আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাহার কথা

সাদ আহাম্মেদ আমি যখন মাহফুজ সাহেবের বাসায় পৌছালাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। ঢাকার সন্ধ্যায় একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। সমস্ত দিনের ব্যস্ত নগরী হঠাৎ করে ঝিম মেরে যায়, মানুষের উচ্ছলতাও যেন একটু হারিয়ে যায়। আমি নিশ্চিত এই সময় কমলা রোদ্দুরের যে আলোচ্ছটা আমাদের নয়নে নয়নে খেলা করে তা আমাদের একটাবারের জন্য হলেও আবেগী করে তোলে। আমরা ফিরে যাই প্রিয় কৈশোরবেলায় যেখানে কতিপয় বন্ধুরা আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।

আফসোস কেউই ফিরে যেতে পারেনা সেই চমৎকার দিনগুলোতে। আমি মেঘনাপারের এক গ্রামের কথা তখন ভাবি যেখানে আমার পুরোটা কৈশোর কেটেছে। মা হারিয়ে গেছে বহুদিন হয়েছে, সেই পাচ বছর বয়সে। বাবা পরিব্রাজক, ঘুরে বেড়ায় পথে প্রান্তরে। সে পথের কোন ঠিকানা নাই, তা থাকে অন্তরে অন্তরে।

বাবা এমনটাই বলেন। আমার আসলে এতে কোন আফসোস নাই। আমার বড় মামা আমাকে দুই হাতে সমান ভালোবাসা নিয়ে মানুষ করেছেন। আজকের এই বিশেষক্ষণে মামা পাশে নেই ভেবে খুব দুঃখবোধ হচ্ছে। প্রিয় পাঠক, আজকে একটা বিশেষ দিন।

আমি আজ জীবনে প্রথম পাত্রী দেখতে যাচ্ছি। আমার সাথে আমার এক দুঃসম্পর্কের খালা আছে, মামাতো ভাই দীপুও আছে। যেই মেয়েটাকে দেখতে যাচ্ছি তার নাম মিতু। তানজিয়া আফসিন মিতু। কিন্তু তাকে আমার কাজিন দীপু মিতু বেগম বলে ডাকে।

আমার কোন যায় আসেনা। সত্যি বলতে বিয়ে করার কোন ইচ্ছা আমার ছিলোনা। জোর করে দেয়া হচ্ছে বলা যায়। ঢাকায় আমি একটা ব্যাচেলর মেসে থাকি উত্তর হাউজ বিল্ডিং এ। ২ বছর আগে তড়িৎ মিস্তিরী হয়েছি।

এখন ছোটখাট একটা চাকরী করছি নিতান্তই পেট চালানোর দায়ে। আমাকে যখন আমার প্রিয় আফিয়া খালা কান ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “বিয়ে করবিনা কেন?” আমি হাসতে হাসতে বললাম, “খালা দুদিন আগে একটা ছ্যাকা খাইছি। বিয়া করতে মন চায় না। “ খালা মুখ বেকিয়ে বলেন, “মেরে ছাতু বানায় দিবো ফাজিল ছেলে। এইভাবে মেসে থাকতে থাকতে তোকে জংলী জংলী লাগে।

দীপুর একটা বন্ধু আছে মিতু নামে। ওই মেয়ের জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে। মেয়ের পরিবার খুব ভালো। আমি মেয়ের ছবি দেখে মুগ্ধ। একেবারে ৬০ দশকের সুচিত্রা সেন আপার মত”।

আমি চোখ বড় বড় করে বলি, “খালাজান আমাকে এমন পুরান আমলের নায়িকার সাথে বিয়ে দিয়েন না”। খালা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, “প্রবলেম নাই ডিয়ার। তোর জন্য আমি ময়ুরীর মত একজনকে ঠিক করে রেখেছি। দিনে রাতে তোরে আছাড় মারবে, কি মজা তাই না?” আমি হাসি, পাশ দিয়ে আমার খালাতো বোন অভিনয় করে দেখায় কিভাবে আমাকে আছাড় মারা হবে। বয়স আর কতইবা হলো, মাত্রই তো ২৫।

