আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্রষ্টার অস্তিত্ব !!! ৬

কিছু ঘটনা *** রোমের বিজয় *** সুরা আর রুমে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “ রোমকগণ পরাজিত হয়েছে, নিকটবর্তী অঞ্চলে। কিন্তু তারা(রোমানরা) তাদের পরাজয়ের পর শিঘ্রই বিজয়ী হবে কয়েক বছরের মধ্যেই। পূর্বের ও পরের সিদ্ধান্ত আল্লাহরই। আর সেই দিন মুমিনগণ হর্ষোৎফুল্ল হবে। ”(আল-কুরআন, ৩০ঃ ২-৪) এই ভবিষ্যৎ বাণী যখন করা হয়েছিল তখন আরবের অবস্থা ছিল এই যে, তৎকালীন পরাশক্তি রোম ও পারস্য আরবদেরকে অধিকার করে শাসন করতে চাইতনা, কারণ তারা ছিল অশিক্ষিত,গোঁয়ার,কলহপ্রিয়।

তাছাড়া সেখানে এমন কোন সম্পদ ছিলনা, যা পাবার জন্য তারা এ অঞ্চল অধিকার করবে। আর এ গোঁয়ার জাতীকে নিয়ন্ত্রণ করাকে তারা ঝামেলা মনে করত। মূলতঃ আরব জাতি কারো গননার মধ্যে পড়ত না। আর এমন অবস্থায় মুসলিমদের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। তারা আরব কতৃক নির্যাতিত হচ্ছিল ।

পারস্য এবং রোমের মধ্যে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল কখনও রোম বিজয়ী হত, কখনও পারস্য। রসূল(সাঃ)এর সময় আপাত দৃষ্টিতে রোমের বিজয়ের কোন লক্ষণ দেখা যাছিল না। ৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে পারস্য বাহিনী সিরিয়া(রোমের অংশ) জয় করে। পরের বছর তারা জেরুজালেম জয় করে এবং খ্রিষ্টানদের উপর ধ্বংলীলা শুরু করে । তারা এখানে ৯০ হাজার লোককে হত্যা করে।

একের পর এক বিজয়ে পারস্য সম্রাট খসররু পারভেজ রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে চিঠি লেখেন-“ সকল খোদার বড় খোদা ,সারা জাহানের মালিক খসরুর পক্ষ থেকে ওই হীন ,কান্ডজ্ঞানহীন বান্দা হিরাক্লিয়াসের প্রতি। তুই বলিস যে,তোর খোদার উপর ভরসা আছে। তাহলে তোর খোদা কেন আমার হাত থেকে জেরুজালেমকে রক্ষা করলোনা ? ’ পরস্যের আপাত বিজয়ে মক্কার মুশরিক্রা খুবই খুশি হয়েছিল এবং তারা বলছিলঃ ‘দেখ ! পরস্যের অগ্নিপূজারীরা বিজয়ী হয়েছে এবং ওহী ও রিসালাতে বিশ্বাসী রোমানরা পরাজিত হয়েছে। এমনিভাবে আমরা প্রতিমা পূজারীরাও তোমাদের(মুসলিমদের) দ্বীনকে নির্মূল করে দিব’। রোম - পারস্যের যুদ্ধে মুসলিমরা মানুষিকভাবে কিতাবীদের অর্থাৎ ঈশা(আঃ)এর অনুসারী খ্রিষ্টানদের পক্ষে ছিল এবং তাদের বিজয় কামনা করছিল।

আল কুরআনের এ আয়াতগুলো যখন অবতীর্ণ হয় তখন মক্কার কাফিররা উপহাস বিদ্রুপ করতে লাগলো। রোম-পারস্য সংক্রান্ত আয়াত হযরত আবুবকর (রাঃ) যখন কুরাইশদের মধ্যে ঘোষণা করছিলেন তখন কুরাইশ নেতা উবাই বিন খাল্ফ তার সাথে বাজি ধরে বললো ‘ যদি ৩ বছরের মধ্যে রোমীয়গণ বিজয়ী হয় তবে আমি তোমাকে ১০ টি উট দিব আর যদি পারস্য বিজয়ী হিসেবে থাকে তবে তুমি আমাকে ১০ টি উট দিবে’। এখবর জানতে পেরে রসুল (সাঃ) আবুবকর (রাঃ)কে বলেন “১০ বছরের সময়কালের শর্ত আরোপ কর এবং উটের পরিমান ১০০ কর। ”এ শর্ত উবাই বিন খাল্ফ মেনে নেন। ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা পরস্য জয় করে।

উবাই বিন খাল্ফ বাজিতে হেরে যায়। এ সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ইসলাম গ্রহন করেছিল নবীকে সত্য জেনে। *** রোম ও পারস্যের সম্পদরাশি আল্লাহর পথে ব্যয়িত হবে *** হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) খেকে বর্ণিত,রসুল (সাঃ) বলেন- কিস্রার(পারস্য সম্রাট)পতনের পর আর কোন কিস্রা ক্ষমতাসীন হবেনা এবং কাইজারের(রোম সম্রাট) পতনের পর আর কোন কাইজার ক্ষমতসীন হবে না। যে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ,তার শপথ ! এ দুই সাম্রাজ্যের সমস্ত ধনভান্ডার আল্লাহর পথে ব্যয় হবে। (তিরমিজী) রসূল(সাঃ) যখন এই ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন,তখন তিঁনি সহ তাঁর সাহাবাগন ছিলেন সহায় সম্বলহীন।

