আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে কাজ করছে ৪০ হাজার ভারতীয়, ভারতে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয় না বাংলাদেশীদের

জিয়াউল হক মিজান(নয়া দিগন্ত) সারা দেশে দাবড়ে বেড়াচ্ছেন ৪০ হাজার ভারতীয় নাগরিক। বছরের পর বছর এ দেশে অবস্খান করে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করছেন তারা। কামিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। কাজ করার অনুমতি নেয়া তো দূরের কথা, ভিসা নবায়নের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন না তারা। অথচ বাংলাদেশের কোনো নাগরিক ভারতে কাজ করার অনুমতিই পান না।

সে দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান, এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিতেও কাজের অনুমতি মিলছে না বাংলাদেশীদের। ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও। তার ফলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে কতজন ভারতীয় নাগরিক কর্মরত আছেন তার হিসাব সরকারের কোনো সংস্খার কাছেই নেই। তবে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বিভিন্ন পক্ষের দেয়া তথ্যানুযায়ী এ সংখ্যা ৪০ হাজারেরও বেশি।

তাদের অর্ধেকই কর্মরত আছেন তৈরী পোশাক শিল্প খাতে। এ ছাড়া বায়িং হাউজ, বিজ্ঞাপনী সংস্খা, নাট্যনির্মাতা প্রতিষ্ঠান, সমাজসেবী সংস্খা, টেলিভিশন চ্যানেল এমনকি সাংবাদিক হিসেবে পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ পদেও কর্মরত আছেন ভারতীয় নাগরিকেরা। এসব প্রতিষ্ঠানে তারা কেবল বড় অঙ্কের বেতনই পান না, সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন অত্যন্ত দাপটের সাথে। দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের সর্বপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি অব: মেজর জেনারেল আমজাদ খান চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার রাজিত মিত্তারের সাথে দেখা করে ব্যবসায়বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নানা খোঁড়া অজুহাত সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন। অপরাপর অভিযোগের পাশাপাশি ভারতে বাংলাদেশীদের কাজের অনুমতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিপুলসংখ্যক ভারতীয় নাগরিক কারিগরি ও ব্যবস্খাপনা পেশায় বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছেন।

এ ক্ষেত্রে তারা অতি সহজেই কাজ করার অনুমতি পান। অথচ বাংলাদেশী নাগরিকেরা শত চেষ্টা করেও ভারতে কাজ করার অনুমতি পান না। এমনকি কোনো বাংলাদেশী নাগরিক বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে ভারতে পোস্টিং পেলেও ভারত সরকার তার কাজ করার অনুমতি দেয় না। এ প্রবণতার দ্রুত অবসান দাবি করেন তিনি। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দক্ষিণ এশীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্খার (ডব্লিউটিও) নিয়মানুযায়ী ভারতে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা।

কাগজে-কলমে হাজার হাজার বাংলাদেশী পণ্য শুল্কমুক্তভাবে ভারতে রফতানির বিধানও আছে। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য ২৭টি প্রধান পণ্যকেই তারা ‘সেনসেটিভ’ তালিকায় রেখেছে। তৈরী পোশাক, টেক্সটাইল পণ্য, ফুটওয়্যার, গোশত, খেলাধুলার সামগ্রী, সিরামিকস, টাইলস প্রভৃতি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশী পণ্য কোনো অবস্খাতেই ভারতে প্রবেশের সুযোগ নেই। বহুল আলোচিত ৮০ লাখ পিস পোশাক নিতেও তাদের বিস্তর আপত্তি।

নতুন করে তারা অতিরিক্ত ১৮ শতাংশ প্যারা-ট্যারিফ আরোপ করেছে বাংলাদেশী তৈরী পোশাক ও সিমেন্টের ওপর। বাংলাদেশ তৈরী পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) বিদায়ী সভাপতি ও এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী সম্প্রতি নয়া দিগন্তকে বলেছেন, দেশের তৈরী পোশাক শিল্পে বর্তমানে ২০ হাজারের বেশি ভারতীয় নাগরিক কাজ করছেন। গার্মেন্ট সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কারখানারই জেনারেল ম্যানেজার, প্রোডাকশন ম্যানেজার, অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার, মার্চেন্ডাইজার প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পদে ভারতীয় নাগরিকেরা অধিষ্ঠিত। তিনি বলেন, মিড-লেভেল ম্যানেজমেন্ট পদে কর্মরতদের ৮০ শতাংশই বিদেশী ও ৭০ শতাংশই ভারতীয়। দেশে দক্ষ লোকের অভাব থাকায় ভারতীয়দের নিয়োগ দিতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা কেবল মোটা অঙ্কের বেতনই নেন না, অনেক ক্ষেত্রে পুরো কারখানার নিয়ন্ত্রণই চলে যায় তাদের হাতে।

