আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক সমাবেশে হামলার পাঁচ বছর> বিচার শুরু হয়নি আজো

জাহিদুজ্জামান > ২৯শে মে, ২০০৬। কুষ্টিয়ায় আয়োজন করা হয় সাংবাদিক নির্যাতন বিরোধী সমাবেশ। পালিয়ে ঢাকায় অবস্থান নেয়া চার সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে আসলেন সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। সঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক ওমর ফারুক, ফরাজী আজমল হোসেনসহ ছোট্ট একটি দল। সমাবেশস্থল কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে জড়ো হয়েছেন আশপাশের বিভিন্ন জেলার সাংবাদিক নেতারা।

ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় সাংসদ ও নেতাকর্মীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এসেছেন জেলার সর্বস্তরের সাংবাদিকরা। দু’জন বক্তব্য দেবার পর শুরু করলেন ফরিদপুরের সাংবাদিক নেতা লায়েকুজ্জামান। বিএনপির নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন একটি রাজনৈতিক দল কতটা দেউলিয়া হলে সাংবাদিকদের নামে মিথ্যা মামলা করতে পারে। এই বক্তব্যের পরই পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া ছাত্রদল ও যুবদলের ক্যাডাররা হামলে পড়লো সমাবেশের উপর। অদূরে অবস্থিত জেলা বিএনপি অফিসের ভেতর থেকে বের হয়ে তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে সমাবেশ স্থলে এসে মারপিট-ভাঙচুর শুরু করলো।

কপাল ফেটে রক্ত ঝরলো ইকবাল সোবহান চৌধুরীর। আহত হলেন ২৩ জন সাংবাদিক। অনেকের মোবাইল, ক্যামেরা ও মোটর সাইকেল ভেঙ্গে ফেলা হলো। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে দেখলো পুলিশ। পরে ঢাকা থেকে নির্দেশ পেয়ে পুলিশের আরেকটি দল গিয়ে আক্রান্তদের উদ্ধার করলো।

ততক্ষণে পন্ড হয়ে গেছে সমাবেশ। সাংবাদিক নেতারা আশ্রয় নিয়েছিল পাবালিক লাইব্রেরীর পাঠ কক্ষে। পরেও সমাবেশ করতে সাপোর্ট দেয়নি পুলিশ। পুলিশ পাহারায় মিছিল করে স্থান ত্যাগ করেন নেতারা। কুষ্টিয়া হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে নির্যাতিত ওই চার সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়েই ঢাকায় ফিরে আসলেন তারা।

সে সময় প্রশাসনে দলীয়করণ এতোটা প্রভাব বিস্তার করেছিল যে দেশে বিদেশে আলোচিত ওই ঘটনায় ইকবাল সোবহান চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা দিলেও তা নেয়নি পুলিশ। ঘটনার পর চলে গেছে পাঁচটি বছর। বিএনপি দলীয় সরকার ক্ষমতা ছাড়লে দায়ের করা হয় মামলা। চার্জশীটও হয়েছে। কিন্তু বর্তমান মাহজোট সরকারের আমলেও একের পর এক তারিখ নির্ধারণ হচ্ছে, শুরু হচ্ছে না ওই মামলার বিচার।

সংবাদ প্রকাশের কারণে পালিয়ে ঢাকায় অবস্থান নেয়া ওই চার সাংবাদিকের একজন আমি। আমার দূর্ভাগ্য যে, ঘটনার শুরুও আমাকে নিয়ে। সেটি ছিল ২৫শে বৈশাখ, ৮ই মে, ২০০৬। তখন কাজ করতাম দৈনিক মানবজমিনে। কুষ্টিয়া স্টাফ রিপোর্টার।

আগেরদিন ৭ই মে ওই পত্রিকায় আমার বাই লাইনে ছাপা হয় ‘তিন এমপি টেনশনে’ শিরোনামে একটি সংবাদ। সংবাদটিতে ছিল ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় কুষ্টিয়ার তিন এমপি জনবিচ্ছিন্নতার কারণে সামনের (২০০৭ সালের) নির্বাচন নিয়ে রয়েছেন টেনশনে। উল্লেখ করার মতো যে, সংবাদটি পরে সত্য প্রমান হয় নির্বাচনের ফল-এ। জেলার ৪টি আসনের সবক’টিতে বিএনপি প্রার্থীর ভরাডুবি হয়। সংবাদে বর্ণিত ওই তিনজনের একজন তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুল ইসলাম।

