আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কলকাতার প্রথম বাড়ির পুজো, কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পুজো

চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি কলকাতার প্রথম বাড়ির পুজো বেহালা সখেরবাজার অঞ্চল। খানিকটা ভেতর দিকে গেলেই চোখে পড়বে দ্বাদশ শিবমন্দির। ঠিক ভগ্নদশা বলা যায় না, তবে রক্ষণাবেক্ষণ না করলে পরের প্রজন্ম হয়তো তাই-ই বলবে। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তারা। মোগল সেনাপতি মানসিংহ কামদেব ব্রহ্মচারীর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তার পুত্র লক্ষ্মীকান্তকে তিনটি গ্রামের জমিদারী দান করেন।

সাবর্ণ গোত্রীয় রায়চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে, শহর কলকাতার গোড়াপত্তন এই ঘটনা থেকেই। কলিকাতা, গোবিন্দপুর, সুতানুটী— এই তিন গ্রামের আর্থিক ও সামাজিক উন্নতির জন্য জমিদার লক্ষ্মীকান্ত, হালিশহরের আদি বসতি ছেড়ে বরিষায় (এখনকার বেহালার সখেরবাজার অঞ্চল) গৃহ নির্মাণ করলেন, সঙ্গে আটচালা দেবদালান এবং ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে আয়োজন করেন কলকাতা শহরের প্রথম পারিবারিক পুজো। মহানবমীর ১৫ দিন আগে দেবীর বোধন হয়। পুজো হয় “দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী” মতে ও “নবমাদী কল্পে”। প্রথম পুজোর আচারবিধি মেনেই হয়ে আসছে এই পারিবারিক দেবী আরাধনা।

পুজো দালানে তৈরি হয় মাতৃমূর্তি। ব্যবহৃত হয় সেই পুরনো কাঠামোই। সপ্তমী ও অষ্টমীতে পাঁঠা বলি এবং নবমীতে মোষ বলির প্রথা ছিল। ২০০৭ সাল থেকে পশুবলির জায়গায় হয় চালকুমড়ো, আখ বলি। দশমীর সিঁদুর খেলাও বেশ জনপ্রিয়।

পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠা, সারাদিন উপোস থেকে মাকে বরণ করেন, সিঁদুর দান করার পর বাকিরা তাঁকে সিঁদুর দিয়ে খেলা শুরু করেন। আগে নিয়ম করে আদি গঙ্গায় প্রতিমা নিরঞ্জন করা হত। দেবীকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হত। গত কয়েক বছর হল বিসর্জনের জন্য যাওয়া হয় বড় গঙ্গায়। আদি গঙ্গার দূষণের জন্যই এই ধারাবাহিকতা থেকে সরে এসেছেন পরিবারের সদস্যরা।

ষষ্ঠী থেকে নবমী অবধি মাছ ভোগই প্রধান। দশমীতে পান্তা ভোগ। লক্ষ্মীকান্তর পারিবারিক পুজোর দায়িত্ব বহন করে চলেছেন এ প্রজন্মের রতিকান্ত রায়চৌধুরী। আশি ছুঁই ছুঁই রতিকান্তবাবু বললেন, “সাবর্ণদের দুর্গাপুজোর পুরোহিত আগে আসত বাংলাদেশ থেকে। পরবর্তীকালে তাঁদের বংশধররা এ পেশায় না থাকায় এখন এখানকার পুরোহিতই পুজো সম্পন্ন করেন।

” পুত্রবধূ সাগরিকা রায়চৌধুরী জানালেন, “পুজোর দিনগুলি কোথা দিয়ে কাটে বোঝাই যায় না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পুজো দালানে আচার-বিচার-আনন্দে খাওয়াদাওয়া করে চারটে দিন যেন ফুৎকারে শেষ হয়ে যায়। সকল আত্মীয়-পরিজন মিলে দু’বেলা একসঙ্গে খাওয়া দাওয়ার মজাটাই আলাদা। ” আদি রায়চৌধুরী পরিবার বৃদ্ধি পেয়ে এখন বড়বাড়ি, মেজোবাড়ি হয়েছে। সে সব বাড়িতেও ঘটা করে দুর্গাপুজো হয়।

তবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে, শহর কলকাতার সব থেকে পুরনো পুজোর বয়স এখন ৪০২ বছর। কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পুজো “নমঃ মহিষগ্নি মহামায়ে চামুণ্ডে মুণ্ডমালিনী...” শারদোৎসবের চারটি দিন এই মন্ত্রোচ্চারণে গমগম করে আদি গঙ্গাতীরবর্তী ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট রোডের সমগ্র পরিবেশ। জাতি-ধর্ম, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল পল্লীবাসী অংশ নেন এই মহোৎসবে। ‘ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’ পরিচালিত এই দুর্গাপুজো এ বার ১০২ বছরে পদার্পণ করল। ১৯১০ সালে শুরু হওয়া এই পুজোই কলকাতা শহরের প্রথম বারোয়ারি পুজো।

