আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সলিমুল্লাহ খানের ইলিয়াস চিন্তা: ভুল ভাংলে তাকে পাওয়া যায়

হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।

এই ক্ষুদে রচনাটি ছাপা হওয়ার কথা ছিল দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকী। (অবশেষে এই শুক্রবারে তা ছাপা হয়েছে) সেইখানে সলিমুল্লাহ খান গত ২৮ মার্চ একটি নিবন্ধ লেখেন '‌আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সংষ্কৃতি চিন্তা' নামে।

লেখা পাঠাবার পর দুই সপ্তাহ পার হবার পরও সেইখানের কর্তৃপক্ষ আমার এই প্রতিক্রিয়াখানি প্রকাশ করবার অবকাশ পান নাই। অগত্যা এই খানে পেশ করা হল। ****লিংকটা অবশেষে পেলামView this link .............................................................................. ছিল একটা রুমাল হয়া গেল বেড়াল। নিজে না থাকিলে মানিতাম সেদিন, মানে ১২ ফেব্রুয়ারি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম দিবসে বুঝি একটা মজমাই বসিয়াছিল। আলোচনা ঈষদোষ্ণ ও কলকলই ছিল কিন্তু কী কারণে বুঝি সেই সভার এক আলোচক_ সলিমুল্লাহ খান, স্বয়ংক্রিয়ভাবে যতই গরম হইয়া উঠিয়াছেন, ততই সভাকে তুলনায় বরফ ঠাউরাইয়াছেন।

কিন্তু পলকের ভুল পলকে সারে না। ইহারই প্রমাণ রাখিতে ঘটনার প্রায় আটচল্লিশ দিন পরে তাঁহার সেই ভ্রমকে রাষ্ট্র করিলেন। ইত্তেফাকের সাময়িকীতে আমরা পড়িলাম 'আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সংস্কৃতি চিন্তা'। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথাসাহিত্যিক। দুইখানা ঢাউস উপন্যাস আর গোটা পঞ্চাশেক গল্পেই তিনি বিরাজ করেন।

আমাদিগের জন্য ইহাই তাঁহার কর্মের ফল। আনুষঙ্গিক হিসাবে যে প্রবন্ধগুলি লিখিয়াছেন, সেগুলিকে ফলের খোসার সহিত তুলনা করা যায়। ফল বাদ দিয়া সলিমুল্লাহ খান এই খোসা লইয়াই বারবার মাতিতেছেন। ফলের দেখা তিনি যেন চাহেনই না! অপিচ, তিনি নাকি ইলিয়াসের রচনা পড়িতেই পারেন না। কী করা যাইবে! তো সেই 'সংস্কৃতি চিন্তায়' খান সাহেব প্রয়াত সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মকে রাখা সুবিধা মনে করেন নাই।

বিন্দুতে সিন্ধুতে দেখিবার ছলে কেবল তাঁর 'সংষ্কৃতির ভাঙ্গা সেতু' নামক নাতিদীর্ঘ নিবন্ধকেই নিছেন। এটি লিখিবার পরেও ইলিয়াস এক যুগ বাঁচিয়াছিলেন। ইহার মধ্যেই প্রকাশিত হয় তাঁহার শ্রেষ্ঠ কর্ম 'খোয়াবনামা'। যাঁহাদের দাঁত গজাইয়াছে তাঁহারাই মানিবেন, বস্তুটি বাংলা ভাষায় লিখিত এবং তাহা পড়া যায়। কিন্তু সলিম খান বারংবার সভায় দাঁড়াইয়া নিজের দাঁতের দূর্বলতা ঘোষণা করিতে পছন্দ করেন এবং বলেন, 'আমি পড়িতে পারি নাই'।

ইহার পর আর কী বলা চলে? তাই বলি-ই না। তিনি শুনিয়াছেন, জনসংস্কৃতি মঞ্চের ওই সভায় নাকি 'কয়েকজন আলোচক-বলিলেন ইলিয়াস উত্তরাধুনিক ঔপন্যাসিক। ' বালাই ষাট! আমি সাংবাদিক, আমার কাছে রেকর্ড আছে। এই কথা কেহ বলেন নাই। আলোচনা ও সমালোচনার পার্থক্য মিহি ও গোদার পার্থক্য।

