আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে মানবাধিকার ও সাম্প্রদায়িকতা

বাংলা আমার দেশ যে কোন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিচারের প্রধান মানদণ্ড হচ্ছে সে দেশের সংবিধান। প্রথমে দেখা প্রয়োজন জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী সে দেশের সংবিধানে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার কতটুকু গ্যারান্টি আছে। দ্বিতীয়তঃ সে দেশের সরকার সংবিধানপ্রদত্ত মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক। তৃতীয়তঃ সরকার যদি মানবাধিকার লংঘন করে তার প্রতিকারবিধানের উপযুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ সে দেশে আছে কিনা। চতুর্থতঃ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বস্তুনিষ্ঠভাবে পরিবেশনের স্বাধীনতা সে দেশের সংবাদপত্রের আছে কি না।

পঞ্চমতঃ দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং মানবাধিকার কর্মীরা সরকারী ও দলীয় চাপ ও প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি না। প্রধানতঃ এই পাঁচটি বিষয় পর্যালোচনা করলে সে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা হলেও * এর ভেতর কিছু মারাÍক অসঙ্গতি রয়ে গেছে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১১ অনুচ্ছেদে (‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’) বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে। ’ আবার একই বিভাগের অনুচ্ছেদ ৮(১ক)-তে বলা হয়েছে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।

’ সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। ’ সংবিধানের এই ধারাটি এবং এ ধরনের আরও কয়েকটি ধারা অর্থহীন হয়ে যায় যখন সংবিধানের মুখবন্ধে থাকে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’। যে সংবিধানের উপর ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার সেই সংবিধান শুরু হচ্ছে আল্লাহর নামে! সংবিধানের প্রথম ভাগের অনুচ্ছেদ ২ক-এ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম...’! সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফেও ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে আরও কিছু অসঙ্গতি আছে, যে প্রসঙ্গে আপাতত যাচ্ছি না। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে মুসলমান ও অমুসলমানের ভেতর বৈষম্যমূলক এসব অসঙ্গতি ছিল না।

১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর পাকিস্তানপন্থীরা ক্ষমতা দখল করে, যে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক আদর্শের কবরের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আদর্শগতভাবে পাকিস্তানপন্থী দুই সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক সংবিধানের মূল চেতনা অপসারিত করে এটিকে একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর সংবিধানে পরিণত করেন এবং এভাবেই বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান প্রভৃতি ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা মগ, হাজং, সাঁওতাল প্রভৃতি এথনিক সম্প্রদায়ের সমান অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টি সংবিধান থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়। ১৯৭২-এ গৃহীত মূল সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি) একটি ধারা (অনুচ্ছেদ ১২) ছিল ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’ শিরোনামে। জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার সংবিধানের এই ধারাটি অবলুপ্ত করেছেন। এভাবেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও এথনিক সম্প্রদায় কার্যতঃ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণতি হয়ে রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান কিংবা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের প্রভাব তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে পড়েছে এবং এভাবে তাদের মৌলিক মানবাধিকার সাংবিধানকিভাবে বিপন্ন হয়েছে। উল্লেখিত অসঙ্গতিগুলা বাদ দিলে বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ধারায় মৌলিক অধিকার সম্পর্কে ২৩টি অনুচ্ছেদ (অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে ৪৭ক পর্যন্ত) আছে, যাতে মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের বিষয়টি বলা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে সংবিধান নাগরিকদের যতটুকু অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে সরকার তা মানতে চায় না। প্রতিনিয়ত সরকার এই সকল ধারা লংঘন করছে এবং এর জন্য সরকারকে কদাচিৎ অভিযুক্ত করে মামলা করা হয়। যেহেতু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সরকার ও প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত নয় সেহেতু নিু আদালত তো বটেই উচ্চতর আদালতের রায়েও অনেক সময় সরকারের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয়।