এখনই বিয়ে করতে মন চাচ্ছিলোনা। কিন্তু কাছের মানুষের দাবী মানতে হবে, তাই তাদেরকে হা বললাম। আজকে উত্তরার ৪ নং সেক্টরে বাস করা বিশিষ্ট মিতু বেগমকে দেখতে সবাই যখন রওনা দিলাম আমার মনে একটা ভয় ভয় কাজ করছিলো। আমি বারবার ভাবছিলাম, যদি মেয়ের পরিবার আমাকে পছন্দ না করে। এই দুঃখ তখন রাখবো কোথায়।

একথা বুঝতে পেরেই আমার কাজিন দীপু আমাকে বলে হয়তো, “কুল ডাউন ব্রো। মেয়ে খুবই ভালো। তার সামনে ব্যাং এনে দিলেও সে হাসিমুখে বলবে, বাহ সবুজ রঙের জামাই কতজন পায়?কি সুন্দর করে মুখ ফুলিয়ে ডাকে”। আমি হাসি। আর ভাবি আমার মায়ের কথা।

মায়ের মুখটা একটুও আমার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়নি,যেমনটা হারিয়ে যায়নি মায়ের স্নেহমাখা হাতের চিড়া, দুধ আর কলা মাখানো স্বর্গান্নের কথা। আমার বাবা আমার মাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন, এতোটাই বেশি যে মা কখনো আমার বাবাকে ছেড়ে তার নানুবাড়িতেও যেতে চাইতেন না। কোন একদিন দুপুরবেলা মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে বললেন, “আমার ছেলেটা কি অনেক কষ্ট পাবে তার মা হারিয়ে গেলে”। আমি বাচ্চা মানুষ কিছু না বুঝে ভ্যাক ভ্যাক করে কেদে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “কোথাও যেতে পারবেনা”।

মা আমার কান্না শুনেনি। তার পরদিন মা হঠাৎ করে হারিয়ে যায়। দুদিন ধরে সব জায়গায় খোজা হয়েছিলো। কোথাও যখন পাওয়া যাচ্ছিলোনা, তখন হঠাৎ করে আমাদের বাড়ির পাশের শান বাধানো পুকুর ঘাটে পচা গন্ধ আসতে থাকে। আমার মাকে খুজে পাওয়া যায়।

মাকে যখন পুকুর থেকে টেনে তোলা হয় তখন আমার বাবা মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিলো শিকল দিয়ে বেধে। একমাস পর যখন বাবা একটু শান্ত হোন তখন তাকে ঘর থেকে বাহিরে বের করা হয়। আমি বাবার পাশে বসে থাকতাম শান্ত ছেলের মত। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন আর বলতেন, “তোর মা আমাকে খুব যন্ত্রণা করে।

দিন নাই রাত নাই একটু পরপর সামনে এসে বলে, আমার বাবুর কি হবে?তুমি ওরে দেখবা তো?” আমি চুপ করে বাবার কথা শুনতাম, ওভাবে কিছু বুঝতামনা। বাবা একদিন যখন হারিয়ে যান তখনও কিছু বুঝিনি। বাবা শুধু গভীর রাতে আমাকে ডেকে তুলে বলেছিলেন, “বাবু তোর মা মেঘনা পারের এক চরে লুকিয়ে আছে। আমাকে ডাকে। আমি যাই?” আমি মাথা নেড়ে সায় দিলে বাবা চলে যায় কাউকে না বলে।

আমি অপেক্ষা করতাম বাবার জন্য। খেতাম না, পড়তাম না। বাবা আর মাকে চিৎকার করে ডাকতাম। রাতে যখন ঘুমাতে ভয় পেতাম তখন গুটিগুটি পায়ে হেটে পুকুরঘাটে যেয়ে মাকে ডাকতাম আর বলতাম, “মা আসি, মা আসি?” এভাবে একটা ভয়ংকর সময় পার করার পর আমার বড় মামা একদিন আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। মামা বিয়ে করেননি।

কেন করেননি তা ঠিকমত উনি বলতেন না। আমি খালাজানের কাছ থেকে শুনেছিলাম, মামার একটা বিয়ে ঠিক হয়েছিলো অনেক আগে। মামার সাথে বিয়ের দিন সেই পাত্রী ভেগে গিয়েছিলো। মামা খুব অভিমান করে আর বিয়ে করেন নি। একদিন আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম তখন মামা বলেছিলেন, “একবার প্যারিসে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।

