আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাহার সঙ্গে কথা (১)



দৃশ্য এক : বিছানায় শয্যাগত মানুষটার চোখে যাতে আলো না লাগে এমনভাবেই টেবিলল্যাম্পটা কাগজের ওপর ফোকাস করে একটা কাব্য নাটকের শেষাংশ লিখে চলেছে মল্লিকা। মানুষটা অর্থাত্ মল্লিকার স্বামী বিজনের কিন্তু তাতেও যথেষ্ট অসুবিধে হচ্ছে। সাদা কাগজে টেলিল্যাম্পের আলো প্রতিফলিত হয়ে দেওয়ালে ছড়িয়ে পড়ছে। তীব্র নয়, ছায়া ছায়া আলোর আভা দেওয়াল থেকে প্রতিফলিত হয়ে বিজনের চোখে এসে লাগছে। লাগাটা সামান্য হলেও বিজনের চেতনায় সেটা অসামান্য বিরক্তিকর হয়ে ওঠায় সে রীতিমতো উশখুশ করছে।

ইতিমধ্যে বার কয়েক বিরক্তিসূচক শব্দও গলা দিয়ে বের করেছে এবং গোটা কয়েক সিগারেট ধরিয়ে কয়েকবার টেনে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়েছে। তবুও মল্লিকার মনযোগ বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি। মল্লিকার এই অখণ্ড মনযোগ বিজনকে ক্রমশই উত্তেজিত করে তুলছিল। তার এই মনযোগ ছিঁড়ে খুঁড়ে তছনছ করার জন্যে আজো বিজন নীলছবি চালিয়েছিল এবং প্রায় ঘন্টাখানেক ছবি চলতে থাকলেও মল্লিকার মন:সংযোগে চিড় ধরাতে পারেনি সে। আসলে প্রায় নিত্যদিন মল্লিকার শরীর নিয়ে ছিনিমিনি খেলার আগে (অবশ্যই নীলছবির স্টাইলে) বিজনের ঐ ছবি দেখার ব্যাপারটা আর মল্লিকাকে বিচলিত করে না।

বিশাল ঘৃণার মেঘ ঢেকে ফেলেছে বিজনকে এবং তার এইসব গা ঘিন-ঘিন করা কাণ্ডকারখানাগুলোকেও। মল্লিকা তাই বিজনের যাবতীয় প্ররোচনাকে তুচ্ছ করেই একমনে নিজের লেখালেখির কাজ করে যেতে থাকে। সাদা কাগজ থেকে প্রতিফলিত উজ্জ্বল আলোর আভায় মল্লিকার প্রোফাইল অসাধারণ সৌন্দর্যে এতটাই ঝলমল করছে যে দেখবো না দেখবো না করেও বার বার বিজনকে তাকাতেই হচ্ছে। শরীরের উত্তাপ ক্রমশ মাথার ভেতরে জমা হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে পৌঁছতে দশ মিনিট সময় নেবে।

বিজন বিছানার ওপর পা ছড়িয়ে উঠে বসলো-- --রাত বারোটা বাজে। আমার কিন্তু ভয়ানক ঘুম পাচ্ছে-- --আজ তোমার মোটেও ঘুম পাচ্ছে না। তুমি আমার জন্যে ওয়েট করছো। আরো একটু সময় লাগবে আমার-- মল্লিকা বিজনের দিকে তাকালো না। লিখতে লিখতেই বিজনের চতুরালি লুফে নিয়ে ছুঁড়ে দিল ওর দিকেই।

ধরা পড়ে গিয়ে বিজনের মাথার পুঞ্জীভূত উত্তাপ সশব্দে ফেটে পড়তে চাইলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ শব্দ করেই দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। এতক্ষণে লেখাটা একটু থামিয়ে ছায়া ছায়া বিছানার দিকে তাকালো মল্লিকা। বিজনের শরীরে জঙ্গলীছাপ একটা বিদঘুটে বেঢপ বারমুডা ছাড়া অন্য কিছু না থাকায় ওর রোমশ শরীরটা হঠাত্ই হাফপ্যান্ট পরা একটা ভালুকের মতো মনে হলো মল্লিকার। ওর মনে হলো বিজনের শরীরে কিছুই না থাকলে হয়তো এতটা অশ্লীল লাগতো না তার।

মাথাটা ঝাঁকিয়ে ফিরে এলো লেখায়। কালকেই লেখাটা পত্রিকায় পাঠাতে হবে। দু-এক মাসের মধ্যে মন ভালো হয়ে যাবার মতো এত ভালো লেখা ওর কলম জুড়ে নামেনি। ফলে ভেতরটা অনেকটাই সাদা হয়ে ছিল। লেখা শেষ হতে হতে সাড়ে বারোটা বেজে গেল।

