আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কথাটা বলার দরকার

Quazi Hassan’ World of Writings

কথাটা বলার দরকার জয়াকে। পরাগ বেশ কিছু দিন ধরে চেষ্টা করছে। পারছে না বলতে। অপেক্ষায় আছে ঠিক সময় আর ঠিক পরিবেশের। জয়াকে বেশ কয়েকবার একা পেয়েছে।

কিন্তু পরিবেশটাকে মনে হয় নি কথাটা বলার জন্যে উপযুক্ত। কিন্তু, সময় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কথাটা বলতেই হবে, না বললেই না। ছাত্র জীবনে পরাগ বিয়ে করেছিল জয়াকে। প্রথমে বিয়ের কথাটা শুধু জানতো ঘনিষ্ট কিছু বন্ধুরা।

তাদের দু জন ছিল বিয়েতে স্বাক্ষী। তারা জানিয়ে ছিল, আরো কয়েক জনকে। পরে এক মুখ থেকে আরেক মুখ। এভাবে ছড়িয়ে পড়ল পরিচিত সবার মধ্যে। ২ পরাগ জানতো তাদের বিয়েটা হবে খুব সাধারণ।

আসলে হয়ে ছিলও তাই। দুই বন্ধু রাজী হয়েছিল স্বাক্ষী দিতে। কিন্তু, তাদের মাথায় ছিল না স্বাক্ষী ছাড়াও, এক জন উকিল বাবার দরকার হয়। তাকে আবার বয়স্ক হতে হবে। বিয়ে পড়ানোর আগে কাজী যখন উকিল কে হবে তা জানতে চাইল, তখন মাথায় বাজ পরার অবস্থা।

হঠাৎই মনে আসলো হাসেম স্যার এর কথা । কেন যেন হাসেম স্যার ওকে একটু বেশীই প্রশ্রয় দেন অন্য সব ছাএ ছাএীদের থেকে । আর তাই স্যার এর সাথে ওর সম্পকটা বন্ধু সুলভ । পরাগ কাজীর অফিস থেকেই ফোন করল হাশেম সারকে। একবার বলাতেই তিনি রাজী হয়ে গেলেন।

বললেন, তিনি পনেরো মিনিটের মধ্যে চলে আসবেন। জয়াকে প্রথম দেখাতে ভালো লেগেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ক্লাসের তারা। প্রথম দিন তারা পাশাপাশি বসলো ঘটনাক্রমে। মেয়েরা সব বসেছিল সামনের দুই বেঞ্চে।

জয়া যখন ক্লাসে ঢুকল, তখন ক্লাস আরম্ভ হয়ে গেছে। একমাত্র পরাগের পাশের জায়গাটা খালি ছিল। অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও জয়াকে ওখানে বসতে হল। জয়ার বেশ আনকমফরটেবল লাগতে লাগল। পাশে একজন অপরিচিত ছেলে বসে আছে।

হয়তো তার দিকে তাকিয়ে আছে ড্যাব ড্যাব করে। নাকি তার হাতের আঙ্গুলগুলির দিকে । আজকে সকালেই লাল নেল পালিস দিয়ে এসেছে। মনে হল, আজকে পারফিউমটা একটু বেশি দেয়া হয়ে গেছে। ছেলেটা যদি গন্ধ পায়, তা হলে কেমন একটা লজ্জার ব্যাপার হবে।

জয়া এমন একটা ভান করল, সে সব মনোযোগ দিয়ে ক্লাসের লেকচার শুনছে। পরাগের মনে তখন ঝড়। একটা মেয়ে এত সুন্দর হয় কি করে। হাতের আঙ্গুল, চোখ, নাক, পোশাক---সবকিছু। সবকিছুই।

ইশ ওই কোমল,নরম হাতটা যদি একবার ধরা যেত, কিংবা কমপক্ষে একবার ছুঁয়ে দেখা যেত! কিসের ক্লাসের লেকচার। পরাগের গলাটা শুকিয়ে আসলো। মনে হল, যদি না সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ক্লাস যখন শেষ হল, জয়া পরাগের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল। পরাগও একটু হাসার চেষ্টা করল।