উচ্চতর আদালতের ক্ষেত্রে ধরনের ঘটনা বিশেষভাবে ঘটছে বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন’, ‘যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট’ ও ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০০১ সালের যে প্রতিবেদন এ বছর (২০০২) প্রকাশিত হয়েছে সেখানে দেখা গেছে অতীতের তুলনায় ২০০১ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি বেশি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানাবাধিকার সংক্রান্ত ‘কান্ট্রি রিপোর্ট’ ৪ মার্চ ২০০২ প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনের ছয়টি ধারায় যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, (১) মানবাধিকারের প্রতি মর্যাদা, (২) মৌলিক অধিকারের প্রতি মর্যাদা, (৩) রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি মর্যাদা (৪) মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক ও বেসরকারী তদন্তের বিষয়ে সরকারের মনোভাব (৫) জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, শারীরিক অক্ষমতা, ভাষা ও সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে বৈষম্য (৬) শ্রমিকের অধিকার ইত্যাদি।

এসব ধারার ভেতর অনেকগুলো উপধারা আছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের কান্ট্রি রিপোর্ট যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এই রিপোর্টে মানবাধিকারের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিষদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এতে মানবাধিকার লংঘনের গুরুত্বপূর্ণ বহু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। বিশেষ কোন দলের প্রতি পক্ষপাত থাকে না বলে বাংলাদেশের সব সরকারের জন্যই এই রিপোর্ট উদ্বেগজনক।

তারপরও আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী যে কোন বিষয় স্টেট ডিপার্টমেন্টও এড়িয়ে চলে। তুলনামূলকভাবে ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর রিপোর্ট বেশি বস্তুনিরপেক্ষ। ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ সহ যে সব আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে কান্ট্রি রিপোর্ট প্রকাশ করে এ বছর সেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের বিষয়টিকে। বক্ষ্যমান নিবন্ধে আমি সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের এই দিকটির উপর আলোচনা করতে চাই। দুই গত ১ অক্টোবরের (২০০১) জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধানতঃ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং বিশেষভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে নজিরবিহীন নির্যাতন শুরু হয়েছে এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তা বন্ধ হয়নি।

প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের সিভিল সমাজের একটি বড় অংশ নির্বাচনে কারচুপি, সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভোটকেন্দ্র দখল, বিরোধী দল ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নানা ধরনের নির্যাতন চালিয়ে তাদের ভোটদানে বাধা দেয় সহ আরও অনেক কারণে নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণযোগ্য নয় বলে অভিমত দিয়েছেন। নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের স্থূল ও সূক্ষ্ম কারচুপি এবং সহিংসতার উপর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘অ জরমমবফ ঊষবপঃরড়হ : অহ ওষষবমরঃরসধঃব এড়াবৎহসবহঃ’ শিরোনামে একটি শ্বেতপত্রও প্রকাশ করা হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার উপর বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন এ পর্যন্ত পাঁচটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। ২০০১ সালের মধ্য জুলাইয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর, বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সু পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিষয়টি বহুমাত্রিক।

সাম্প্রতিক সময়ে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের যে সব ঘটনা আমরা বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করছি এটিকে নিছক নির্বাচনোত্তর সহিংসতা কিংবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে আখ্যায়িত করলে মানবাধিকার লংঘনের এই ক্ষেত্রটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা যাবে না। যে কোন সমস্যা নিরসন করতে হলে সেটি সম্পর্কে সার্বিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যাটি বুঝতে হলে এর ঐতিহাসিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো আমাদের জানতে হবে। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে প্রায় এক হাজার বছর আগে। ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চলে অবশ্য এর আগেই ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল।

পশ্চিমাঞ্চলে ইসলাম এসেছে যোদ্ধাবেশে, মহম্মদ বিন কাশিম তলোয়ারের জোরে সিন্ধু জয় করেছিলেন এবং ইসলাম প্রচার করেছিলেন। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেছেন প্রধানত সুফী দরবেশরা, যাঁরা এসেছিলেন আরব বণিকদের সঙ্গে। বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাবের আগে এখানে হিন্দু ধর্মের প্রচার ঘটেছে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ঘটেছে এবং তারও আগে আদিবাসীদের ভেতর প্রাকৃতিক ধর্মের চর্”া ছিল। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ভেতর শাসকদের প্ররোচনায় কখনও কখনও ধর্মীয় সংঘাত হলেও সাধারণভাবে বাঙালিরা পরমতসহিষ্ণু, উদারনৈতিক এবং ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের সহঅবস্থানে বিশ্বাসী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরোনো ধর্মমতের জায়গায় নতুন ধর্মমত এসেছে সমঝোতার ভিত্তিতে।