প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। করেন অশ্লীল গালিগালাজ। শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে তখন চলছিল রবীন্দ্র জন্মদিনের উৎসব। এই সভ্য সভায়ই চরম অসভ্যতা। কেন এরকম নিউজ করেছি, সে কারণ জানতে চেয়ে সভামঞ্চের সামনেই অকথ্য ভাষায় অশ্লীল গালিগালাজ করেন তিনি।

পাশে বসা দু’জন মন্ত্রী, অন্যান্য এমপি, শহীদুলের স্ত্রী। উপস্থিত হাজার হাজার রবীন্দ্র ভক্ত হতভম্ব। হতভম্ব আমিও। তিনি এমন আচরণ করতে পারেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। স্বভাব ও ক্ষমতার মিশেলে এমন হতেই পারে।

কিন্তু তিনিই যে এ অনুষ্ঠানের আয়োজক। তিনি অধ্যাপক! সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও তিনি। স্মৃতিধন্য কুঠিবাড়িতে কবির জন্মদিনের উৎসবে তার এ আচরণ খুবই বেমানান দেখালো। সঙ্গে সঙ্গেই ছি ছি পড়ে গেল। সহকর্মী সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানালো।

স্কুল জীবন থেকে সাইকেলে করে এই শিলাইদহে আসতাম। তারপর বেড়াতে, অন্যদের দেখাতে এবং পেশাগত কাজে কতবার এখানে এসেছি সে হিসেব করা কঠিন। বিশ্বকবির স্মৃতিধন্য এই কুঠিবাড়ি আমার কাছে তখন একেবারে অচেনা মনে হলো। এই ঘটনার পরও অনেকবার শিলাইদহ গেছি। ওই দুঃস্মৃতি ভেসে উঠেছে ছবির মতো।

সেদিনের ওই ঘটনার রেশ ছিল আরো দীর্ঘ। ক্ষুব্ধ সংবাদকর্মিরা কুষ্টিয়া ফিরে প্রতিবাদ সভা করে। পরদিন ৯ই মে সমকাল, যুগান্তরসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক শহীদুলের এই অসভ্যতা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ওই দিনই এমপি শহীদুল বাদী হয়ে মিথ্যা মামলা করেন তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। আমি বাদে বাকী দু’আসামী মুন্সী তরিকুল ইসলাম(সমকাল) ও আল-মামুন সাগর(যুগান্তর)।

তাদের অপরাধ হলো আমার পাশে দাড়ানো, এবং শহীদুলের অসভ্যতার প্রতিবাদ করা এবং পত্রিকায় নিউজ করে অসভ্যের মুখোশ খুলে দেয়া। মজার ব্যাপার হলো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার খবর পরদিনের খবরের পাতায় ছাপা হলে আরেকটি মামলা করা হয় আমাদের তিনজনের বিরুদ্ধে। পুলিশ পাঠানো হয় বাসায়। এরপর ঢাকায় পালানোর পথে আমাদের ধরতে পুলিশ ও ছাত্রদলের কর্মিদের দিয়ে প্রহরা বসানো হয়। মিঠু ভাই (মনজুর এহসান চৌধুরী, সম্পাদক, দৈনিক আন্দোলনের বাজার) এর প্রাইভেট গাড়ীতে করে গ্রাম্য পথে ঢাকায় পৌছাই আমরা।

হামলা ও মামলার হুমকিতে ক’দিনের মাথায়ই মিঠু ভাইও আমাদের সঙ্গী হন। বন্ধ করে দেয়া হয় তার পত্রিকা আন্দোলনের বাজার। বন্ধ ছিল ৪৪ দিন। বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় এই ঘটনার উপর সংবাদ প্রকাশিত হয়। জাতীয় প্রেসক্লাব ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন নানা প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহন করে।

সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, শওকত মাহমুদসহ অন্যরা উদ্যোগ নিলেন কুষ্টিয়া গিয়ে সমাবেশ করে আমাদের রেখে আসবেন। আমরা আশার আলো দেখতে পেলাম। কিন্তু খবর পেলাম কুষ্টিয়ায় গেলে হাত পা ভেঙ্গে দেয়া হবে। সমাবেশেই হামলা করা হবে। খবরটি জানালাম ইকবাল ভাইকে।

