আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুস্থ সংস্কৃতির ভিত্তি

সুস্থ সংস্কৃতির অনন্ত পথের যাত্রী আমি সংস্কৃতিবান লোকদেরকে ‘সত্যকে’ এইভাবে দেখতে বলি যে, আগুন তাপ দেয়, কখনো ঠান্ডা দেয় না। আগুন কারো জন্য উষ্ণ কারো জন্য ঠান্ডা এমন নয়। আবার ঝড়ের কথা আমরা বলতে পারি, ঝড় গাছ-পালা ভাঙ্গে, ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে-চুরে ফেলে, জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে এবং জান-মালের প্রচুর তি করে। ঝড় কালো ফর্সা দেখে না, ধনী-গরিব দেখে না, শিক্ষিত-অশিক্ষিত দেখে না। আগুন বা ঝড় দৃশ্যমান বস্তু।

কিন্তু যা অদৃশ্য যেমন ক্রোধ, প্রতিহিংসা বা লালসা এসব বিষয়গুলো নিজের এবং অপরেরর চরম তি করে। লোভ-ক্রোধের কাছেও কোন বাছ-বিচার নেই। সবল-দুর্বল, মতাবান বা অসহায় সবার সমান তি করে। অর্থাৎ যা কিছু মন্দ এবং ক্ষতিকারক তা সবার জন্য মন্দ এবং ক্ষতিকারক। বিপরীতদিকে- যা কিছু ভালো ও সুন্দর তা সবার জন্য ভালো ও সুন্দর।

আজ তুমি ক্ষমতাবান বলে মন্দ কাজে তুমি ভালো ফল পাচ্ছো, এর মানে এই নয় মন্দ ভালো ফল দেয়। তুমি ক্ষমতাবান বলে বস্তুজগতের প্রাণী ও মানুষ যেমন তোমাকে ভয় পায় তেমনি ‘মন্দও’ তোমাকে ভয় পায়। কাছে ঘেষতে চায় না। তাই বলে তোমার সৃষ্ট মন্দ কিন্তু ধ্বংস হয়ে যায় না। সে তোমার জীবনে মন্দ আনবেই।

অনাদীকাল পর্যন্ত, এমনকি তোমার মৃত্যুও পরও সে মন্দ বেঁচে থাকে। মন্দের মন্দ ফল তুমি পাবেই। অথবা আজ তুমি দুর্বল বলে ভাল কাজ করেও মন্দ ফল পাচ্ছো, এর মানে এই নয় যে ভালোর ফল তুমি পাবে না। আজ হোক কাল হোক ভালোর ফল তুমি পাবেই। কারণ তোমার সৃষ্ট ‘ভালো’র মৃত্যু নাই।

সেও অনাদীকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবে এমনকি তোমার মৃত্যুর পরও। সে ভালোর ভালো ফল তুমি পাবেই পাবে। ভালো ও মন্দ হচ্ছে গুণ, বস্তু আকৃতিগত দিক দিয়ে নানা রঙের হলেও দৃশ্য বা অদৃশ্য কোন বস্তুর গুণ পরিবর্তন হয় না। মিষ্টির উৎস বিভিন্ন হতে পারে, সেই উৎস বস্তুর পরিবর্তন বা বিবর্তন সাধিত হতে পারে কিন্তু তার যে জাত সত্বা মিষ্টত্ব, এর পরিবর্তন হয় না। ভালো ও মন্দ দুটি পৃথক সত্বা।

কোন বস্তু, বিষয় বা মানুষের উপর আমরা ভালো বা মন্দ সত্বা আরোপ করি। মানুষ নিজে ভালো বা মন্দ নয়। তবে টেলিভিশন বা এই ধরণের বস্তু তৈরির সময় নির্মাতা ইন-বিল্ট হিসেবে এর মধ্যে ’ভালো’ ঢুকিয়ে দেন। ভালো গুণটি দুর্বল বা নষ্ট হলে মন্দ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং টেলিভিশনটি নষ্ট হয়ে যায়। মহান আল্লাহও মানুষসহ সবপ্রাণীর মধ্যে ইন-বিল্ট হিসেবে ‘ভালো’ ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

