আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

।।---দ্যা পিয়ানো প্লেয়ার---।।

যতোবার আমি শান্তি খুঁজেছি, ঠিক ততোবার আমার মাথায় শুধু একটি চিন্তাই এসেছে। সেটা হচ্ছে একটা ড্রিল মেশিন দিয়ে মাথার খুলিটা ফুটো করে দেওয়ার চিন্তা। আমি এখনো দূর হতে তাকে দেখি। বিশাল বড় হোস্টেল। হোস্টেলের সামনের বড় নারকেল গাছের পাতা গুলি সব সময়ই দোল খায়।

হোস্টেল ঠিক যতো বড়, গেটটা ঠিক ততোটাই ছোট। প্রতিদিন ৮ টার সময়ে ঢুলুঢুলু চোখে সে গেট থেকে বের হয়। ক্লাসে যেয়েও ঘুমায় কিনা কে জানে। মাথার চুলগুলো সবসময়ই এলোমেলো। তবু এলোমেলো ছোট চুলে তাকে কেন যে এতো ভালো লাগে, আমি জানি না।

আমি প্রতিদিন এখানে ৭.৪০ এ এসে দাড়াই। প্রতিদিন, মানে গত ৩ মাস ১৪ দিন ধরে আর কি। শুধু শুক্রবার দাড়িয়ে থেকেও লাভ হয়না। তাই শুক্রবার এর দিন গুলোতে আমার খুব কষ্ট হয়। শুক্রবার আমার তাই ভালো লাগে না।

শুক্রবার পচা। আজ আসতে একটু দেরী হয়ে গেলো। ৭.৫২ বাজে। তবু আমি মোটামুটি নিশ্চিত সে এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। তাকে দেখার জন্য আমার প্রতিদিন ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়।

অপেক্ষা করতে খুব একটা খারাপ লাগে না। অপেক্ষাও যে মাঝে মাঝে এতো মধুর হয়, তা কে জানতো? ও মা!! ভ্র কুচকাচ্ছেন কেন? আমি বখাটে নই। আমি এমনকি তার সাথে কোনোদিন কথা বলার চেষ্টাও করিনি। আমি শুধু দূরে দাড়িয়ে থাকি, তাকে একপলক দেখার জন্য। যাকে ভালোবাসি, তাকে প্রতিদিন এক পলক দেখা কি দোষ? তবে হ্যা, এরকম ভাবে নির্লজ্জের মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখলে কেউই ভালো ভাবে নিবে না ব্যাপারটা।

প্রথম প্রথম আমারও খুব অস্বস্তি লাগতো। কয়েকটা মেয়ে এখানে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতো, ফিস ফিস করে কথা বলতো। আরে কি অদ্ভুত!! আমি কি মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা ১০ হাত পা ওয়ালা কোন বস্তু নাকি!! শুধু সে ই কোনদিন কিছু বুঝে নি। তবে এখন ভালো হয়েছে, এখন আর আগের মতো অস্বস্তি নিয়ে দাড়াতে হয়না। ওর নাম নিহা।

নিহা প্রচণ্ড রেগুলার স্টুডেন্ট। কলেজেও, এমনকি হাসপাতালেও। এতো মেডিকেল স্টুডেন্ট দেখলাম, ওর মতো রেগুলার আর কাউকে দেখলাম না। নির্ঘাত সে বিশাল এক ডাক্তার হতে যাচ্ছে!! নিহাকে আমি প্রথম দেখি হাসপাতালের ওয়ার্ডে। তখন আমি হাসপাতালে ভর্তি।

টানা ৪ দিন ধরে অচেতন। সেরেব্রাল হেমোরেজ এর পেশেন্ট অচেতন থাকবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না। বরং চেতনা ফিরে সুস্থ হওয়াটাই যে কিছুটা অস্বাভাবিক। কিভাবে ফিরলাম কে জানে। টানা ৪ দিন মা এর চোখে ঘুম নেই।

মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। ৪ টা দিন আগের আর ৪ টা দিন পরের পৃথিবীটা কত আলাদা !!! ভাবলেও অবাক লাগে। ধুসর নিষ্ঠুর পৃথিবীটা রাতারাতি যেন শান্ত,মায়াবী একটা ভুবনে পরিনত হয়ে গেলো। যেদিন জ্ঞান ফিরে, ওইদিনই আমি ওকে প্রথম দেখি। ছোট ছোট চুল।

