আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্রে যাত্রা: চিলিতে সালভেদর আলেন্দের উত্থান এবং পতন। (৩য় পর্ব)

পরিবর্তনে বিশ্বাস করি। চিলির রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ অন্যান্য লাতিন আমেরিকার দেশের ন্যায় চিলিতে একক কতৃত্বের শাসন বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ দেশের একক কতৃত্ব অন্যান্য দেশের কতৃত্বের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছিল। চিলিতে অন্যান্য দেশের মত সামরিক একনায়কত্ব ছিল না বললেই চলে। ১৯৭৩ সালের সামরিক অভ্যূত্থানের পূর্বের ১৪০ বছর চিলি ১৮৩৩ ও ১৯২৫ সালে প্রনীত সংবিধানের মাধ্যমে শাসিত হয়েছে।

একটু ভিন্ন ধর্মী এ শাসন ব্যবস্থায় যে কোন রাজনৈতিক জরুরী প্রয়োজনে নির্বাহীদের লাগামহীন ক্ষমতার অনুমতি দিয়েছিল, নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রহিত করতে পারত এবং প্রচার মাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রন আরোপ করতে পারত। ১৮৩৩ সালের সংবিধান চিলিকে এরূপ কতৃত্বের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের মডেল হিসেবে দাঁড় করায়। এ সংবিধানের অধীনে ১৮৩০- ১৮৭১ সাল পর্যন্ত চিলি একটি স্বৈরতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের দ্বারা এবং ১৮৭১-১৮৯১ সাল পর্যন্ত একটি উদারবাদী প্রজাতন্ত্রের দ্বারা শাসিত হয়েছে। ১৮৯১ সালে ছোট একটি গৃহযুদ্ধ হয় এবং ১৮৩৩ সালের সংবিধানের পুনঃব্যাখ্যা দেয়া হয়। ১৮৯১- ১৯২০ সাল পর্যন্ত চিলিতে সংসদীয় প্রজাতন্ত্র বিদ্যমান ছিল।

কংগ্রেস এ সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল, ফলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রায় শূন্য হয়ে গিয়েছিল, যেখানে ১২১ টি কেবিনেট ও ৫৩০ জন মন্ত্রী ছিল। ৩৩ বছর সময় ব্যপী এ সংসদীয় প্রজতন্ত্র ক্ষমতায় ছিল। নির্বাচনী প্রতারণা ও দূর্নীতি তখন খুব স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কংগ্রেস এসময় একগোষ্ঠী ক্ষমতাসীন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। উঁচু শ্রেণীর কিছু শিক্ষিত পুরুষ নির্বাচক মন্ডলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করত।

সংঘবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণী এবং উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল না, যাদের সাথে মার্কস্বাদের অল্প বিস্তর যোগাযোগ ছিল। যদিও তখন নাগরিকদের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে মেনে নেয়া হত, সংসদীয় প্রজাতন্ত্র তখন ততটা সক্রিয় ছিল না। ১৯২০ সালের আলেসান্দ্রি পালমা লিবারেল এ্যালায়েন্স গঠন করেন। তিনি আইন ও শাসন ব্যবস্থার পুর্নগঠন, সংবিধান সংশোধন এবং প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতার পুনপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। তার এ নির্বাচনকে তখন ‘নির্বাচকদের বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করা হয়।

পালমার ক্ষুদ্র একগোষ্ঠীর শাসন রোধ করার জন্য জনগনের প্রতি ডাক দেন। শেষ পর্যন্ত আলেসান্দ্রি রাষ্ট্রপতি নিবাচিত হন এবং এর মাধ্যমে দীঘদিন ধরে চলে আসা ওলিগারসিক্যাল শাসনের অবসান ঘটে। পালমার ১৯২৫ সালে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠা করেন। লাতিন আমেরিকার আর্জেনটিনা, ব্রাজিল সহ অনেক দেশেই সেনাবাহিনীর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন খুব স্বাভাবিক হলেও চিলিতে ১৯৭৩-১৯৯০ সালের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পূর্বে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা ছিলনা বললেই চলে। ১৮৩০-১৯৭৩ সালের মধ্যে মাত্র ১৩ মাস চিলি সামরিক সরকারের অধীন ছিল; একবার ১৮৯১ সালের গৃহযুদ্ধের পর এবং ১৯২৪-১৯৩১ সালের মধ্যে দুইবার অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য।

