আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সলিমুল্লাহ খানঃ পরস্পরবিরোধী চিন্তার সমাহার

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের এক অনন্য নাম সলিমুল্লাহ খান। তিনি নানা কারণে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর চিন্তার জগতে অনেক শিষ্য বসবাস করেন। তারা অনেক কিছুই বলতে চান। কিন্তু বাঙময়তার অভাবে বলতে পারেন না অনেক কিছুই।

কিন্তু তারা স্বপ্ন দেখান আমাদের। আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। তাই, এই দুঃস্বপ্নের কালে কিছুটা সাধু স্বপ্ন দেখতে জনাব খানের চিন্তার রাজ্যে ঢুঁ মারতে চেয়েছিলাম। জনাব খান আমাদের কালের জীবিত পন্ডিতদের একজন। তার কথার মূল্য রয়েছে বেশ।

শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে তাঁর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা আছে বলে জেনেছিলাম আগেই। তাই, মনে হলো সেইসব চিন্তার কাছে যাওয়া উচিৎ। যেইভাবা সেই কাজ। সেইসব চিন্তার গেলাম;এবং আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে জ্বলজ্বল করে উঠলো তাঁর চিন্তার অদ্ভূত বৈপরীত্য,পরস্পর বিরোধীতা আর উদ্ভট উল্লম্ফন । তারই কিছু কিছু শেয়ার করছি।

“শাহবাগের ভবিষ্যৎ কি?” প্রবন্ধটি নিয়েই প্রথমে আগানো যাক। আমি সরাসরি বিষয়ে প্রবেশ করছি। তাই কথা আর বাড়ালাম না। শাহবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার চারদিন পর,অর্থ্যাৎ,ফেব্রুয়ারীর নয় তারিখ ‘সর্বজন’ বুলেটিনে লেখাটি প্রকাশিত হয়। সেখানে সলিমুল্লাহ খান বলছেন, “সর্বসাধারণের মনে সওয়াল দেখা দিয়াছে।

তৃতীয় ও চতুর্থক্রমে অন্যান্য রায়ের শাস্তিও কি এই পরিমাপে কমিতে থাকিবে? আন্দোলনের শরিক জনসাধারণ প্রশ্ন করিতেছেন আদালতের এই রায়ের সহিত ক্ষমতাসীন সরকার একমত কিনা। সরকারের শীর্ষ হইতে এই মর্মে কোন বিবৃতি আজ পর্যন্ত পাওয়া না গেলেও দেখা যাইতেছে সরকারি দলের অনেকেই মঞ্চে আসিয়া বলিতেছেন এই দ্বিতীয় রায়ে তাহারাও ক্ষুব্ধ। শুদ্ধ সরকারের মন্ত্রীরাই নহেন, বেসরকারি সংগঠন ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ বা টিআইবি পর্যন্ত বলিয়াছেন বিচারটা যথার্থ হয় নাই”। ( শাহবাগের ভবিষ্যৎ কি? , ৯ই ফেব্রুয়ারী, সর্বজন) অর্থ্যাৎ, টিআইবি তো বটেই সরকারি দলের অনেকেই মঞ্ছে এসে বলেছেন দ্বিতীয় রায়ে তারাও ক্ষুব্দ। এর আরেক মানে হলো, শাহবাগের আন্দোলনের সাথে তারাও একমত।

তার আরেকটা মানেও দাঁড়ায়, সরকারী দলের(এখানে মন্ত্রী,এমপি থেকে শুরু করে সাধারণ সমর্থক সবাই রয়েছে) লোকজন শাহবাগ-সমর্থকদের বুঝাতে চেয়েছেন যে, সরকারী দল এই রায়ের সাথে নাই। সরকারী দল কর্তৃক সরকারী দলের বিরূদ্ধে আনা অভিযোগকে খারিজ করার প্রবণতাই ধরা পড়ে তাদের এই কর্মকান্ডে। যদি সরকারি দল নিজেদেরকে এই রায়ের সাথে একমত মনে না করে, এবং যদি তারা শাহবাগে এসে রায়ের বিরূদ্ধেই অবস্থান নেয়, তবে তো এটাই ধরে নিতে হয় যে, সরকারী দল বুঝাতে চেয়েছে, আদালত সঠিক রায় দেয় নাই। তবে কি রায়ের প্রতি অনাস্থা দেখিয়ে এইভাবে সরকারী দল/সরকারী দলের অনেকেই (সলিমুল্লাহ খানের ভাষায়) আদালতের দিকেই আঙুল তুলেছেন?সরকারি দলের মতে তাহলে আদালতই এই রায়ের জন্য দায়ী?দেখলাম, সলিমুল্লাহ খানও নিজের ক্ষুব্দতা সহযোগে সরকারী দলের অনেকের এই ‘ক্ষুব্দ’তাকে প্রকাশ করলেন। তিনি নিশ্চয়ই আত্নতৃপ্তি পেয়েছেন এই ভেবে যে, সরকারী দলের অনেকেই রায়ের প্রতি ক্ষুব্দ।

তাহলে তিনি এই রায়ের দিকে প্রশ্ন তোলেন না কেন?আদালত অবমাননার ভয়ে?কিন্তু তা তো হবার নয়। আমরা জানি, সলিমুল্লাহ খান সাহসী জ্ঞানী। তাই আদালতের ভয়ে তিনি সত্যকথা বলবেন না তা হতে পারে না। তার আপত্তি নিশ্চয়ই অন্যজায়গায়। সেটা নিশ্চয়ই প্রসিকিউশনের দিকে।