হালকা পাতলা, মায়াময় চেহারা। ওয়ার্ড এর এক কোনায় দাড়িয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করছিলো। বাকি ১০ টা মেয়ের সাথে তার কিছু একটা পার্থক্য আছে । কি পার্থক্য , আমি সেটা ধরতে পারিনি। ২ ঘণ্টা পরে সে যখন চলে গেলো ক্লাস শেষে, তখনো জানতাম না আমি, তাকে ঘিরে আমার এরকম একটা অনুভুতি তৈরি হবে।

ওই দিন সন্ধ্যাতে কারন ছাড়াই ঘুরে ফিরে তার কথা মনে হতে লাগলো বারবার। তার ঔদাসিন্য, তার নির্লিপ্ততা । কয়েক ঘণ্টার মাঝে তাকে আরেকবারের জন্য এক পলক দেখার ইচ্ছাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হল। কিন্তু কিছুই করার নেই। কি ই বা আমি করতে পারি? ইচ্ছে হল কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসা করি।

পরক্ষনেই নিজেকে একটা আহাম্মক মনে হল। চিনিনা, জানিনা একটা মেয়ের কথা কার কাছে জিজ্ঞাসা করবো আমি? ভয়ে ভয়ে মা এর দিকে তাকালাম। কিছু বুঝেনি তো আবার? বুকের ধুকপুক আওয়াজ তো বাইরে থেকেও শুনা যাচ্ছে। মা আবার না ডাক্তার ডেকে বসে!! দাতে দাত চেপে শুয়ে থাকলাম। কাল আবার দেখতে পাবো তো? আমি কিছু জেনে বুঝে উঠার আগেই আমার অসুস্থ মস্তিষ্কটা ভয়ংকর ভাবে নিহা নামের মেয়েটার প্রেম এ পড়লো।

দ্বিতীয় দিন সে এলো ঠিক ৯ টায়। আশ্চর্যের ব্যাপার, ওই দিন তাকাতেই পারলাম না ঠিকমতো। যদি বুঝে ফেলে!!!! তাকে বুঝতে দিতে চাই না!! শুধু তার উপস্থিতিই আমার কাছে অনেক বড় কিছু ছিলো হয়তোবা। প্রেম এ পড়লে মানুষের বোধ হয় খুব ছোট প্রাপ্তিতেও অসাধারণ সুখ হয়!! অবশ্য নিহা কিছু বুঝেনি। আমার মা ই বুঝেনি, নিহা তো দুরের কথা।

ইচ্ছা করেই বুঝতে দেইনি। জীবনের শেষ কয়টা দিনে কারো কষ্ট বাড়াতে চাই নি। কেউই জানতোনা, শুধু আমি জানতাম, আমি চলে যাবো। বাবা শুকনো মুখে বসে থাকে পায়ের কাছে। কে বলবে এই বাবা দুনিয়ার মাঝে সবচেয়ে ব্যস্ত বাবা? আমি অবাক হয়ে দেখি।

বাবাকে বলি- "আব্বু, তোমার অফিস নেই?" "যাবনা আজকে। কাল যাবো। " "প্রতিদিনই তো বল- কাল যাবো, কাল যাবো। গেছো একদিন ও? মনে তো হয়না। " "তুই সুস্থ হ।

তারপরে যাবো। " "আব্বু , আমি সুস্থ। কোন সমস্যা নেই। যাও তুমি। আর আম্মু তো আছেই।

রুকু কই?" "স্কুলে গেছে। বিকেলে নিয়ে আসবো নে এখানে। " মা আছে সারাক্ষন আমাকে খাওয়ানোর চিন্তায়। সারাক্ষন মাথার কাছে ঘুরঘুর করে। আর প্রতি ১০ মিনিটে একবার জিজ্ঞাসা করে- "তোর কি কিছু লাগবে? খাবি কিছু এখন?" "নাহ।

দিনের মধ্যে কয়বার খাব? একটু আগেই তো খেলাম। আম্মু, এতো দৌড়াদৌড়ি করোনা তো। চুপ হয়ে বসতে পারো তুমি? নাকি পারো না? কোনটা?" বাবা মা এর মুখ থেকে শঙ্কার ছায়া তবুও সরে না। বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে তারা বসে থাকে আমার পাশে। আমার বুকটা কেপে উঠে।

