আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

-বেকার সমাচার--

আমি এবং আরণ্যক ছাইরংয়া বধ্যভূমিতে দাড়িয়ে দেখছি শেষ সূর্যাস্ত গাবতলী থেকে ১৩ নম্বর বাসে চড়ে বসতেই রফিকের মনে হলো সে গনগনে চুলার ভেতর ঢুকে পড়েছে। বাসের দরজা থেকে ভেতর অবধি যাত্রীর সংখ্যা এতোবেশি যে কোথাও ভালোমতো একটু পা ফেলবার জায়গা নেই, ডানে-বামে একটু নড়তে চড়তে গেলেই সামনেপেছন থেকে নানারকম তিরস্কার শোনা যায়, এই যেমন ঐ মিয়া একটু সইরা খাড়ান, ইস পায়ে পাড়া দিয়ে এক্কেরে চ্যাপ্টা কইরা দিলেন। রফিক অনেক কষ্টে কাঁধের ব্যাগটাকে একটু সাইডে সরিয়ে শরীরটাকে সোজা করবার চেষ্টা করতেই দেখলো তার পীঠ থেকে কাঁধ পর্যন্ত আশ-পাশের চার পাঁচটি কনুই ও শরীরের চাপে একেবারে অনড় হয়ে গেছে। এদিক-ওদিকে নাড়ানোর চেষ্টা করে কোন লাভতো হলোই নাউপরন্তু নিজেকে কেমন অথর্ব মনে হতে লাগলো । অঘ্রানের মাঝামাঝি এই সময়ে প্রকৃতির এমন অনুচিত বৈরিতা একেবারেই বেমানান।

গ্রাম-গন্জে মোটামুটি শীতের আমেজ আসতে শুরু করেছে। অথচ ঢাকা শহরের কোথাও শীতের আগাম লক্ষণ দেথা যাচ্ছেনা । বরং যতই দিন যাচ্ছে বাতাসের তাপমাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনভাবে চলতে থাকলে হয়তোবা একদিন ভুলেই যেতে হবে এদেশে শীতকাল আছে। রফিকের পাঁজড় ও পীঠ ঘেষে সেঁটে থাকা কয়েকটি শরীরের উষ্ণতায় সহ্যের পরিমানটা অসম্ভবের পর্যায়ে চলে গেল।

সে আবারে চেষ্টা করলো ডানে-বামে একটু সরে যাওয়ার, অনেক কষ্টে একটু পায়ের জায়গাটা পরিবর্তণ করতেই পেছন থেকে মাঝবয়েসি একজন ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন “ কি ব্যপার পা দিয়ে এমন ঠেলা দিচ্ছ কেন? সমস্যা কি?” রফিক যথাসম্ভব বিনয়ী ভঙ্গিতে জবার দিল “ সরি আংকেল কিছু মনে করবেন না, খেয়াল করতে পারিনি”। লোকটির ভেতর তেমন কোন পরিবর্তন দেখা গেলনা সে আগের মতোই কটমটে চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল । এবারে রফিকের ইচ্ছে করছিলো লোকটিকে কষে একটা চড় দিতে, এমনিতেই বাসের ভেতর পা ফেলবার জায়গা নেই তার উপর লোকটির ভাব দেখে মনে হচ্ছে উনি বাসে নয় প্লেনে চড়ে বসেছেন । রফিক উপেক্ষা করার ভঙ্গিতে বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাস্তা জুড়ে সারি সারি যানবাহন এবং অসংখ্য মানুষের ছোটাছুটি, সবাই কোথাও না কোথাও পৌঁছুতে চায় ।

রফিক কয়েক মাস আগেও বুঝতে পারিনি তাকেও সামিল হতে হবে অসহ্য কষ্টকর এই দৌড়পাল্লায় । জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনরকমে মাস্টার্স কমপ্লিট করে মাস ছযেক হলো ঢাকা শহরে এসেছে চাকরীর সন্ধানে । কিন্তু হাজার চেষ্টার পরও এখনো গা থেকে বেকারত্বের বোটকা গন্ধটা তাড়ানো সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি । অবশেষে ছোটখাটো একটা টিউশানি জোটানো সম্ভব হয়েছে। এখানে আসবার পর প্রতিদিনের সেই একই গৎবাধা রুটিন এই যেমন সকালে ঘুম থেকে ওঠা,পাশের দোকান থেকে দু’টো রুটি ও সবজি দিয়ে নাস্তা করা, তারপরা চাকরীর সন্ধানে ব্যাগভর্তি সি.ভি নিয়ে অফিসে অফিসে ব্যর্থ ছোটাছুটি ।