মেয়েটা এখন ওখানে থাকে। আমার খুব জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা, সে এমন করলো কেন?” আমি একটু বড় হয়ে যখন মানুষের অনুভূতিগুলো দেখতে বুঝতে শিখলাম তখন মনে প্রশ্ন আসতো এত আবেগ আর ভালোবাসা মানুষগুলো কোথায় লুকিয়ে রাখে?আমার ব্যাচেলর মামার সাথে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ট সময়গুলো আমি পার করেছি। প্রতি শুক্রবার মামা আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতেন, আমার হাত ধরে হাটতেন। মামা আমাকে বড় হওয়া শিখিয়েছেন। উপরের নীল আকাশ যেমন তার বিশালত্ব নিয়ে আমাদের সামনে এসে বলে, “খোকা আমার মত হতে পারো?” মামাও তেমন একটা আকাশ হয়ে আমার সামনে নিজেকে মেলে ধরতেন।

আমি শিখেছি, জীবনকে শিখেছি এবং জেনেছি। মামা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। মিতুর বাবা মাহফুজ সাহেব একটা স্কয়ার ফ্রেম চোখে দিয়ে আছেন। লোকটাকে দেখেই মনে হয় যথেষ্ট সৌখিন। তার বিশাল বাড়ির চারদিকে অসাধারণ সব তৈলচিত্র।

একটা তৈলচিত্র দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। লালা পাড়ের সাদা শাড়ি পরা এক মায়াকাড়া নয়না তার আজন্ম লজ্জা মুখে লুকিয়ে কোথায় যেন তাকিয়ে আছে। এই ব্যাপারগুলো এভাবে ছবিতে ফুটিয়ে তোলার মত মানুষ পৃথিবীতে এসেছে বলেই কি পৃথিবীটা এত সুন্দর? মাহফুজ সাহেব আমার পাশে এসে বসলেন। কাধে হাত দিয়ে বললেন, “বাবা তুমি যে ছবিগুলা দেখছো এগুলো সব আমার মেয়ের আকা। ও এই ছবিগুলো কাউকে দিতে চায়না, কোন একজিবিশনে ওর শো অফ করারও ইচ্ছা নাই।

সব এঁকে এঁকে ঘর ভরিয়ে তুলেছে”। আমি বিশাল লজ্জা পেলাম কোন এক কারণে। মাথা নেড়ে বললাম, “ছবিগুলো অনেক সুন্দর”। মাহফুজ সাহেব হেসে দিলেন। আমার খালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাদের ছেলেটা তো মেয়েদের থেকেও বেশি লজ্জা পায়।

আমার মেয়েটাও খুব লজ্জা পায়। এরা তো প্রেম ভালোবাসা করতে পারবেনা। বিয়ে ক্যান্সেল”। আমার খালা হেসে বললেন, “আমরা শিখায় পড়ায় দিবো দুইজনকে। কিছু ক্যান্সেল করতে হবেনা।

কিন্তু আমাদের মেয়ে কোথায়?” একটু পর মিতু বেগম ঘরে আসলো। তার গায়ে একটা হালকা লালচে গোলাপী রঙের জামা। গায়ে একটা শাল, নিজ হাতের বুনোনে গাথা চমৎকার একটা শাল। সে কারো দিকে তাকায় না। মাথা নিচু করে তাকিয়ে আমাদের বিপরীতে বসে।

আমি তাকে দেখি, হয়তোবা দেখতে পাইনা। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে আড়চোখে তাকে দেখার আলতো চেষ্টা করি। ভাবছিলাম আমার কি তার প্রেমে পড়া উচিত। আমি বুঝতে পারিনা, আমার বোঝার ইচ্ছাও নাই। যা হবে হোক।