তাঁর এই বাণী বাহ্যত পাগলের প্রলাপ মনে হয়েছিল কাফিরদের কাছে এবং তারা বিভিন্নবাবে ঠাট্টা বিদ্রুপও করছিল এ কথা শোনার পর। রসুল (সাঃ) মদীনাতে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে তার প্রধান হন। এর কিছুকাল পর তিঁনি পরস্য সম্রাট খসরু, রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস,আফ্রিকার হাফসা (আবিসিনিয়া),ইয়েমেন,ইরাক সহ ৮/১০টি রাষ্ট্র প্রধানের কাছে ইসলাম গ্রহনের আহবান জানিয়ে দূত প্রেরণ করেন। এমন একটি সময়ে তিঁনি তাদেরকে আল্লাহর বিধাণ মেনে নিয়ে আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করতে বলেছিলেন,যখন গোটা আরবকে তৎকালিন পরাশক্তি রোম ও পারস্য(ইরান) দখল করে শাসন করাকেও ঘৃণা করত। মহাকবি ফেরদৌসী তাঁর শাহনামা মহাকাব্যে পরস্যের শান শওকতের কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন, তার একটি হলো এরকমঃ সম্রাট খসরু মৃগয়া(শিকার করতে)যাওয়ার ইচ্ছা করলেন।

সম্রাট আদেশ দিলেন- ৩ হাজার সুবর্ণসাজধারী ঘোড়া প্রস্তুত হলো। সম্রাটের সাথে এক হাজার একশত ষাট জন অনুগত বীর যোদ্ধা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে গেল। দামী বস্ত্র ও অলঙ্কারে সজ্জিত ঘোড়ায় চড়ে এক হাজার যুবক গেল সম্রাটের পেছনে ,যাদের সবার হাতে দামী ও নক্সাযুক্ত তরবারী। অশ্বারোহীদের পেছনে গেল সাতশত প্রশিক্ষিত ব্যক্তি যাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে শিকারী বাজপাখি এবং খাঁচার মধ্যে বহন করা হলো প্রশিক্ষিত সত্তুরটি বাঘ ও সিংহ যাদেরকে সোনার শিকল দিয়ে বাধা। আরো গেল সাতশো শিকারী কুকুর যাদেরকে সোনার শিকল দিয়ে বাধা।

শিকারের সময় এরা হরিণের পেছনে ধাওয়া করবে। বিশাল বাহিনীর পেছনে চললো দুই হাজার সঙ্গীতকার,যারা শিকারের সময় বাদ্য বাজাবে ও গান গাইবে। এদের সবার বাহন ছিল সুন্দর কারুকার্য খচিত কাপড় দিয়ে সাজানো উট। সঙ্গীতকারদের মাথায় সোভা পাচ্ছিল সোনার টুপি । এতগুলো মানুষের খাদ্য,পানীয়,তাবু ও অন্যান্য সরঞ্জামাদী নিয়ে চললো ছয়শত উট।

দুই শত দাস আগর বাতি,ধুপধুনো নিয়ে চললো আগে আগে। তাদের সামনে গেল অনুগত দুই শত তরুন। তাদের হাতে জাফরানের পাত্র ও ফুলদানী। সবার আগে চললো জলপাত্রবাহী সুগন্ধি মৃগনাভী বাহকের দল। মৃগয়া দলের যাত্রাপথে তারা সুগন্ধি পানি ছড়াতে ছড়াতে গেল যাতে সম্রাটের যাত্রা পথ সুগন্ধিযুক্ত হয় এবং কোন দূর্গ›ধ ও ধুলাবালি যেন সম্রাটের কাছে না আসে ।

সম্রাটের পেছনে পেছনে চললো তিন হাজার সামন্ত রাজা লাল,হলুদ ও বেগুনি রংয়ের পোশাকে সজ্জিত হয়ে। সম্রাটের সঙ্গে বহন করা হলো বড়ো বড়ো সুসজ্জিত ও সুশোভিত পতাকা। পারস্য সম্রাট খসরু এভাবে সজ্জিত হয়ে মৃগয়া যওয়ার আগেই কিন্তু তিনি রোমানদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন এবং প্রচুর সম্পদ হারিয়েছেন। তার পরও তার শানসওকাতের বিবরণ শুনলে রুপ কথার গল্পের মত মনে হয়। মূলতঃ আমরা অনুমান করতে সক্ষম নই যে, তিঁনি রোমানদের উপর বিজয়ী থাকা কালে কিভাবে সম্পদের প্রদর্শণী করতেন ? রসুল (সাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে হুযায়ফা (রাঃ) এর মাধ্যমে পারস্য সম্রাট খসরুর কাছে ইসলামের আহবান পাঠান একটি পত্রের মাধ্যমে।

পত্রটি হলোঃ “বিসমিল্লাহির রহমান হির রহিম , আল্লাহর রসুল মুহাম্মদের নিকট হতে আল্লাহর বান্দা, পারস্যের প্রধান কিস্রার প্রতি। যারা হিদায়াতের অনুসরণ করে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আনয়ন করে এই কথায় সাক্ষ দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য নয় এবং সমগ্র বিশ্বের লোকদেরকে সতর্ক করার জন্য তিঁনি আমাকে রসুল রুপে প্রেরণ করেছেন, তাঁর (রসুল সাঃ)প্রতি সালাম। আপনি ইসলাম গ্রহন করুন, মুক্তি লাভ করতে পারবেন। অন্যথায় অগ্নি উপাসক প্রজাদের পাপের জন্যও আপনি দায়ী হবেন। ” পত্র পাঠ করে সম্রাট তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন এবং চিঠিটি ছিড়ে টুকরো টুকরো করলেন এতেও তাঁর ক্রোধ মিটলো না।

