আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাদ্দাফি

প্রবাসী কর্নেল মোহাম্মাদ মোয়াম্মার আল গাদ্দাফি বা সংক্ষেপে গাদ্দাফি। পৃথিবীতে বেশি দিন ক্ষমতাসীন শাসকদের মধ্যে ৪র্থ আর আফ্রিকাতে এবং আরবদের মধ্য সবচে’ বেশী দিন ধরে ক্ষমতাসীন লিবীয় নেতা গাদ্দাফি। ১৯৪২ সালে ভুমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় শহর “সার্ত” এ বেদুইন পরিবারে জন্ম নেন গাদ্দাফি। বেনগাজী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগে ভর্তি হয়েও তা শেষ না করে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের ১লা সেপ্টেমবর রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুথানে রাজা ইদ্রিসকে কে উতখাত করে তৎকালীন সামরিক বাহিনীর যে ২৭ বছরের যুবক অফিসার “ক্যাপটেন গাদ্দাফি” ক্ষমতা দখল করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ৪২ বছর আগে , তার পরিসমাপ্তি ঘটল।

প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন তবে পরে সমস্ত দাপ্তরিক পদ ত্যাগ করেন এবং নিজেকে “ ব্রাদার লীডার” হিসেবে অভিহিত করেন। ৬৬ লক্ষ অধিবাসী আর প্রায় ১৮ লক্ষ বর্গ মাইল এলাকার তেল সম্বৃদ্ধ মরুভুমির দেশ লিবিয়া। বিতর্কিত, খাম খেয়ালী নেতা গাদ্দাফী ছিলেন চরম অসহিষনু, এবং প্রেসিডেন্ট রিগানের ভাষায় “ Mad Dog ”. গাদ্দাফি ১৯৭৭ সালে দেশের নাম পরিবর্তন করে রাখেন” Great Socialist Popular Libyan Arab Jamahiriyah” গাদ্দাফির দর্শন ছিল জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশ বিরোধী এবং ইসলামের জগাখিচুড়ি। তার রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশ করেন নিজের লেখা “ গ্রীন বুক” এ। মিশরের জাতীয়তাবাদী নেতা গামাল আব্দুল নাসের ছিলেন তার রাজনৈতিক আদর্শ।

ক্ষমতায় আসার পর এ যাবত দেশ শাসন করে এসেছেন কঠিন হাতে। একনায়ক গাদ্দাফির লিবিয়াতে ছিল না কোন বিরোধী শক্তি। রাজনৈতিক বিরোধিতা ছিল নিষিদ্ধ। যে যমস্ত ইটালীয় অধিবাসী সে দেশে বসবাস করত তাদের বিতাড়ন করেন। ইংরেজী ক্যালেন্ডার খৃস্টান বিবেচনা করে তা হিজরী তে রুপান্তরিত করেন আর মাসের নাম গুলোও পরিবর্তন করেন।

যেমন ১৯৬৯ সাল হল ১৩৬৯ সাল আর আগস্ট মাস হল “হানিবাল” সংবাদ পত্র এবং প্রচার মাধ্যম ছিল কঠোর ভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রনাধীণ। বিদেশী তেল কোম্পানী গুলো যা লিবিয়ার তেল সম্পদ লুট পাট করে খেত তাদের কাছ থেকে আগের ৫০/৫০ ভাগ তেল রাজস্বের পরিবর্তে ৭৯/২১ ভাগ আদায় করেন। ১৯৭৩ সালে আরব ইজরায়েল যুদ্ধের পর পশ্চিমা দের বিরুদ্ধে “তেল অবোরোধ” আরোপের নায়ক ছিলেন গাদ্দাফি। বিদেশী ভাষা ইংরেজীর পরিবর্তে রাশিয়ান ভাষা চালু করার উদ্যোগ নেন। বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল গঠন করেন এবং সমস্ত সরকারী অফিস আদালত, ফ্যাক্টরী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে তলেন গুপ্তচর নেটওয়ার্ক।

সরকারের সমালোচনা করলেই ছিল মৃত্যু। ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রকাশ্যে ফাসি তে ঝুলিয়ে হত্যা করা হত এবং তা রাস্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখান হত। উত্তর আফ্রিকার অনারব অধিবাসীদেরকে বলা হয় বারবার। বারবারদের সম্পর্কে তার ধারনা ছিল নেতিবাচক। বারবারদের দেওয়া বিভিন্ন যায়গার নাম গুলো পরিবর্তন করে নতুন নাম করন করেন এবং ছেলে মেয়েদের বারবার নাম রাখা নিষিদ্ধ করেন।

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মদদ দাতাঃ- এ গুলোর মধ্যে আছে ১৯৮৮ সালে স্কটল্যান্ডের লকারবির উপর প্যান আম বিমান সংস্থার জেট বিমান বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাতে ২৭০ জন প্রান হারান। প্রথমে অস্বীকার করলেও ২০০৪ সালে দায়িত্ব স্বীকার করে নেন, এবং নিহতদের প্রতি পরিবারকে ১০ লক্ষ ডলার পর্যন্ত ক্ষতিপুরন দেন। অভিযুক্তদের তুলে দেন আন্তর্জাতিক আদালতের হাতে। ১৯৭০ এর দশকে বেনগাজী এবং ত্রিপোলিতে আন্দোলন রতছাত্রদের দমন করেন কঠো্র হাতে, শহরে প্রকাশ্য স্কোয়ারে ছাত্রদের ফাসি দেন। নিজস্ব মতামতের বিপ্লব ঘটানোর আশা করতেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।