এসব ভাবতে ভাবতে সে কখন যেন আমার সামনে তার হালকা মেহেদী রাঙ্গা হাতে এক কাপ ধোয়ায় ভেসে ওঠা চা নিয়ে দাড়ালো। আমি তাকে দেখলাম, এবং শুধুই দেখে গেলাম। এমনটা সিনেমায় হয়, অথবা রোমান্টির লেখকের লুতুপুতু গল্পে। আজকের এই শ্রাবণঝড়া সন্ধায়, আধার নেমে আসা দিনের শেষে আমাকে কেউ একজন ছুয়ে গেলো। মিতু বেগম, আপনাকে আমি কি কখনো ভালবাসতে পারবো?হয়তো না।

আমি শুধু আপনাকে চেয়ে চেয়ে দেখবো আর গল্প লিখবো। আমার গল্প, যেগুলো আমি কখনো কাউকে বলিনি ঠিক সেই গল্পগুলো। মাহফুজ সাহেব নীরবতা ভাঙ্গলেন। আমাকে বললেন, “অয়ন তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে। চলো আমার স্টাডিরুমে চলো, আমার বই দেখতে দেখতে কথা বলবে”।

আমি মাহফুজ সাহেবের সাথে হেটে চলি তার বিশাল বইসম্ভারের মাঝ দিয়ে। উনি আমাকে নিয়ে গেলেন তার লাইব্রেরীর ঠিক পূর্বকোণে। আমাকে মাথা নিচু করে বললেন, “বাবা আমার মেয়েটা অনেক ভালো এটা বুঝতে পারো?” আমি মাথা নাড়ি। আমাকে তিনি আবার বললেন, “আমার মেয়ের যে একটা সমস্যা আছে এটা জানো?দীপু জানিয়েছে তোমাদের?” আমি আবার মাথা নাড়ি। আমি জানি মিতু যখন এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হলো তখন তার এক কাজিনের সাথে গভীর প্রণয় ছিলো।

ছেলেটাকে মিতুর বাবা মাও অনেক পছন্দ করতেন। সব কিছু ঠিকঠাক ছিলো। মিতু পাগলের মত ছেলেটাকে ভালোবাসতো। তার সবকিছু সে ছেলেটাকে অর্পণ করেছিল। তাই যখন হঠাৎ করে মিতু একটা অস্তিত্ব টের পায় তার মাঝে সে একটুও ঘাবড়ে যায়নি।

সে অনেক ভালোবেসে ছেলেটাকে বলেছিলো, “আমাকে বিয়ে করবে?আমাদের একটা স্বপ্নকে আলো দেখানোর সময় হয়েছে”। ছেলেটা বলেছিলো, “হা করবো তো। নাম ঠিক করেছো?” মিতু মাথা নাড়ে। বলে, “ওর নাম দেবো স্বপ্ন”। মিতুর সেই স্বপ্নকে আর দুনিয়া দেখানো সম্ভব হয়নি।

হঠাৎ করে একদিন ধ্রুব বলে ওঠে, “এটা আমার স্বপ্ন না। অন্য কারো”। মিতু চুপ করে শুনে, সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। হারিয়ে যায় গভীর অতলে। যখন জ্ঞান ফিরে তখন ধ্রুব হারিয়ে গেছে।

মিতু এক বছর অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলো। তারপর আবার নতুন করে জীবন শুরু করার চেষ্টা করে যা কিনা ছিলো একটি প্রাণহীন জীবনের উচ্ছ্বল প্রয়াস। আমি সব জানতাম এবং জানা ব্যাপারগুলোতে আমার আপত্তি ছিলোনা। কেন আপত্তি থাকবে?একজন ভালোবেসেছিলো, একটা ছোট্ট ভুল করেছিলো কারণ সে আমার মতই একজন মানুষ। সহস্র ভুলে আমরা একজন মানুষ, আবার এই ভুলগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলার প্রাণশক্তিগুলোই তো মানুষ।

আমার জীবনে আমার কখনো কোন চাহিদা ছিলোনা। আমার মত বাবা মা নেই এমন একজন মানুষের জন্য মিতুর মত অনেক কিছু হারানো একজন মানবীই হয়তো দরকার ছিলো। মাহফুজ সাহেব অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে বললেন, “তোমার কি এত কিছুর পরও ওকে পছন্দ হয়েছে?” আমি মাথা নাড়ি অনেক বিশ্বাসের সাথে। মাহফুজ সাহেব হেসে বললেন, “আমি চাচ্ছি তুমি মিতুর সাথে কথা বলো। আমি ওকে পাঠাই”।