অন্য ভাবে বললে বারোজন ‘ইয়ার’ বা বন্ধু মিলে যে পুজোর আয়োজন করা হয়, তাকেই বারোয়ারি পুজো বলে। উদ্দেশ্য? রাজ পরিবার, জমিদার বাড়ি বা পারিবারিক পুজোর বেড়া ভেঙে সকলে মিলে দেবী মা-কে আহ্বান করা। এখানে একচালার মাতৃমূর্তি। শিল্পী অরুণ পালের হাতে প্রাণ পায় এই মৃন্ময়ী সাবেকি মূর্তি। জানলে অবাক হতে হয় যে, দেবী এখানে স্বর্ণালঙ্কারা।

এ বারের পুজোর যুগ্ম-সম্পাদক তরুণ চক্রবর্তী জানালেন, “বারোয়ারি পুজোয় এমন ঘটনা বিরল। তবে কোনওদিন কোনও অসুবিধা হয়নি। পুজো কমিটির সদস্য, পাড়ার মহিলা এবং সেবাইতরা সব সময়ই উপস্থিত থাকেন পুজোদালানে। ” দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে আসা পুরোহিত মহাশয়ের তৃতীয় প্রজন্ম নিষ্ঠাভরে প্রতি বছর মায়ের পুজো সম্পন্ন করেন। এখনও পাঁচজন পুরোহিত পুজোর কাজ করেন।

দু’জন থাকেন শুধুমাত্র চণ্ডীপাঠ করার জন্য। যে সকল সেবাইতরা আছেন, তাঁরাও তিন পুরুষ ধরে আসেন পুজোর কাজের জন্য। ষষ্ঠীতে বোধন, নবমীতে কুমারী পুজো, দশমীতে অপরাজিতা পুজো, ভাসানের পর রাখিবন্ধনের মতো একে অপরের হাতে অপরাজিতার সাদা পাঁপড়ি বাঁধা, পুজোর নিয়মের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায় ভ্রাতৃত্ববোধ, সৌহার্দ্যবোধ। অরুণবাবু নিজের বাড়িতেই অপরাজিতা গাছ লাগিয়েছেন যাতে পাঁপড়ি কম পড়লে জোগান দেওয়া যায়। সুদীর্ঘ এই ১০২ বছর ধরে কোনও প্রতিকূলতা ছাড়াই পুজো হয়েছে, তেমনটা নয়।

এই পুজোর অন্যতম প্রাণপুরুষ রায়সাহেব ভূপতি চট্টোপাধ্যায়ের বংশধর অমিতবাবু বললেন, ‘‘সত্তর দশকের শুরুতে এক বার খুব দুর্যোগ হয়। পুজো মিটে গেলেও, প্রতিমা বির্সজন নিয়ে ছিল সব থেকে বেশি চিন্তা। কিন্তু মায়ের কৃপায় তাও সুষ্ঠু ভাবে মিটে যায়। নিয়ম মেনে দশমী তিথিতেই মূর্তি নিরঞ্জন হয়। বারের বিচার না করে, প্রথম থেকেই দশমীতে বিসর্জন দিয়ে বিজয়া পালন হয়।

” সপ্তমী থেকে নবমী খিচুড়ি ভোগ আর দশমীতে পান্তা ভোগ উৎসর্গ করা হয় দেবীকে। পুজোদালানে যে সকল পুরুষ সদস্যরা থাকেন, তাদের পরনে থাকে সাদা ধুতি ও গেঞ্জি। ‘‘আমরা ড্রেস-কোড মেনে চলি’’, সগর্বে বললেন অমিতবাবু। এই পুজোকে কেন্দ্র করে অনেক অনুষ্ঠান হয় যার মধ্যে অন্যতম সানাই-বাদন। তাও আবার ‘লাইভ’! ষষ্ঠী থেকে দশমী, সানাইয়ের সুরে ঘুম ভাঙে পল্লীবাসীর।

দিনের কোনও কোনও সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতও শোনা যায়। পুজো উপলক্ষে রক্তদান, চক্ষুপরীক্ষা শিবির, দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য, শাড়ি বিতরণ ও নানাবিধ সমাজকল্যাণ মূলক কাজ করা হয়। আর পুজোর দিনগুলিতে হয় ‘স্পট-ক্যুইজ’, দর্শনার্থীদের বিবিধ প্রশ্ন করে পুরস্কার দেওয়া হয়। এ বারের পুজোয় ছৌ-মুখোশ বিশেষ আকর্ষণ। তাই পুরুলিয়া থেকে শিল্পী-কারিগরেরা এসেছেন।

বাজার চলতি থিম-দৌড়ে কখনও যোগ দেওয়ার কথা যে ভাবা হয়নি, তা ঠিক নয়। কিন্তু পুরস্কারের থেকে ঐতিহ্য বজায় রাখাতেই প্রাধান্য দিয়েছে এই বারোয়ারি। তবে শতবর্ষ পূর্তিতে বেশ কয়েকটি শারদ-সম্মান পেয়েছিল শহর কলকাতার প্রথম এই বারোয়ারি পুজো। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।