পৃষ্ঠাগুলো পর পর সাজিয়ে ঝর্ণার আঘাতে আঘাতে প্রায় নিটোল গোল হয়ে যাওয়া কালচে হলুদ পাথরটা চাপা দিয়ে রাখলো। টেবিলল্যাম্পের স্যুইচ অফ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অন্ধকার বিছানার দিকে তাকালো। নাইটল্যাম্প জ্বলছে, কিন্তু চোখদুটো ধাতস্থ না হলে কিছুই দেখা যাবে না। কি ভেবে মল্লিকা কাব্যনাটেকের পাণ্ডুলিপির শেষের কয়েকটা পাতা তুলে নিয়ে বিছানায় উঠে এল। বেড স্যুইচ অন করতেই সাদা আলোয় ঘর ভরে গেল।

বাঁ হাত দিয়ে বিজনকে একটু ঠেলা দিল মল্লিকা-- --এই, শেষটা একটু শুনবে? এটা তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে-- শরীরটা বিজনের শক্ত হয়ে উঠতেই মল্লিকা মনে মনে হাসলো। জেগে আছে বিজন। আর একটু জোরে ঠেলা দিল মল্লিকা-- --শোর না একটু? এই-- --রাত দুপুরে নষ্ট মেয়ের নষ্ট কবিতা শুনতে হবে? কি ভেবেছো তুমি? এইসব জঞ্জাল আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলবে-- ঝট্ করে বিছানায় বিজনকে উঠে বসতে দেখে মল্লিকা চমকে উঠেছিল। তারপর বিজনের বসার ভঙ্গি, দাঁত মুখের চেহারা দেখে আঁতকে উঠলো একপ্রস্থ। বিজন মল্লিকার প্রায় অবশ হাত থেকে সদ্য লেখা কাগজগুলো ফস্ করে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল ঘরের মেঝেয়।

। পৃষ্ঠাগুলো ঘরের বাতাস কাটতে কাটতে ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়লো ইতস্তত:। মল্লিকা বাধা দেবার কোনো অবকাশই পেলো না। পাথর হয়ে গেল মল্লিকা বেশ কিছুক্ষণের জন্যে। বিজন যদি ওর গলাটা টিপে ধরতো তবুও মল্লিকা নড়তে পারেতো না সম্ভবত:।

তীব্র আগুন ঝরো দৃষ্টিতে মল্লিকাকে লক্ষ্য করে বিজন বলে উঠলো-- --মেয়েছেলেদের সাহিত্য নিয়ে নাচানাচির কারণটা আমি বুঝি। ঘরের মানুষে যখন মন ওঠে না তখন খুব সহজেই বাইরে ঢলাঢলি করা যায় পদ্য-টদ্য লিখে। অনেকগুলো অকর্মণ্য ইল্লি-বিল্লি জুটে যায় চারপাশে। এসব নষ্টামি আমি ঢের জানি, বুঝলে? তীব্র গরলে মল্লিকাকে নীল করে দিয়ে বিজন ফের দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। অথচ এই বিজন প্রতিদিন শেভ্ করে কোট-প্যান্ট-টাই পরে অ্যাটাচি হাতে যখন অফিসে যায়, সৌজন্য বিনিময়ের হাসি হাসে, চমত্কার ঢঙে কথা বলে তখন সেই বিজনকে মল্লিকা বুঝতে পারে না।

এই বিজনকেই সে স্পষ্ট করে বোঝে। এই বিজনই তার যাবতীয় রোদ্দুর আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে বলেই অন্ধকার থেকে আলোয় দৌড়োবার তীব্র আবর্তে মল্লিকা প্রতিনিয়ত ছটফট করে। মল্লিকা প্রতিমুহূর্তে অনুভব করে তার আকাশটা বড্ড ছোট। সেই আকাশটুকুও বিজন তার আশি কেজি ওজনের রোমশ শরীর দিয়ে সর্বদা ঢেকে রাখতে চায়! প্রস্তুতি নয়, আবেগ নয়, খুশির ঢেউ তোলা নয়, বিজন তার জান্তব স্পৃহা মেটাতে মল্লিকা নামের যন্ত্রটাকে ব্যবহার করতে পারেনি---তাই সমাজ ও লোকচক্ষুর আড়ালে বিজনের এই অন্য চেহারা। এই বিজনকে সে সকলের সঙ্গে পরিচয় করাবে কি করে? ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে এল।