হাসি বের হল বলে তো মনে হয় না। মুখটা হয়তো কোন একটা বিকৃত আকার ধারন করল। পরের দিন, পরাগ ঠিক আগের জায়গায় যেয়ে বসল। ছোট একটা আশা ছিল, যদি আজকে জয়া এসে আবার তার পাশে বসে। কিন্তু, খেয়াল করলো আজকে জয়া আগেই এসে, অন্য মেয়েদের সাথে একেবারে প্রথম দিকে বসেছে।

মনটা ভীষন হতাশ হয়ে গেল। ভাগ্যটাই খারাপ। উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু কেন যেন চোখটা নিজের থেকেই জয়ার দিকে বারে বারে ফিরে যেতে থাকল। ক্লাস আরম্ভ হবার মিনিট পাঁচেক আগে, জয়া মাথা ঘুরিয়ে কাওকে যেন খুঁজতে লাগল।

পরাগের সাথে চোখা-চুখি হওয়া মাত্রই, বই খাতা গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার পরে এগিয়ে আসতে থাকল পরাগের দিকে। পরাগ নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারলো না। জয়া এসে তার পাশে, একেবারে কাছে এসে বসল। তার পরে কালকের সেই মিষ্টি হাসি।

পরাগের আনন্দে চিৎকার করে মরে যেতে ইচ্ছে করলো। পরাগ থেকে কি এখন ফুল ফুটবে, জয়াকে কি সব সময়ের জন্যে জয় করা যাবে? ৩ হাশেম স্যার আসলেই বিয়েটা হবে। গতকালই পরাগ জয়াকে বলেছে, সে জয়াকে বিয়ে করবে। আর তা একেবারে পরের দিন। বন্ধু বাবু একটা গাড়ি যোগাড় করে নিয়ে আসলো।

তার ভাইয়ের গাড়ি। সাথে নিয়ে আসলো লাবলুকে। ওরা দু জনই আজকে বিয়েতে স্বাক্ষী হবে। জয়া যখন পরাগকে তার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, তখন বাবা পরাগকে একজন ক্লাস মেটের বেশী কিছু ভাবেন নি। কিন্তু, পরে যখন তিনি আবিষ্কার করলেন, জয়া তাকে বিয়ে করতে চায়, তখন তিনি একেবারে বেঁকে বসলেন।

হৃদ্যতার সম্পর্ক হয়ে গেল একেবারে কঠিন ধরনের। জয়াকে জানাতে তিনি দ্বিধা করলেন, তার এই সম্পর্কে কোন সম্মতি নেই। যে ছেলে এখনো আয় করা আরম্ভ করে নি, সে বিয়ে করলে নিজে খাবে কি আর বউকে খাওয়াবে কি? বিষয়টা পরাগের ভাল ভাবেই জানা। অনেক কষ্ট করে সে একটা চাকরি পেয়েছে। পড়ালেখা, চাকরি আর অনান্য সব কাজ চালাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল।

তার মধ্যে জয়ার বাবার কাছে প্রস্তাব আসলো আমেরিকা প্রবাসী এক পাত্রের। ছেলের চেহারা না দেখেই তিনি বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। জয়াকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন তার সিদ্ধান্ত। পরাগ কথা বলতে আসলো জয়ার বাবার সাথে। তিনি এক কথার মানুষ।

পরাগ বেশ কয়েক বার বলল, তাকে এক বছর, শুধু একটা বছর সময় দিতে। এর মধ্যে পড়ালেখা শেষ হয়ে যাবে, চাকরিটাও পার্মানেন্ট হবে। কোন কথাই উনার মন নরম করাতে পারলো না। ভীষণ একটা মন্তব্য করলেন পরাগকে। “আমার জানা আছে, তুমি কি করতে পারো।

“ পরাগের গায়ের রক্ত টগবগ করে উঠলো। প্রকাশ করলো না ভিতরের অবস্থা। সে তার ভবিষ্যৎ শ্বশুর সাহেবকে বলল না, সে কালকেই তার মেয়েকে বিয়ে করবে। কথাটা আসলে কি বলার দরকার ছিল তাকে ? ৪ হাশেম স্যার চলে এসেছেন। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।