বছরের পর বছর বাংলাদেশে কর্মরত এসব ভারতীয় নাগরিক কাজ করার অনুমতি নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বিধিবিধান অনুসরণ করে না বলেও স্বীকার করেন তিনি। অনুসìধানে জানা গেছে, গত এক বছরে অর্ধশতাধিক কারখানার মালিকানা বদল হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এসকিউ, ক্রিস্টাল, মাস্টার্ড, হলিউড, শান্তা, রোজ, ফরচুনা, ট্রাস্ট, এজাক্স, শাহরিয়ার, স্টারলি, ইউনিয়ন প্রমুখ দেশসেরা গার্মেন্ট কারখানা। বিক্রির কথাবার্তা চলছে আরো শতাধিক কারখানার। কারখানা বিক্রেতাদের তালিকায় রয়েছে বিজিএমইএর অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও নামকরা ব্যবসায়ীর নামও।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ, আমেরিকান, কানাডিয়ান নাগরিকেরা কিনে নিচ্ছেন এসব কারখানা। বিক্রি হয়ে যাওয়া প্রতিটি কারখানাই এক বা একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভাঙচুরের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হাত ছিল বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। অভিযুক্তদের প্রায় সবাই ভারতীয় নাগরিক বলে জানান সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কেবল কাজের অনুমতির ক্ষেত্রে নয়, ভারতে পণ্য রফতানিতেও নানাভাবে বাধা দিয়ে চলেছে ভারত।

এ ক্ষেত্রে সে দেশের সরকার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পণ্যের মান সার্টিফিকেট। বিএসটিআইর (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট) সার্টিফিকেট নিয়ে আমাদের ব্যবসায়ীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পণ্য সরবরাহ করলেও ভারত সরকার এ সার্টিফিকেট গ্রহণ করে না। পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে তাদের দেশ থেকে আবার সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা চুক্তি হলেও রাজ্য সরকারগুলো তা মানতে নারাজ। নতুন করে ভারত থেকে সার্টিফিকেট নিতে কেবল মোটা অঙ্কের টাকাই খরচ হয় না, হয়রানির শিকার হতে হতে রফতানিকারক হাল ছেড়ে দেন এখানে এসেই।

কারণ রফতানির জন্য যেকোনো পণ্য ভারত সীমান্তে নেয়ার পর সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে মানসনদ গ্রহণ করতে সময় লেগে যায় তিন থেকে পাঁচ মাস। সব কিছু শেষ করে রফতানিকারক যখন মানসনদ সংগ্রহ করেন, তখন অজুহাত হিসেবে বলা হয়, দীর্ঘ দিন গুদামজাত থাকতে থাকতে সংশ্লিষ্ট পণ্যটি মান হারিয়ে ফেলেছে। রফতানিকারকের তখন পথে বসা ছাড়া আর উপায় থাকে না। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পরিমাণ যা হোক না কেন, প্রতিটি কনসাইনমেন্টের জন্য ভারত সরকারকে সিএফএল ল্যাব ফি দিতে হয় তিন হাজার রুপি। স্যাম্পল ড্রয়িংয়ের জন্য দিতে হয় আরো দুই হাজার রুপি।

৫০০ করে এক হাজার রুটি দিতে হয় স্যাম্পল ডিপোজিট ও স্যাম্পল কালেকশন বাবদ। অন্যান্য খরচ আছে আরো অন্তত ছয় হাজার রুপি। এভাবে অন্যান্য শুল্কের পাশাপাশি প্রতিটি কনসাইনমেন্টের জন্য ১২ হাজার রুপি করে দেয়ার ফলে রফতানিকারকের খরচ পড়ে যায় পণ্যের মূল দামের কয়েক গুণ বেশি। অন্য দিকে বাংলাদেশ সরকারের দেশের স্বার্থবিরোধী মনোভাবের সুযোগে ভারতীয় পণ্যে ভরে আছে আমাদের বাজার। পরিস্খিতির ভয়াবহতার কথা বলতে গিয়ে ভারতের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের সফল রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপের উপব্যবস্খাপনা পরিচালক আহসান খান চৌধুরী বলেন, ওরা কেবল একের পর এক অজুহাত তৈরি করে চলেছে।

যেকোনোভাবে বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করাই ভারত সরকার এবং তার কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য। বেসিক ডিউটি, সিভিসি, সিইএসএস, এসিডি প্রভৃতি নামে শুল্ক আরোপের পাশাপাশি টেস্টিং সার্টিফিকেট, প্যাকিং-বোটলিং-সিলিং, ওয়্যারহাউজ, ফুড ল্যাবরেটরি, ভিসা জটিলতাসহ নানামুখী জটিলতার সৃষ্টি করে ভারত বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশে অনৈতিক বাধার সৃষ্টি করে চলেছে। এসব জটিলতার কথা উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ মামুন রশিদ বলেন, এত বাধা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় কৌশল অবলম্বন করে আমাদের ভারতের বিশাল বাজারে প্রবেশ করতে হবে। এ জন্য তৈরী পোশাক, সিরামিকস, ওষুধসহ অন্তত পাঁচটি পণ্যকে টার্গেট করে বাংলাদেশের অগ্রসর হওয়া দরকার বলে অভিমত দেন তিনি। এ জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাজনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপযুক্ত দরকষাকষির মাধ্যমে ভারতে ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল বাজারের সামান্য অংশ দখল করতে পারলেও বাংলাদেশ উপকৃত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় অর্থমন্ত্রীর আজকের বাংলাদেশ সফর একটি মোক্ষম সুযোগ হতে পারে বলেও মনে করেন মামুন রশিদ। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.