আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টুকরো টুকরো একাত্তর: পর্ব - ১ (আব্বা বেঁচে আছেন!)

শালিক পাখি মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি পৃথিবীতে আসি নাই। ইতিহাস পড়ে অনেক কিছুই জেনেছি। তবে ইতিহাসেও যে ভেজালের চেষ্টা করা হয়, তা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। সঠিক ইতিহাস যে কী, তা আমি জানি না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিয় ইতিহাস, আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী ইতিহাস, এটাই আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস।

আর তাই আমার পরিবারের যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকেই জানতে চেয়েছি টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো। তাঁরা হয়তো ইতিহাসের পাতায় অতো ইম্পর্ট্যান্ট কেউ ছিলেন না, কিন্তু আমার জন্য তাঁদের কথা অনেক ইম্পর্ট্যান্ট। তাঁদের কাহিনীগুলো শুনে শুনে যেনো আমার মন বার বার ছুটে গেছে সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোয়। আমার এই ধারাবাহিক সিরিজে আমি তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া সেই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলোর কথাই শেয়ার করবো। আমার নানা মুক্তিযুদ্ধের আগে বিএডিসিতে (বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন, তত্কালীন ইপিএডিসি) চাকরি করতেন।

যুদ্ধের সময় তাঁর পোস্টিং ছিলো রাঙামাটিতে। আর তখন তাঁর পরিবার থাকতো ঢাকার খিলগাঁওয়ে। মার্চে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর পরই তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মা, খালারা, মামা, নানু সবাই খুব দুশ্চিন্তা করতেন। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন হয় তিনি ইন্ডিয়া গেছেন, অথবা তিনি আর জীবিত নাই।

মহল্লার কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন তিনি রাঙামাটিতে কাজ করছেন। এরই মধ্যে এপ্রিল-মে এর দিকে একদিন মুক্তিযোদ্ধা লুত্ফুর রহমান বিনু আমাদের খিলগাঁওয়ের বাসায় আসেন। তিনি ঐ বাসার পাশের বাসায়ই থাকতেন। তিনি ছিলেন একজন প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা, যিনি যুদ্ধের শুরুর দিকেই চলে যান ইন্ডিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য, আর যত দ্রুত সম্ভব প্রশিক্ষণ শেষ করে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। বলে রাখা ভালো, নানার পরিবার খিলগাঁওয়ের বাসায় যান ১৯৭০ সালে।

তাই আশেপাশের কারো সাথে অতো ভালো সম্পর্ক ছিলো না, যার সাথে নানার ব্যাপারে মন খুলে কথা বলা যায়। সেই অস্থির দিনগুলোতে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন তিনি ইন্ডিয়া গেছেন বা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, এটা লুকানোর জন্য নানার পরিবারের পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো কমতি ছিলো না, যাতে রাজাকারদের কুনজর তাঁদের উপরে না পড়ে। যাই হোক, মুক্তিযোদ্ধা বিনু আমার নানুর সাথে কথা বললেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "ভাবি, সত্যি করে বলেন তো, ভাইজান কোথায়? আমি আগরতলায় ভাইজানের মতো দেখতে একজনকে দেখেছি।

উনি কি ইন্ডিয়া গেছেন?" তখনো বাসার কেউ জানেন না যে আসলে নানা কোথায়। এর মধ্যে আবার এমন প্রশ্নে তাঁরা দারুণ ভড়কে গেলেন। বিনু কি আসলেই মুক্তিযোদ্ধা, নাকি ছদ্মবেশী রাজাকার, যে নানার ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছে? তাঁকে বিশ্বাস করে যদি ঠকতে হয়? আবার আসলেই যদি তিনি মুক্তিযোদ্ধা হন, তাহলে হয়তো তাঁর কাছ থেকে নানার কিছু খোঁজ পাওয়া যাবে। হয়তো নানা বেঁচে আছেন ইন্ডিয়ায়! এরকম আশা নিরাশার দোলাচলে তাঁরা বিনুকে বিশ্বাসের উপরই জোর দিলেন। তাঁরা তাঁকে সব খুলে বললেন যে হয়তো নানা ইন্ডিয়া থাকলেও থাকতে পারেন, যদিও তাঁরা নিজেরাই নিশ্চিত না।

বিনু তাঁদের আশ্বস্ত করলেন, যেভাবেই হোক, ওনার খবর তাঁদের কাছে পৌঁছে দেবেন। এরপর বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। বিনু আগরতলায় গিয়ে নানার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেন। তিনি জানতে পারেন, আমার নানা তখন কাজ করছেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মচারী হিসাবে। তিনি তাঁর সাথে যোগাযোগ করেন ও বাসার খবর জানান।

নানা তাঁকে তাঁর ব্যবহৃত একটা গামছা আর একটা সাবান দেন, যাতে এটা দেখে আমার নানু আর মা-খালা-মামারা বুঝতে পারেন যে তিনি জীবিত আছেন আর সত্যি সত্যিই বিনুর সাথে তাঁর কথা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা বিনু তাঁর সেই গামছা আর সাবান নিয়ে আবার আসেন সেই খিলগাঁওয়ের বাসায়। নানার মেজো মেয়ে, আমার মা, তাঁর সেই গামছা আর সাবানে গন্ধ শুঁকে চিত্কার করে ওঠেন, "আব্বা বেঁচে আছেন!" ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.