খারাপ উপাদানে ভরা সংস্কৃতিগুলো সেই ভালোকে শুধু নষ্ট করে ফেলে তা নয়, মানুষের মনুষ্যত্বকে পঙ্গু করে ফেলে, মানুষের সুবিচারবোধ, ন্যায়-অন্যায়বোধ কেড়ে নেয়, নিজের ও নিজেদের প্রতি এক ঘৃণিত ভালোবাসার জন্ম দেয় যা অন্যের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধকে লুপ্ত করে ফেলে। অথচ অন্যের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে মানুষ হিসেবে উন্নিত করে। এখন প্রশ্ন হলো ভালো ও মন্দের মাপকাঠি কি? অথবা ভিত্তি কি? যা তোমার ভালো মনে হয় তাই-ই কি ভালো? অথবা তোমার গুরুজন যাকিছুকে ভালো বলেন তাই কি ভালো? অথবা বহুলোক বলছে এটি ভালো, অথবা খুব জ্ঞানী-পন্ডিত কোনো ব্যক্তি বা দার্শনিক বলছেন এটি ভালো, তা-ই কি ভালো? মনে রাখতে হবে সূর্যকে সবাই সূর্য বলে, লাল রঙকে সবাই লাল রঙ বলে কিন্তু একটি ‘ন্যায়কে’ সবাই ন্যায় বলে না। একটি ‘সত্যকে’ সবাই সত্য বলে না। একটি ‘উচিৎকে’ সবাই উচিৎ বলে না।

তাহলে? এসবের সহজ ও সরল উত্তর হলো: যিনি সূর্য, লালরঙ, ন্যায় এবং উচিতের স্রষ্টা তাঁরই মতামতকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু তিনি উপর থেকে মাইক দিয়ে বলবেন না যে কিসে ন্যায় বা কোন বিষয়টি উচিৎ। সেটা বিজ্ঞানের পরিপন্থি। অথচ তিনি বিজ্ঞানময়। নীলাকাশ থেকে বৃষ্টি পড়া বিজ্ঞান ভিত্তিক নয়।

সূর্যের কীরণে পানি বাষ্প হবে, বাতাসে ভেসে ভেসে তা আকাশে উঠবে, একত্রিত হয়ে তুলোর মত দল বেধে ভাসবে, তাতে একসময় কালো রঙ ধরবে তারপর ঠান্ডা বাতাস লেগে ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়বে। এটাই বিজ্ঞানভিত্তিক এই কারণে যে এতে চিন্তা-গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। মহান স্রষ্টা আল্লাহ এটাই চান যে মানুষ তার সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করুক। এতে মানুষের জ্ঞান বাড়বে, সে স্রষ্টার মহত্ত্ব বুঝতে চেষ্টা করবে। আল্লাহ নিজেই তাঁর পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘ইন্না ফি খলকিছ সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বী, ওয়াখতিলা ফিল লাইলী ওন্নাহারি লায়াতিল লিউলিল আলবাব; আল্লাজীনা ইয়াজকুরুনাল্লাহা ক্বিয়ামাও ওয়া কুউদাও ওয়ালা জুনুবিহিম ওয়াতাফাক্কারুনা ফি খলকিছসামাওয়াতি অল আরদ্ব।

রব্বানা মা খালাকতা হাজা বাতিলা। ’ সূরা আল বাকারা: আয়াত-১৯০-১৯১, অর্থ: ‘আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির ব্যাপারে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে সেইসব বুদ্ধিমান লোকের জন্য অসংখ্যা নিদর্শন রহিয়াছে, যাহারা উঠিতে বসিতে ও শুইতে সকল অবস্থায়ই আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি ও সংগঠন সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে। তাহারা স্বত:স্ফ’র্তভাবে বলিয়া ওঠে, আমাদের রব! এইসব কিছু তুমি অনর্থক ও উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করো নাই। ’ অতএব ভালো-মন্দ বিচারের ভিত্তি হলো আল কোরআন এবং আল কোরআন যার মাধ্যমে এসেছে সেই মহানবী, শেষ নবী এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ হযরত মুহম্মদ স.-এর সুন্নতে রসূল তথা হাদিস সমূহ। মহানবী স.-এর সাংস্কৃতিক মানদন্ড কি ছিল! একটি মানুষের সাংস্কৃতিক উপাদান এবং উপকরণ গুলো অন্যের জন্য।