তিনি হয়তো মনে মনে ভাবেন, প্রসিকিউশন ঠিক মতো যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করতে পারে নাই। তাই আদালতের রায় তার বা অন্যদের মনোমতো হয় নাই। অতএব,আদালতের কোন দোষ নাই। দোষ ঐ সরকার নিযুক্ত প্রসিকিউশনের, মতান্তরে, সরকারের। কিন্তু সলিমুল্লাহ খান তো আত্নতৃপ্তি পেয়েছেন এই ভেবে যে,সরকারী দলের অনেকেই এই রায়ে ক্ষুব্দ হয়েছেন।

তার মানে, রায়ের প্রতি সরকারী দলের অনেকের অনাস্থার সাথে সলিমুল্লাহ খান একমত। তাহলে, এর অপর মানে হচ্ছে প্রসিকিউশন/সরকারের প্রতি তার কোন সমালোচনা নাই। তাহলে, কোন আঁতাত হয়েছে বা সরকার/প্রসিকিউশন এর জন্য দায়ী- এটা তিনি মনে করেন না?তাহলে তিনি কার বিরূদ্ধে আন্দোলনে নামলেন?রায়ের?প্রসিকিশনের?আদালতের?কার? এই যে চিন্তার বহুমাত্রিক বৈপরীত্য –এটাই আসলে শাহবাগে অংশগ্রহণকারী বুদ্ধিজীবী,জ্ঞানী এবং অন্যদের সরকার-তোষণ নীতির অন্যরূপ। এটাকে এমনই একটা লোকদেখানো ব্যাপারে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে, এখানে সাধুত্বের সাথে আওয়ামী-তোষণ খুব সহজেই করা যায়। অথচ,কেউ বুঝতে পারে না।

সলিমুল্লাহ খান এ ধরণের সাধুদের মধ্যে অবশ্যই অগ্রগণ্য। তবে সলিমুল্লাহ খানদের যুক্তির অভাব নেই। তারা নিজের কথাকেই অস্বীকার করে বলতে পারেন, এই মঞ্চে সরকারী নেতাদের উঠতে দেয়া হয়নি। অথচ এটা একটা ডাঁহা মিথ্যা কথা। কয়েকজনকে যে উঠতে দেয়া হয়নি- এটা যেমন সত্যি,এটাও সত্যি যে, পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মানিত নেতা এবং, সরকারী দলের অনেক নেতারই সেই মঞ্চে উঠার সৌভাগ্য হয়েছিলো।

এভাবে গণজাগরণ মঞ্চ তার নানারকম বৈপরীত্য সহযোগে একসময় আওয়ামী মঞ্চে পরিণত হয়। জনগণের আবেগকে এভাবেই রাজনীতিকরণ করা হয়। আর সলিমুল্লাহ খানেরা পরোক্ষে তাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক সাহায্য দিতে থাকেন সদাতৎপর। সলিমুল্লাহ খান যখন মঞ্চ দখলকারী আওয়ামীদের দিকে আঙুল তাক করেন না ,তখনই বুঝা যায় তিনি আসলে আদালতের রায়ের দিকেই আঙুল তাক করেছেন। কিন্তু সে ব্যাপারে তার মুখ থেকে কিছুই শোনা যায় না।

আবার প্রসিকিউশন/সরকারের প্রতিও তার কোন প্রশ্ন নাই,কেননা,তার মতে, সরকারী দলের অনেকেই এই রায়ে ‘ক্ষুব্দ’ হয়েছেন ! কী অদ্ভূত বৈপরীত্য ! সলিমুল্লাহ খান বলছেন, “বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের অমীমাংসিত জাতীয় সমস্যা সমাধানের একটা পথ বাতলাইয়া দিয়াছিল। সে পথ ছিল জাতীয় ঐক্যের পথ, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় চেতনার পথ। আজ তাহার কি দশা দাঁড়াইতেছে?” তারপর বলছেনঃ “১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সহিত যাহারা একমত হয়েন নাই তাহারা জাতীয় ঐক্যের এই ধর্মনিরপেক্ষ পথকেই বর্জন করিয়াছিলেন। শুদ্ধ তাহাই নহে তাহারা দখলদার বিদেশি বাহিনীর সহিত একজোট হইয়াছিলেন। শরিক হইয়াছিলেন সকল যুদ্ধাপরাধের।

”(শাহবাগের ভবিষ্যৎ কি? , ৯ই ফেব্রুয়ারী, সর্বজন) জনাব সলিমুল্লাহ খান বলছেন, দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের অমীমাংসিত জাতীয় সমস্যা সমাধানের একটা পথ বাতলে দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম। কিন্তু সেই পথের আজকে দশা নাই,ওটি হয়ে পড়েছে দশাহীন। ওখানে,সলিমুল্লাহর, মতে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় চেতনা আর নাই। জাতীয় চেতনা আজ সেক্যুলার আর ইসলামপন্থীদের রক্তাক্ত লড়াইয়ে বিভক্ত। সলিমুল্লাহ খান এই দশাহীন অবস্থা থেকে নিশ্চয়ই মুক্তি পেতে চান।

