে বাংলায় আসায় কারণটাই বা কী? নাঃ, সব বড্ড গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আসলে গোলমালটা তো অন্য জায়গায়। শাস্ত্রে লেখে এক রকম, আর মানুষ কল্পনা করে নেয় আর এক রকম। সাধারণ মানুষের বয়েই গিয়েছে পুথিপত্র পড়তে।

শুধু এখানে নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই একই ছিরি, আর শুধু আজকে নয়, হাজার হাজার বছর ধরেই। দেবদেবীদের শুরু তো লেখালিখির অনেক আগেই। শক্তির প্রতীক হিসেবে সিংহ সেই সুদূর অতীত থেকে কত সভ্যতায় যে মর্যাদা পেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই ব্রিটিশ সিংহ তো এই সে দিন পর্যন্ত আমাদের ঘরের কথা। আর উর্বরতা শক্তির প্রতীক হিসেবে দেবী-আরাধনাও সৃষ্টির আদি কাল থেকেই। সাধারণ মানুষের এ ছাড়াও দেবীকে নানা ভাবে প্রয়োজন হয়েছে।

দেবী অসুর নিধন করে যুদ্ধ জয় করেন, মানব ও জীবকুলকে পালন করেন, কোনও বিশেষ দুর্গ বা নগরকে রক্ষা করেন অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে। এই সব ভাবনা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর নানা অঞ্চলে মিলেমিশে গিয়ে সিংহবাহিনী দেবীকে কল্পনা করে নিয়েছে। এক জন নন, বহু জন। ফলে অন্তত ছ’হাজার বছর আগে থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমরা বহু সিংহবাহিনী দেবীর অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি। শুধু ভারতে নয়, ভারতে তো সিংহবাহিনীর পাথুরে প্রমাণ পাচ্ছি হাজার দুই বছরের কিছু আগে থেকে।

কিন্তু এর বাইরে যে বিশাল ভূখণ্ডে সিংহবাহিনীর বিচরণ, পশ্চিমে তার সীমা ক্রিট দ্বীপ (মিনোয়ান সভ্যতার জন্য বিখ্যাত), উত্তরে আনাতোলিয়া (তুরস্ক), আর পুবে মেসোপটেমিয়া (সুমের, ব্যাবিলনমোটামুটি আধুনিক ইরাক)। সব জায়গায় সিংহবাহিনী যে আমাদের দুর্গার মতো সিংহের উপরে চড়ে যুদ্ধ করেছেন এমন নয়, বরং সিংহ-আসনে বসা অবস্থাতেই তাঁদের সবথেকে বেশি দেখা যায়। মজার বিষয়, একাধিক সিংহবাহিনী দেবীর সঙ্গে খোঁজ মেলে বৃষবাহন কোনও দেবতারও! যেমন আজকের ইজরায়েল, লেবানন, প্যালেস্তাইন, পশ্চিম জর্ডনঅর্থাৎ মোটামুটি জর্ডন নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত যে এলাকায় ব্রোঞ্জ যুগে কানানাইট-দের বাস ছিল, সেখানে দেখছি সিংহবাহিনী দেবী ‘আশেরা’কে, যাঁর সঙ্গে থাকেন বৃষবাহন ‘এল’, যিনি ওদের পুরাণে মহাদেবের মতোই দেবাদিদেব বলে গণ্য। ‘এল’-এর ছেলে ‘হাদাদ’ও বৃষবাহন, আবার তাঁর সঙ্গে পুরনো ভাস্কর্য-ফলকে দেখা যায় সিংহবাহিনী ‘আতারগাতিস’কে, বোধহয় একটু বেশি গুরুত্ব নিয়েই। সিরিয়ায় এই দেবীকে মানব ও জীবকুলের রক্ষক হিসেবেই দেখা হয়েছে।

সিরিয়া থেকে উত্তর মেসোপটেমিয়া, ভূমধ্যসাগর হয়ে গ্রিক-রোমক সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশ পর্যন্ত আতারগাতিসের প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। এতে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নেই। আতারগাতিসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আরও কয়েকজন কানানাইট দেবী ‘আশেরা’, ‘আনাত’, ‘আস্তারতে’র। খ্রিস্টের আগের দেড়-দু’হাজার বছরে পশ্চিম সিরিয়ায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই সিংহবাহিনীরা। অন্য দিকে সুমেরীয় সভ্যতায় দেবী ‘ইনান্না’ আর আসিরিয়ায় দেবী ‘ইস্তার’ একই পৌরাণিক ধারাবাহিকতায় অনেক বিস্তীর্ণ এলাকায়, অনেক বেশি দিন ধরে প্রভাব অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন।

ইনান্না সিংহবাহিত রথে চেপে যুদ্ধে যেতেন, সুমের-এ তাঁর অন্তত সাতটা মন্দির ছিল। ইস্তারও কিছু কম বিখ্যাত ছিলেন না। মিশরে পাচ্ছি সিংহবাহিনী ‘কুদশু’কে। তাঁর সঙ্গে আনাত, আস্তারতে-র যোগসূত্র নিয়ে পণ্ডিতেরা অনেক মাথার ঘাম ফেলেছেন, কিছুই নির্দিষ্ট করে বলা যায়নি। আবার দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার সিংহবাহিনী ‘হেবাত’কেই সম্ভবত পরে পশ্চিম এশিয়ায় ‘কুবিলি’ নামে পাই।

কুবিলি-র জন্ম দুর্গার মতোই পাহাড়ে। গ্রিক ‘অ্যাথেনা’-কেও তো সিংহবাহিনী রূপে দেখেছি, গ্রিক পুরাণে দেবাসুরের যুদ্ধে অসুরনিধনে তাঁর ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। পের্গামনের বিখ্যাত ভাস্কর্যে তার টুকরোটাকরা আজও দেখতে পাওয়া সম্ভব। ইরানের দেবী ‘অনহিতা’ও সিংহবাহিনী। আস্তে আস্তে আমরা ভারতের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম।

তবে এশিয়ার নানা প্রাচীন সভ্যতা থেকে সরাসরি সিংহবাহিনী দুর্গা কুষাণদের হাত ধরে ভারতে ঢুকে পড়লেন, এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। সিংহকে পেলেও আমরা মোষকে কিন্তু এই দেবীদের কারও সঙ্গে পাচ্ছি না। পরে অবশ্য ভারত থেকেই যে মধ্য এশিয়ায়, আফগানিস্তানে মহিষমর্দিনী দুর্গার পুজো ছড়িয়ে পড়েছিল তার কিছু কিছু নজির দেখা যায়। ভারতীয় ঐতিহ্যে দেবীকল্পনা ছিলই, পরে তার সঙ্গে নানা প্রতীক জোড়া হতে থাকে। গ্রিক, শক-পহ্লব, কুষাণ রাজাদের সময় উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার যে যোগসূত্র ছিল তার মাধ্যমেই এমন ভাববিনিময় ঘটে থাকতে পারে।

সব মিলিয়ে দুর্গা যেমন ব্রাহ্মণ্য সংস্কারে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন, পুরাণে লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছে তাঁর নানা কাহিনি, তেমনই পূর্ব ভারতে লোকাচারের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে পুরাণ-কল্পনা। তাই কৈলাস থেকে আসার সময় কোথায় ঠিক মোষটা ঢুকে পড়ল, যার জন্য দুর্গাকে আবার অস্ত্রশস্ত্র বার করে এত লড়াই করতে হল, আজ আর তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। যাক্, পুজোর মুখে আর এত গবেষণা করারই বা দরকার কী! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.