তবু আমি চোখ মেলে তাদের দিকে চেয়ে একটু হাসি। নির্ভয়ের হাসি, আশ্বাসের হাসি। মিথ্যা হাসি। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় এক ভাইয়া এসে চেক আপ করে যায়। ভাইয়াটা এতো ভালো, এত্ত সুন্দর করে হাসে, মনটা ভালো হয়ে যায়।

"কি খবর ইয়াংম্যান?" "এইতো, ভালো। " "দেখি তো একটু চোখটা। " ভাইয়া গভীর মনোযোগে আমার চোখের মনি এর সংকোচন প্রসারন খেয়াল করে। "এবার একটু উঠে দাড়াও তো, ইয়াংম্যান। " ভাইয়া আমাকে ধরে দাড়া করিয়ে দেয়।

অদ্ভুত মূর্ছনা বেজে চলে কোথাও। আমি সেই ছন্দের তালে তালে হেটে বেড়াই। "বাহ, তুমি তো পুরদস্তুর ফিট!! এখন তো পারলে ফুটবল ও খেলতে পারবে দেখছি!!! ভাইয়া এর চোখ মুখ জুড়ে আত্মতৃপ্তির ছোঁয়া। স্যার রাউন্ডে এলে আজই হয়তো রিলিজ পেয়ে যাবে। " ২ ঘণ্টা পর বাবাকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন ডাঃ সেন।

"বসুন, জামান সাহেব। কেমন আছেন?" "জী ভালো। " "কি খবর আপনার ছেলের? খাওয়া দাওয়া করে ঠিকমতো?" "খেতেই তো চায়না একেবারে। তবে হ্যা,আগের চেয়ে ভালো। " "হম, এই অল্প কদিনেই সে যেভাবে রিকভার করলো, ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট।

আমি ভাবিনি সে এতো তাড়াতাড়ি আবার নিজেকে ফিরে পাবে। এখন আর তেমন কোন সমস্যা নেই। আপনি চাইলে ওকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। " "আজই?" "আজও নিতে পারেন, অথবা কাল, যেদিন ইচ্ছা। " "তাহলে আজ থাকুক, কাল নিয়ে যাবো।

" "ok, আপনার যেটা ভালো লাগে। তবে হ্যা, তাকে কিন্তু বিশ্রামে রাখতে হবে। আর এখন চার্ট করে দিবো, কিছু জিনিস মেনটেন করতে হবে। বুঝতে পারছেন?" "কিন্তু এমনটা হওয়ার কারন কি?" "দেখুন, আমি ওর সমস্ত রিপোর্ট দেখেছি। খুব ভালোভাবেই দেখেছি।

দেয়ার ইজ নো সাচ অ্যাবনরমালিটি আই হ্যাভ ফাউন্ড। ওর বয়সী এমন ছেলের এমনটা হওয়ার কথা না। এমন ও না যে ওর ব্লাড প্রেশার অস্বাভাবিক। সবকিছুই নরমাল। CT Scan , MRI রিপোর্ট থেকে হেমোরেজ এর কোন কারন খুজে পাওয়া গেলো না।

তবে ওর EEG অন্য সবার থেকে একটু আলাদা। দিস ইজ, সামহাউ মিস্টেরিয়াস। " "সেটা কিরকম?" "ব্রেন নিউরনের ইলেকট্রিকাল সিগনালিং এর ব্যাপার স্যাপার। তবে এটার সাথে হেমোরেজ এর কোন সম্পর্ক থাকার কথা না। যাই হোক, ওকে ক্লোজ অবসারভেশনে রাখবেন।

আর কোনভাবেই যেন উত্তেজিত না হয়, বা স্ট্রেস না পড়ে ওর উপরে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। " "না ডাঃ সেন, ধ্রুব খুবই শান্ত ছেলে। আমি তাকে কোনদিনই স্ট্রেস নিতে দেখিনি। " "হম, সেটা ওকে দেখলেই বুঝা যায়। যাই হোক, সামনের দিন গুলিতে ওর জন্য বেশ রিলাক্সিং কিছু দরকার।

পড়াশুনা ছাড়া কি ওর আর কোন আলাদা অ্যাক্টিভিটি আছে, যেটাতে সে কমফোর্ট ফীল করে?" "ও পিয়ানো বাজায়। অসম্ভব সুন্দর পিয়ানো বাজায়। " "বাহ!! চমৎকার। একদিন তাহলে আপনার বাসায় তো যেতেই হয় পিয়ানো শুনতে!" "আমার বাসায় আপনাকে এম্নিতেও আসতে হবে ডাঃ সেন। ধ্রুবকে বেশ কদিন পরপর একবার চেক আপ করাব ভাবছি।