এটুকু বলে মাহফুজ সাহেব চলে গেলেন। মিতু বেগম যখন আমার সামনে এসে দাড়ালো, আমি একটু আনমনা হয়ে গেলাম। তাকে কিছু বলার মত সাহস আমার ছিলোনা। আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কেউ কিছু বলছেনা, সব নীরবতা এসে ভর করেছে আজকে তাহার আমার এই ছোট্ট কোণে।

মিতু হঠাৎ করে আমাকে বললো, “আমি কি চলে যাবো?” আমি বলি, “চলে যান। যাওয়ার আগে আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম”। মিতু মাথা নাড়ে মাটির দিকে তাকিয়ে। আমি ওর সম্মতি পেয়ে বললাম, “আমি খালাকে আজকে জানায় দিবো যে আমার আপনাকে অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে”।

মিতু কিছু বলেনা। আমি মাহফুজ সাহেবের স্টাডিরুম থেকে বের হয়ে আসার প্রস্তুতি নেই। হঠাৎ করে সাহস নিয়ে মিতুকে জিজ্ঞেস করি, “আপনার ফোন নম্বর পেতে পারি?” মিতু দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে যায়। আমার মনে হলো সে বিশাল লজ্জা পেয়েছে। আমিও অবশেষে লজ্জা পেলাম।

আমার খালা এসময় বিশাল গল্প জুড়ে দিয়েছেন মাহফুজ সাহেবের সাথে। আমি সামনে গেলে বললেন, “বাবা তোমার যৌতুকনামা জানায় দাও”। মাহফুজ সাহেব বললেন, “সাইকেল চাও না ঘড়ি?” আমি মুচকি হেসে বলি, “ঈগল ব্র্যান্ডের রেডিও চাই। সোনালী রঙের হতে হবে”। ঠিক যখন চলে যাচ্ছিলাম তখন মিতু আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট কাগজ বাড়িয়ে দেয়।

আমি বুঝলাম কাগজে তার ফোন নম্বর লিখা। কেউ যেন না দেখতে পায় এমন ভাবে কাগজটা তার হাত থেকে বুঝে নিলাম। এই সময় একটিবারো আমি তার ধবধবে শুভ্র হাত বা তাতে স্বর্ণশিকড় হয়ে জড়িয়ে থাকা আঙ্গুলগুলো স্পর্শ করিনি। আমি নিশ্চিত একটুও যদি ছোয়া লাগতো মিতু অজ্ঞান হয়ে যেত। সে এতোটাই পবিত্ররূপে আমার সামনে প্রতীয়মান হয়েছিলো যে আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার সবগুলো অন্ধকার স্মৃতির কথা, আমার না বলা অব্যক্ত কান্নাগুলোর প্রত্যেকটি ব্যাথা।

বিশ্বাস করুন আমি তার প্রেমে পড়িনি, এটা অন্য কিছু ছিলো। এই জগতের বাহিরে অন্য কোন জগতের অনুভূতি। সেদিনের পরদিন রাত দশটা বেজে দশ মিনিটে আমি তাকে অনেক ইতস্ততার সাথে ফোন করলাম। সে ফোনটা ধরে কিছু বললোনা। সামান্য হ্যালো বলার কষ্টটাও করলোনা।

আমার কেন যেন শুধু হাসি পাচ্ছিলো। আমি হাসি থামিয়ে বহু কষ্টে তাকে বললাম, “আপনি ভালো আছেন?” মিতু কিছু বলেনা। অনেকক্ষণ পর শুনতে পাই সে হুমম জাতীয় একটা শব্দ করলো। আমি তাকে একটা একটা করে আমার গল্প বলি। সে শুধু বলে আচ্ছা।