পুরোনোকে পুরোপুরি বর্জন নয়, পুরোনোর অনেক বৈশিষ্ট্য নতুন নির্দ্বিধায় আÍস্থ করেছে। যার ফলে ধর্মে ধর্মে কিংবা একই ধর্মের বিভিন্ন পথ ও মতের ভেতর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কয়েক হাজার বছরের বাঙালির সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে বরং সমৃদ্ধ হয়েছে। ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক চরিত্রের উন্মেষ ঘটেছে বৃটিশ শাসনের আমলে, বিশেষভাবে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর। ভারতবর্ষের দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় যাতে এক জোট হয়ে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আর বিদ্রোহ না করতে পারে সে জন্য তারা গ্রহণ করেছিল ধর্মীয় বিভাজন নীতি। তারা হিন্দুকে বেশি হিন্দু এবং মুসলমানকে বেশি মুসলমান হওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছে।

ইংরেজ শাসকরা নতুনভাবে ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখতে গিয়ে মুসলমানদের দুর্গতির জন্য হিন্দুদের এবং হিন্দুদের দুর্গতির জন্য মুসলমানদের দায়ী করেছে এবং নিজেদের প্রতীয়মান করতে চেয়েছে আদর্শ শাসক হিসেবে। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে হিন্দু ও মুসলমানের ভেতর অত্যন্ত তুচ্ছ সব বিষয়ে মতবিরোধ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে রূপ নিতে থাকে যা কালক্রমে রাজনৈতিক চরিত্র লাভ করে। পাকিস্তানের জন্মদাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটেছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে, যাঁকে সরোজিনী নাইডুর মতো নেত্রী হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই জিন্নাহ এক পর্যায়ে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং এমনই হিন্দুবিদ্বেষী হয়ে পড়েন যে, ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন। পাকিস্তান আন্দোলনকে জয়যুক্ত করার জন্য চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষে ভয়ঙ্কর সব সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে যার পেছনে বৃটিশ শাসকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ও অনুমোদন ছিল।

প্রকৃতপক্ষে জিন্নাহর পাকিস্তান আন্দোলন ছিল বৃটিশদের ধর্মীয় বিভাজন নীতির চূড়ান্ত রূপ। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে অখণ্ড ভারতবর্ষকে খণ্ড বিখণ্ড করে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর জিন্নাহ নিজেই তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘পাকিস্তানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাস করবে। ’* পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত জিন্নাহ পাকিস্তানকে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানের সামন্ত-ভূস্বামী ও সামরিক বাহিনীর আঁতাত জিন্নাহর স্বপ্নকে কবর দিয়ে পাকিস্তানকে একটি ইসলামিক-সামরিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলে। ’৪৭-এর আগে বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অল্প সময়ের ভেতর এ বিষয়ে তাদের মোহভঙ্গ ঘটে।

এর প্রধান কারণ পূর্বাঞ্চলের প্রতি পাকিস্তানের শাসক সম্প্রদায়ের কলোনিসুলভ আচরণ । ইসলামের দোহাই দিয়ে তারা তেইশ বছর ধরে বাঙালিদের উপর যাবতীয় শোষণ-পীড়ন চালিয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বায়ত্বশাসনের সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার যুদ্ধকে পাকিস্তানি শাসকরা ইসলামবিরোধী ও ভারতের চক্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মপরায়ণ হলেও ধর্মের নামে রাজনীতি এবং ধর্মের নামে শোষণ নির্যাতন তারা যে পছন্দ করে না একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় তার বড় প্রমাণ। একাত্তরে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দল পাকিস্তান ও ইসলামকে সমার্থক বিবেচনা করে বাঙালিদের ইসলামের শত্র“ হিসেবে গণ্য করেছে।