তিঁনি সঙ্গে সঙ্গে ইয়েমেনের শাসনকর্তা বাযান’কে হুকুম করলেন- ‘মুহাম্মদ কে গ্রেফতার করে অনতিবিলম্বে আমার কাছে নিয়ে এসো’ বাযান রসুল (সাঃ)কে গ্রেফতারী পরোয়ানা শুনানো ও তাঁকে হাজির হবার জন্য দুজন দূতকে পাঠালো। দূতদ্বয় রসুল(সাঃ) কে পরস্য সম্রাটের হাতে ধরা দিতে বললেন, নইলে সম্রাট শুধু তাকেই নয় সমগ্র আরবকে ধ্বংস করে ফেলবেন বলে জানিয়ে দিলেন, কিন্তু এ কথা শুনে রসুর(সাঃ ) এর মধ্যে কোন ভাবান্তর হলনা । তিঁনি বললেন- তোমরা কাল এসো , কাল তোমাদের প্রশ্নের জবাব দিব। সম্রাটের দ্যূতদ্বয় পরষ্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ী করে বিদায় নিল। পরদিন দ্যূতদ্বয় দেখা করে যখন গ্রেফতারী পরোয়ানার কথা বললো ,তখন রসুল (সাঃ ) তাদেরকে বললেন - কার পরোয়ানা ? দূতদ্বয় বললো ঃ কেন ,শাহানশাহ খসরু পারভেজের পরোয়ানা ! ’ রসুল (সাঃ) বলেলন ,‘খসরু পারভেজ তো জীবিত নেই,যাও বাযান’কে গিয়ে বলো- শিঘ্রই পারস্যের রাজধানী ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হবে ।

’(আল্লাহু আকবার !!!) দূতদ্বয় চলে গেল। ইয়েমেনের শাসনকর্তা বাযান সব কথা শুনে বললেন ‘যদি তাঁর কথা সঠিক হয় ,তবে সে সত্য নবী এবং আমি তাঁর প্রতি ঈমান আনবো। ’ (বাযান পরে ইসলাম গ্রহন করেছিল) এর কিছুদিন পর পারস্যের রাজধানী থেকে চিঠি আসে বাযানের কাছেঃ ‘আমি খসরুর পুত্র শেরওয়াইয়াহ্ ,পিতা অত্যাচারী সম্রাটকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেছি। আমি আপনাকে আপনার পদে বহাল রাখলাম। আমার আনুগত্য স্বীকার করে দায়ীত্ব পালন করতে থাকুন আর সেই অরবী নবী সম্পর্কে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কিছুই করবেন না।

’ রসুল (সাঃ) কতৃক প্রেরীত দ্যূতকে পারশ্য সম্রাট খশরু পারভেজ অপমান করার পর তিঁনি(সাঃ)বলেছিলেন ‘ইয়া আল্লাহ ! সে যেমন আমার চিঠিকে টুকরো টুকরো করেছে, তুমি তেমনিভাবে তাঁর রাজ্যকেও টুকরো টুকরো করে দাও !’(আল্লাহু আকবার !!!) এর কয়েক বছর পর আল্লাহর তলোয়ার হিসেবে খ্যাত সর্বকালের সর্বোশ্রেষ্ঠ সেনানায়ক হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের(রাঃ) সেনাপতিত্বে ১৪ শত বছর ধরে বিশ্বকে নেতৃত্ব দানকারী তৎকালীন দুই পরাশক্তি রোম ও পরস্য মুসলিমদের অধিকারে আসে। হযরত আদী ইবনে হাতেম(রাঃ)(আদী ছিলেন ইতিহাসখ্যাত দাতা হাতিম তাঈ এর পুত্র,তিঁনি পাস্যের লোক ছিলেন । আদী রসূল সাঃ কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে সংগঠিত হচ্ছিল,রসূল সাঃ তাঁর মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেন। কিন্তু এক নাটকীয় ঘটনার মধ্যদিয়ে তিঁনি এবং তাঁর খালা ইসলাম গ্রহন করেন এবং তাঁকে মাফ করা হয়। ) বলেন ‘ আমি রসূল(সাঃ) এর কাছে বসে ছিলাম।

এমন সময় একজন লোক এসে তার ক্ষুধার্ত অবস্থার কথা জনালো। অন্য একজন এসে ডাকাতি রাহাজানির অভিযোগ করলো। এরপর রসূল (সাঃ) আদীকে বললেন, হে আদী তুমি কি হিরা শহর দেখেছ ? যদি তোমার আয়ু বেশী হয়, তবে তুমি দেখতে পাবে যে, ঘোড়ায় চড়ে একজন মহিলা(নিরাপত্তামূলক অবস্থা বোঝাতে একজন মহিলার কথা বলা হয়েছে মূলতঃ তখনকার অবস্থা এমন হবে যে, মহিলারাও নিরাপত্তার সাথে এতটা দূরবর্তী স্থানে যেতে ভয় পাবেনা) হীরা থেকে আসবে এবং ক্কাবা ঘর তাওয়াফ করবে। এসময়ে তার মনে আল্লাহর ভয় ছাড়া অন্যকোন ভয় থাকবে না। যদি তুমি দীর্ঘজীবি হও তবে দেখতে পাবে,আঁচল ভরে সোনা বিতরনের জন্য নেওয়া হবে কিন্তু গ্রহন করার লোক পাওয়া যাবেনা’ (সহিহ্ বুখারী) (রসূল সাঃ এর প্রতিটি কথাই সত্য, কারণ তিঁনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হতেন।