তো সলিমুল্লাহ খান ইলিয়াসের যে গোদা সমালোচনাটি করিয়া সারিয়াছেন, যতটা বুঝিতে পারি তাঁহার দুঃখ ইলিয়াস ''কোথাও 'কৃষক সংস্কৃতি' বা 'জাতীয় সংস্কৃতি' কথা দুইটা ব্যবহার করেন নাই''। বানান করিয়া লেখেন নাই তবে 'নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী সংস্কৃতি', গ্রামের মানুষ ইত্যাদি অভীধায় ইলিয়াস পুরো নিবন্ধে মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির বিপরীতে যাহাদের লক্ষ্য হিসেবে হাজির করান, তাঁহারা কৃষক বৈ আর কেহ নয়। তবে কথা কি; 'কৃষক সংস্কৃতি'ই জাতীয় সংস্কৃতি কিনা; কোন মতে তাহা সাব্যস্ত হয় তাহা যাচাই না করিয়া কেনই বা বলিবেন! তিনি প্রবন্ধটি লিখিয়াছিলেন বামপন্থি কর্মীদের উদ্দেশ্যে। যে, তাহাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চা শহুরে বৃত্ত না ছাড়াইলে এবং গরিব মানুষের প্রতি মর্যাদাবোধ অর্জন না করিলে ব্যর্থই হইবে। পাশাপাশি সাহিত্যিকদেরও বলিয়াছেন, গ্রামের মানুষের সঙ্গে এই সংযোগ বিনা ''মধ্যবিত্তের আধুনিক শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চা দেশের সংস্কৃতি চর্চার মূল প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিণত হয় উদ্ভট ও নিষ্প্রাণ ব্যায়ামে''।

কিন্তু যেই কালে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় সংস্কৃতির ধ্বনি শ্রমজীবী মেহনতিকে নাম-পরিচয় মুছিয়া লেজুড় করিবার ফাঁদ হইয়া ওঠে, সেই কালে 'জাতীয় সংস্কৃতি'র সেবা করা শেয়ালের কাছে মুরগি জমা রাখার সামিল। ইলিয়াস তাহা বুঝিতেন, তাই বিশেষ রাজনৈতিক ঝাঁজযুক্ত জাতীয় সংস্কৃতি আউড়ান নাই। এই অপরাধ কী প্রকৃতির-ফৌজদারি না দেওয়ানি তাহা না আলোচনা করিয়া কেবল বলিয়াছেন, গিনি বিসাউ ও কেপ ভার্দের 'স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা আমিলকার কাব্রাল এই বিষয়ে মূল্যবান কথা বলিয়াছেন। ' স্থানাভাবে বলিতে পারেন নাই, কিন্তু জ্ঞানের অভাবে আমরা কি বুঝিব? আমাদের আকুল প্রশ্ন, 'কেমনে কি?' পলকের ভুল কি আর পলকেই ভাঙ্গে? আরো আছে। তিনি দেখিতে পাইয়াছেন, 'মধ্যবিত্ত সমাজে শিল্পীর প্রধান উদ্দেশ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি।

তখন মনে হয় তিনি সৌন্দর্য সৃষ্টির কোনো ভাগ নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীকে দিতে রাজি হইতেছেন না। ' মনে রাখিতে হইবে ইলিয়াস সমগ্র সংস্কৃতির আলোচনা করিতেছেন না, বিভিন্ন শ্রেণীর সংস্কৃতি চর্চার তুলনা ও সম্ভাবনা যাচাই করিতেছেন। সাধারণভাবে আমরা সংস্কৃতিকে উপরিকাঠামো বলিয়া থাকি। আর বৈষয়িক জগতকে বলি অবকাঠামো। ইলিয়াসের নজরে পড়িয়াছে যে, মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি চর্চা উপরিকাঠামোরও উপরিকাঠামো।

'মধ্যবিত্তের সংগঠিত সংস্কৃতি চর্চা অনেকটাই সৌখিন। ' পক্ষান্তরে, 'নিম্নবিত্তের সংস্কৃতি চর্চা তাঁর জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ' এক কদম পরেই আরো পরিষ্কার করিয়া বলিতেছেন, 'শ্রমের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন বলে তাঁর (শ্রমজীবীর) সংস্কৃতিকে উপরিকাঠামোর পর্যায়ে ফেললে ভুল করা হবে'। কথাটা নতুন এবং অব্যর্থ। পুরাতন অভ্যাসে এর মাজেজা বোঝা দুষ্কর বটে।

সংস্কৃতির মধ্যেই শ্রমজীবী তার নিজস্ব চেতনার দিশা পায়। সেই কারণে সর্বহারা হইয়াও সে সংস্কৃতি হারায় না, উচ্চবর্গের খাঁচার মধ্যে বসিয়াও স্বপ্ন দেখিতে পারে। জীবন-উতপাদন ও সংগ্রামের মধ্যে ইহাই তাহাদের মেলবন্ধন। সলিম ভাই ইলিয়াসের এই আবিষ্কার রেজিস্ট্রি করিতে রাজি না। আমরা তাই আপিল করিয়া রাখিলাম।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.