আর এভাবেই পুরো সপ্তাহ জুড়ে কথা বললাম সেই সলজ্জ নারীর সাথে, জানাতাম আমার সব স্বপ্নের কথা। বহু কষ্টে তার মুখ থেকে কথা বের করতে পেরেছিলাম। এখন সে আমাকে একটু একটু নিজের কথা বলে। কোন এক শুক্রবার রাতে আমাকে সে জীবনে প্রথমবারের মত ফোন দিলো। ফোনটা ধরার সাথে সাথে প্রশ্ন করলো, “কেন আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন অয়ন?” আমি একটুও না ঘাবড়িয়ে তাকে বললাম, “আমার আসলে ছোটকাল থেকে খুব কাছের কেউ নাই।

আপনাকে দেখে অনেক কাছের কেউ মনে হয়েছিলো। আপনার চোখে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে মিতু। আমাকে ওটা অনেক কাছে টানে। আপনার ছোট্ট হাতের দিকে যখন আমি তাকাই তখন অনেক লোভ হয়েছিলো একটাবার আপনার হাতটা ধরে রাখার জন্য। আমি যখন আপনার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিলো এত সুন্দর করে সৃষ্টিকর্তা কি করে মানুষকে একেছেন, এতো শুভ্রতার উৎস কই?” মিতু আমাকে কঠিন করে প্রশ্ন করে, “আমার ব্যাপারে আপনি সব জানেন?” আমি বলি, “জানি।

আমার কোন যায় আসেনা”। মিতু আমাকে দম আটকানো স্বরে বলে, “কাল আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। ঠিক দশটায় শহীদ মিনারের সামনে থাকবেন”। আমি মিতুকে বললাম, “ঠিক আছে”। এরপর সারারাত ঘুমাতে পারিনাই।

ভোরবেলা ভয় ভয় নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। আমাকে ঠিক দশটায় একজন পরীর পাশে যেয়ে দাড়াতে হবে। একটুও দেরী করা চলবেনা। আমি যখন মিতুর সাথে দেখা করতে গেলাম তখন চারদিকে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের উদাসীনতা। মিতু আমাকে নিয়ে একটা রিকশায় উঠে শ্যামলীর শিশুপল্লীতে নিয়ে গেলো।

একটু পর একটা চার বছরের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “এটা আমার মেয়ে। আমি কখনো বিয়ে করতে চাইতাম না যদি না আমার এই মেয়েটা থাকতো। আমি যতদিন না বিয়ে করবো এই মেয়েটাকে কাছে রাখতে পারবোনা। এখন বলুন আমাকে বিয়ে করবেন?” আমি ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি আনমনা হয়ে। তাকে বলি, “মামণি আইসক্রীম খাবা?” মেয়েটা ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

এরপর তার মায়ের পিছনে আশ্রয় নেয়। আমি একটা সাহসিকতার কাজ করলাম। মেয়ে আর মা দুজনের হাত ধরে বললাম, “চলো কোথাও আইসক্রীম খেয়ে আসি। ধানমন্ডি আনাম র্যাং গস প্লাজায় বুমারস আছে। আমার প্রিয় আইসক্রীম পারলার।

যাবে?” মিতু মাথা নাড়ে। মিতুর মেয়েটাও মায়ের মত মাথা নাড়ে। মিতুকে আমি বললাম, “মিতু তোমার বাসার পাশে একটা লেক আছে। আমার খুব ভালো লাগে জায়গাটা। আমি ছোটকালে যে বাড়িতে বাবা মার সাথে ছিলাম সেখানে একটা পুকুর ছিলো।

আমি ওই পুকুরের পাশে যেয়ে দাড়ালে যেমন বোধ করতাম, তোমাদের লেকেও একই রকম একটা অনুভূতি পাই। জানিনা কেন!আমি কথা দিচ্ছি প্রতিরাতে তোমাকে নিয়ে এই লেকের পাশে হাটবো”। মাহফুজ সাহেব আমাকে একদিন বেশ সকালে ফোন দিয়ে তার বাসায় আসতে বললেন। তার কন্ঠ বেশ গম্ভীর ছিলো। আমাকে বললেন মিতুর আম্মু এবং তিনি আমার সাথে জরুরী কথা বলবেন।