বাসটি বেশ কিছুক্ষন দ্রুত গতিতে চলার পর একসময় জ্যামে আটকা পড়লো । বাসের ভেতরের উষ্ণতা মনে হলো একলাফে কয়েকশো ডিগ্রী বেড়ে গেছে । রফিক একবার ঠিক করলো বাস থেকে নেমে যাবে, কারন ঢাকা শহরের জ্যাম একবার শুরু হলে তা ছাড়তে প্রায় অনন্তকাল লেগে যায় । কিন্তু বাসের ভেতরের যাত্রী সংখ্যা এতটাই যে নামবার পথ পর্যন্ত নেই । বেশ কিছুক্ষন দ্বিধাদন্দের মাঝখানে দোল খেতে খেতে অবশেসে বাস থেকে না নামার সিদ্ধান্ত নিলো ।

কারণ মাঝপথে নেমে অন্যকোন বাসে উঠলে সেই একইরকম অবস্থার সম্মখীন হতে হবে । প্রায় মিনিট বিশেক পর জ্যাম ছুটে গেলে বাসটি আবার চলতে শুরু করলো । বাসের জানলা দিয়ে মাঝে মাঝে বৃষ্টির হালকা ছাটের মতো কয়েক দমকা ঠান্ডা বাতাস আসছে, এই অসম্ভব কষ্টকর মুহূর্তে এটিকে মনে হচ্ছিলো স্বর্গের লিলুয়া বাতাস। মধ্যাহ্ণ বিরতীর পর সূর্যটা মাঝবরাবর থেকে একটু পশ্চিমে হেলে পড়েছে, আকাশে রোদের তীব্রতা আপাতত কিছুটা কমে এলেও গায়ে জ্বালা ধরা গরমের কোন কমতি হয়নি । রফিকের মনে হলো এসময় পথ-ঘাট ভাসিয়ে বৃষ্টি হলে কেমন হতো? অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয়না ।

এই আগ্নেয়গিরীরুপি ঢাকা শহরটা একটু টান্ডা হলে আর কারো না হোক অন্তত তার মতো ভবঘুরে বেকারদের জন্য ভালো হতো । কেননা শুধু তাদেরকেই আগুন রোদ মাথায় করে, চটির তলা ক্ষয় করে দারে দারে চাকরীর জন্য ঘুরতে হয় , এর ঘোরাঘুরিটা একটু আরামদায়ক হলে তাদের জন্য মন্দ হতোনা । সুদীর্ঘ কয়েকঘন্টার ধ্বস্তাধ্বস্তি শেষে বাসটি আসাদ গেটের কাছাকাছি এসে থামলো । ঠাসাঠাসি ভীড় থেকে কোনরকমে শরীরটাকে গলিয়ে বাস থেকে নেমে দাঁড়াতেই রফিকের মনে হলো সুদীর্ঘ হাজত বাসের এইমাত্র অবসান হলো। দীর্ঘ সময় বাসের ভেতর একনাগাড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হাত-পায়ের শিরাগুলোতে রক্তসঞ্চালন প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো ।

মাটিতে দাঁড়াতে গিয়ে মনে হলো শরীরের নিচের অংশটুকুই কোন সাড়াশব্দ নেই। কাঁধের ব্যাগটাকে একহাতে শক্ত করে চেপে ধরে সে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগুতে লাগলো । আপাতত এই মুহূর্তে তার কোন সুনির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল নেই। এখন থেকে কয়েক ঘন্টা আশ-পাশে কোথাও বসে জিরোবার পর ফিরে যাবে মেসে । মেসে মিলের টাকা বাকি পড়েছে একারনেই বিগত কয়েকদিন খেতে বসলেই সবার দৃষ্টিবানে একটু আধটু আহত হতে হয়।