১৯২৭ সালে জেনারেল কার্লোস ইবনে ডেল ক্যামপো স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৩৮-৪৬ সালের মধ্যে সাম্যবাদী, সমাজতান্ত্রিক ও র্যা ডিক্যালরা একত্রে পপুলার ফ্রন্ট গঠন করে। ১৯৪৮-১৯৫৮ সময়কালে সাম্যবাদী দলকে চিলিতে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। ১৯৫২ সালে জেনারেল কার্লোস ইবনে ডেল ক্যামপো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। ১৯৬৪ সালে এডুয়ার্দো ফ্রেই খ্রিষ্টান ডেমোক্র্যাট দল হতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং সামাজিক সংস্কার কর্মসূচী হাতে নেন।

কিন্তু তিনি তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন। তার সময় মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারন করে। পূর্ববতী সরকার গুলোর ব্যর্থতার ফলে আলেন্দের রাজনৈতিক দল পপুলার ইউনিটি অন্যান্য রাজনৈতিক দল গুলোর তুলনায় ভোট যুদ্ধে কিছুটা এগিয়ে যায় এবং আলেন্দে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটস্ দের সমর্থন পাওয়ার ফলে। ১৯২০ সাল থেকে পূর্বের অবস্থা বিদ্যমান থাকলেও ১৯৬৪ সালে তা ব্যাপক পরিবর্তিত হয়; যা ফ্রেই সরকারের কারনে হয়েছিল। ফলে চিলিতে রাজনীতি ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে বহুমূখীতার সৃষ্টি হয়।

জনগনের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৮ সালে যেখানে ৪৮,৫০,০০০ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ১৯৭০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩ মিলিয়নে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিভাজন ও বাম আন্দোলনের প্রসার মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক অবদান রাখে। আলেন্দের শাসন এবং চিলির সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ পরিক্রমাঃ ১৯৭০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বামপন্থীরা সম্পূর্ণ রূপে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী দলসমূহ খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটস ও প্রগতিবাদীদের মধ্য থেকে বের হয়ে আসা ছোট ছোট দলগুলোকে নিয়ে পপুলার ইউনিটি নামে একটি কোয়ালিশন দল গঠন করে এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা সালভেদর আলেন্দেকে এর পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত করে।

আলেন্দের মতানুসারে তার সরকারের উদ্দেশ্য হবে ‘সাংবিধানিক উপায়ে সংবিধান পরিবর্তন করা’। তার কৌশল ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধ উপায়ে ক্ষমতায় আরোহন এবং একইসাথে সাধারণ জনগণকে উদারনৈতিকতাবাদী রাষ্ট্রের সকল বিভাগ সমূহকে বাস্তবিক অর্থে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরের জন্য সংঘবদ্ধ করা। যে অবিশ্যম্ভাবী ঝুঁকি তখন বিদ্যমান ছিল, সেটি হলো ডানপন্থী ও মধ্যপন্থী প্রতিনিধিরা এতে অংশগ্রহণ করবে না বরং বিরোধিতা করবে। কারণ এর ফলে তাদের নিজেদেরই বিপর্যয় ঘটবে। পপুলার ইউনিটির উদারনৈতিকতাবাদী সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব উচ্চবিত্ত ও ম্যধবিত্ত শ্রেণীর চিন্তার কারণ হয়ে গিয়েছিল।