তাঁর এ কথা শুনে এটাও বোঝা যায় যে আদী দীর্ঘজীবি হবে । আদী ১২০ বছর বেঁচে ছিলেন এ ঘটনার সাক্ষী হয়ে। ) এর কয়েক বছর পর মুসলিমরা তৎকালীন দুই পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য রোম ও পারস্য বিজয় করে। আদী ছিলেন মুসলিম বাহিনীর একজন দক্ষ যোদ্ধা(তিঁনি এতটা বিশাল দেহী ছিলেন যে,ঘোড়ায় চড়লে তার দু পা প্রায় মাটি স্পর্শ করত)। আদীর(রাঃ) তখন রসূল (সাঃ) এর কথা মনে পড়াতে তিঁনি বলেন ,আমি দেখেছি- ,হীরা থেকে মহিলারা মক্কায় তাওয়াফ করতে গেছে কিন্তু তাদেরকে শুধু আল্লাহকে ভয় করতে দেখা গেছে।

(কারণ বিশাল মুসলিম ভূখন্ডে শান্তি আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল আর তা জাতি, ধর্ম,বর্ণ ,নারী- পুরুষ,ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্যই নিশ্চিত করা হয়েছিল) ইসলামের পঞ্চম খলিফার সময় মুসলিম ভূখন্ডের মানুষের সম্পদের প্রাচুর্য এমন আকার ধারণ করে যে, এমন একজন লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি যাকে যাকাত দেওয়া যায় । খলিফাকে যাকাতের অঢেল অর্থ নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছিল। তখন ইউরোপসহ বিশ্বের অন্য প্রান্তে যাকাতের অর্থ ও দানের অর্থ(অবশ্যই নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থভাবে) প্রেরণ করা হয় গরিবদের জন্য এবং দাস কিনে তা মুক্ত করার জন্য। শান্তি,নিরাপত্তা আর প্রাচুর্যের কারনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অমুসলিমরা ইসলামিক রাষ্ট্রে স্থায়ী বসতি গড়তে দলে দলে আসতে থাকে। *** সুরাকার চুক্তি *** রসূল(সাঃ) যখন হিযরত করেন,তখন তাঁর মাথার দাম ওঠে ১০০টি তাজা উট।

এ লোভে অনেকে তাঁকে হত্যার জন্য খুঁজতে থাকে। সুরাকা নামের এক মুশরিক(মূর্তি পূজারী) অন্য একজনের মাধ্যমে রসূল (সাঃ) এর মত একজনের অবস্থান জানতে পারে কিন্তু উটের লোভে তিঁনি ওই লোকটিকে ‘তিঁনি মুহাম্মদ নয়’ বলে বিরত রাখেন। এরপর একা গোপনে অস্ত্র ও ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সে প্রচন্ড বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে নির্দিষ্ট স্থানের কাছে রসূল(সাঃ),আবু বকর(রাঃ) ও গাইডকে দেখতে পায়। এমন সময় তাঁর ঘোড়ার পা বালুতে দেবে যায় ও সুরাকা পড়ে যায়।

সুরাকা আবার উঠে ঘোড়া ছুটায় আবারও পড়ে যায়। সে এটাকে ভাল লক্ষণ মনে করেনা কিন্তু ১০০ উট তার চাই’ই। সে তখন দৌড়ে তীর নিক্ষেপ করার জন্য ধনুকে তীর গাঁথে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত অসাড় হয়ে যায়,তাঁর সামনে ধোয়ার কুন্ডলি এসে তাঁর দৃষ্টিকে বাধাগ্রস্থ করে। সুরাকা ভয় পেয়ে যায় সে চিৎকার করে বলে ‘ওহে মুহাম্মদ ! তোমার প্রভুর দরবারে আমার ও ঘোড়ার মুক্তির জন্য প্রার্থনা কর ! আমি তোমাদের অকল্যান করবো না।

’ রসূল(সাঃ)দোয়া করলেন সুরাকা মুক্ত হলো। সাথে সাথে সুরাকার আবার ১০০ উটের কথা মনে হলো , সে আবার ঘোড়ায় চড়ে ধনুকে তীর গাঁথতে উদ্যত হলো। এবারও তাঁর ঘোড়ার পা হাটুর উপর পয্যন্ত দেবে গেল এবং তাঁর হাত অবশ হয়ে গেল। সে বললো এবার মুক্ত করলে আমার অস্ত্র ও খাদ্য তোমাদের দিয়ে দিব এবং তোমার খোঁজে আসা অন্যলোকদের বিরত রাখবো। তার আকুতিতে রসূল(সাঃ) আবার দোয়া করলেন,সে মুক্ত হলো।

রসূল(সাঃ) তাঁর সামগ্রী নিলেন না। তখন সে কিছুক্ষন ভাবলো এবং বললো ‘আমি নিশ্চিত, শিঘ্রই আপনার দ্বীন বিজয়ী হবে । আপনি ওয়াদা করুন যে,আমি যখন আপনার সাম্রাজ্যে যাব তখন আমাকে সম্মান দেবেন। আর এ কথাটি আমাকে লিখে দিন’ রসূল(সাঃ) আবু বকর(রাঃ) এর মাধ্যমে একখন্ড চমড়ার উপর তা লিখে দিলেন। সুরাকা ফিরতে উদ্দত হলে রসূল (সাঃ) বললেন, ‘সুরাকা ! তুমি যেদিন পারস্য সম্রাটের রাজকীয় পোশাক পরবে , তখন কেমন হবে ?’ সুরাকা বিশ্ময়ে হতবাক, কারণ রসূল(সাঃ) মক্কার কুরাইশদের কারনে হিযরত করছেন।