তিনি আমাদের উপর ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আমি ভয় পাচ্ছি না। তোমাদের এতো ভয় কিসের। হামলা হলে আমার উপর হবে। আমরা সাহস পেলাম।

নির্ধারিত দিন ২৯ মে কুষ্টিয়া পৌছালাম। এর পরের ঘটনা আগেই বর্ণনা করেছি। কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক সমাবেশে ইকবাল ভাই’র উপর এই হামলার ঘটনায় দেশে বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। আওয়ামী লীগের এমপি আব্দুর রাজ্জাক এই হামলার বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেন। এর প্রেক্ষিতে সংসদে বক্তব্য রাখেন হামলাকারি শহীদুল এমপি।

তার সেই দম্ভের পক্ষে টেবিল চাপড়ে সমর্থন করেন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এই দৃশ্য দেখে আমাদের মনে হলো চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আর বোধহয় কুষ্টিয়া ফেরা হবে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে কুষ্টিয়া পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। ২ মাস ৪দিন পর আমরা কুষ্টিয়া ফিরতে পেরেছিলাম। মামলার যা অবস্থা: বিএনপি সরকার বিদায় নেবার পর এক এগারো সরকারের আমলে মামলা করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

দৈনিক খবরের প্রতিনিধি ওই হামলায় আহত সাংবাদিক শামীম বিন সাত্তার বাদী হয়ে কুষ্টিয়া থানায় মামলাটি দায়ের করেন ২৫শে মার্চ ২০০৭। সাবেক সাংসদ শহীদুল ইসলাম, মেহেদী আহমেদ রুমীসহ আসামী করা হয় ১২ জনকে। এসময়ে তৎপর পুলিশ মামলার চার্জশীট দেয় ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর। এসময় হামলার ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ দুই ছাত্রদল কর্মিকে গ্রেফতার করে মামলায় যুক্ত করে দেয়। পরে জামিনে মুক্তি পায় তারা।

এদিকে আসামি পক্ষ চার্জ শুনানীর বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন করে। বাদী অভিযোগ করেছেন এখন শুধু একের পর এক দিন ফেলা হয়। শুরু হয়না সাক্ষ্য গ্রহন বা বিচার কাজ। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে এসে যদি এই মামলার বিচার না হয় তাহলে এর ভবিষ্যৎ কি? আবার যদি বিএনপি সরকার গঠন করে তাহলে কি অবস্থা হবে মামলা বাদীর? সাংবাদিকদের আবার মুখোমুখি হতে হবে একই পরিস্থিতির। তিনি এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন বলেও জানান।

কৃতজ্ঞতা জানাই: অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, সেই সময়ের বিএনপি দলীয় কুষ্টিয়ার আরেক এমপি। তিনি অ্যামেরিকান দূতাবাসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মাধ্যমকে প্রকৃত সত্য তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। মাইনুল হক খান, উদ্যোগ নিয়ে বিসিডিজেসি থেকে অর্থ বরাদ্দ করে আমাদের ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম ও সাংবাদিক কাজী আব্দুল হান্নান মামলা থেকে আমাদের জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, মতিউর রহমান, সাংবাদিক কামরুল হাসান, হারুন অর রশিদ, সাইফুল ইসলাম তালুকদারসহ অন্যদের, যারা সংবাদপত্রে লেখনির ঝড় তোলেন।

সংবাদিক আদিত্য শাহীন ও রাহুল রাহা, যারা এ ঘটনা নিয়ে চ্যানেল আই ও এটিএন বাংলায় সংবাদ তুলে ধরেন। জাতীয় প্রেসক্লাব, শহীদুলের ছবি টানিয়ে তাকে নিষিদ্ধ করে। ইউরোপীয় তিন দেশ, বিমানবন্দরে শহীদুলকে কালো তালিকাভক্ত করে। অ্যামেরিকান এ্যামবেসি, আমেরিকান জার্নালিষ্ট, অ্যামনেস্টি ইন্টান্যাশানালসহ কয়েক’শ আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা চাপ সৃষ্টি করেছিলেন আমাদের পক্ষে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.