পপুলার ইউনিটির সাথে নীতিগতভাবে কিছু মিল থাকা সত্ত্বেও খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটস্রা সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ১৯৬৪ সালে জর্জ আলেসাঁন্দ্রি পুনরায় ডানপন্থী দলগুলোর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাদের দূর্বল কার্যক্রমের জন্য এবং জনগনকে তাদের স্বপক্ষে টানার জন্য আবেগ প্রকাশ করতে থাকে। সকলেই এটি অনুধাবন করতে পেরেছিল যে চিলির রাজনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু কি ধরনের বা কিভাবে এ পরিবর্তন আসবে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক বিদ্যমান ছিল।

এ ধরনের দ্বন্দ্ব ও দ্বিধা বিভক্তির ফলে ডানপন্থী, বামপন্থী ও মধ্যপন্থী দলসমূহের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট চিলিতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরী করেছিল। ফলে কোন রাজনৈতিক গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব চেতনা অনুযায়ী দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য যে পরিমান ভোট প্রয়োজন তা অর্জন করতে পারেনি। প্রধান যে তিনটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী চিলিতে ছিল তার মধ্যে বামপন্থীরা মতাদর্শগতভাবে জনগণের মধ্যে অনেক বেশী আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছিল। তবে কিছু নাগরিক ছিল যারা অর্ধশতাব্দীকাল ধরে চলে আসা পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ফিরে যেতে ইচ্ছা পোষন করতো।

তার মধ্যে আবার কিছু অংশ ছিল যারা দেশের সংবিধান ভেঙ্গে পড়ে কিনা, এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ের মধ্যে ছিল। সুতরাং বামপন্থীদের কৌশল ছিল খুবই সংকটাপন্ন। তাদের কৌশল ছিল ‘‘সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সংবিধান পরিবর্তন’’। এ নীতি খোদ বামপন্থীদের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তির সৃষ্টি করে। যদিও সাম্যবাদী দলের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল সসস্ত্র বিপ্লবের প্রতি, সমাজতান্ত্রিক দলের নেতৃত্ব বুঝতে পারল চিলিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এটিই (সাংবিধানিক পদ্ধতি) একমাত্র পথ।

কারন মধ্যবিত্ত শ্রেণী চিলির রাজনীতি, অর্থনীতি সকল &&ক্ষত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। তাদের বাদ দিয়ে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হতে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয়, বা সম্ভব হলেও পরবর্তীতে টিকে থাকা সম্ভব নয়। যদিও ঐ সময়ে বেশিরভাগ বামপন্থী নেতা কর্মী মনে করতো ডানপন্থীদের কোন আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পূর্বেই দ্রুত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপায়ণ প্রয়োজন। টটস্কির অনুসারী মুভমেন্ট অব রেভ্যুলুশনারী লেফ্ট ও মীর (MIR) এ বিশ্লেষণের প্রতি একমত পোষণ করে। মীর সবসময় স্বশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে চাইত।

তাদের মতে- সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য শান্তিপূর্ণ পথ ধাঁধাঁ ভিন্ন আর কিছু নয়। আলেন্দের বিজয়ঃ ১৯৭০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সালভেদর আলেন্দে খুব অল্প পরিমান ভোট ব্যবধানে জয়ী হন। আলেন্দে ঐ নির্বাচনে ৩৬.৩০% ভোট অর্জন করেন। অন্যদিকে জর্জ আলেসাঁন্দ্রি ডানপন্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে পেয়েছিল ৩৪.৯০% ভোট এবং খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটস্ পার্টি রাডোমিরো টমিক পেয়েছিল ২৭.৮০% ভোট। যাহোক এরূপ অবস্থায় অন্যান্যদের অসমর্থন সত্ত্বেও খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটদের সমর্থনে আলেন্দে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

ডানপন্থীরা তার পরও তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। এমনকি আলেন্দের শপথ গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। অক্টোবরে তারা চিলির সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ রিনে স্নাইডারকে ক্ষমতা থেকে অপসারন করে সামরিক অভ্যূত্থান ঘটানোর প্রত্যাশায়। সমস্যার আবর্তে সরকারঃ আলেন্দে সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ব্যাপক বিরোধীতার শিকার হয়। পপুলার ইউনিটি দলের চেম্বার অব ডেপুটি কিংবা সিনেট কোনটিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না।

