আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেয়ার প্রাইস কার্ড ঃ ডিলারের কবজায় গরিবের কার্ড

নিম্ন আয়ের মানুষ যাতে কম দামে চাল-গম কিনতে পারে, সে লক্ষ্যে সরকার তাদের জন্য যে ফেয়ার প্রাইস কার্ড দিয়েছে, সেই কার্ড এখন ডিলারের কবজায়। গরিব মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে ডিলাররা এসব কার্ডের অধিকাংশই নিজেদের হাতে নিয়েছেন। গরিবের নাম ব্যবহার করে তাঁরা সরকারের কোটি কোটি টাকার খাদ্যশস্য হাতিয়ে নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, সরকারের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের কারণে সারা দেশে বিতরণ করা ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কার্ডের প্রায় সবই এখন ডিলারদের কবজায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, অপব্যবহার ঠেকানোর জন্য সরকার কার্ডে কার্ডধারীর ছবি লাগানোর নির্দেশ দিয়েছে আর 'শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা'র মতো এ দায়িত্বও পড়েছে ডিলারদের ওপর।

এখন আর কৌশল নয়, অনায়াসেই তাঁরা গরিবের সব কার্ড হাতিয়ে নিতে পারবেন। খাদ্যমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাকের কাছে বিষয়টি তোলা হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'ফেয়ার প্রাইস কার্ড ডিলারের হাতে চলে যাওয়ার কোনো তথ্য আমার জানা নেই। এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ' তবে ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক সুকুমার চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গরিব মানুষের কার্ড ডিলারদের হাতে চলে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমন ঘটনা ঘটলে আমাদের কী করার আছে? একজন মানুষ যদি নিজের স্বার্থ না বোঝে, তাহলে আমরা কী করতে পারি? আর মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে যদি কোনো কার্ড ডিলার নিয়ে থাকে, তাহলে অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

' নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাদ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ফেয়ার প্রাইস কার্ড কর্মসূচিটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। উপকারভোগী বাছাই থেকে শুরু করে ডিলার নিয়োগ, গুদাম থেকে খাদ্যশস্য উত্তোলন ও বিতরণ পর্যন্ত কোনো স্বচ্ছতা নেই। কর্মসূচি শুরু করতে খুব বেশি তাড়াহুড়া করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকার ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে আটজন ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ওয়ার্ডের মোট ১০ হাজার ব্যক্তি ফেয়ার প্রাইস কার্ড পেয়েছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ৩৭/১ উত্তর বেগুনবাড়ীর বাসায় ফেয়ার প্রাইস কার্ড পেয়েছেন পাঁচজন। টিনের বেড়ার ওপর কাঠের পাটাতনের বাসাটি তিন তলার। অধিবাসীরা নিম্ন আয়ের মানুষ। একটি ঘরের দরজার কড়া নাড়তেই বেরিয়ে আসেন মধ্যবয়সী একজন। তাঁকে ফেয়ার প্রাইস কার্ডের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানান, কার্ড পেয়েছেন।

একবার ২০ কেজি চালও কম দামে কিনেছেন। কিন্তু ওই একবারই। এরপর ডিলার নানা কথা বলে কার্ডটি নিয়ে যান। আর ফেরত দেননি। ডিলারের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'নাম লিখলে আবার কোন বিপদে পড়ি!' পরে তিনি নামটি জানিয়েও না লেখার অনুরোধ করেন।

তেজগাঁওয়ের বউ বাজারের ফেয়ার প্রাইস কার্ডধারী মনোয়ারা বলেন, 'আমি দুইবার কার্ডের মাধ্যমে চাল তুলেছি। এরপর ডিলারের প্রলোভনে পা দিয়েছি। ডিলার বলেছিলেন, চাল ও গমের সাথে তেল, চিনি, ডাল নামমাত্র দামে দেওয়া হবে। আর এসব পাওয়ার জন্য তার হাতেই কার্ড তুলে দিতে বলে ডিলার। আমি কার্ড দিয়ে দিই।

কিন্তু রোজায় যখন আবার চাল দেওয়া শুরু হয়, তখন ডিলারের কাছে যাই। ডিলার নানা কথা বলে কার্ড না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। অনেকে চাল পেলেও কার্ড না থাকায় আমি পাই না। ' তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়ার ফেয়ার প্রাইস কার্ডধারী আলী বলেন, তাঁর কার্ডও ডিলারের কাছে। ডিলার বলেছিলেন, 'বাড়িতে নিয়ে গেলে কার্ডটি হারিয়ে যাবে, তাই আমার কাছেই রেখে যাও।

' এখন তাঁদের কার্ড ব্যবহার করে ডিলার নিজেই চাল তুলে নিচ্ছেন। স্বল্প ও সীমিত আয়ের জনগোষ্ঠীকে অস্থায়ী কার্ডের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার ফেয়ার প্রাইস কার্ড চালু করে। গত বছর শুরু হওয়া এ কর্মসূচির আওতায় কার্ডধারীদের প্রতি মাসে ২০ কেজি করে চাল ও গম দেওয়া হয়। প্রতি কেজি চালের দাম ২৪ টাকা আর গমের দাম ২০ টাকা। সরকারের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী এবং জেলা বা মহানগর ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ জনকে এ কার্ড দেওয়া হয়েছে।

এসব কার্ডধারীকে চাল দেওয়ার জন্য সারা দেশে ১২ হাজার ১৮০ জন ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত বছর এ কর্মসূচিতে এক লাখ ৭৬ হাজার ৮০০ টন চাল ও এক লাখ ২০ হাজার ৯৫০ টন গম দেওয়া হয়। চলতি বছর বিতরণের জন্য পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল এবং তিন লাখ টন গম বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অবশ্য এ বরাদ্দের মধ্যে খোলা বাজারে বিক্রির চালও (ওএমএস) রয়েছে। একজনের ফেয়ার প্রাইস কার্ড দিয়ে অন্যজনের খাদ্যশস্য তুলে নেওয়ার অনিয়ম প্রতিরোধ করার জন্য সরকার নতুন উদ্যোগ নিয়েছে।