এর মধ্যে কাজী সাহেবের আরেক জন ক্লায়েন্ট চলে এসেছে । তাদের বিয়ে পড়ানো নিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পরাগের মনে খেলছে তার নিজের বাবা-মার আর বাড়ির অন্য সবার কথা। বাবা-মা হয়তো কল্পনায় ভাবেন নি, তাদের একমাত্র ছেলে তাদের না জানিয়ে একা একা বিয়ে করছে। বাবার কিছু দিন আগে হার্ট এট্যাক হয়েছিল।

মার সারাজীবনের সমস্যা, হাই ব্লাড প্রেসার। বিয়ের খবর তারা যখন পাবেন, তারা সেটা কিভাবে পারবেন? তাদের কি হাসপাতালে ভর্তি হবে? এর বেশী নিশ্চয়ই কিছু হবে না। ছোট বেলা থেকে মায়ের স্বপ্ন, অনেক লোক ডেকে লাল শাড়ি পরা রাঙা বউ আনবেন। সেই কবে থেকে তিনি শাড়ি, অলংকার জমাচ্ছেন। ছেলের বউকে দেবেন।

বাবা মায়ের কাছে বলতেন, ছেলের বউ আসলে তার মেয়ের অভাবটা ঘুচাবে। তাদের এক মেয়ে ছিল চন্দনা। পরাগের থেকে দু বছরের ছোট। পাচ বছর বয়সে মারা যায়। বিকালে খেলে আসলো।

তার পরে হঠাৎ জ্বর। একেবারে আকাশ-পাতাল। ভোর রাতে যখন চন্দনাকে হাসপাতালে নেয়া হল, সে তখন আর এই পৃথিবীতে নেই। হয়তো চাঁদের দেশে চলে গেছে চড়কা বুড়ির কাছে। পরাগ ভাবল, ছোট বোনটা যদি আজ পাশে থাকত।

তা হলে সাহসের কোন কমতি হত না। বাবা, মাকে ওই সামাল দিয়ে দিত। কমপক্ষে, তার নিজের একজন থাকত বিয়েতে। একটু পরে তার বিয়ে। কাজী সাহেব ডাক পাঠালেন।

পরাগের মাথায় আসলো, আগে বাবা-মাকে বলে রাজী করিয়ে, তার পরে বিয়ে করতে। কিন্তু, জয়ার বাবা সে সময় হয়তো দিবেন না। পরাগ জয়াকে বলতে পারলো না, চল না, আর কিছু দিন অপেক্ষা করি। বলা হল না তার বাবা-মার কথা। তার আশংকার কথা, এই বিয়েতে তাদের যদি কোন অমঙ্গল হয়।

৫ পরাগ-জয়ার বিয়ের সময় দু জনেরই বয়স ছিল চব্বিশ। দেখতে দেখতে প্রায় পঁচিশ বছর পার হয়ে গেল তাদের দাম্পত্য জীবনের। তাদের দু ছেলে মেয়ে, অনন্যা আর রতন। প্রথমে অনন্যা। এক বছর পরে রতন।

অনন্যা বিবিএ শেষ করে একটা ব্যাংকে কাজ করেছে। রতন রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়ছে। বছর তিনেক বাকী পুরো ডাক্তার হতে। বিনা নোটিসে রতন বাসায় এসে হাজির। বাবাকে কানে কানে বলল, বাবা-মায়ের বিয়ের পঁচিশ বছর ঘটা করে তারা পালন করবে।

প্লানটা অবশ্য অনন্যা আপুর। প্রায় এক শ মানুষ দাওয়াত দেয়া হয়েছে পাণ্ডা গার্ডেন চাইনিস রেষ্টুরেন্টে। মা কিছুই জানে না। তাকে বড় ধরনের একটা সারপ্রাইজ দেয়ার কাজ চলছে। লাল শাড়ি কেনা হয়েছে।