আর একটা ক্লেদাক্ত রাত কেটে গেল নির্ঘুম। মল্লিকা নি:শব্দে বিছানা থেকে নেমে এসে মেঝেয় পড়ে থাকা কাগজগুলো একট একটা করে তুলে নিল। তার বেঁচে থাকা জীবনের আসল মানেটা এই কাগজগুলোর মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। যে কোনো মূল্যে মল্লিকা এই মানেটাকেই রক্ষা করে যাবে। বিজনের কাছে হার না মানার সঙ্কল্প নিয়ে মল্লিকা শোবার ঘরের দরজা হাট করে খুলে দিল।

দৃশ্য দুই : কাব্য নাটকটা শেষ হয়েছে এই খবরটা সকালেই মল্লিকা ফোন করে জানিয়ে দেওয়ায় অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছে নীলাঞ্জন। অফিস যাওয়ার পথে মল্লিকার স্কুল থেকে পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে 'স্বদেশ' পত্রিকার বিশেষ সাহিত্য সংখ্যার জন্যে সম্পাদককে জমা দিয়ে দেবে। পথেই শেষাংশটুকু পড়ে নেবে। দিন দিন মল্লিকার লেখার জোর বাড়ছে। নীলাঞ্জনের অভিজ্ঞতা বলছে মল্লিকা অনেকদূর যাবে।

'স্বদেশ' সম্পাদক সুধাময়দাও একই বিশ্বাস পোষণ করছেন। তিনি চান মল্লিকা লেগে থাকুক। নিজের গল্পটা শেষ করে কয়েকটা পাতা লিখতে লিখতে মল্লিকার কথাও ভাবছিল নীলাঞ্জন, নিটোলভাবে নয়, টুকরো টুকরো ভাবে। লিখতে লিখতে অন্য কোনো ভাবনা ফাঁক-ফোকড়ে অনুপ্রবেশ করলে লেখাটার জন্যে একটু সময় বেশি লাগে মাত্র। লেখার অঙ্গহানি ঘটে না।

--আজ বুবানের স্কুলে সাড়ে এগারোটায় যেতে হবে, মনে আছে তো? টেবিলের একপ্রান্তে কফির কাপটা ঠক্ করে নামিয়ে নীলাঞ্জনকে চমকে দেওয়ার ব্যাপারটা সেরে অঞ্জলি অত্যন্ত দ্রুত জরুরি কথাটা মনে করিয়ে দিল। কিন্তু যথারীতি বিপন্ন বিস্ময়ে নীলাঞ্জন দু'এক মুহূর্ত ফ্যাল ফ্যাল করে অঞ্জলির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ভ্রূ বেঁকিয়ে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে অঞ্জলি ফের বলে উঠলো-- --মল্লিকাকে সময়টা দিয়ে দিলে বুঝি? আর একবার ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলো নীলাঞ্জন। কিচেনের মিশ্রিত শব্দ ছাপিয়ে মল্লিকার সঙ্গে ফোনে সামান্য দেড় মিনিটের কথাটাও কান পেতে 'রিসিভ' করে নিয়েছে অঞ্জলি। নীলাঞ্জনকে বলতে হলো-- -- আসলে দিন সাতেক আগে কথাটা বলেছিলে তো---তাই ঠিক মনে নেই-- --কি করে রাখবে? ঠিকই তো--- লেখক বলে কথা! আসলে কি জানো, আমি তোমার রান্নাঘর থেকে বিছানা সব কিছুই সামলাই।

আর মল্লিকা তোমার মতোই লেখে--পত্র-পত্রিকায় তোমাদের লেখা একসঙ্গে ছাপা হয়। মল্লিকার কথা ভোলার কোনো উপায়ই নেই-- --বড্ড বাজে কথা বলো তুমি। বিচ্ছিরি এক ঈর্ষায় তুমি অকারণে আমাকে আজেবাজে কথা বলে বলে প্ররোচিত করছো কিন্তু! --অর্থাত্ আমার ঈর্ষার কারণেই তুমি মল্লিকা-গত প্রাণ হবে। ফাইন! --অসম্ভব! তোমার সঙ্গে কথা বলাটাই-- --ইদানীং ভীষণ বোরিং! বুবান ক্লাস নাইনে পড়ছে। তিতলি ক্লাস সেভেনে।

চারজনের সংসারে তেল-কালি মাখতে মাখতে আমিও কিম্ভূত হয়ে গেছি। তোমার আলমারিতে বিয়ের একবছরের মধ্যে ছাপা 'নীলাঞ্জলি' পদ্যের বইটা কি এখনও আছে? অপরিণত কবির কলমে অঞ্জলির সে কী রূপ, কী প্রণয়াবেগ-- --অফিসে আমার জরুরি কাজ আছে, এখন আর চেঞ্জ করার উপায় নেই-- (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।