আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিনান্তের স্বীকারোক্তি...

সাগর দেখেছি কিন্তু সাগর হতে পারিনি ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটায় বাঁধা একঘেয়ে জীবনের মাঝে কয়েকটা দিন বড় অন্যরকম। ইদানিং প্রায়ই বাসায় একা থাকা হয়। একা থাকাটা আমার কাছে বিশাল কোন সমস্যা না, বরং আমি এতে একটু ভীষণ রকমের অভ্যস্তই বলতে গেলে। আমাদের সবার একটা নিজস্ব ভূবন আছে। সেই ভূবনে আমাদের অবাধ বিচরণ।

বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন সবার ঊর্দ্ধে এই নিজস্ব ভূবন, বড় বেশি নিজের, বড় বেশি আপন। একাকী সময়গুলোতে এই ভূবনটিই আমার একান্ত সঙ্গী। হাসি বা কান্নায়, ডায়রী বা ব্লগে সেই ভূবনের অস্তিত্ব টের পাই। আরও বেশি করে টের পাই আমার একাকীত্বে। বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে শুরু করে ১০১ রকমের নানা সমস্যা নিয়ে একা অন্ধকার একটা রাত কাটালাম গতকাল।

সবার চোখে অসীম সাহসী এই আমি জীবনের প্রথম ভয় পেয়েছিলাম অন্ধকারকে, তারচেয়েও বেশি নিঃসঙ্গতাকে। দেয়ালে মোমবাতির শিখার ছায়ার কাঁপন, চারপাশের গাঢ় অন্ধকার, গুমোট নির্জনতা সবই মনে হচ্ছিল নতুন। এই নতুনের মোড়কে নতুন করে ফিরে আসছিল পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো। অসম্ভব সুন্দর ছেলেবেলা, দুই বোনের খুনসুটি, অল্পে মুগ্ধতা, জানার আগ্রহ, সাফল্য, আদর-ভালবাসার চাদরে মোড়ানো এক সময় সবকিছু একে একে জীবন্ত হয়ে উঠছিল। একইসাথে অস্থির বয়োসন্ধিকাল, নিজেকে ও চারপাশের মানুষকে বুঝতে না পারার টানাপোড়েন, অপরিণত মনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভুল, ব্যর্থতা, বিষন্নতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তাভাবনা সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছিল।

ভাবনা আর ভয়ে অবশেষে চোখ লেগে এল ঘুমে। ভোরবেলা শো শো বাতাস আর মেঘের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এমন কত ঝড়ের রাতে দৌঁড়ে গেছি আম্মার কাছে ঠিক যেমনি ভীত পাখির ছানা আশ্রয় নেয় মায়ের ডানার তলায়। আবারও আক্রান্ত হই ভয়ে। গত বেশ কয়েকদিন ধরেই এমন একটা ভয়টা মনের মধ্যে দানা বাঁধছিল, নিজের জন্যে নয়, মায়ের জন্যে।

জীবনের একটা সময় মানুষ খুব একা হয়ে যায়। শেষ বয়সে এসে অসম্ভব ব্যস্ত দুটো মানুষও একে অপরের প্রতি বড় বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ যেন ব্যস্ত দাম্পত্য জীবনের অবসর, ছেলেমেয়ে পরিণত হবার পর নির্ভার সময়। ঠিক এই সময়টাতে আমার মা বড় একা। যে মানুষটা ছায়ার মত আমাকে সঙ্গ দিয়ে এসেছেন, পাখির মত ডানায় আগলে রেখেছেন তার নিঃসঙ্গতা দূর করার কোন সঠিক পথ আমার জানা নেই।

একটা সময় ছিল যখন একা থাকাটাকে মনে হত চ্যালেঞ্জ, বড় হবার লক্ষণ, নিজের ভূবনে ডুব দেবার সুযোগ। দিনে দিনে তাও পালটে যাচ্ছে। এখন বুঝতে পারি একা থাকাটা কত কষ্টের, বিশেষ করে শেষ বয়সে একটা মানুষের পাশে সমসাময়িক ভাবনাগুলো শেয়ার করার কেউ না থাকাটা বড়ই পীড়নদায়ক। আসলে বড় হওয়াটাই যন্ত্রণার। যতদিন মনের চোখ বন্ধ থাকে, বোঝার ইন্দ্রিয় থাকে অপরিণত ততদিনই সুখ।

একটা সময় মনে হত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বিশাল পৃথিবী আমার। কিন্তু বড় হতে হতে জানলাম ও বুঝলাম আমার পৃথিবী আসলে অনেক ছোট। দু’টি মানুষের হাসি-কান্না, দুঃখ-আনন্দে সীমিত। এখন আর স্বার্থপরের মত শুধু নিজের সুখ নিয়ে ভাবতে ভাল লাগেনা। আমার পরিণত মন আজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাস্তবতা।

মনে করিয়ে দেয় সবসময় সুখে পরিপূর্ণ এক দাম্পত্যের অকাল করুণ বিচ্ছেদ, সঙ্গীহারা এক নারীর দুই সন্তানের জন্যে সব সুখ বিসর্জন আর বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আমি দুঃখবিলাসী বা কল্পনাবিলাসী নই, তবু আমি ভাবি, ভাবনাগুলো আমাকে বড় ভাবায়। নিজের মধ্যে প্রচন্ড তাগিদ অনুভব করি কিছু একটা করার। হাত খরচের ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেকে ঈদ বা মা দিবসের উপহার দেয়া নয়, আরও অনেক বড় কিছু। হয়তোবা তার ত্যাগের তুলনায় কিছু নয়।

তবু তার মুখে একটুকু হাসি ফোটাবে, তাকে বলবে, তোমার ত্যাগের ফসল ব্যর্থ বা স্বার্থপর নয়। ভালবাসা পৃথিবীর সবচে কঠিন আবেগের অনুভূতি। আর তাই হয়তো আমরা কখনও তা ঠিকমত প্রকাশ করতে পারিনা। বারবার “মা, তোমাকে ভালবাসি” বলে যেমন তা প্রকাশ করা যায়না তেমনি হাজার ব্লগ লিখেও তা প্রকাশ করা যায়না। অন্ধকার রাতের ভয় ও নিঃসঙ্গতার ভাঁজে যেমন তার অস্তিত্ব তেমনি দিনের আলোর কলমের আঁচড়ে আর কী-বোর্ডের দাপানিতেও তা সম্পূর্ণ মুক্তি পায়না।

দিনান্তের শেষ আলোয় আমার সহজ স্বীকারোক্তি, আমি পৃথিবীর সবচে ভাগ্যবতী কন্যা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।