আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুখের মতো কান্না-৩

মিসেস জলি। বয়স একুশ। অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে। নজর কাড়া চেহারা। চাল-চলন পরিশীলিত।

কথাবার্তায় স্মার্ট। অতি আধুনিক অথচ উগ্রতা নেই। চমৎকার গোছানো একটি মেয়ে। বাবা-মা’র ইচ্ছায় তিন বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।

গত মাসে প্রমোশন পেয়ে পূর্ণ সচিব হয়েছেন। পাশাপাশি বাবার বিজনেসও দেখাশুনা করছেন। মিসেস জলির স্বামী খন্দকার আমিনুর রেজা সাহেবের বাবা মৃত্যুর সময় এত সম্পদ রেখে গেছেন, যেগুলো সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হয়। কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তারপরও আমিন সাহেব প্রজাতন্ত্রের চাকরি করেন।

জীবিকার জন্য নয়, দেশের জন্য। তিনি নিজেকে সৎ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। জীবনে অসৎ পথে পা বাড়ান নি। সরকারের উচ্চ পদস্থ আমলার চাকরিটা তিনি করছেন, কারণ, অন্তত: একটি চেয়ারকে অসৎ কারো কবলে চলে যাওয়া থেকে তো রক্ষা করা যাবে। আমিন সাহেবের বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশুনা করার জন্য আলাদা লোক আছে।

উনার দূর সম্পর্কের আত্মীয় জগলু আহমদই সবকিছু হেন্ডেল করে। ব্যবসা নিয়ে তাকে মাথা ঘামাতে হয় না। মাসে একবার বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত থাকলেই চলে। আমিন সাহেব বাবার টাকায় একটা বাড়ি করেছেন। দেখার মত বাড়ি।

তাজমহল না হলেও এমন বাড়ি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি তৈরি হয় নি। সুইজারল্যান্ড থেকে আর্কিটেক্ট এনে বাড়িটির ডিজাইন করা হয়েছে। বাড়ির দেয়ালগুলো ধবধবে সাদা দশ ফুট পুরো বুলেট প্রুফ গ্লাস দিয়ে তৈরি। থাইল্যান্ড এবং চায়না যৌথভাবে গ্লাসের সাপ্লাই দিয়েছে। বাড়িটির ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যে, আট তলা বিল্ডিংকে একতলাতেই সাজিয়ে ফেলা হয়েছে।

প্রথমে মূল বাড়ি। তাকে ঘিরে চতুর্দিকে আরেকটি। তারপর আরেকটি। এভাবে একে একে আটটি স্তরে সাজানো হয়েছে বাড়িটি। কাজটি এত নিখুঁতভাবে করা হয়েছে, দূরে থেকে তাকালে আটতলাই মনে হয়।

যে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। বাড়ির কেন্দ্রীয় বেডরুমটি রাখা হয়েছে একদম মধ্যবিন্দুতে এবং সবচে' উঁচুতে। রুমটির চতুর্দিকে বিশেষভাবে তৈরি ওয়ান সাইটেড লুকিং গ্লাস। এর বৈশিষ্ট হল ভেতর থেকে বাইরের সবকিছু দেখা যায় কিন্তু বাইরে থেকে ভেতরে দেখা যায় না। আবার উত্তর দিকের দেয়ালে ৫৬ ইঞ্চির বিশাল একটা মনিটর বসানো।

সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পুরো বাড়ির আশপাশের এক বর্গ কিলোমিটার এলাকা পর্যবেক্ষণ করা যায়। পুরো বাড়িতে মানুষ থাকেন সতের জন। মিসেস জলি, আমিন সাহেব ছাড়াও তাদের ফ্লাটে কাজের লোক আছে তেরো জন। বাড়িটির একদম বাইরের ফ্লাটে অর্থাৎ প্রথম তলায় আমিন সাহেবের দূরসম্পর্কের এক ভাই থাকেন স্ব-স্ত্রীক। মূল বেডরুমের সদর দরজাটি কম্পিউটারাইজ সিস্টেমে তৈরি।

অনেকটা টাচ্ স্কিন মোবাইল ফোনের মত। কম্পিউটারে সিস্টেম লোড করে সেখানে মিষ্টার এবং মিসেস আমিনের হাতের চাপ এডজাষ্ট করে রাখা হয়েছে। তাঁরা দু’জনের যে কেউই কেবল দরজায় বিশেষভাবে হাত রাখলে দরজা খুলবে। অন্য কেউ হাজার চেষ্টা করলেও দরজা খুলতে পারবে না। মূল বেড রুমটির বিশদ বর্ণনা দেয়ার পেছনে কারণ হল, এই ঘরটির কথা পাঠককে বিশেষভাবে মনে রাখা।