তাঁর এখন না আছে- অজস্র সৈন্য,না আছে অস্ত্র-শস্ত্র,এমনকি মাথা গোজার ঠাই নাই। হাজার বছর ধরে পরাশক্তির আসনে বসে থাকা একটি বিশাল সাম্রাজ্য সম্পর্কে এমন কথা বলা কিভাবে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে ! সুরাকা বললো ‘কিসরার পোশাক !’ রসূল (সাঃ) শান্ত ভাবে বললেন, ‘ হ্যাঁ’ । মক্কা বিজয়ের পর রসূল (সাঃ) সুরাকাকে যথেষ্ট সম্মান দেন এবং সুরাকা ইসলাম গ্রহন করেন। পারস্য সাম্রাজ্যের পতনের পর যখন মদীনাতে গণিমতের মাল আসে তখন তার মধ্যে পারস্য সম্রাটের পোশাকও ছিল। খলিফা হযরত ওমর(রাঃ) রসূল(সাঃ) কতৃক সুরাকাকে দেওয়া প্রতিশ্র“তির কথা জানতেন।

তিঁনি সুরাকাকে ডাকলেন। তাঁকে নিজ হাতে পারস্য সম্রাটের পোশাক পরিয়ে দিলেন। সম্রাটের দামী পাথর খচিত তরবারী তাঁর কোমরে ঝুলিয়ে দিলেন, সম্রাটের দামী ব্রেসলেট তাঁর হাতে পরানো হলো এবং সম্রাটের রাজকীয় মুকুট তাঁর মাথায় পরিয়ে দিলেন। মুসলিমরা তাকবীর ধ্বনি দিচ্ছিল আর সূরাকা রসূলের প্রতিশ্র“তি পূরণে এবং এমন সময়ে রসূল(সাঃ) এর অনুপস্থিতির কারনে কান্ন্ায় ভেঙ্গে পড়েন। *** পাদ্রী বুহাইরা *** রসূল(সাঃ)এর বয়স যখন ১২ বছর তখন আবু তালিব তাঁকে নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়া হন ব্যবসার জন্য।

বসরায় পৌঁছার পর তিঁনি একস্থানে তাবু ফেলেন। এসময়ে রোমের একজন পাদ্রী এখানকার এক গীর্জার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তার নাম ছিল ‘জারজিস’ কিন্তু তিঁনি ‘বুহাইরা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বুহাইরা গীর্জা থেকে বের হয়ে আসেন এবং কাফেলার লোকদেরকে মেহমানদারী করেন। অথচ পাদ্রী বুহাইরা কখনই তাঁর গীর্জা থেকে বের হতেন না।

পাদ্রী বালক মুহাম্মদকে চিনে ফেলেন এবং তাঁর হাত ধরে বলেন ইনি সাইয়েদুল আলআমিন। আল্লাহ একে রহমাতুল্লিল আল আমিন হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আবু তালিব বুহাইরাকে বললেন -আপনি কিভাবে বুঝলেন ? তিঁনি বলেন, আমরা তাঁর বর্ননা আমাদের ধর্মগ্রন্থে এমন ভাবে পেয়েছি যে তাঁকে চিনতে মোটেও কষ্ট হয়নি। আর তাঁর কাধের নীচে নরম অংশে মহরে নবুয়্যতের চিহ্ন অংকিত আছে যা ‘সেব’ ফলের মত। বাইবেল সহ প্রাচীন সকল আসমানী কিতাবে নবী(সাঃ) এর বর্ণনা পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে উল্লেখ ছিল যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে চিনতে পারে।

বুহাইরা বলেছিল ,আমি জানতাম তিঁনি সিরিয়ার উদ্দেশ্যে এরকম একটি সময়ে গীর্জার ওই পাশে তাবু ফেলবেন। তাঁকে এক খন্ড মেঘ ছায়া দিতে থাকবে। আমি এই বালকের সাক্ষাৎ লাভের আশায় এই গীর্জায় দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম এবং দিনের হিসাব করছিলাম। আমার নির্ধারিত দিন উপস্থিত হলে আমি বাইরে বের হয়ে খুঁজতে থাকি এবং পেয়ে যায়। এরপর পাদ্রী বুহাইরা আবু তালিবকে গোপনে ডেকে নিয়ে বললেন,ওকে মক্কায় ফেরৎ পাঠিয়ে দিন।

সিরিয়ায় নেবেন না। ইহুদীরা ওর ক্ষতি করতে পারে। এ পরামর্শ অনুযায়ী আবু তালিব কয়েকজন বিশ্বস্ত লোকের সাথে প্রাণ-প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ (সাঃ)কে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড পৃঃ ১৮০-১৮৩ , মুখতাছারুছ সীরাত,তিরমিযি,যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড,পৃঃ ১৭) *** সম্রাট হিরাক্লিয়াস *** ইবনে আব্বাস(রাঃ)হতে বর্ণিত(এবং অসংখ্য ঐতিহাসিক কতৃক বিবৃত) ঃ আবু সুফিয়ান ব্যবসা উপলক্ষে আরও অনেক কুরাইশের সাথে সিরিয়া গিয়েছিলেন। তাদের আগমনের সংবাদ শুনে তৎকালীন পরাশক্তি রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াস তাদেরকে ডেকে পাঠান।

মক্কার ব্যবসায়ীরা সেখানে পৌঁছালে দোভাষীর মাধ্যমে সম্রাট তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আরব দেশে যে লোকটি নবুয়্যতের দাবী করছে তোমাদের মধ্যে কে বংশের দিক দিয়ে তার নিকটতম ?’ আবু সুফিয়ান(আবু সুফিয়ান রসূল সাঃ এর আত্মীয় হলেও মক্কায় যে কয়জন লোক তাঁকে সবথেকে বেশী নির্যাতন করতো,কুৎসা রটাত,আপমান করতো,আবু সুফিয়ান ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান এবং সে রসূল সাঃ এর হত্যার পরিকল্পনাকারী ছিল। ) বলেন ‘আমিই বংশের দিক দিয়ে তাঁর নিকটতম’। হিরাক্লিয়াস তাকে কাছে ডাকলেন এবং তাঁর সঙ্গীদেরকে তার পেছনে বসতে বললেন। হিরাক্লিয়াস তখন ইলিয়া শহরের দরবারে আবস্থান করছিলেন। দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলা শুরু হলো।