" "হা হা , আচ্ছা ঠিক আছে। যাবো আপনাদের বাসায়। " ডাঃ সেন আমার সমস্যা ধরতে পারেন নি। জানলে কখনোই আমাকে আর পিয়ানোর কাছে যেতে দিতেন না। শুধু আমিই জানি, আমার অসুস্থতা এর কারন।

আর কেউ জানতোনা। আজ কাউকে আমার গোপন কথাটা বলতে ইচ্ছা করছে খুব। মারা যাওয়ার আগের দিনগুলি এতো সুন্দর না হলেও হতো। ৩ টা মাস প্রতিটা দিন পুরো ২৪ বছরের স্মৃতিকে বিস্মৃতিতে সরিয়ে নিজের জায়গা করে নিয়েছে অদ্ভুতভাবে। ভাবতে অবাক লাগে আমার এখন কোন শৈশবস্মৃতি নেই।

চাইলেও মনে করতে পারছি না। শুধু মনের আকাশে ভেসে বেড়ায় ৩ মাসের ছবিগুলো। মনের আকাশের কোনায় জমে থাকে নীল হয়ে থাকা একরাশ মায়া। আমি এখনো পা ঝুলিয়ে বসে থাকি আমাদের বাড়ির দেয়ালে। এখানে গাছের পাতার ফাকে ফাকে নীলাকাশ , খেলা করে তপ্ত বাতাস।

বিকেলে খেলতে নামা বাচ্চাগুলোর খিলখিল হাসি সময়কে হাচড়ে পাচড়ে টেনে নিয়ে চলে পিছনের দিকে। শেওলাধরা পুকুর ঘাটটিতে এককালে ঘুরে বেড়াতো ছোট ছোট অজস্র মাছ। সবুজ পানি, পানির নিচে বড় দরজা। জানালার ফাক দিয়ে নরম আলো ঠিকরে পড়ে আমার পিয়ানোর উপরে। জমে থাকে ধুলো, পড়ে থাকে মায়া।

আর সুর উঠেনা বাবার বেহালায়। দেয়াল থেকে নেমে সামনে আগাই। শূন্য দেয়ালে থেমে থাকে ছায়াটা। বায়ে মোড় নিলেই সেই ছোটবেলার সরু মেঠো পথ। ধোয়াটে বিকেল চলে যাওয়া শীতকাল কে আর একবার মনে করিয়ে দেয়।

বহু দূরে বিলের ধারে দেখা যায়, ছোট্ট বাড়িটি, যেখানে সুর করে পুথি পড়ে আজও হয়তো কেউ। জলের মাঝে দাড়িয়ে আছে পাতা না মেলা দুটো শাপলা, কবে তা মেলবে পাতা জানিনা। মৃদু বাতাসে জলের ঝিরি ঝিরি কাপন দেখতে বড় ভালো লাগে। এমন বিকেলে আমার খুব বেচে উঠতে ইচ্ছা হয়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় নিহার গান।

আহা, একটাবার যদি নিহাকে দেখাতে পারতাম এই বিকেলগুলো। আমি নিহাকে পাওয়ার কোন চেষ্টা করিনি। আমি জানতাম, আমি অতি দ্রুত শেষ হয়ে যাবো। আমি চলেই গেছি কিন্তু নিহা এখনো কিছু জানেনা। তার একটা স্বাভাবিক জীবন আছে।

সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ আছে। কেন আমি নিজ হাতে তা নষ্ট করবো? আমি সুর সৃষ্টি করি, সুর ধ্বংস করিনা। একটা গোপন কথা শুনবেন? প্লিজ আমাকে পাগল ভাববেন না। আমি পাগল নই। আমি মিথ্যাও কম বলি।

একেবারে না পারলে বলি না। ছোটবেলায় বলতাম। মা এতো এতো খাবার দিতো খেতে, না খেলেই চিল্লাচিল্লি। ছোটবেলায় খাবার কাক কে দিয়ে মা কে তাই বলতাম- খেয়ে নিয়েছি পুরোটা। যাই হোক, কথাটা বলি।