সে জন্যই তিনি দশাহীন অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাহলে এই অবস্থাটা বেহাত হলো কেন?ভুল ছিলো কোথায়?পুঁথি পুস্তকের তত্বের সাথে বাস্তবতা মিললো না কেন?তত্ত্বের কোথায় গলদ ছিলো?ইসলামিস্ট আর সেক্যুলারদের লড়াই শুরু হলো কেন?ধর্মনিরপেক্ষতার মতো এমন একটা সুমহান চেতনা থাকার পরও সেই চেতনা আজ আর ‘জাতীয়’ নাই কেন?সলিমুল্লাহ খান তা ভেঙে বলতে চান না। পাছে তার বৈপরীত্য আর আওয়ামীপনা পুরোদমে ধরা পড়ে !নাকি সলিমুল্লাহ খান ভাবেন, কেবল ষড়যন্ত্র করেই বাস্তবতাকে ব্যাখ্যাকারী সঠিক তত্বকে বাতিল করা যায়?ষড়যন্ত্র করে আমরা তাহলে এখন ফিউডাল যুগেও ফিরে যেতে পারি?বাস্তব শর্ত না থাকার পরও নিয়ে আসতে পারি ধর্মনিরপেক্ষতাকে?তারপর এই মহান চেতনা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করতে পারি, উত্তেজিত করে দিতে পারি সাধারণ মুসলমানদের?আর এরই সুযোগ নিয়ে দলবাজি রাজনীতি করতে দিতে পারি সেক্যুলার আর ইসলামিস্টদের?কি বলেন সলিমুল্লাহ খান? তারপর,খান সাহেব বলছেন, “একটি পত্রিকা শিরোনাম করিয়াছে, ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’। তাহারা ভুল করিয়াছেন। শাহবাগে যাহা দেখা দিয়াছে তাহাকে সার্বভৌম ইচ্ছার প্রকাশ বলিয়া গ্রহণ করিবার যথেষ্ট কারণ আছে।

এই প্রকাশ নিছক ফাঁসির দাবি লইয়া ক্ষান্ত হইবে না”। (শাহবাগের ভবিষ্যৎ কি? , ৯ই ফেব্রুয়ারী, সর্বজন) সার্বভৌম ইচ্ছা অবশ্যই রাষ্ট্রের ভেতরে বসবাসকারী নাগরিকদের সম্মিলিত ইচ্ছা। এই সম্মিলিত ইচ্ছার কাছেই সমস্ত কিছুর বন্ধক রাখা হয়েছে। কিন্তু শাহবাগে যা দেখা দিয়েছে তা যদি ‘সার্বভৌম’ ইচ্ছার প্রকাশই ধরে নেই, তবুও প্রশ্ন থেকে যায়। এই ‘সার্বভৌম’ ইচ্ছা কি আওয়ামীলীগের ইচ্ছা?এই সার্বভৌম ইচ্ছা কি ফাঁসির রায় চায়?সলিমুল্লাহ বলছেন, এই সার্বভৌম ইচ্ছা নিছক ফাঁসির দাবি নিয়ে ক্ষান্ত হবে না।

তবে সে কি নিয়ে ক্ষান্ত হবে-তাও তিনি বলেন নাই। শাহবাগ কি আদালতের দিকে আঙুল তুলেছে?রায়ের দিকে তুলেছে?কিংবা সরকারের দিকে আঙুল তুলেছে?গঠনতন্ত্রের দিকে আঙুল তুলেছে?সেদিকে আঙুল না তুলে তারা এমন একদিকে আঙুল তুলেছে যার কোন দিক নাই। দিকহীন হয়ে আছে সেই আঙ্গুল। অথবা বেদিশা অবস্থা তার। নাকি সলিমুল্লাহ খান মনে করেন এটি এমন এক বৈপ্লবিক অবস্থা যার প্রভাবে রাষ্ট্র নিজেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্গঠন করে ফেলবে? কিন্তু তার তো কোন লক্ষণ নাই।

বরং পরবর্তীতে তাঁর কথা ভুল প্রমাণিত করে, ব্লগার রাজীবকে প্রতীকায়নের মাধ্যমে শাহবাগ যা ধারণ করেছে তারই বিপরীতে অন্য একটি গোষ্ঠীকে আর সাধারণ মুসলমানকে উত্তেজিত করা ছাড়া শাহবাগীদের আর কোন অবদান নাই। ফাঁসির রায় চাওয়ার সাথে সাথে এটাই এখন পর্যন্ত শাহবাগের অর্জন। মূল জায়গা চিহ্নিত করতে শাহবাগীদের তো ব্যর্থ হওয়ার কথা না। তারা অবশ্য আন্দোলনের একেবারে প্রথমেই মূল জায়গা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন কিছুটা। কিন্তু আওয়ামী-রাজনীতির কারণে সেই প্রশ্ন আর সামনে আগায় নাই।