একজন কারিগর প্লাষ্টিক দিয়ে যে খেলনা বানায় তা অন্যের জন্য। কারিগর একজন শিল্পি। শিল্পি যা করে তা অন্যের জন্য করে। কিন্তু এগুলো বৈষয়িক সংস্কৃতি। মানুষের মনকে যা রঞ্জিত করে তাই মানসিক সংস্কৃতি।

সঙ্গীত, কবিতা, সাহিত্য, চিত্রকলা, অভিনয়, নাটক, চলচ্চিত্র এসবই মানসিক সংস্কৃতির বিষয়। কাজগুলো বড় গুরত্বপূর্ণ। মানুষের অন্তর্লোকের সৎ-প্রবৃত্তিকে শক্তিশালি করা অথবা মন্দ-প্রবৃত্তিকে শক্তিশালি করা এই সংস্কৃতির উদ্দেশ্য। এর পরবর্তী পদক্ষেপে মানুষ বৈষয়িক সাংস্কৃতিক কর্মে লিপ্ত হয়। এখন মানসিক সংস্কৃতির ভালো-মন্দের ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করা যাক: এক্ষেত্রে দু’একটা উদাহরণের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

যেমন: তুমি একটা অর্ধ-উলঙ্গ যুবতীকে নায়িকা করে নায়ক সেজেছো, নাচছো, গাইছো, জড়িয়ে ধরছো... যুবতী তোমার কোনো আত্মীয় নয়। আচ্ছা ধরা যাক যুবতীটি তোমারই স্ত্রী, কন্যা অথবা বোন, তুমি কি পছন্দ করবে সেও অন্য নায়কের সাথে অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে নাচুক বা জড়িয়ে ধরুক! যতোই এটা অভিনয় হোক তুমি কখনোই তা পছন্দ করবে না। আবার অন্যদিক দিয়ে ভাবা যাক, যেমন: বেয়াদবীর কারণে একটি ছেলেকে তুমি থাপ্পড় দিলে, এখন তোমার বেয়াদবীর কারণে তোমার চেয়ে শক্তিশালী কেউ যদি তোমাকে থাপ্পড় দেয়, তুমি সেটাকে উচিৎ না অনুচিত বলবে? এসব ক্ষেত্রে এসবের পক্ষে যত যুক্তি এসেছে তাতে দেখা যায় সম্মান, অর্থ, ক্ষমতাশালী'র মতো কতোকগুলি শব্দের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলেছে এবং আজো চলছে। অন্যদিকে গালভরা বুলি, ‘একটি অপরাধের কারণে একজন সাধারণ মানুষের যে শাস্তি হবে একজন প্রধানমন্ত্রীরও একই শাস্তি হবে। এবং এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত গণতন্ত্র।

’ কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। এই সংস্কৃতিই দেশে, সমাজে এবং সমগ্র পৃথিবীতে একটা অরাজকতা সৃষ্টি করে চলেছে। শিল্পিদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা নাটক, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা এবং সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সেই সাক্ষ্যই বহন করে। অতএব ভালো এবং মন্দের মাপকাঠি অথবা ভিত্তি হিসেবে আমরা নিশ্চিন্তে ও পরম বিশ্বাসে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম উন্নত সংস্কৃতির জনক হযরত মুহম্মদ স.-এর সংস্কৃতিই গ্রহণ করতে পারি এবং তা হলো: ‘ভালো তাই যা তুমি নিজের জন্য ভালো মনে করো তা অন্যের জন্যও ভালো মনে করো। ’ আর মন্দ তাই ‘যা অন্যের জন্য মন্দ মনে করো তা নিজের জন্যও মন্দ।

’ প্রখ্যাত দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল এই বিষয়টিকে অন্যভাবে বলেছেন, তিনি বলেছেন, নিজেকে অন্যের মধ্যে অনুভব করা এবং অন্যকে নিজের মধ্যে অনুভব করার নামই সংস্কৃতি। আসলে মহানবী স:-এর হাদিসটিকে যে আঙ্গিকেই ব্যাখ্যা করা হোকনা কেন সুস্থ সংস্কৃতির মৌলিক তত্ত্ব এই হাদিসটিতেই নিহিত। এই তত্ত্বের ভিত্তি শুধু মঞ্চ বা সিনেমা টিভির পর্দাই নয় বরং পরিবার সমাজ দেশ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সুস্থতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।