আমি মানুষের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সুর পড়তে পারি। বুঝলেন না? না বুঝারই কথা। জানতাম কাউকে বুঝাতে পারবো না । তাই কাউকে বলাও হয়নি। এটা এতো অদ্ভুত একটা অনুভুতি, কি করে বোঝাবো? প্রতিটা মানুষের একটা নিজস্ব আলাদা সুর আছে।

যে সুরে তার মস্তিস্কের প্রতিটা নিউরনে আনুনাদ ঘটে। প্রতিটা মানুষের মুল সুরের কম্পন ভিন্ন, তাই মুল সুরটাও ভিন্ন। আমাদের যে সব সঙ্গীত ভালো লাগে, তা এই মুল সুরটার কাছাকাছি কোন সুর, কিন্তু প্রকৃত সুরটা নয়। তাইতো প্রতিটা মানুষের সঙ্গীত রুচি এক অপরের থেকে আলাদা। আমি মানুষের সেই সুরটা পড়তে পারি।

আমি কারো কণ্ঠস্বর শুনে তার মস্তিস্কের কম্পন ধরতে পারি। আমি জানি, কোন কম্পাঙ্কে সেখানে একটা অনুরনন ঘটবে। আমার পিয়ানোতে তোলা সব সুরই কোন না কোন মানুষের অব্যক্ত মধুর সুর। আমি জানি একটা মস্তিস্ক কি চায়। আমি জানি না কিভাবে এটা সম্ভব কিন্তু আমার এটা হয়েছে।

তবে এটাতে আমার অসম্ভব রকম কষ্ট হত। মাথার অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে কুড়ে কুড়ে শেষ করে ফেলতো। মনে হতো, এখুনি বুঝি মরে যাবো। জানতাম, এই ক্ষমতা প্রাননাশী, একদিন আমাকে এটা শেষ করবে, তবুও পারতাম না এটার থেকে দূরে থাকতে। এটা হয়তো নেশার চেয়েও ভয়ংকর কোন কিছু ছিল।

এটা যে কি, আমি জানিনা। আমি আড়াই বছর ধরে ধীরে ধীরে তৈরি করেছি এসব সুর। কেউই জানেনা সেটা, কাউকে শোনানোর ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনটাই ছিলনা। শুধু মানুষ জানতো এতোটুকুই, যে আমি ভালো পিয়ানো বাজাতে পারি। দুই বছরে সৃষ্টি করা সব সুর আমি আপলোড করেছি মাইস্পেস এ, মৃত্যুর ঠিক দুই দিন আগে।

এতদিনে হয়তো মানুষ তা পেয়েছে। তবে আমার খ্যাতির দরকার নেই। যেই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রন করা যায়না, সেটা আশীর্বাদ নয় , অভিশাপ। অভিশাপ নিয়ে গর্ব করা যায়না। তিন মাস আগে যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম, তখনই বুঝেছিলাম সময় বেশি নেই।

আমার শুধু আর একজনের সুরই প্রয়োজন ছিল তখন। সে হল নিহা। নিহা কোনদিন ও জানবে না তার অকল্পনীয় মধুর সুরে নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে একটা ছেলে কিভাবে শেষ হয়ে গেছে। আফসোস একটাই , নিহার সুর পিয়ানোতে তুলবার সময়টুকুও মেলেনি যে ছেলেটার। আফসোস, সুরের মালিককে সুরটা ফেরত দেয়া হয়নি তার।

আমি আগের মতোই আছি। আগের মতো এখনো দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে আমার ভালো লাগে। আগের মতোই হেটে বেড়াই ক্লান্ত বিকেলে। শুধু সন্ধ্যার সময় আমার অনেক খারাপ লাগে। আমার আর আগের মতো ঘরে ফেরা হয়না সন্ধ্যায়।

সামনের মাঠের ঘাসে বসে আমি অপেক্ষা করে যাই, পরের দিনের। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে। রাতজাগা পাখিরা চুপ করে বসে থাকে গাছের ডালে। আমি তাদেরকে গান গেয়ে শোনাই। নিহার গান।

চাদের আলোয় পৃথিবীটা অদ্ভুতুড়ে লাগে। আজ বোধ হয় পূর্ণিমা। ঠিক এরকম এক রাতেই আমি পাড়ি দিয়েছিলাম অন্য এক ভুবনে। সব রাত কেন পূর্ণিমার রাত হয়না???  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.