হিরাক্লিয়াস বললেন আমি তোমাকে নবুয়্যতের দাবীদার সম্পর্কে কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করবো। (দোভাষীকে বললেন) সে যদি মিথ্যা বলে তবে তা ধরিয়ে দিবে। আবু সুফিয়ান বলেন,আল্লাহর কসম(পৌত্তলিক আরবের লোকেরা আল্লাহকে বিশ্বাস করতো তবে তারা শিরকে লিপ্ত ছিল),যদি আমাকে আমার সঙ্গীগণের নিকট মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন হবার লজ্জা বাধা না দিত, তবে অবশ্যই আমি মুহাম্মদ সম্পর্কে হিরাক্লিয়াসের কাছে মিথ্যা বলতাম(জাহেলিয়ার যুগে আরবের লোকেদের যে সমস্ত বিষয় আভিজাত্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত ছিল তার মধ্যে ছিল- মিথ্যা না বলা,ওয়াদা পালন করা,মেহমানদারী করা ইত্যাদি)। হিরাক্লিয়াস ঃ ঐ লোকটির(রসূল সাঃ) জন্ম কেমন বংশে ? অবু সুফিয়ান বলেন ঃ উত্তম ও উচ্চ বংশে। হিরাক্লিয়াস ঃ এইরুপ কথা অর্থাৎ নবুয়্যতের দাবী তোমাদের বংশে এর পূর্বে কেউ কখনও করেছে ? অবু সুফিয়ান বলেন ঃ ‘না’।

হিরাক্লিয়াস ঃ তাঁর পিতা-পিতামহ প্রভৃতির মধ্যে কেউ রাজা বাদশা ছিল ? অবু সুফিয়ান বলেন ঃ না। হিরাক্লিয়াস ঃ প্রভাবশালী,লোকেরা তার দলভুক্ত হয় বেশী, নাকি দূর্বলেরা ? আবু সুফিয়ান ঃ অভাবগ্রস্থ, দূর্বলেরা। হিরাক্লিয়াস ঃ তার দলভুক্ত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না কমছে ? অবু সুফিয়ান বলেন ঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে । হিরাক্লিয়াস ঃ কেউ তার ধর্ম গ্রহন করার পর ,এর কোন দোষ ত্র“টি দেখিয়ে এই ধর্ম পরিত্যাগ করে কি ? অবু সুফিয়ান বলেন ঃ ‘ না ’। হিরাক্লিয়াস ঃ নবুয়্যতের দাবী করার আগে এই লোকটির উপর তোমরা কখনও মিথ্যাবাদীতার অভিযোগ এনেছ কি ? অবু সুফিয়ান বলেন ঃ ‘না’ ।

হিরাক্লিয়াস ঃ এই লোক কখনও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে কি ? স্রষ্টার অস্তিত্ব ! অতঃপর ... - ৪২ - অবু সুফিয়ান বলেন ঃ না, তবে আমরা সম্প্রতি তার সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ আছি। জানিনা সেই চুক্তির ব্যাপারে সে কি করে(আবু সুফিয়ান বলেন,এই কথাটি ছাড়া মুহাম্মদ সম্পর্কে বলার মত আমি আর কোন কথা পেলাম না)। হিরাক্লিয়াস ঃ তাঁর সাথে তোমাদের যুদ্ধ হয়েছে কি ? অবু সুফিয়ান বলেন ঃ হ্যাঁ,হয়েছে। হিরাক্লিয়াস ঃ তার ফলাফল কি হয়েছে ? অবু সুফিয়ান বলেন ঃ কোন যুদ্ধে তারা জয়লাভ করেছে ,কোন যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছি(মূলতঃসব যুদ্ধেই মুসলিমরা জয়লাভ করেছিল। তবে উহুদ যুদ্ধে একটি নিশ্চিত জয় ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয় এবং এর ফলাফল অ-মিমাংসিত ছিল অবশ্য ক্ষয় ক্ষতির পরিমান মুসলিমদের পক্ষে বেশী ছিল।

এটা কুরাইশদের কাছে ছিল বীজয়তুল্য। আবু সুফিয়ান এটাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেছেন। ) হিরাক্লিয়াস ঃ তিঁনি তোমাদেরকে কি কি নির্দেশ দেন ? অবু সুফিয়ান বলেন ঃ সে আমাদেরকে বলে-এক আল্লাহর ইবাদত কর,তাঁর সাথে শরিক করোনা,তোমাদের পিতা, পিতামহের ভ্রান্ত বিশ্বাস পরিত্যাগ কর। সে আমাদেরকে নামাজ পড়তে,যাকাত দিতে,সত্যকথা বলতে,পবিত্র থাকতে,প্রতিজ্ঞা পালন করতে,আমানত আদায় করতে ও সামাজিক সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আদেশ করে । অবু সুফিয়ান বলেন,অতঃপর হিরাক্লিয়াস দোভাষীকে বললেন,তাকে বল,আমি তোমাকে মুহাম্মদের বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় তুমি বলেছ- তিনি আমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশজাত।