তবে রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগসমূহের যেমন বিচার বিভাগসহ অন্যান্য বেসামরিক বিভাগসমূহ সরকারের নীতি রূপায়নে যথেষ্ট কর্মোদ্যোমী ছিল। কিন্তু গণযোগাযোগের পুরো অংশের উপরেই নিয়ন্ত্রণ ছিল মধ্য ও ডানপন্থীদের কারন এগুলোর মালিক ছিল তারা। বিদেশী যে সকল প্রতিষ্ঠান চিলিতে উৎপাদন ও ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে জড়িত ছিল এর অধিকাংশই ছিল উত্তর আমেরিকার পুঁজিবাদী দেশের মালিকানায় এবং যেকোন সময়ে উৎখাতের আতংকে তারাও পপুলার ইউনিটি দলের বিপক্ষে ছিল। মার্কিন সরকার চিলিতে একজন বামপন্থীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠানকে শুভদৃষ্টিতে দেখেনি এবং ভয়ের মধ্যে ছিল- কখন দেশটি সম্পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রবেশ করে লাতিন আমেরিকার বাম আন্দোলনকে সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে শক্তির ভারসাম্য সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বপক্ষে নিয়ে যায়। এর ফলে চিন্তিত মার্কিন সরকার চিলির সরকার বিরোধী দলসমূহকে অর্থাৎ ডানপন্থী দলসমূহকে ব্যাপক সাহায্য সহযোগীতা প্রদান করতে থাকে।

একই সময়ে চিলিকে বরাদ্দকৃত সকল প্রকার ঋণ ও সাহায্য বন্ধ করে দেয়। তবে চিলির সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও সামরিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছিল। সমস্যার মধ্যে চিলির অবস্থাঃ যদিও চিলির ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক শক্তির সৃষ্টি হচ্ছিল, পপুলার ইউনিটি তার পরও তার বৈপ্লবিক নীতিতে অনড় ছিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা ভূমি মালিক, একচেটিয়া পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের শক্তিকে খর্ব করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এ পুঁজিবাদী শক্তির বেশিরভাগই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন মাইনিং কোম্পানী, ব্যাংক ও বহুজাতিক সংস্থা।

এর পরিবর্তে তারা জনগনের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে, যা কেন্দ্রীয়ভাবে জনগনের কাউন্সিল দ্বারা পরিচালিত হবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে পপুলার ইউনিটির অবস্থান ছিল ‘অনুন্নয়ন’ কে আঘাত করা। তারা অনুন্নয়নের কারণ হিসেবে বিদেশী পুঁজিবাদের উপর নির্ভরশীলতাকে বের করেছিল। মাইনিং কোম্পানীগুলোর জাতীয়করণ ও বৃহৎ ভূমি মালিকানা রোধ করার মাধ্যমে তারা এ অবস্থার পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। একসময়ে সরকার বেশ ভালো অবস্থাতেই পৌঁছেছিল, অর্থনীতির পুরো নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নিয়ে নিতে পেরেছিল।

কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে পেরেছিল, চাকুরী নিশ্চিত করেছিল নাগরিকদের এবং জনগনের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু এটি ছিল স্বল্পকালীন সুফল, দীর্ঘমেয়াদে চিলির ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পতিত হয়। মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারন করে এবং এর ফলে সরকারের উপর থেকে জনসমর্থন উঠে যেতে থাকে। ক্ষনিকের জন্য অর্থনীতির চাঙ্গা ভাব এবং পুনরায় ভঙ্গুর অবস্থাঃ আলেন্দের সরকারের প্রথম নজর ছিল চিলির ভগ্নপ্রায় অর্থনীতিকে একটি ভালো অবস্থায় নিয়ে যাওয়া এবং আয় পুনর্বন্টনের মাধ্যমে জনগনের জীবনের মানোন্নয়ন করা। এ দু’টি পদক্ষেপই সম্ভব হয়েছিল।