কারণ এই রুমকে ঘিরেই এক সময় চরম নাটকীয়তা তৈরি হতে পারে। এই বেড রুমটির আরো কিছু বিশেষত্ব আছে। সেটা যথা সময়েই বলা যাবে। তো, সাধারণত বড়লোক স্বামীদের স্ত্রী’র বেলায় যা হয়ে থাকে, মিসেস জলির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। তিনি সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকেন স্যোসাল ওয়ার্ক নিয়ে।

আরেকটু স্পেসিফিক করে বললে উইম্যান সোস্যাল নিয়ে। মিসেস জলি একটি নারীবাদী সংগঠনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। উনার সংগঠনের নাম- Organaigation of Real Rights for women. যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা-নারীর প্রকৃত অধিকার বিষয়ক সংস্থা। এই সংগঠনের ব্যানারে তৃণমূল পর্যায়ে চষে বেড়াচ্ছেন তিনি। নারীদের সচেতন করার চেষ্টা করছেন।

আজ সেই সংগঠনের ব্যানারে আয়োজন করা হয়েছে। ‘‘অধিকার ও দায়িত্বঃ প্রসঙ্গ নারী’’ শীর্ষক একটি সেমিনারের। মিসেস জলির সেখানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেয়ার কথা। বরাবরের মতই সময়ের আগে গিয়ে উপস্থিত হলেন মিসেস জলি। প্রায় আট’শ মহিলা এসে জড়ো হয়েছেন।

প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হবার কথা মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাননীয় মন্ত্রী সালমা ইসলামের। মন্ত্রী মহোদয় এখনো এসে পৌঁছান নি। তাঁর পিএ’র সাথে যোগাযোগ হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌছে যাবেন। তিনি আসলেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।

আপাতত তাঁর জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রী মহোদয় এসে উপস্থিত হলেন। সভার কাজও শুরু হল আনুষ্ঠানিকভাবে। সাত/ আট জন নারী নেত্রী বক্তব্য রাখলেন। উপস্থিত শ্রুতাদেরও অনেকে তাদের অভিমত ও পরামর্শ ব্যক্ত করলেন।

এরপর মাইকে নাম ঘোষণা করা হল মিসেস জলির। তিনি এগিয়ে গেলেন ডায়াসের দিকে। চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বক্তব্য শুরু করলেন- ‘‘সম্মানিত মন্ত্রী মহোদয়কে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আজকের সভাপতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আমি আমার কথা শুরু করছি। প্রিয় বোনেরা, আমার সংগ্রামী শুভেচ্ছা নেবেন। আপনারা কষ্ট করে এসে হাজির হয়েছেন বলে আমি পনাদেরকে কোনো ধন্যবাদ দেবো না কারণ, প্রথমতঃ আপনারা এসেছেন আপনাদের নিজেদের স্বার্থ ও অধিকার সম্বন্ধে জানতে।

দ্বিতীয়তঃ এটা ধন্যবাদ দেয়া ও নেয়ার সময় নয়। কাজ করার সময়। আমাদেরকে সবাই ধন্যবাদ দেয়। কৃতজ্ঞতা জানায়। আমরা তাতে আত্মতৃপ্তি লাভ করে বসে থাকি।

আমাদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। ’’ উপস্থিত শত শত মহিলার তুমুল করতালিতে গোটা হল মুখরিত হয়ে উঠলো। মিসেস জলি বরাবরই বেশ গুছিয়ে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সময় ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন তিনি। মিসেস জলি বলতে শুরু করলেন- ‘‘প্রিয় বোনেরা, আমি আমাদের আজকের প্রধান অতিথি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁকে কোনো রকম খাঁটো করার উদ্দেশ্য না রেখেই একটি কথা বলতে চাই।

কথাটি আমি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের উপস্থিতিতে বলতে চাই এজন্য যে, যাতে করে আমার আওয়াজটি সরকারের মূল কেন্দ্রে গিয়ে পৌছে যায়। প্রিয় বোনেরা, আমরা নারীদেরকে এই সমাজে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং ম্যাচিউরড হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। জ্ঞানে-গুণে, অভিজ্ঞতায়, দক্ষতায় আমরা এতই কাঁচা যে, সেটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়। আমাদেরকে শিশুদের'চে খুব একটা বেশি বুদ্ধিমান বলে ভাবা হয় না। আর এ জন্যই আমাদের দেশের সরকারগুলো মহিলাদেরকে অবুঝ বাচ্চাদের সাথে মিলিয়ে একত্রে একটি মন্ত্রণালয় করে রেখেছে।