নবীদেরকে এমন সম্ভ্রান্ত বংশেই প্রেরণ করা হয়। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম,নবুয়্যতের দাবী তোমাদের বংশে এর পূর্বে কেউ কখনও করেছে ? তুমি বললে ,না। আমি বলি,তাঁর পূর্বে কেউ যদি এরুপ বলে থাকতো তবে বুঝতাম,এই ব্যক্তি তাদের মধ্যে কারো দাবীর পুনরাবৃত্তি করছে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর পিতা-পিতামহ প্রভৃতির মধ্যে কেউ রাজা ,বাদশা ছিল কিনা ? তুমি বললে, না। যদি তাঁর বাপ দাদাদের মধ্যে কেউ রাজা বাদশাহ্ থাকতো তবে বলতাম যে,তিঁনি তাঁর পূর্ব পুরুষের রাজ্য পুনুরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় রত।

আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, নবুয়্যতের দাবী করার আগে এই লোকটির উপর তোমরা কখনও মিথ্যাবাদীতার অভিযোগ এনেছ কি ? তুমি বললে ,না। আমি বুঝলাম,তিঁনি মানুষের ব্যপারে মিথ্যা ত্যাগ করেন আর আল্লাহর ব্যপারে মিথ্যায় লিপ্ত হন ,এটা অবান্তর,অযৌক্তিক। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, প্রভাবশালী,লোকেরা তাঁর দলভুক্ত হয় বেশী, নাকি দূর্বলেরা ? তুমি বললে,দূর্বলগণ। এইরুপ লোকেরাই নবীদের অনুবর্তী হয়ে থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর অনুগত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না কমছে ? তুমি বললে,বৃদ্ধিপাচ্ছে।

ঈমানের ব্যপারটি পূর্ণতা লাভের সময় পর্যন্ত এরুপই হয়। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ তাঁর ধর্ম গ্রহন করার পর এর কোন দোষ ত্র“টি দেখিয়ে এই ধর্ম পরিত্যাগ করে কি ? তুমি বললে, না। ঈমানের আলোর বলিষ্ঠতা অন্তরে বসে গেলে এরুপই হয়। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই লোক কখনও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে কি ? তুমি বললে, না। নবী-রসূলগণ কখনও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন না।

আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিঁনি তোমাদেরকে কি কি নির্দেশ দেন ? তুমি বললে, সে আমাদেরকে বলে,এক আল্লাহর ইবাদৎ কর,তাঁর সাথে শরিক করোনা,তোমাদের পিতা পিতামহের বিশ্বাস(ভ্রান্ত) পরিত্যাগ কর। সে আমাদেরকে নামাজ পড়তে,যাকাত দিতে,সত্য কথা বলতে,পবিত্র থাকতে,প্রতিজ্ঞা পালন করতে,আমানত আদায় করতে ও সামাজিক সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আদেশ করে । তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয় তবে অচিরেই তিঁনি আমার দু পায়ের নিচের যমীনের অধিকারী হবেন। আমি জানতাম তিঁনি আবির্ভূত হবেন কিন্তু তোমাদের মধ্য থেকে তিঁনি আত্মপ্রকাশ করবেন, তা ভাবিনি। তাঁর কাছে আমি পৌঁছাতে পারব বলে যদি মনে করতাম, তবে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য কষ্ট স্বীকার করতাম(সম্রাটের পারিপার্শ্বিকতাই ছিল প্রধান বাঁধা)।

আর যদি আমি তাঁর নিকটে থাকতাম তবে নিশ্চয় তাঁর পা দুটো নিজহাতে ধুয়ে দিতাম। এরপর সম্রাট হিরাক্লিয়াস রসূল(সাঃ) এর দেওয়া পত্র পাঠ করেন ঃ “ মহান করুনাময় আল্লাহ তায়ালার নামে,আল্লাহর বান্দা ও রসূল মহাম্মদ(সাঃ) এর পক্ষ থেকে রোম সম্রাট, হিরা ক্লিয়াসের প্রতি। হেদায়েত অনুসারীর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহন করুন,শান্তি লাভ করবেন।

আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ পুরষ্কার দিবেন। যদি আপনি এ আহবান কবুল না করেন,তবে আপনি সমস্ত প্রজার পাপের ভাগী হবেন। আর হে আহলে কিতাবগণ ! তোমরা সেই বাণীর দিকে চলে এস,যা তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এইরুপ যে আমরা আল্লাহর ইবাদত করব,তাঁর সাথে কাউকে শরিক করব না। আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে প্রভু স্বীকার করব না। যদি তারা এই বাণী গ্রহণ না করে,তবে তোমরা বলে দাও যে,তোমরা সাক্ষী থাক,আমরা আল্লাহর অনুগত।

” আবু সুফিয়ান বলেন,যখন হিরাক্লিয়াস রসূলের পত্র দোভাষীর মাধ্যমে উচ্চস্বরে পাঠ করান, তখন চারি দিকে কোলাহলের সৃষ্টি হয় এবং আমাদেরকে দরবার থেকে বের করে দেওয়া হয়(হিরাক্লিয়াসের দরবারের লোকেরা তাদেরকে বের করে দেয়)। আবু সুফিয়ান তিক্ত স্বরে(তাচ্ছিল্য করে) বলেন-‘মুহাম্মদের ব্যপারটা যে খুবই গুরুত্ব পেয়ে উঠেছে দেখছি ! রোমাধিপতিও তাঁকে ভয় করছে !’ আবু সুফিয়ান বলেন,তখন থেকেই আমার বিশ্বাস জন্মায় যে,শিঘ্রই সে জয়যুক্ত হবে। ’আবু সুফিয়ান বলেন, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে ইসলামে দিক্ষীত করেন(মক্কা বিজয়ের সময়)। তখন বাইতুল মুকাদ্দাসের শাসনকর্তা ছিলেন ইবনে নাতুর। একদা ভোরে হিরাক্লিয়াস বাইতুল মুকাদ্দাসে বিমর্ষভাবে উপস্থিত হন(বাইতুল মুকাদ্দাস রোমের অন্তর্ভূক্ত ছিল)।