আয় পুনর্বন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগনের বিশেষত প্রান্তিক আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। পণ্যের দাম সরকার বেঁধে দেয়ায় মুনাফার মার্জিন ঠিক রাখার জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। একদিকে যেরূপ জনগনের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিজনিত কারণে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল সেই সাথে যোগানের পরিমানও ছিল যথেষ্ট। এদিকে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি শিল্প সকল ক্ষেত্রে বাড়তি শ্রমের প্রয়োজন ছিল ফলে বেকার সমস্যা দূর হয়েছিল। আর্থিক এই রমরমা অবস্থা মোটামুটি বছরখানিক স্থায়ী হয়েছিল।

কিন্তু ১৯৭২ সালের শেষের দিকে অতিরিক্ত পরিমান মুদ্রা ছাপানোর কারনে দেশে মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করে এবং তা ১৮০.৩০% এ গিয়ে ঠেকে, যা চিলির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ফলে সরকারি ব্যয় ও টাকার প্রবাহ সীমার বাইরে চলে যায়। মুদ্রাস্ফীতির চাপে সরকারের বেঁধে দেয়া পণ্যমূল্যনীতি অকার্যকর হয়ে পড়ে। শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ তখন ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাওয়া চাহিদার বিপরীতে যোগান দিতে অসমর্থ হয়। যেহেতু চিলির মুদ্রামান কমে যাচ্ছিল তাই শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎপাদন প্রযুক্তি ও এর সম্পর্কিত দ্রব্যাদি ক্রয়ের জন্য প্রচুর পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হত।

এর ফলশ্রুতিতে কালো বাজারের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং সরকার তা বন্ধ করতে অসমর্থ হয়েছিল। মুদ্রাস্ফীতি রোধে প্রথাগতভাবে যে সকল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে একটি মার্ক্সবাদী সরকারের পক্ষে তার প্রয়োগ করা ছিল প্রশ্নাতীত। তাই সরকারি ব্যয় কমানো, ঋণ কমানো, মজুরী মুদ্রাস্ফীতি হারের নিচে নিয়ে আসা অসম্ভব ছিল। এ সমস্যাকে আরও সমস্যাসংকুল করে তুলেছিল ভূমি মালিক ও ব্যবসায়ীদের সরকারের জাতীয়করণ ও উচ্ছেদ নীতির বিরোধীতা। এ বিরোধীতা করা হয়েছিল বিনিয়োগ প্রত্যাহার, পুঁজির স্থানান্তর, পণ্যউৎপাদন কমানো ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে।

জাতীয়করণ কর্মসূচীঃ শিল্প জাতীয়করণের নীতি সল্পমেয়াদে চিলিতে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছিল। রাষ্ট্রশক্তি বা ট্রেড ইউনিয়নগুলো গুলো কতৃত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা উৎপাদন শিল্পের অধিগ্রহনের ফলে উৎপাদনের স্বাভাবিক ধারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্যহারে পতন হয়েছিল যা ক্রমান্বয়ে পণ্যঘাটতির সৃষ্টি করে। তারপরও সরকারের জাতীয়করণ প্রক্রিয়া চলমান ছিল। কংগ্রেসের কিছু উত্তেজনা সত্ত্বেও সকল কপার মাইনিং কোম্পানীসমূহকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল।

ফোর্ড, ইন্টারন্যাশনাল টেলিফোন এন্ড টেলিকমিউনিকেশনস এর সকল অধীনস্ত ও সহযোগী সকল প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হয়। এ সময় বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকার ফলে ঐ সকল প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা চিলির সরকারের পক্ষে অসম্ভব ছিল। এ সকল কোম্পানীগুলোর বেশির ভাগই ছিল মার্কিন মালিকানাধীন। ফলে নিক্সন প্রশাসন সরাসরি চিলির সরকারের বিপক্ষে চলে যায়। নিক্সন প্রশাসন চিলির সকল ঋণ ও সাহায্যের উৎস বন্ধ করে দেয়।