এভাবে তারা ধর্মের নামে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞ বৈধ করতে চেয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় এজেন্টরা ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার কথা বলে তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে, সোয়া চার লাখেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করেছে, শত সহস্র জনপদ ধ্বংস করে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের এত বড় ঘটনা বিশ্বের আর কোথাও ঘটেনি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার নতুন প্রজাতন্ত্রের যে সংবিধান রচনা করেছিল সেটি ছিল তৃতীয় বিশ্বের অনগ্রসর মুসলিম অধ্যুষিত দেশের জন্য এক যুগান্তকারী দলিল। এই সংবিধানে নতুন প্রজাতন্ত্রের অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে।

এতে বলা হয়েছিল ধর্মের নামে কেউ কোন রাজনৈতিক দল করতে পারবে না। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার ও মর্যাদা বাহাত্তরের সংবিধানে যেভাবে রক্ষিত হয়েছিল, যেভাবে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়েছিল, পৃথিবীর খুব কম দেশের সংবিধানের ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। একাত্তরের পরাজয় পাকিস্তান যে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি তার প্রমাণ হচ্ছে ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং পাকিস্তানপন্থীদের ক্ষমতা দখল। জেনারেল জিয়াউর রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে যে দল গঠন করেছিলেন সেই দলের একটি বড় অংশ ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে প্রথমেই বাংলাদেশের সংবিধান থেকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গৃহীত ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র মুছে ফেলে, সংবিধানের উপরে ‘বিসমিল্লাহ .....’ লাগালেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানী যুগে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে জেনারেল জিয়ার আমল থেকে সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও এথনিক সম্প্রদায়ের উপর নতুনভাবে নির্যাতন আরম্ভ হয় এবং তাদের অনেকে অনন্যোপায় হয়ে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়া আরম্ভ করে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কারণে এক কোটি বাঙালি দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল, যাদের ভেতর সত্তর লক্ষেরও বেশি ছিল হিন্দু। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের প্রায় সকলেই দেশে ফিরে আসে কিন্তু পঁচাত্তরের পর সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের যারা দেশত্যাগ করেছে তারা কেউ ফেরেনি। রাজনৈতিক নির্যাতন, আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা এবং মানবিক অবমাননার কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অভিপ্রয়ান দীর্ঘ একুশ বছর অব্যাহত থাকার পর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারের সময় অনেক কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিরিশ বছর পর পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক কালাকানুন ‘শত্র“ (অর্পিত) সম্পত্তি আইন’ আওয়ামী লীগ সরকার বাতিল করেছিল।

সরকারী চাকুরির ক্ষেত্রে উচ্চপদে হিন্দুদের নিয়োগের ক্ষেত্রে যে সব অলিখিত বাধা ছিল আওয়ামী লীগ আমলে সেগুলো বহুলাংশে দূর করা হয়েছিল। পাবর্ত্য-চট্টগ্রামে যুদ্ধরত পাহাড়ী সম্প্রদায়ের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর দেশত্যাগকারী পাহাড় জনগোষ্ঠী দেশে ফিরে এসেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছিল। কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামাতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির মারাÍক অবনতি ঘটেছে। তিন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর দক্ষিণপন্থী, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলির নির্যাতন অতীতেও ঘটেছে। ‘৯৬-এর নির্বাচনে যদিও আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল সেবারও প্রায় সাত লক্ষ হিন্দু ভোটারকে বিভিন্নভাবে ভোটদানে বাধা দেয়া হয়েছে, যারা ছিল প্রধানতঃ আওয়ামী লীগের সমর্থক।

আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করায় এ নিয়ে তারা তখন কোন উচ্চবাচ্য করেনি। ২০০১ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে ধরনের নির্যাতন ঘটেছে তা এক কথায় নজিরবিহীন। নির্বাচনের আগে থেকেই হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, বাড়িঘর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান লুট করা হয়েছে, গৃহে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে, জোর করে অর্থ আদায় করা হয়েছে এবং হত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসবই করা হয়েছে তাদের ভেতর ত্রাস সৃষ্টির জন্য, যাতে তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায় কিংবা এলাকায় থাকলেও যেন ভোট দিতে না যায়। নির্বাচনের আগে আমরা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে সেখানকার ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের জবানবন্দি রেকর্ড করেছি।