আজকাল এসবের জন্য মন খারাপ হয়না শুধু নিজের উপর তিক্ততা বেড়ে যায় । হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল হলো পেটের ক্ষুধাটা চরমে উঠে যাওয়ায় পা দুটো সামনের দিকে এগুতে চাইছে না । পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দেখলো একেবারে কোনার দিকে একটি পঞ্চাশ টাকার সাথে গুটি কয়েক দু’টাকার নোট গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে । টিউশানির বেতন পেতে এখনো দু তিন দিন বাকি। একয়েকদিন যেভাবেই হোক হিসাব নিকাশটা এই পঞ্চাশ টাকার ভেতরই সিমাবদ্ধ রাখতে হবে ।

হিসাব নিকাশ বলতে অবশ্য সকালের নাস্তা পরোটার বদলে একটি বিস্কুট ও লাল চা দিয়ে সারতে হবে এবং যাতায়াতের ক্ষেত্রে যতদুর সম্ভব হেঁটে যেতে হবে । সিগারেটটা ছেড়ে দেবার পর মাসের খরচের একটা বড় অংশ বেঁচে গেছে । দুর্বল পায়ে বেশ কিছুদুর এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ পনেরো ষোল বছরের একটি মেয়ে তার পথ আটকে দাঁড়ালো । মেয়েটি দেখতে শ্যামলা, হালকা পাতলা গড়নের, নাকে বেদেনীর মতো বড় কালো একটি দুল, ফলার মতো ধারালো চোখদু’টোতে গাঢ় করে কাজল পরা। হঠাৎ এমনকরে পথ আটকে দাঁড়ানোতো রফিক কিছুটা ভড়কে গেল।

মেয়েটি শাড়ির আঁচলের ভেতর থেকে ছোট একটি কাঠের বাক্স বের করে তার মুখের সামনে তুলে ধরে বললো “ এই ভাই এই নাগিনীরে কয়ডা টাকা দে, তোর ভালো হবে”। রফিকের ঠোঁটে আনমনে বিদ্রুপের হাসি খেলে গেল, মনে মনে বললো “ তোর তো তাও ভিক্ষা করার পথ খোলা আছে, আমারতো তাও নেই” । রফিকের দিকে তাকিয়ে অধৈর্য্য হবার ভঙ্গিতে মেয়েটি অধিকার মেশানো সুরে বলে উঠলো “ কি হইলো টাকা দিচ্ছিস না ক্যান?”। রফিক পকেট থেকে দু’টাকার একটা নোট বের করে মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিলো । মেয়েটি এবার ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো কয়েক হাত পেছনে সরে গিয়ে আশ্চর্য সুরে চেঁচিয়ে উঠলো “ মাত্র দুই টাকা দিচ্ছিস ক্যান? আমার নাগিনী কি মিসকিন?” রফিক ঠোঁটে মুদূ হাসি দিয়ে পকেট থেকে আরও একটি দু’টাকার নোট মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললো “ কি করবো বল, বেকার মানুষ পকেটে দু’টাকার বেশি কখনোই থাকেনা” ।

মেয়েটির চোখে মুখে এবার অস্পষ্ট এক শীতলতা নেমে এলো আস্তে করে বললো “ ঠিক আছে যা তোর ভালো হবে”। একসময় এরকম মণি ঋষি টাইপের কথা শুনলে বেশ বিভ্রান্ত হতে হতো। কলেজে পড়বার সময় একবার সে এক পাগলকে রুটি কিনে খাওয়ালে পাগলটি তার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলো “ তোর ভালো হবে” । সেদিন সত্যিই সে একথা বিশ্বাস করেছিলো আজ মেয়েটির মুখে সেই একই কথার পুনরাবৃত্ত্বি শুনে তার আনমনেই হাসি পেল । সময়টা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে, রাস্তা-ঘাট-প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষের মানুষের হৃদপিন্ড পর্যন্ত সব কিছুই নিত্য নতুন ছাচে তার অবয়বটা বদলে নিচ্ছে।