প্রতিটি ফেয়ার প্রাইস কার্ডে চলতি মাসের মধ্যেই ছবি সংযোজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে খাদ্য বিভাগ থেকে। কর্মসূচি বন্ধ না করে চাল দেওয়ার পাশাপাশি কার্ডে ছবি সংযোজন করা হচ্ছে। এতে করে আরো বেশি হারে কার্ড ডিলারদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। খাদ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, আগে ডিলারদের কৌশল করে কার্ড নিতে হতো। এখন ছবি সংযোজনের নাম করে তাঁদেরই কার্ড সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।

এতে করে কার্ডে ছবি সংযোজন হলেও অনেক কার্ডই ডিলারের হাতে চলে যাবে। ডিলারদের এসব অসৎ কাজে খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তেজগাঁওয়ের কয়েকজন ডিলারের মুখোমুখি হলে তাঁরা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পাবলিকের কার্ড কি আর এমনি এমনি নিয়েছি? বাধ্য হয়ে নিয়েছি। ডিলারশিপ পেতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছি। প্রতিবার পাঁচ টন করে চাল উঠাই।

পাঁচ টনের জন্য চার হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় ঢাকা রেশনিং অফিসে। পল্টনের এই অফিস থেকে স্লিপ নিয়ে তেজগাঁওয়ের গুদাম থেকে চাল তুলতে আরো দিতে হয় এক হাজার টাকা। গুদামের বড় কর্তা থেকে গেটের দারোয়ানকেও খুশি করতে হয়। এত মানুষকে খুশি করে আমরা আর খুশি হতে পারি না। তাই বাধ্য হয়ে এদিক-সেদিক করতে হয়।

খাদ্য বিভাগের এসব বিষয় ওপেন সিক্রেট। যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে, ভবিষ্যতেও হবে। ' ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক সুকুমার চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে আরো বলেন, ঘুষ দিয়ে চাল তোলার বিষয়ে নতুন করে বলে লাভ নেই। কারণ এ অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। তার পরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে মোট ২২ লাখ ২৫ হাজার দরিদ্র ব্যক্তিকে ফেয়ার প্রাইস কার্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও পরে তা থেকে সরে আসে সরকার। লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১২ লাখে নামিয়ে আনা হয়। ফেয়ার প্রাইস কার্ডের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে উপকারভোগী নির্বাচন করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি করে দেওয়া হয়। বিভাগীয় শহরের জন্য ওয়ার্ড কমিটি করা হয় ছয় সদস্যের। আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে ওয়ার্ড কমিশনারের প্রতিনিধি একজন, ওয়ার্ডের দুজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষক প্রতিনিধি একজন এবং একজন নারী সদস্য রয়েছেন।

ঢাকা মহানগরেও এ কমিটি উপকারভোগী চিহ্নিত করেছে। কমিটির একমাত্র সরকারি প্রতিনিধি হচ্ছেন আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক। ঢাকা মহানগরের ৯০টি ওয়ার্ডে তাঁর নেতৃত্বে উপকারভোগী চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলত ওয়ার্ড কমিটিতে আহ্বায়ক ছাড়া বাকি সবাই রাজনৈতিক ব্যক্তি। তাঁরা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উপকারভোগী চিহ্নিত করেছেন বলে অভিযোগ আছে।

ওয়ার্ড কমিটি উপকারভোগী মানুষের তালিকা তৈরি করে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সামনে উপস্থাপন করে। আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক টেবিলে বসে সেই তালিকা অনুমোদন করেন। তাঁর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রকের পক্ষে ৯০টি ওয়ার্ডে উপকারভোগী চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। কমিটির অন্য সদস্যরা যাদের নাম লিখে দিয়েছেন, তিনি তাই অনুমোদন করেছেন। আর কমিটিকে তালিকা তৈরির জন্য খুব অল্প সময় দেওয়া হয়েছিল।

এত অল্প সময়ে ৯০টি ওয়ার্ডের তালিকা তৈরি কঠিন কাজ। আর কাজটি ঢাকা রেশনিংয়ের হলেও আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রককে দায়িত্ব দেওয়ার বিষযটিও পরিষ্কার নয়। ঢাকার আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আবদুল আজিজ মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মাঠপর্যায় থেকে যে তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে আমি তাতেই অনুমোদন দিয়েছি। কারণ ৯০টি ওয়ার্ডের আহ্বায়ক আমি একা। ' তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ এম এম শওকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ফেয়ার প্রাইস বা রেশন কার্ড যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এর অপব্যবহার হবেই।

সাধারণ মানুষের কার্ড ডিলাররা হাতিয়ে নেবে এটা আর নতুন কী? গরিব মানুষের নামে চাল তুলে সে চাল বাজারে বিক্রি করে ডিলাররা ধনী হবে_এটা তো আমাদের দেশের বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। কার্ডের মাধ্যমে চাল-ডাল দেওয়ার ইতিহাস ভালো নয়। অতীতে এই কার্ড বন্ধ করার জন্য সেনাবাহিনী নামাতে হয়েছিল। ' তিনি বলেন, 'এ কার্ড চালু করার আগে সরকার আমার কাছে লিখিত মতামত চেয়েছিল। আমি সরকারকে লিখিতভাবেই বলেছিলাম এসব কার্ডে খাদ্যশস্য না দেওয়ার জন্য।

সূত্র ঃ কালের কণ্ঠ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।