এর ফলে চিলির লেনদেন ভারসাম্যের চরম অবনতি ঘটে। কিন্তু ঐ সময়ে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের ব্যাপক প্রয়োজন ছিল সদ্যজাতীয়করণকৃত শিল্প কারাখানাসমূহের উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য। ভূমি সংস্কার প্রকল্পঃ আলেন্দের সরকারের অন্যতম বৈপ্লবিক স্তম্ভ ছিল ভূমি সংস্করণ। খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটরা ১৯৬৭ সালে আইন করেছিল যে ৮০ হেক্টর এর বেশি জমি কোন ভূমিমালিকের অধীনে থাকতে পারবে না। আলেন্দের সরকার সেটি বাস্তবায়ন শুরু করে অতি দ্রুততার সাথে এবং অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমবায়ে কৃষি খামার সৃষ্টি করে।

যদিও এ সংস্কারের মাধ্যমে কৃষকরা খুব অল্প পরিমান লাভবান হয়েছিল তারপরও আলেন্দের সরকার অবস্থার পরিবর্তনের আশায় এটি চালিয়ে যায়। খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটসরা যা ৬ বছরে বাস্তবায়ন করেছিল আলেন্দের সরকার ১৪ মাসে তার চেয়ে বেশি এগিয়ে গিয়েছিল। ভূমি সংস্করণের ধারটি নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। অনেক কৃষক লীগ তাদের অধিকার অর্জনের নিমিত্তে সহিংস কার্যক্রম চালানো শুরু করে এবং বিভিন্ন বামপন্থী ধারার লোকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তারা অবৈধভাবে জমি দখল শুরু করে যাতে সরকার চাপের মুখে দ্রুত ভূমি সংস্কার নীতিটির বাস্তবায়ন করে।

এধরনের কার্যক্রম চলতে থাকায় কৃষি খামারগুলোর উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমানে হ্রাস পায়। কৃষকেরা সমবায় খামারে চাষাবাদের পরিবর্তে নিজেদের জমিতে চাষ করতেই বেশি উৎসাহী ছিল। ফলে ঐ জমিগুলোর পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতকরা যায়নি। ফলশ্রুতিতে পণ্য উৎপাদন বহুলাংশে হ্রাস পায়। সরকার কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য যে ভর্তুকি প্রদান করত তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি, ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি।

পপুলার ইউনিটি সরকারের ১বছর অতিবাহিত করার পর এ সংস্কার কর্মসূচী প্রভূত সমস্যাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে বৈপরীত্য সৃষ্টি হয়। মীর ও টটস্কির আদর্শে বিশ্বাসীরা স্বশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের সমাজতান্ত্রিক শাসন আনয়নের চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু সাম্যবাদীরা সাংবিধানিকভাবে তা ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের পক্ষপাতি ছিল। কারণ তখন স্বশস্ত্র বিপ্লবের মত অবস্থা বিদ্যমান ছিল না। সরাসরি সংঘর্ষের মাধ্যমে প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা অসম্ভব ছিল বুর্জোয়াদের তুলনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে শক্তির স্বল্পতা থাকায়।

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিরোধী অবস্থানঃ শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য সাম্যবাদীদের কৌশল ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাথে সংঘবদ্ধ শ্রমিকদের মৈত্রী স্থাপনের মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুদ্রাস্ফীতির চরম অবনতি ঘটলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ে পপুলার ইউনিটি দলের প্রতি সম্পূর্ণরূপ আস্থা হারায় এবং বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের দিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আলেন্দে বিরোধীতা আন্দোলন বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। হাজার হাজার নারী দেশটির দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও পণ্য স্বল্পতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু করে। ধীরে ধীরে দোকানদার, শ্রমিক, ছাত্র ও অন্যান্য পেশাজীবি সংগঠনসমূহ অনুরূপভাবে বিক্ষোভ শুরু করে।