তো,এখন, বিজ্ঞ সলিমুল্লাহ খান সাহেব তাদেরকে মূল জায়গাটা আবার চিনিয়ে দেন না কেন?নাকি মুখে মুখে বললেও তিনি বিপ্লবকে ভয় পান? তারপর ঐ একই প্রবন্ধে তিনি বলছেন, “শাহবাগ মোড়ের তরুণ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কি হইবে তাহা আদালতের রায়ের উপর নির্ভর করিতেছে না। বরং মনে হইতেছে এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কি দাঁড়াইবে তাহা নির্ভর করিতেছে এই আন্দোলনের ব্যাপকতার উপর”। (ঐ) এই আন্দোলনের ‘ব্যাপকতা’ অর্জনের জন্য যে যে জায়গায় হাত দেয়া দরকার সেসব নিয়ে তার তো কোন কথাই নাই। বরং আন্দোলন কেবল মধ্যবিত্তের শিক্ষিত তরুণদের একাংশের মধ্যেই পুলিশী পাহারায় সীমাবদ্ধ থাক-সেটাই তিনি মনে মনে কামনা করছেন। শাহবাগের তরুণদের এই সংগ্রামী চেতনার মূল শত্রু সলিমুল্লাহ খানেরা।

তারা মূল জায়গায় প্রশ্ন তুলতে তরুণদেরকে সাহায্য না করে জন্য একটা মিথ্যার আশা দেখিয়ে প্রতিনিয়ত তাদেরকে ঠকিয়ে যাচ্ছেন। গত মাসের নয় তারিখে সলিমুল্লাহ খান এই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। তারপর পেরিয়ে গেছে অনেক দিন। সলিমুল্লাহ’র ‘সার্বভৌম ইচ্ছা’ এখনও নিজেকে নিরস্ত্র বলেই স্বীকার করে। অথচ, সার্বভৌম মানেই সশস্ত্র।

আর তার ভুল প্রয়োগ কীভাবে করতে হয় তা লোকজন ইতোমধ্যেই দেখে ফেলেছে। ফেব্রুয়ারীর দশ তারিখ সলিমুল্লাহ খান বলছেন, “ কোন এক এয়ুরোপিয়া মনস্বী কহিয়াছেন মনুষ্যের মনে যদি কোন প্রশ্নের আনাগোনা হইতে থাকে তখন ধরিয়া লইতে হইবে সেই প্রশ্নের উত্তরও তৈরি হইয়াছে। হইতে পারে নিছক খসড়া উত্তর। এই উত্তর শব্দের একটা অর্থও ‘পর’। শাহবাগ একটা প্রশ্ন তুলিয়াছে।

ইহার উত্তর কোথায়? এই প্রশ্ন অর্থহীন হইবে না। এই প্রশ্ন অনর্থক মাত্র। শাহবাগের পর কি? মানে, শাহবাগের উত্তর কখন পাওয়া যাইবে? শাহবাগ একপ্রস্ত পূর্বাভাস বৈ নহে। ইতিহাসের এই সংকেত আগেও আমরা দেখিয়াছি। ইহার অর্থ ধরিতে না পারিলে আমরা ভুল করিব”।

(শাহবাগ ও ফ্যাসিবাদ,সর্বজন ১০ ফেব্রুয়ারী,২০১৩) এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে কোন অর্থ প্রকাশ পেয়েছে কি? তিনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন আর কিইবা বলতে চাচ্ছেন?একবার বলছেন, খসড়া পর্যায়ের হলেও প্রশ্নের উত্তর তৈরী থাকে। তারপর বলছেন, শাহবাগ একপ্রস্থ পূর্বাভাস। অতএব,ধরে নিতে পারি, একটা বৈপ্লবিক অবস্থার পূর্বাভাস-ই শাহবাগ। তো সে বৈপ্লবিক অবস্থাটা কি হবে? তিনি আগেরদিন বলছেন ঃ “এই প্রকাশ নিছক ফাঁসির দাবি লইয়া ক্ষান্ত হইবে না”। এইতো জনাব খানের খসড়া-উত্তর পাওয়া গেলো।

কিন্তু তিনি বলছেন, “শাহবাগ একটা প্রশ্ন তুলিয়াছে। ইহার উত্তর কোথায়? এই প্রশ্ন অর্থহীন হইবে না। এই প্রশ্ন অনর্থক মাত্র” !অনর্থক প্রশ্ন একবার নিজেই তুললেন,নিজেই এর উত্তর দিলেন,এবং এখন আমাদের বলছেন,এই প্রশ্নটাই অনর্থক। তো জনাব খান এই অনর্থক প্রশ্ন নিজে উত্থাপন করেন কেন?নাকি,কেবল তাঁরই ক্ষমতা আছে অনর্থক প্রশ্ন উত্থাপনের? তাহলে আর কারো এই ক্ষমতা/যোগ্যতা নাই?তিনিই প্রশ্নকর্তা,তিনিই উত্তরদাতা। বাকি সব তফাৎ যা।

সর্প হইয়া দংশন করো,ওঝা হইয়া ঝাড়ো ! কী লীলা !! কিছুক্ষণ পর পর নিজের কথাকে নিজেই বাতিল করে দিচ্ছেন জনাব সলিমুল্লাহ খান। একেকবার একেক কথা বলেন। অথবা,দেখতে পাচ্ছি,বলছেন কিছু অর্থহীন এলোমেলো কথা। দশ তারিখের পর বহু তারিখই পার হয়েছে। বৈপ্লবিক অবস্থা যা দেখার দেশের মানুষ তা দেখতে পেয়েছে।