আমি তাকে জানালাম অফিস শেষ করে তার বাসায় আসবো। ঠিক ছটার দিকে আমি যখন মিতুদের বাসায় পৌছালাম তখন আন্টি আর আঙ্কেল খুব ব্যস্ত। তাদের বাসায় কিছু মেহমান এসেছেন। আমি চুপ করে ওদের ড্রইংরুমে বসলে আন্টি আর আঙ্কেল আমাকে ডাকলেন। তারা তাদের একটি ঘরে নিয়ে আমাকে বললেন, “অয়ন, ধ্রুব কাল দেশে এসে আমাদের বাসায় এসেছিলো।

ও মিতুকে বিয়ে করতে চায় এখন”। আমি হেসে বললাম, “তাহলেতো অনেক ভালো। আমি খুব খুশি হলাম জেনে”। মাহফুজ সাহেব বললেন, “অয়ন তোমার যদি কিছু কখনো প্রয়োজন হয় আমাদেরকে জানিয়ো”। আমি আবারো হাসলাম।

তাদেরকে বললাম, “কিছু চাইনা। আমার জন্য দোয়া করবেন”। আন্টি আমাকে বললেন, “আমাদের মেয়েটা অনেক হাসিখুশি এখন। তুমি কোন রাগ রেখোনা আমাদের প্রতি”। মিতুর কথা শুনে বুকের ভিতর হঠাৎ করে একটা ধক করে উঠলো।

আমি তবুও স্বাভাবিকভাবে তাদেরকে বললাম, “কোন রাগ নেই। আমি যাই?” মিতুদের বাসা থেকে যখন বের হয়ে আসছিলাম ঠিক তখন ওদের বিশাল গেটের কাছে মিতুর গায়ের গন্ধ পেলাম। আমি পাশে তাকিয়ে দেখি মিতু হাটছে একটা উচ্ছ্বাসময় ছেলের সাথে। আমাকে সে দেখলো কিনা জানিনা। আমি দ্রুত একটা সি.এন.জিতে উঠে বসি।

আমাকে পালাতে হবে এখান থেকে। মিতুর গায়ের মিষ্টি গন্ধ আমাকে তাড়া করে, আচ্ছা এটা কি ভালোবাসার গন্ধ। আমি বুঝতে পারিনা। আমার সমস্ত চোখে তখন অনেক আবেগ ঝরে পড়ছে। আমার উত্তরায় ভাড়া করা শাদা বাড়িটার সামনে যখন আমি পৌছালাম তখন চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

আমি নিজের রুমে ঢুকে বারান্দায় যেয়ে পিচ্ছিল মেঝেতে বসে পড়ি। আমার একটু শ্বাসকষ্টের রোগ আছে। আমি টেনে টেনে শ্বাস নেই, কিন্তু চাদের রূপ দেখতে একটুও পিছপা হইনা। আজ পুরো আকাশ ভেঙ্গে জোসনা হয়েছে। আজ পুরো নীলাম্বরের বাধ ভেঙ্গেছে আমাদের এই ছোট্ট বসুধায়।

আমি অদ্ভুত পৃথিবীর রূপ দেখি সব গ্লানি মুছে ফেলে। আমার এক পাশে একটা বিশাল চাঁদ, তাকে ঢেকে দিতে চায় ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টিধারা। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে নাকি অন্য কোন এক কারণে আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে শুধু পানি ঝরে। আমি মুছে কূল পাইনা, ঝরতেই থাকে। থামতে চায়না।

মিতুদের বাসা থেকে বেশ দূরে একদিন উত্তরা লেকের পারে আমি বসে বসে মায়ের কথা ভাবি, বাবার কথা ভাবি। আমার বাবার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর লেভেল ১ টার্ম ১ এ। বাবা আমার ভার্সিটির পাশে ক্যাফেটেরিয়ার শান্ত হয়ে বসে ছিলেন। আমাকে দেখে হাত দিয়ে কাছে ডেকে বলেছিলেন, “বাবু তোর চোখ এমন গর্তে ঢুকে গেছে কেন?” আমি বাবাকে কোন প্রশ্নের উত্তর দেইনাই। বাবার হাত ধরে বসে ছিলাম।