এরা একত্রে চিলির সরকারকে পঙ্গু করার জন্য একযোগে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক লীগগুলোর তৎপরতার ফলে পরিবহন ধর্মঘট শেষ হয়। অক্টোবরের এ সংকট তখনই নিরসন হয় যখন আলেন্দে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থের সাথে আপোষ করে এবং ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহকে জাতীয়করণ করা হবে না এই মর্মে নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং একচেটিয়া নয় এমন সম্পত্তির অধিকারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করে। ১৯৭২ সালের অক্টোবরের পর দেখা যায় সাম্যবাদীদের আন্তঃশ্রেণী মৈত্রীপন্থা অকার্যকর হয় এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী স্পষ্টতই ডানপন্থীঘেষা অবস্থান গ্রহণ করে। এ অবস্থায় বিপ্লবী বামপন্থীরা এর সমর্থকদের প্রতি স্বশস্ত্র বিপ্লবের জন্য প্রস্ত্তত হওয়ার ডাক দেয়।

কিন্তু আলেন্দে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। ১৯৭৩ এর কংগ্রেস নির্বাচনে আলেন্দে সরকারের ইতিবাচক ফলাফলঃ ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিতব্য কংগ্রেস নির্বাচনে আলেন্দে ও তার বিরোধী ডানপন্থী ও মধ্যপন্থীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ডানপন্থী ও মধ্যপন্থীরা তাদের ভোট বৃদ্ধির জন্য সমন্বিতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে আলেন্দেকে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে। এর জন্য দুই তৃত্বীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর দেখা গেল আলেন্দের পপুলার ইউনিটি দল কংগ্রেসে জয়ী হয়।

এর ফলে ডানপন্থী ও মধ্যপন্থীদের অনাস্থা প্রস্তাবের স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ হয় এবং আলেন্দের সংবিধান পরিবর্তন ও জনগনের কাউন্সিল চালু করার পথ সুগম হয়। সাংবিধানিকভাবে সমাজতন্ত্র উত্তরণের পথে যেসকল অন্তরায় ছিল তা দূরীভূত হয়। এসময়ে চিলির রাজনৈতিক ধারাগুলো তাদের বিপরীত দলকে ক্ষমতাশূন্য করার জন্য সাংবিধানিক পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে যে নির্বাচন হয় তা চিলির বিদ্যমান সংশয়পূর্ণ অবস্থার কোন ইতি টানতে পারেনি। পপুলার ইউনিটি পুনরায় এ নির্বাচনে জয়ী হয়।

এবার ১৯৭০ সালে নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট ৩৬.৫০% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৩% হয়। সরকারের বিরুদ্ধে পুনরায় আন্দোলন শুরুঃ যেহেতু ডানপন্থী ও মধ্যপন্থী দলসমূহ নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে আলেন্দেকে ক্ষমতা থেকে অপসারন নিশ্চিত করতে পারেনি তাই পুনরায় আন্দোলন শুরু করে দেশে অচল অবস্থার সৃষ্টি করে। দুই পক্ষের মধ্যেই তখন হতাশা বিরাজ করছিল। মধ্যপন্থী ও ডানপন্থীরা যে অবরোধ ধর্মঘট শুরু করেছিল তা প্রতিরোধ করতে জনগন, সরকারের সমর্থকরা এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলো রাস্তায় নেমে আসে। অন্যদিকে মীর অবৈধভাবে ফ্যাক্টরি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠা দখল শুরু করে নিজেদেরকে প্রস্ত্তত করতে থাকে পুঁজিবাদী শক্তির বিরূদ্ধে সর্বশেষ আন্দোলনের জন্য।