রাষ্ট্র তার অস্ত্র বাহিনী দিয়ে নিজেই এখানে বিপ্লব করছে ! আহা, কী মজার বিপ্লব !! ইতিহাসে এই ঘটনা অবশ্যই অনন্য। সামান্য নহে তাহা ! খুবই অসামান্য !!মানব ইতিহাসের সোনালী অক্ষরে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বপ্রণোদিত এই বিপ্লবের কথা অবশ্যই লেখা থাকবে। এবং, আমরা আশা করতে পারি, অবশ্যই তা লেখা থাকবে মহিমান্বিত সাধুদের নিখাদ সাধু ভাষায়। তারপর, আবারো ফিরে আসি তার কাছে। তিনি বলছেন, “১৯৬৯ সালেও বাংলাদেশ জাগিয়াছিল।

যাহারা এই জাগরণের অর্থ ধরিতে পারেন নাই, তাহারাই ব্রিটিশ জবরদখলদার ওয়ারিশস্বরূপ স্থাপিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অকালপ্রয়াণের আলামত চিনিতে পারেন নাই। তাহারাই সর্বসাধারণের দুশমন অথবা রাজাকার হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির জনসাধারণ রাজাকারদের প্রত্যাখ্যান করিয়া প্রমাণ করিয়াছেন সকল প্রশ্নেরই উত্তর থাকে। আমরা বলিব, যে প্রশ্নের উত্তর থাকে তাহাকেই বলে ইতিহাস। আর যে প্রশ্নের কোন উত্তর নাই তাহাকে আমরা সাহিত্য বলিতে পারি।

সকাল বেলার সূর্য, বিকালবেলার এক ফালি মেঘ কিংবা তৃণভক্ষণরত গর্দবের ছাও”। (শাহবাগ ও ফ্যাসিবাদ,সর্বজন, ১০ ফেব্রুয়ারী,২০১৩) সলিমুল্লাহ খানকে বুঝতে দীর্ঘ উদ্ধৃতি প্রয়োজন। আশা করি পাঠক বিরক্ত হবেন না। উপরে লক্ষ্য করুন,তিনি বলছেন, সকল প্রশ্নেরই উত্তর থাকে। আর কিছুক্ষণ আগেই তিনি বললেন, “শাহবাগ একটা প্রশ্ন তুলিয়াছে।

ইহার উত্তর কোথায়? এই প্রশ্ন অর্থহীন হইবে না। এই প্রশ্ন অনর্থক মাত্র” !অবশ্যই তা অনর্থক,কেননা সেই প্রশ্ন উঠালে সলিমুল্লাহ খানদের চাতুরী ধরা পড়ে যায়। ১৯৬৯-এ কি রাষ্ট্র স্বপ্রণোদিত হয়ে জেগে গিয়েছিলো?নাকি বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরূদ্ধে জনগণ অভ্যুত্থান করেছিলো?সেই রাষ্ট্র গড়ে তুলতেই কি জনগণ ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় নাই?বলে নাই গঠনতন্ত্র তৈরী করতে? নাকি ৬৯-এ যারা জেগেছিলো তাদের সাথে ছিলো পাকিস্থানের সরকারি বাহিনী?কিসের ইঙ্গিত দিতে চান সলিমুল্লাহ খান? ৬৯-এর গণ অভ্যত্থান কি শুদুমাত্র জাগরণ ছিলো?অথচ সলিমুল্লাহ খান আজকের গণজাগরণ মঞ্চের আওয়ামী নেতাদের তোষামোদী করতে গিয়ে গণঅভ্যুত্থানকে গণজাগরণে টেনে নামিয়ে আনছেন। ইতিহাসকে বিকৃত করছে কে?নাকি তিনি ইতিহাস জানেন না,কেবল কিছু ইঙ্গিত জানেন?কোনটা?এই প্রশ্নের উত্তর কি সলিমুল্লাহ দিয়েছেন?নাকি এখন থেকে বলতে হবে, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিলো রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে সাথে নিয়ে জনগণের অভ্যুত্থান?এর থেকে হাস্যকর কথা আর কি হতে পারে ! এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দেন নাই,কেননা,এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে আর নাই। শাহবাগ তার মৌলিক প্রশ্নগুলো ভুলে গেছে,অথবা তাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে।

তাই আজও রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাকে পাহারা দেয়। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান যেহেতু সলিমুল্লাহ নির্দেশিত পথে আগায় নাই,তাই সলিমুল্লাহর কাছে এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নাই। তাই জনাব খানের কথাই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারিঃ“আর যে প্রশ্নের কোন উত্তর নাই তাহাকে আমরা সাহিত্য বলিতে পারি। সকাল বেলার সূর্য, বিকালবেলার এক ফালি মেঘ কিংবা তৃণভক্ষণরত গর্দবের ছাও”। তারপর তিনি বলছেন, “শাহবাগ হইতে বাংলাদেশের সার্বভৌম ইচ্ছা বা ইতিহাসের রায় জাহির হইতেছে।