বাবাকে বরং জিজ্ঞেস করি, “তুমি আমাকে কিভাবে পেলে?” বাবা হেসে বলে, “তোর মা আমাকে জানালো তুই বড় হয়ে গেছিস। তোকে দেখে আসতে বললো। তুই তো বেটা একটুও বড় হলিনা। ওইযে হাতে কাটা দাগটা এখনো আছে। আজকে যখন লেকের পারে বসে বসে আনমনে বলছিলাম, মা আসি, মা আসি? তখন বাবাকে দেখতে পেলাম আবার।

বাবা এখনো সেই সৌম্যদর্শন গ্রীক কবিদের মত বিশালতা নিয়ে বেচে আছেন। আমার পাশে বাবা এসে বসলেন। আমাকে বললেন, “বাবু তোর মা খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে কিছুদিন ধরে। বলে তোর অনেক কষ্ট হয়েছে। কোথায় কষ্ট দেখা”।

আমি কিছু বলিনা। বাবাকে বলি, “তুমি আমার সাথে থাকোনা কেন?” বাবা মাথা চুলকিয়ে বলে, “ঠিক আছে থাকবো। পরের আশ্বিন থেকে থাকবো”। আমি বাবার হাত ধরে ঝিম মেরে বসে থাকি। বাবা আমার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, “বাবু মেয়েটা তোর ভালোবাসা যেদিন বুঝবে সেদিন দৌড়িয়ে এসে পড়বে।

ভালোবাসা অনেক পবিত্ররে বাবা, কেউ এটাকে অবহেলা করতে পারেনা”। আমি কিছু বলিনা। বাবা উঠে বসে। এরপর হারিয়ে যায় কোথায় যেন আবার। আমি বিধাতাকে কখনো কোন অভিযোগ করিনি।

আজ ভাবলাম করবো। অভিযোগ করবো, আমার ভালোবাসাগুলো কোথায়?সব হারিয়ে যায় কেন? পাশ ফিরে খেয়াল করলাম একটা নীল শাড়ি পড়া শুভ্র নারী দৌড়িয়ে আমার কাছে ছুটে আসছে। আমি মিতুর দিকে তাকাইনা একবারও। আমার সমস্ত হৃদয়ে তখন অনেক অভিমান। কার প্রতি তা অবশ্য জানিনা।

মিতু আমার পাশে বসে। আমাকে বলে, “আমি খুজতে খুজতে অবশেষে আপনাকে পেলাম। হাত ধরুন। আপনি না আমার হাত ধরতে চাইতেন অনেক”। আমি মিতুর হাত ধরি।

তাকে শুধালাম, “তুমি তো আরেকজনের তাই না?” মিতু মাথা নাড়ে দুপাশে। আমাকে বলে, “আপনার চোখে আমাকে নিয়ে যে ভয়ংকর সুন্দর স্বপ্নগুলো দেখেছি আমি তাতে বন্দী হয়ে গেছি। ধ্রুবর সাথে আমি যখনই কথা বলেছি, যতবার তার পাশে দাড়িয়েছি ততবার মনে হয়েছে আমি কেন আরেকজনের সাথে এভাবে কথা বলছি? আমি তো তার নই। আমি আপনাকে ভালোবাসি কিনা জানিনা অয়ন। কিন্তু আমি আপনাতে বাধা পড়ে গেছি”।

আমি কিছু বলতে পারিনা। আমি শুধু মিতুকে অনেক কাছে টেনে নিয়ে বসি। মিতু বাধা দেয়না, আমাকে শক্ত করে ধরে রাখে। আমি আমার কাধে মাথা দিয়ে রাখা মেয়েটাকে বলি, “আমি তোমাকে আরো স্বপ্ন দেখাতে চাই। দেখবে?” মিতু মাথা নাড়ে।

আমার তখন এক চোখে জল আরেক চোখে নতুন কিছু স্বপ্ন। ****************************************************************** ঈদের সময় ঘরে বসে মুড়ি খেতে খেতে আর খই ভাজতে ভাজতে মিতু নামের মেয়েটার কথা মনে পড়লো। গল্পটা শুধুই এই অসাধারণ মেয়েটার জন্য লেখা হলো। এই মেয়েটা আমাদের সত্যিকার দুনিয়ায় বেচে আছে। তাকে এবং তার শুভ্র জীবনযাপনকে আমি ভালোবাসা জানালাম।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।