জামাতে ইসলামী ও বিএনপি নির্বাচনী প্রচারণায়ও উগ্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আশ্রয় নিয়েছিল। জামাত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর (বর্তমানে এমপি) এলাকায় আমরা গিয়ে শ্লোগান শুনেছি ‘এবারের নির্বাচন হিন্দু আর মুসলমানের লড়াই। ’ বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে পিরোজপুরে এ ধরনের শ্লোগান দেয়া হয়েছে। নির্বাচনে সাঈদীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের এডভোকেট সুধাংশু শেখর হালদার। বিএনপির প্রধান নেতা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো দায়িত্ববান ব্যক্তিও নির্বাচনী প্রচারণায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন।

১ অক্টোবরের নির্বাচনের আগে এসব প্রচারণা নির্বাচনোত্তর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’, ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’, ‘সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন’ ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’, ‘বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য পরিষদ’ সহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করেছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে, এমনকি সরকার সমর্থক সংবাদপত্রেও সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বহু খবর ছাপা হয়েছে। তবে এবারের নির্যাতনের প্রকৃত পরিসংখ্যান কখনও পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ ১) নির্যাতনকারীরা প্রধানতঃ ক্ষমতাসীন বিএনপি ও জামাতে ইসলামীর কর্মী ও সমর্থক হওয়ায় নির্যাতকরা থানায় অভিযোগ জানাতে ভয় পেয়েছে অধিকতর নির্যাতনের আশঙ্কায়।

নির্যাতকরা মানবাধিকার সংগঠন কিংবা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পেয়েছে একই আশঙ্কার কারণে। ২) দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কে কখনও জানা সম্ভব নয়। ৩) ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে নির্যাতিতরা কদাচিৎ থানায় অভিযোগ করে, অধিকতর নির্যাতনের পাশাপাশি সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার বহু দেশে ধর্ষণকারীর চেয়ে ধর্ষিতা নারীকে সমাজে অবাঞ্ছিত ও ঘৃণ্য বিবেচনা করা হয়। ৪) এবার যেহেতু প্রথম থেকেই সরকার সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা অস্বীকার করছিল, থানাও সেই কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ রেকর্ড করার বিষয়টি বহু ক্ষেত্রে সচেতনভাবে উপেক্ষা বা প্রত্যাখ্যান করেছে।

৫) নির্বাচনকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হাজার হাজার হিন্দু পরিবার সহায়-সম্পদ-সম্ভ্রম-আপনজন হারিয়ে কাউকে কিছু না বলে প্রাণ রক্ষার জন্য ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, যাদের সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানার কোন উপায় নেই। সংবাদপত্রে এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এবারের সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের যে সব নৃশংস ঘটনা জানা গেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছাড়া বাংলাদেশে অতীতে কখনও এরকম ঘটেনি। তবে একাত্তরে নির্যাতনের জন্য দায়ী ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, যারা ছিল বহিরাগত। এবারের ঘটনা একটি ক্ষেত্রে একাত্তরের চেয়েও ভয়াবহ, কারণ নির্যাতনকারীরা বহিরাগত শত্র“দেশের সৈন্য নয়, তারা বাঙালি এবং নির্যাতিতদের প্রতিবেশী কিংবা একই গ্রামের মানুষ। একাত্তরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা প্রাণে বাঁচার জন্য দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তারা আবার ফেরত এসেছেন।

এবার যারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, যাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তারা জানিয়েছেন যে, তাদের কেউ দেশে ফিরবেন না। ২০০১ সালের মধ্য জুলাইয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে যে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের সূচনা ঘটেছে, নির্বাচনের পর তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম তিন মাস এমন একটি দিন পাওয়া যাবে না যেদিন দেশের কোথাও না কোথাও সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। এবারের সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের প্যাটার্ন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে হত্যার চেয়ে লুণ্ঠন, গৃহে অগ্নি সংযোগ, বলপূর্বক চাঁদা আদায় ও ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটেছে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে ছয় বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত হামলাকারীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