যে ছেলেটি গতকাল হাফ-প্যান্ট পরে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যেত, সে আজ ছুটছে কলেজে, সারাদিন রিকশা চালিয়ে যে ঘর্মাক্ত রিকশাওয়ালা গতকাল গামছায় মুখ মুছে জিরিয়ে নিচ্ছিলো শহরের কোন এক গলির নির্জন ছায়ায়, আজ তার কোমরে ভিজে যাওয়া বিড়ির প্যাকেটের জায়গায় সুর তুলছে চিনা প্রযুক্তির অত্যাধূনিক যাদুকরী যন্ত্র। রফিক হাঁটতে হাঁটতে সংসদ ভবনের মুখোমুখি কয়েকটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো । কাঁধের ব্যাগটাকে নামিয়ে বসার মতো একটা জায়গা হাত দিয়ে পরিস্কার করে বসে পড়লো। দু’চোখের পাতা ক্রমশই ভারী হয়ে আসছে । রফিকের ভীষন ইচ্ছে করছিলো এখানেই শুয়ে কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে নিতে ।

মাথার ভেতর কয়েকটা কবিতার লাইন খেলা করছে, কবিতাদের সময় জ্ঞানটা একেবারেই কম, স্থান-কাল পাত্র বোঝেনা । রফিক ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে লিখে ফেললো কয়েকটি বিচ্ছিন্ন লাইন - “সামনে পেছনে অন্ধকার চারদেয়াল রোদখেকো বাজপাখির বিশুষ্ক ঠোঁট খোঁজে কয়েক ফোটা তৃষ্ণার জল, এপারেতে জল নেই, নেই আলোকিত ভোরের রক্তিম পূর্বাভাস ওপারেতে নির্ঘুম কয়েক ডজন চোখে আধকপালী বৈরিতার দগদগে গাঁড় দাগ"। ঋতু ভালোই করেছিলো, অবশ্য ঋতুরা সবসময় ভালোই করে । আবেগের সমুদ্রে শুধু শুধু ভেসে বেড়ানোর চেয়ে সময় বুঝে হিসাব নিকাশ চুকিয়ে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ । প্রথম প্রথম রফিকের জন্য বিষয়টা মেনে নেওয়া খুব কষ্টের ছিলো ।

পরে বুঝতে পেরেছে নিজের অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্তের বোঝা আরেকজনের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা রীতিমত অপরাধ বটে । কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে স্মৃতিগুলো বেয়াড়া হয়ে ওঠে, আকাঙ্খা ও প্রাপ্তির সমাধানহীন বিবাদে চোখের সিমানা থেকে অনর্থকই ঘুম ছুটে যায় । পেটের ভেতর ক্ষুধার চিনচিনে ব্যাথাটা ক্রমশই ব্যপকতর হতে শুরু করেছে। এভাবে কিছুক্ষণ গেলে হয়তোবা মাথা ঘুরে পড়ে যাবে । একটু দুরেই ঝালমুড়ির ঝাকা নিয়ে বসে আছে একজন।

রফিক এখান থেকেই তার দিকে হাত ইশারা করে ডাকলো । ঝালমুড়িওয়ারা তার ঝাকা মাথায় তুলে নিয়ে রফিকের দিকে এগিয়ে এলো । মাথা থেকে ঝাকাটি আস্তে করে নীচে নামিয়ে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বললো “ কয় টাকার দিমু মামা?” । রফিক দূর্বলভাবে জবাব দিলো “দাও পাঁচ টাকার, পারলে একটু পেয়াজ মরিচ বেশি দিও”। ঝালমুড়িওয়ালা কোন কথা না বলে দ্রুতগতিতে মেশিনের মতো হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝালমুড়ি বানাতে লাগলো ।

রফিক অদ্ভুত চোখে তার হাতের কারুকার্য দেখতে লাগলো, ঝালমুড়ি বানানো হয়ে গেলে পকেট থেকে টাকা বের করে লোকটির পাওনা মিটিয়ে দিয়ে মুড়ি চিবোতে শুরু করলো । অনেক সময় ধরে গরমে সিদ্ধ হবার পর মুখের ভেতরটা কেমন যেন বিস্বাদ ঠেকতে লাগলো । কোন রকমে খাওয়া শেষ করে ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে ঢকঢক করে কয়েক চুমুক পানি খেয়ে নিলো । শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে, মনে হচ্ছে রাতের ভেতরেই জ্বর আসবে । আরও কিছুসময় জিরোবার পর মেসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সে উঠে দাঁড়ালো।

৩০.০৫.২০১১ অফিস (মহাখালী) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।