শাহবাগ দাবি করিতেছে– ক বা খয়ের ফাঁসি নহে, দাবি করিতেছে ফ্যাসিবাদের ফাঁসি। এই দাবি ইতিহাসের রূপান্তর বিশেষ”। ((শাহবাগ ও ফ্যাসিবাদ,সর্বজন, ১০ ফেব্রুয়ারী,২০১৩) তার মানে, শাহবাগ ফ্যাসিবাদের ফাঁসি চাচ্ছে?বাহ,বেশ ভালো ! তার মানে ফাঁসির দাবী নয়,শাহবাগ আসলে ফ্যাসিবাদের ফাঁসি চাচ্ছে?এটাই সলিমুল্লাহ খান বুঝেছেন?ঐখানের স্লোগানরতরাও তাই বুঝাচ্ছে তো?এটা কার ফ্যাসিবাদ?বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদীদের ফ্যাসিবাদ?নাকি জামাত-শিবিরের ফ্যাসিবাদ?বাংগালী জাতিয়তাবাদী ফ্যাসিবাদের ফাঁসি বোধ হয় শাহবাগ চায় নাই। শ্লোগান কিন্তু ঠিকই উঠেছে-“তুমি কে,আমি কে/বাংগালী,বাংগালী”। এইভাবেই তাহলে ফ্যাসিবাদের ফাঁসি চাওয়া হয়?ও,আচ্ছা ! আরেকটা উদ্ধৃতি দেয়া যাকঃ “বাংলাদেশে যাহারা ১৯৬৯ সালে এসলামের নাম ধরিয়া সার্বভৌম জনগণের ইচ্ছার ফাঁসি দিতে চাহিয়াছিল ১৯৭১ সাল তাহাদের ফাঁসি দিয়াছে।

দুর্ভাগ্যের মধ্যে, তাহাদের লাশ এখনো হাঁটিয়া বেড়াইতেছে”। (শাহবাগ ও ফ্যাসিবাদ,সর্বজন, ১০ ফেব্রুয়ারী,২০১৩) ফাঁসি দেওয়ার পর যে-লাশ হেঁটে বেড়াতে পারে,সেটা লাশ কিনা সে নিয়ে বিস্তর সন্দেহ থেকে যায়। সলিমুল্লাহ খান নিশ্চয়ই সাহিত্য রচনা করছেন না। তিনি কংক্রিট রাজনীতির কথা বলছেন। কিন্তু রূপক হিসেবে যা নিয়ে আসছেন,তাতে বুঝা গেলো ,তিনি আসলে অনেকগুলো তর্ক এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন।

তিনি ফ্যাসিবাদের ফাঁসি চাচ্ছেন রূপকের মাধ্যমে ! ভালো !আমাদেরকে বুঝাচ্ছেন, লাশ হেঁটে গেলে এখন থেকে সন্দেহ পোষণ করতে হবে যে লাশটা জীবিত না মৃত !! এই রূপক গুলার মাধ্যমে তিনি প্রকারান্তরে সেক্যুলারদের খোঁচায় ইসলামিস্টদের উত্থানের পুরো প্রকিয়াটিকেই নাকচ করছেন। বাংলাদেশের এতগুলা অঞ্চলে এতগুলা লাশ তাহলে হেঁটে বেড়াচ্ছে?এগুলোকে আবার কবরস্থিত করবেন কীভাবে খান সাহেব?খান সেনাদের রাজত্ব কিন্তু আর নাই। সে যাক। ফেব্রুয়ারীর সাতাশ তারিখে জনাব খান আরেকটা প্রবন্ধ লিখলেন। সেখানে তিনি তার বয়ান উপস্থাপন করলেন এইভাবে ঃ “১৯৬৯ সালের নাহান গ্রামে গ্রামে কৃষক ও ক্ষেতমজুর শ্রেণির জনগণ জাগিয়া উঠে নাই।

কেন জাগে নাই সেই প্রশ্ন না তুলিয়াও রেহাই পাওয়া যাইবে না"। (যুদ্ধাপরাধবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের গতি ও প্রগতি;সর্বজন; ১৭ ফেব্রুয়ারী,২০১৩) সলিমুল্লাহ খান আন্দোলনের বারোদিন পর এসে বুঝতে পারলেন, এই আন্দোলনে কৃষক আর ক্ষেতমজুর শ্রেণির জনগন জেগে উঠে নাই। তার মানে জনগণের এক বিশাল অংশ এই আন্দোলনে নাই?কিন্তু তিনি তো কিছুক্ষণ আগেই বললেন যে, শাহবাগে সার্বভৌমত্বের প্রকাশ ঘটেছে। জনগণের এক অংশকে বাতিল করে এই তাহলে সার্বভৌমত্বের প্রকাশ?এটাই?তারপর,তারা কেন জাগে নাই,সেই প্রশ্নও তিনি সবাইকে তুলতে বলছেন। তিনি এর উত্তর দিয়ে যান নাই।