হত্যা করা হয়েছে সদ্যজাত শিশু থেকে আরম্ভ করে পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত। হত্যার কবল থেকে মন্দিরের পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, বর্ষীয়ান জ্ঞানতাপস পর্যন্ত রয়েছেন, যাঁদের পক্ষে কারও অনিষ্ট করা কল্পনারও অতীত বিষয়। বিভিন্ন পত্রিকায় সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের সংবাদ যখন প্রাত্যহিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংস্থা উপদ্রুত এলাকাসমূহ ঘুরে এসে দেশবাসীর সামনে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে সরকারের কাছে প্রতিকার চেয়েছে, সরকার কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন সরকারের নির্লিপ্ততায় ক্ষুব্ধ হয়ে উচ্চতর আদালতে মামলা পর্যন্ত করেছিল। আদালত সরকারের কাছে কৈফিয়ৎ তলব করেছে।

নয় মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সরকার এ বিষয়ে কোন কৈফিয়ৎ দেয়নি, বরং প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা বার বার অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদকে ‘বানোয়াট’, ‘অতিরঞ্জিত’ ও ‘দলবিশেষের সাজানো নাটক’ বলেছেন। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সরকারের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কখনও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনাবলী সরকার কর্তৃক বার বার অস্বীকার করার কারণে পুলিশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

সরকার ও প্রশাসনের নির্লিপ্ততা নির্যাতনকারীদের অধিকতর নির্যাতনে উৎসাহ প্রদান করেছে। যে সব নির্যাতিত ব্যক্তি সংবাদপত্র ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছে সরকারী দলের লোকজন ও পুলিশ তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে এই মর্মে জবানবন্দি লিখিয়ে নিয়েছে যে, তাদের উপর নির্যাতনের কোন ঘটনা ঘটেনি, পত্রিকা মিথ্যা সংবাদ ছেপেছে। এর পাশাপাশি গত অক্টোবরে দুর্গাপূজার সময় ক্ষুব্ধ ও অনিচ্ছুক হিন্দু সম্প্রদায়কে অনেক জায়গায় সাড়ম্বরে পূজা করতে বাধ্য করা হয়েছে, যাতে মনে হয় হিন্দু সম্প্রদায় বাংলাদেশে মহা সুখে আছে। এবারের সুপরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা একে এক ধরনের ‘এথনিক ক্লিনজিং’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নির্বাচনের আড়াই মাস আগে থেকেই গ্রাম এলাকায় বিএনপি-জামাতের দলীয় সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে বলেছেবাংলাদেশে কোন হিন্দু থাকতে পারবে না।

বিএনপি ও জামাতে ইসলামীর মত দলগুলো ধরে নিয়েছে অমুসলিম মাত্রেই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং আওয়ামী লীগের প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। বিএনপি-জামাতের বিবেচনায় নির্যাতনের কারণে অমুসলিমরা দেশ ছেড়ে চলে গেলে ১) আওয়ামী লীগের ভোট কমবে এবং ২) বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো মনোলিথিক মুসলিম রাষ্ট্র বানানো সহজ হবে। আমরা বিভিন্ন উপদ্রুত এলাকা ঘুরে দেখেছি দলীয় পরিচয় নির্বিশেষে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রমণের শিকার হয়েছে। চট্টগ্রামের বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরিকে জামাতে ইসলামীর ঘাতকরা হত্যা করেছে, যিনি ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য। চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ভিক্ষু জ্ঞানজ্যোতি মহাথেরো, ভিক্ষু দুলাল বড়–য়া ও হিন্দু পুরোহিত মদনমোহন গোস্বামীকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই।

সিরাজগঞ্জের গণধর্ষিতা বালিকা পূর্ণিমার মা বাসনারাণী বলেছেন তারা বিএনপিকে ভোট দেবেন বলেও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাননি। সুতরাং এরকম ধারণা করা উচিৎ হবে না যে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সমর্থক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতনের শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক কারণ অবশ্যই রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা গত দশ মাস ধরে নির্যাতিত হচ্ছেন। কিন্তু হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের কারণ মূলতঃ সাম্প্রদায়িক, যার সঙ্গে সম্পর্কিত বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সমাজকে মনোলিথিক সমাজে পরিণত করার মৌলবাদী প্রয়াস।