‘মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ’ ‘ও’ অব্যয়টি মধ্যখানে তখনই ব্যবহৃত হয় যখন তার উভয় দিক সমান বা সামঞ্জ্যপূর্ণ হয়। কোনো না কোনোভাবে মিল থাকে। যেমন, বলা হল আম ও কাঁঠাল। দু’টি দুই স্বাদের ফল হলেও ‘ফল’ হিসেবে তাদের মধ্যে অভিন্নতা রয়েছে।

বলা হল ঢাকা ও চট্টগ্রাম। তো দু’টা আলাদা আলাদা জায়গা হলেও উভয়টি জেলা হিসেবে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে মিল থাকতে হবে। আপনি বললেন, মিছিল ও মিটিং। এটা ঠিক আছে।

দু'টোর মধ্যে সম্পর্ক আছে। কিন্তু যদি বলেন- সেমিনার ও তালগাছ, তাহলে বাক্যটি সঠিক হলো না। কারণ, সেমিনার ও তালগাছের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই। এবারে মুল পয়েন্ট আসা যাক। বলা হয়েছে ‘মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

’ এর অর্থ, মহিলা ও শিশুর মধ্যে গুণগত সম্পর্ক রয়েছে। এখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হোক বা খুঁজে বের করা হোক কী সেটা? কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ সামনে আসতে পারে। ১। উভয়ই দুর্বল। ২।

উভয়ই বুদ্ধিহীন প্রাণী। ৩। উভয়ই পরনির্ভরশীল। ৪। উভয়ই অকেজো।

৫। উভয়ই বিবেক শূন্য। আমি জিজ্ঞেস করি কোনটি? মহিলা ও শিশুদের মধ্যে মিল কোনটি? কোন প্রকারের মিল থাকার কারণে একত্র করা হলো? আর যদি বলা হয় কোনো মিল থাকার দরকার হয় না। এমনি এমনিই দু'টোকে একত্র করে এক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে। আর এটা যদি দোষের কিছু না হয়, তাহলে আজকের এই সভা থেকে আমি প্রস্তাব করছি পুরুষদের জন্যও আলাদা একটি মন্ত্রণালয় করা হোক।

নারী মন্ত্রণালয় থাকতে পারলে অর্ধেক জনগোষ্ঠি পুরুষের জন্য কোনো মন্ত্রণালয় থাকবে না কেন? আমি সকল পুরুষ সমাজের পক্ষে এই প্রস্তাব করছি। ’’ উপস্থিত সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ী করতে লাগলেন। মিসেস জলি কী বলতে চান? ব্যাপারটি অনুমান করে নিতে কষ্ট হল না মিসেস জলির। তিনি বললেন- ‘‘প্রিয় বোনেরা, আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। দেশে পাগলের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।

ছোট-বড়-মাঝারী মিলিয়ে অন্তত কয়েক লক্ষ তো হবেই। এরা তো আমাদেরই ভাই বোন। এদের প্রতি সরকারের একটা দায়িত্ব আছে। সুতরাং এদের জন্যও একটা মন্ত্রণালয় থাকা দরকার। সেটা হবে ‘পাগল মন্ত্রণালয়।

’ এবারে যেহেতু আলাদা আলাদা বিভাগ করলে খরছ ও পরিধি বেড়ে যাবে, তাই আজকের সভা থেকে মাননীয় মন্ত্রীর মাধ্যমে আমি সরকারের কাছে প্রস্তাব করছি, এই নতুন দু’টি মন্ত্রণালয় জরুরী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা হোক এবং তাদেরকে একই বিভাগের অধিনে নিয়ে আসা হোক। বিভাগটির নাম হবে ‘পুরুষ ও পাগল বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ’’ উপস্থিত নারীরা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘ঠিক। ঠিক। ’ মন্ত্রী মহোদয় তাঁর আসনে বসে মুচকি হাসতে লাগলেন।

মিসেস জলি দশ সেকেন্ড বিশ্রাম নিয়ে আবারো বলতে শুরু করলেন- চলবে  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।