অথবা দিতে চান নাই,কারণ ৬৯-এ কৃষকদের অংশগ্রহণের পেছনে কী কারণ কাজ করছিল তা যদি বলে দেয়া হয়,তবে এই কথিত ২০১৩- বিপ্লব কি করে ‘বিপ্লবের পূর্বাভাস’ হয়ে উঠলো তা-ও ব্যখ্যা করতে হয়। কিন্তু রোমান্টিক ভাবালুতায় আচ্ছন্ন জনাব খান ইতিহাসকে এখনো পাঠ করেন শ্রেণীকক্ষে;তাই প্রশ্নের উত্তর যা আছে তাই তিনি মুখস্ত করে আসেন,অন্য কিছু ভাবতেও চান না। তিনি অবশ্যই একজন মেধাবী ছাত্র। তাই তার অজানা নাই নিশ্চয়ই যে, ৬৯-এর আন্দোলনের পেছনে যে এগারো দফা দাবি ছিলো তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিলো কৃষকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবিও। তো শাহবাগের এমন কী চরিত্র আছে যে,তা ঐ শ্রেণীকেও তার আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করবে?শাহবাগ তো রাষ্ট্র,আদালত,আর সরকার নিয়ে কোন মৌলিক প্রশ্ন তুলতেই ভয় পাচ্ছে,যেমন ভয় পাচ্ছেন/এঁড়িয়ে যাচ্ছেন তাদের একাংশের তাত্ত্বিক গুরু সলিমুল্লাহ খান সাহেব।

তো,যাই হোক,তিনি কিন্তু শ্রমিক জনগণের কেন এই আন্দোলনে উপস্থিত থাকা উচিৎ তা বলছেনঃ “শ্রমিকশ্রেণির জনগণ কেন এই আন্দোলনে শামিল হইবেন? দুই কারণে হইবেন। একটা কারণকে ‘জাতীয়’ বলা যাইতে পারে। অপরটাকে বলা যায় ‘গণতান্ত্রিক’ বা ‘প্রজাতান্ত্রিক’। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশে নতুন জাতি গঠনের সম্ভাবনা তুলিয়া ধরিয়াছিল। নানান কারণে ১৯৭১ বাংলাদেশে ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’কে সম্ভব করিয়া তুলিতে সক্ষম হয় নাই।

সেই কাজ, সেই কর্তব্য আজও জারি আছে”। (যুদ্ধাপরাধবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের গতি ও প্রগতি;সর্বজন; ১৭ ফেব্রুয়ারী,২০১৩) বুঝুন ঠ্যালা!একটা কারণ হচ্ছে ‘জাতীয়’, আর আরেকটা কারণ হচ্ছে, গণতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক। কারণের নাম যদি হয় এমন(জাতীয়,গণতান্ত্রিক) ,তবে কৃষক শ্রমিক তো দূরের কথা,খোদ খান সাহেবও তা বুঝেছেন কিনা কে জানে !কৃষক শ্রমিক কেন এই আন্দোলনে আসবেন,সে যুক্তি তাদেরকে পেশ করতে হবে এভাবে ? এমন দার্শনিক মার্কা কথায় ?বাহ,বেশ!!এরকম অস্পষ্ট, খন্ডিত, আর বৈপরীত্যে ভরা সলিমুল্লাহ খান আজকে বাংলাদেশের তরুণদের এক অংশের গুরু সেঁজে বসে আছেন। নিশ্চয়ই গুরুর শিষ্যেরা সেইসব অস্পষ্ট,ধোঁয়াশাপূর্ণ,হাস্যকর কথার এক একটা গভীর ‘ভাষ্য’ তৈরী করে ফেলবেন ভবিষ্যতে। তারপর,মার্চের সাত তারিখে সলিমুল্লাহ খান আরেকটি বিস্ময় উপহার দিলেন আমাদের।

তাঁর নিজের লেখাই উদ্ধৃত করা যাক ঃ “জাতি গঠিবার গোড়ায় ছিল দেশের সকল মানুষের সমানাধিকারের বাসনা। দেশের উপর সকলের হক বা অধিকার সমান না হইলে জাতি গঠিয়া উঠিবে কি করিয়া? ‘গণতন্ত্র’ আর ‘সমাজতন্ত্র’ নামক দুইটা মোটা শব্দের মধ্যে এই বাসনাটা বাঁধা হইয়াছিল”। (জাতীয় চেতনার চোরাগর্ত, সর্বজন;৭ মার্চ,২০১৩) জাতি কীভাবে গড়ে উঠবে সে বিষয়ে সওয়াল দেয়ার পর সলিমুল্লাহ খান বলছেন, গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র নামক দুইটা মোটা শব্দের মধ্যে নাকি এই বাসনাটা বাঁধা হয়েছিলো। মিথ্যাচার আর কাকে বলে ! ৭১-এর এপ্রিলে গঠিত মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রে এই কথা নাই,কৃষক শ্রমিক ক্ষেতমজুর গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য যুদ্ধে গেছে-এ কথা বলার আগে বোধহয় দ্বিতীয়বার ভাবা উচিৎ। কেন ভাবা উচিত,বলছি।