চার বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান এবং সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার যেভাবে ঘটছে তার ফলে বাঙালি জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা আজ হুমকির সম্মুখীন। পাকিস্তান পর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বিকাশ ঘটেছিল, বাহাত্তরের সংবিধানে যা বাংলাদেশের অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল, জাতীয়তাবাদের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা বহুলাংশে অবলুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধে এক সময় মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রচারিত একটি পোস্টারের ভাষা ছিল, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টাবনআমরা সাবই বাঙালি। স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালিত্বের এই চেতনা মুছে ফেলার মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপচেষ্টার অন্ত নেই। রাজনীতির ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কিংবা সামাজিক আচরণে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা অতীতের মতো শক্তিশালী না হওয়াতে মানুষের মনোজগতে সাম্প্রদায়িকতা প্রচ্ছন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করছে।

সাধারণ মানুষের ধর্মপ্রীতির সঙ্গে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার কোন সম্পর্ক নেই এ কথা যেমন সত্য, আবার এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, ধর্মপ্রীতির প্রাবল্য ও উগ্রতা চেতনাকে ধাবিত করে মৌলবাদের দিকে, অসহিষ্ণুতার দিকে, ভিন্ন ধর্ম ও মতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ ও সহিংসতার দিকে। বাংলাদেশের যে গরিব মানুষ দু বেলা দু মুঠো খাবার জোগাড় করতে গিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তাদের জীবনে ইহজাগতিকতার অবস্থান এমনই দৃঢ় যে, ধর্মচর্চা বা আধ্যাÍিকতার স্থান সেখানে নেই বললেই চলে। অবসর পেলে তারা হয়তো ওয়াজ শুনতে যায়, ঈদের দিনে নামাজের জামাতেও যায়, কিন্তু ভোট দেয়ার সময় তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জামাতে ইসলামী কিংবা তাদের সমগোত্রীয় দলের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো দলকে ভোট দেয় এই বিবেচনায় যে, তারা চায় তাদের পছন্দের দল ক্ষমতায় যাক। দল হিসেবে জামাতে ইসলামী সহ অন্যান্য মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলো কখনও শতকরা দশভাগের বেশি ভোট পায়নি। জামাতে ইসলামী জানে এককভাবে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না তাই তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জোট বাঁধে কিংবা ক্ষমতাশীল দলের সঙ্গে সহযোগিতা করে নিজেদের কর্মসূচী যতদূর কার্যকর করা সম্ভব সে মত চেষ্টা করে।

’৯৬-এর নির্বাচনে জামাতে ইসলামী এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদে মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল কিন্তু ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে এবং বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রতি নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করে তাদের শক্তি বৃদ্ধির পথ সুগম করেছে। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা বাম ও সেক্যুলার দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তোলার পরিবর্তে দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী শিবিরে ভাঙন সৃষ্টির নিষ্ফল চেষ্টা করেছে, তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে, যার খেসারত ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের মাধ্যমে শুধু আওয়ামী লীগই দিচ্ছে না, গোটা জাতিকে দিতে হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্মের যথেষ্ট ব্যবহার করেও আওয়ামী লীগ মৌলবাদীদের ভোট পায়নি। ’৯৬-এর তুলনায় ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের ভোট বেড়েছে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে মানুষ আওয়ামী লীগ আমলে তুলনামূলকভাবে ভাল ছিল। শহরাঞ্চলে আওয়ামী লীগের ভোট কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে শুধু দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করা হয়।

শহরে মধ্যবিত্তদের ভেতর মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে এবং ভোটের রাজনীতিতেও তার প্রতিফলন ঘটছে। এবার বিএনপি-জামাতের জোটের নীতি নির্ধারকরাও জানতেন শহরে তাঁরা ভোট বেশি পাবেন, তাই শহরগুলোকে স্বাভাবিক রেখে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও সন্ত্রাসের জন্য গ্রামাঞ্চলকে বেছে নিয়েছেন। অতীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময়ে দেখা গেছে নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ এবং কার্যকর ভূমিকা, এবার সেরকম কিছু দেখা যায়নি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রতিবাদ সভা করেছে, পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছে, উপদ্রুত এলাকা ঘুরে এসে সংবাদ সম্মেলনও করেছে, কিন্তু অতীতের ম।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.