বামপন্থী এবং ডানপন্থীদের জিম্মি করার ঘটনা ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ এ অবস্থাই প্রতীয়মান করেছিল যে আলেন্দে দেশের উপর থেকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। র্যা ডিক্যাল বামপন্থীদের নিকট হতে উপর্যুপরি চাপ সত্ত্বেও আলেন্দে সাংবিধানিক পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথকে তুচ্ছজ্ঞান করেন নি। এ অবস্থায় Ei Teniente কপার মাইনস এর শ্রমিকরা পুনরায় মজুরী বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন শুরু করে, যেখানে চিলির মুদ্রাস্ফীতি বার্ষিক ৬০০% হারে বাড়ছিল। এ আন্দোলন প্রায় দুই মাস স্থায়ী হয়েছিল এবং ডানপন্থীরা এ বিক্ষোভের সুযোগ গ্রহন করেছিল। দেশী-বিদেশী শক্তির ইন্দনে সেনাবাহিনীর সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ততাঃ পরিস্থিতি তখন সেনাবাহিনী ভিন্ন অন্য কারো পক্ষে নিয়ন্ত্রণে নেয়া সম্ভব ছিল না।

ডানপন্থীদের উন্মুক্ত আহবানের পরেও আলেন্দের উপর অনুগত ছিল সেনাবাহিনীর সকল উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। জেনারেল কার্লোস প্রাটস তখন সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। ২৯ জুন সানতিয়াগোতে বিদ্রোহ হলে এবং তার কিছু সহকর্মী তার পদত্যাগের দাবী করলে জেনারেল প্রাটস আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। এসময় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য চিলির সেনা সদস্যরা দেশব্যাপী তল্লাশী চালায়। এসময় শুধুমাত্র র্যাধডিক্যাল বামপন্থীদের অস্ত্রই জব্দ করে সেনাবাহিনী সেইসাথে চরমপন্থী ডানদের সরকার বিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অস্ত্র রাখাকে না দেখার ভান করে।

আলেন্দে তার কর্তৃত্বের সামর্থ বৃদ্ধির নিমিত্তে খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটসদের সাথে আলোচনায় বসতে চেয়েছিল। কিন্তু এটি খুব বেশি দেরী হয়ে যায়। মধ্যপন্থী ও বামপন্থী মৈত্রী তৈরীতে তারা রাজি হয়নি। এদিকে চলমান বিশৃঙ্খল অবস্থায় বাণিজ্য ও পেশাভিত্তিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো রাস্তায় নেমে আসে। সেনাবাহিনীর প্রতি আহবান জানায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য।

এদিকে সহকর্মীদের চাপের মুখে জেনারেল প্রাটস পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল অগাষ্টো পিনাচ আলেন্দের কেবিনেটে যুদ্ধমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়। ১৯৭০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আদেশে মার্কিন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ চিলিতে সামরিক ক্যু ঘটানোর জন্য চিলির সেনাবাহিনীর চীপ অব স্টাফ জেনারেল রিনে স্নাইডারকে প্ররোচিত করে কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। CIA মদদ পুষ্ট Roberto Viaux ও Camilo Valenzuela নামক দুটি সামরিক দল ১৯৭০ সালের ২২ অক্টোবর তাকে অপহরণ করে। তিনি আহত অবস্থায় পালিয়ে আসতে সমর্থ হলেও পরে তিনি মারা যান। পরবর্তীতে প্রাটস্কে একই ধরনের প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

কিন্তু ইতোমধ্যে তার অনেক সহকর্মী এ ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় এবং যার ফলশ্রুতিতে তিনি পদত্যাগ করেন। অবশেষে CIA-র সহযোগিতায় পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশ গুলোর সমর্থনে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে জেনারেল পিনচেট আলেন্দে সরকারের অবসান ঘটায়। আলেন্দে তখন পর্যন্ত নিজেকে দেশের একমাত্র বৈধ প্রধান প্রশাসক হিসেবে দাবী করেন এবং রাষ্ট্রপতি ভবনে বোমা হামলার সময় এই প্রবীণ সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে আঁকড়ে ধরে থাকা নেতা আত্মহত্যা করেন বা তাকে হত্যা করা হয়। একইসাথে শেষ হয়ে যায় সম্পূর্ণ নতুনভাবে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের তার অভিনব পদক্ষেপ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.