ইবনে নাতুর বলেন- হিরাক্লিয়াস জ্যোতিষী ছিলেন। তারকার গতিবিধি দেখতেন(যদিও এভাবে ভাগ্য গণনার একটি পদ্ধতি আছে এবং তা কখনও কখনও হুবহু সত্যিও হয়,তবে এটি হারাম। রসূল সাঃ গণকের ধারে কাছে যেতেও কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন। গণকরা কিভাবে ভাগ্য গননা করে তা রসূল সাঃ বিষদ ব্যাখ্যা করেছেন,আল-কুরআন ও সুন্নাহতে এর উল্লেখ আছে। এ বিষয়ে আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়,তাই এ মুহুর্তে বলা প্রয়োজন মনে করছিনা)।

ইবনে নাতুর বলেন,আপনাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে। জবাবে তিঁনি বলেন,আমি আজ রাতে তারকারাজির দিকে তাকিয়ে দেখলাম,খৎনাকারীদের বাদশা আত্মপ্রকাশ করেছেন। এই যুগে কোন লোকেরা খৎনা করে ? ইবনে নাতুর সহ সবাই বললো- ইহুদীরা ছাড়া কেউ খৎনা করেনা। তবে ইহুদীদের বর্তমান অবস্থায় ভয় পাবার কোন কারণ নেই। আপনি আদেশ জারী করেন, যেখানে যত ইহুদী আছে তাদেরকে যেন হত্যা করা হয়।

এইসব কথা চলাকালে হিরাক্লিয়াসের কাছে একজনকে উপস্থিত করা হল,তাকে গাস্সানের রাজা পাঠিয়েছিল। সে আল্লাহর রসূলের খবর নিয়ে এসেছিল। সম্রাট আদেশ দিলেন তাঁর খৎনা করা আছে কিনা তা জানার জন্য। বলা হল,তাঁর খৎনা করা আছে। সম্রাট বললেন অরবেরা কি খৎনা করে ? সে বললো ,হ্যা,করে।

তখন হিরাক্লিয়াস বললেন,তাহলে সেই ব্যক্তিই(রসূল সাঃ) এই যামানার বাদশাহ্(এ সময়ে রসূল সাঃ শাসক ছিলেন)। তিঁনি আবির্ভূত হয়েছেন। অতঃপর হিরাক্লিয়াস রোমবাসী তাঁর এক প্রখ্যাত জ্যোতিষী বন্ধুর কাছে পত্র প্রেরণ করে এব্যপারে মন্তব্য করতে বলেন। হিরাক্লিয়াস যখন ‘হেমসে’ আসেন তখন তিঁনি বন্ধুর পত্র পান। তাঁর বন্ধু তাঁর সাথে একমত হয়ে বলেন, শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদের আবির্ভাব ঘটেছে।

হিরাক্লিয়াস এর নির্দেশে রাজ দরবারের দরজা বন্ধ করা হল। এরপর হিরাক্লিয়াস হেম্সের সভাসদবৃন্দকে ইসলাম তথা সেই নবীকে মেনে নেওয়ার আহবান জানান। তিনি বলেন,হে রোমবাসীগণ ! তোমরা কি কল্যাণ, সুপথ এবং তোমাদের রাজ্যের স্থায়ীত্ব চাও ? চাইলে, এই নবীর আনুগত্য স্বীকার কর। এক প্রস্তাব দরবারীরা প্রত্যাখ্যান করল এবং তারা সবাই উঠে চলে গেল । দরজা বন্ধ দেখে তারা দাড়িয়ে গেল ,হিরাক্লিয়াস তাদের এরুপ জঘন্য প্রত্যাখ্যানে নিরাশ হলেন এবং কাছে ডাকলেন।

( হিরাক্লিয়াসের মধ্যে তখন আবার সম্মান,ক্ষমতা,প্রতিপত্তির চিন্তা ঢুকলো) তারপর তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,আমি একটু আগে তোমাদেরকে যা কিছু বলেছি,তা দ্বারা আমি তোমাদের ধর্ম বিশ্বাসের দৃঢ়তা পরিক্ষা করেছিলাম। আমি তোমাদের অবস্থা এখন বুঝতে পারলাম। তখন তারা সম্রাটকে সেজদা করলো এবং সন্তোষ প্রকাশ করলো। (সহীহ্ বুখারী) (মূলতঃ হিরাক্লিয়াস সত্যকে জেনে বুঝে প্রত্যাখ্যান করেছে। এতে তার নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে হলেও ক্ষমতা,প্রতিপত্তির নেশায় সে সত্য দ্বীনের বিরোধিতা করে।

সে জানত যে মুসলিমরাই জিতবে এবং তাদের লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হবে কিন্তু তার বিশ্বস্ত লোকেদের উপর এমন নিয়ন্ত্রন ছিলনা যে, তাদের জীবনাদর্শ পাল্টে দিবেন। বৈষয়িক লাভের চিন্তা তাকে সত্যের বিরোধীতায় উৎসাহিত করে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি,আল্লাহর তলোয়ার খ্যাত খালিদ বিন ওয়ালিদের হাতে বার বার পরাজিত হয়ে সম্রাট হিরাক্লিয়াস বাইজান্টাইনে পালিয়ে যান। সেখানেই তার মৃত্যু হয় কাফির হিসেবে । ) এভাবে আরও অসংখ্য ঘটনা বর্ণনা করা যায়, কিন্তু আমাকে আরও অনেক বিষয় নিয়ে কখা বলতে হবে তাই ঘটনাগুলো সীমিত করলাম।

চলবে..... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।