কলম্বিয়ার FARC এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের IRA গেরিলাদের সহায়তা দেন। বিদেশে অবস্থআনরত ভিন্ন মতাবলম্বীদের গুপ্তহত্যাতে অর্থ যোগান দেন। সবচে কঠোর অমানুষিকতার পরিচয় দেন আবু সালিম কারাগারের প্রায় ১২০০ জেলবন্দিকে ৩ ঘন্টার ও কম সময়ে হত্যা করে। ১৯৮৬ সালে বার্লিনের নাইট ক্লাবে হামলা চালিয়ে দুই জন আমেরিকান সৈন্যেকে হত্যার দায়ে তৎকালীণ প্রেসিডেন্ট রীগানের নির্দেশে লিবিয়ার উপর বিমান হামলা চালান হয় যাতে গাদ্দাফির পালিত কন্যা সহ ৩৫ জন মারা যান। তার খেয়ালের অন্যতম নিদর্শন হল তিনি সব সময় তাবুতে ঘুমাতেন এবং কয়েক ডজন নারী দেহরক্ষী পরিবেস্টিত থাকতেন।

তার ব্যাক্তিগত সুশ্রসাকারী ইউক্রেনের নার্স গ্যালিনা। একত্রীকরন প্রচেস্টাঃ- বিভিন্ন সময় তিউনিসিয়া মিশর, সিরিয়া ইত্যাদি দেশের সাথে লিবিয়া কে একত্রীকরনের চেস্টা চালান যা ফলপ্রসু হয় নি। আরব জাতীয়তাবাদ এবং একত্রীকরনের চেস্টা ফললপ্রসু না হলেও আফ্রিকার একিভুত সংস্থা “অর্গানাইজেশান অফ আফ্রিকান ইউনিয়ন” OAU এর রুপকার তিনি। ২০০৩ সালে সাদ্দাম ধৃত হওয়ার ৬ দিন পর সমস্ত রাসায়নিক ও অনান্য অস্ত্র শস্ত্র ধংশ করার ঘোষনা দেন। পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

২০০৯ সালে লকারবি বিমানে হামলায় দোষী সাব্যস্ত আল মাগ্রেহী বৃটেন থেকে স্বাস্থ্যগত কারনে মুক্ত হয়ে ফিরে এলে তাকে বীরের সংবর্ধনা দেন এবং পুনরায় আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের বিরাগভাজন হন। ২০০৯ সালে জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে ভাষন দেওয়ার জন্য আমেরিকা যান। সেখানেও তার থাকার জন্য তাবুর ব্যাবস্থা করা হয়। তার ১৫ মিনিট ভাষন দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি দেড় ঘন্টা ভাষন দেন। জাতিসঙ্ঘ সনদের কপি প্রকাশ্যে ছিড়ে ফেলেন এবং জাতিসঙ্ঘকে সন্ত্রাসবাদী সংস্থা আল কায়েদার সাথে তুলনা করেন।

ভাষনে তিনি উপনিবেশিক পশ্চিমাদের কাছে আফ্রিকার জন্য ৭.৭ ট্রিলিয়ন ক্ষতিপুরন দাবী করেন। ২০১০ সালে ইটালী সফরের সময় ইটালীর তরুনদের ইসলাম গ্রহনের আহবান জানান ফলে রোম এবং ত্রিপলীর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তা ব্যার্থতায় পর্যবেশিত হয়। ২০১১ সালে ফেব্রুয়ারীতে প্রতিবেশী রাস্ট্র তিউনিসিয়া এবং মিশরের গন অভ্যুথানের ঢেউ এসে লাগে লিবিয়াতে। গাদ্দাফি বিদ্রোহ দমনের এবং মরনপন লড়াইয়ের ঘোষনা দেন। বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষার অজুহাতে জাতিসঙ্ঘের অনুমোদন সাপেক্ষে ন্যাটো বিমান হামলা শুরু করে লিবিয়ার উপর।

২১ সে আগস্ট বিদ্রোহীরা রাজধানী ত্রিপোলীতে পৌছায়। গাদ্দাফির সময়ে তার পরিবার এবং নিকট জনেরাই সমস্ত ধন সম্পদ কুক্ষিগত করেন। তার জনহিতকর অনেক গুনাবলী ছিল। শিক্ষার হার ৯০ শতাংশের উপর, স্বাস্থ্যগত সেবা ছিল সম্পুর্ন বিনামুল্যে যা একটা ঈর্ষনীয় ব্যাপার। তার প্রচেস্টাতেই লিবিয়া আজ মধ্যম ইনকাম গ্রুপের দেশ।

সেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ত্রিপোলীর কোথাও কোথাও গাদ্দাফি বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।