‘গণতন্ত্র’ হিসেবে শুধু আওয়ামীলীগারদের নিয়ে গঠিত আওয়ামীলীগ বা তৎকালীন সরকার যা বুঝেছিলো তা নিছকই ছিলো পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে সংসদীয় নির্বাচনের সংস্কৃতি। আর ‘সমাজতন্ত্র’?এটি হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো?আর যদি উদয় হয়েও থাকে কোন আওয়ামীদের ভেতর থেকেই,তবে কী আওয়ামীরা সুন্দর ‘সমাজতন্ত্রী’ হয়ে গেছিলো ৭১-এ আর তার পরে- এ কথাই আমাদের বিশ্বাস করতে হবে !! পুঁজিবাদী গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র এক সাথে যায় কীভাবে শুনি?আর যদি ‘গণতন্ত্র’ বলতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতরে জনগণের প্রতিনিধিত্বের কথা বলা হয়, জনসাধারণের আশা আকাংখার প্রতিফলন ঘটানো হবে,তাই যদি নির্দেশ করা হয়-তবে তাকে আলাদাভাবে গণতন্ত্র বলার দরকারটা কি পড়ে?মূলনীতিতে একই কথার পুনরাবৃত্তি হওয়ার দরকার কি?জনাব খান এই দুই শব্দের মধ্যে মানুষের ‘বাসনা’ দেখাতে গিয়ে আমাদেরকে ঘোলা জলে মাছ শিকারে পাঠাতে চাচ্ছেন। এটা ধোঁকাবাজি আওয়ামী প্রকল্প ছাড়া আর কিছুই না। জনাব খানও সেই ধোঁকাবাজির চক্ররথে আরোহণ করেছেন। তারপর, সর্বশেষে,আরেকটা উদাহরণ টেনে শেষ করবো।

৫ মার্চ তারিখে তিনি একটি প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্নটি তার ভাষায়ই শোনা যাক ঃ “বাঙালি জাতীয়তাবাদী হইলেই কি মানুষ অমুসলমান হইয়া যাইবে?” (সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষম পরিণাম,সর্বজন,৫ মার্চ) এর উত্তরে তিনি যা বলতে চেয়েছেন,তার সোজা মানে হচ্ছে বাঙালী জাতীয়তাবাদী হলেই মানুষ অমুসলমান হয়ে যায় না। বাংগালী জাতীয়তাবাদীও মুসলমান হতে পারে। এই কথার খানি পরেই তিনি এক বিস্ময়কর কাজ করে বসলেন। সেটিও তাঁর নিজের জবানিতেই তুলে দিচ্ছি ঃ “বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইবার পর বিশেষ করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় এবং দেশের উত্তর আর উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে যে সকল জাতি নিজেদের অধিকারের জন্য লড়িয়াছেন তাহাদের লড়াই ন্যায়সংগত।

তাহারা ধর্মে যেমন মুসলমান নহেন, বর্ণে ও তেমনি বাঙালি নহেন। তাই রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে তাহাদের পরিচয় হইল ‘বাংলাদেশি’। তাহাদের কল্যাণেই ‘বাঙালি’ বলিয়া কথিত সংখ্যাগুরু বর্ণটিও ( জাতিও বলিতে পারেন) এতদিনে হইয়াছে বাংলাদেশ”। (সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষম পরিণাম,সর্বজন,৫ মার্চ)। তার মানে, বাংলাদেশী হওয়াটাই অন্যান্য সমস্ত জাত-পরিচয়ের (বাংগালী বা মুসলমান,হিন্দু,বৌদ্ধ ,খ্রিস্টান) থেকে বেশি ভালো।

কেননা,তাতে অন্যদের অর্থ্যাৎ চাকমা,মারমা,গারো সহ অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীকে এক ছাতার নিচে আনা যায়। কিন্তু প্রথমেই তিনি আবার বলছেন ঃ “তাহারা কেন হিন্দুদের বাড়িতে হামলা করে? কারণ কি এই যে হিন্দুরা এই দেশে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ কায়েম করিতে চাহেন? কি চাহেন তাহারা? তাহারা চাহেন ( অন্যান্য দ্রব্যের মধ্যে) ধর্মনিরপেক্ষতা, তাহারা চাহেন ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ”। (সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষম পরিণাম,সর্বজন,৫ মার্চ) যেই বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভূতকে কাঁধ থেকে কিছুক্ষণ পরই তিনি নামিয়ে দিয়েছেন, প্রবন্ধের শুরুতেই সেই বাঙালীত্বকেই তিনি আঁকড়ে ধরে সামনে আগাতে চাইলেন। তারপর হোঁচট খাওয়ার উপক্রম হলে বাঙ্গালী থেকে বাংলাদেশী হলেন। জনাব খানের পূর্বোকত যুক্তি মোতাবেক বাঙ্গালী হিন্দুরা ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ চেয়ে আসলে ভুলই করেছে,যেহেতু বাংলাদেশী না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পরিচয় গড়ে উঠতে পারে না !! দেখা যাচ্ছে, তিনি নিজেই নিজের চিন্তার বিরোধীতা করছেন! এই প্রশ্ন যদি এখন তোলা হয় তবে তিনি কি উত্তর দেবেন?নাকি, জনাব খান কি নিজেই একজন সাম্প্রদায়িক ? তিনি কি তাহলে নিজের সাম্প্রদায়িকতাকে ঢাকার জন্যই পরস্পর বৈপরীত্যসূচক বাক্যের মায়াজাল ছড়ান শুধু? এরকম উদ্ভট, বৈপরীত্যসূচক আর ধোঁয়াশাপূর্ণ খেয়ালী কথাবার্তা জনাব খানের একান্ত বৈশিষ্ট্য।

এ রকম পরস্পর-বিরোধী বক্তব্যদানকারী কোন পন্ডিত শেষ পর্যন্ত যা বলতে চান তার পথরেখা এঁকেবেঁকে বহু আগেই চলে গেছে সাম্প্রদায়িকতা আর ফ্যাসিবাদের দিকে। জনাব খান সেই পথের প্রধানতম দুরন্ত পথিকদের একজন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.