মাকে নিয়ে বিউটি পার্লারে নিয়ে সাজিয়ে আনা হবে। বাবার জন্যে নতুন স্যুট কেনা হয়েছে। মা ছেলে-মেয়ের কাছে অনেক বার অভিযোগ করেছে, তার বিয়েটা খুবই সাধারন ছিল। ছেলে, মেয়ে চেষ্টা করছে বাবা-মার জীবনে বর্নাঢ্য কিছু একটা যোগ করতে। জয়া লাল শাড়ি পরবে, তার পাশে দাঁড়াবে।

ভাবতেই রোমাঞ্চিত মনে হল নিজেকে। পরাগের মনটা চট করে চলে গেল সেই দিন গুলিতে। জয়াকে প্রথম দেখা, প্রথম হাত ধরা, প্রথম ঠোঁটে চুমু খাওয়া আরো কত কি। প্রথম চুমুর দেয়ার কথা তার সব সময় মনে পরে। অনেকটা অনিচ্ছা থাকাতেও, জয়া চুমুতে রাজী হল।

হয়তো, পরাগকে না বলতে ইচ্ছে করে নি। কেও দেখে ফেলবে এই ভয়ে জয়া ছিল আড়ষ্ট আর পরাগ ছিল প্রথম চুম্বনের উত্তেজনায় মত্ত। প্রথম চুমু শেষ হতেই দেখা গেল, জয়ার ঠোট রক্তাক্ত । পরাগ এর পরে আর জয়াকে চুমু দিতে চায় নি। ঠিক করে ছিল, একেবারে বিয়ের রাতে বাসর ঘরে ঠোঁট দুটো চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেবে।

যদি আবার রক্ত বের হয়, তো বের হবে। লাল শাড়ি দিয়ে সেটা মোছা হবে। না বিয়েতে জয়াড় লাল শাড়ি পরা হয় নি আর ঠোটটাও রক্তাক্ত হয় নি। কথা গুলো জয়ার সাথে শেয়ার করতে যেয়েও করা হয় নি। যদি বলে বসে, তোমার সব অসভ্য, জংলি চিন্তা ভাবনা।

৬ প্রায় বছর খানেক হল পরাগের রাতের ঘুম নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। ঘণ্টা দুয়েক পরে আর সে বিছানায় থাকতে পারে না। কাশির চোটে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার পরে শ্বাস নিতে কষ্ট। প্রথম দিকে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যেত।

কিন্তু দিন যত যায়, কষ্টটা ততো বাড়তে লাগল। সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হয়। খুবই সন্তর্পণে পরাগ তার কষ্টের সাথে যুদ্ধ করছে। জয়াকে সে কোন ভাবেই বুঝতে দিতে চায় না। যদি সে উদ্বিগ্ন হয়ে পরে, কষ্ট পায়।

ঘুমের ওষুধ খেয়ে জয়া রাতে ঘুমাত বলে, তার ঘুমটা খুবই গাঢ় ছিল। সে জানতই না পরাগ বিছানা থেকে উঠে, বসার ঘরে যেয়ে রাত কাটাত। অফিসের সহকর্মী আনিস সাহেব পরাগের সমস্যার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন। তিনিই প্রথম আবিস্কার করলেন, পরাগের ওজন কমে যাচ্ছে, চোখের নীচে কালিও পরছে। একটু চেপে ধরতেই পরাগ তার সমস্যার কথা জানাল আনিস সাহেবকে।

তিনি আর দেরী করলেন না, ওই দিনই নিয়ে গেলেন খুব বড় একজন ডাক্তারের কাছে। জয়া জানলো না, কেও তাকে বলল না, পরাগ এক জন ডাক্তারের কাছে গেছে। তার শ্বাস কষ্ট, বুকে ব্যাথা। । ৭ পরাগ-জয়ার প্রেম আরম্ভ হবার প্রায় মাস ছয়েক পরে, জয়ার সাথে পরিচয় হল মান্নান নামের এক জ্যোতিষীর সাথে।

অনেকটা নাটকীয় করে বলল, আপনি যেখানে প্রেম করছেন, সেটা টিকবে না। টিকাতে হলে আমার অফিসে আপনাকে দেখা করতে হবে। পরের সোমবার দুপর আড়াইটায় অ্যাপয়নমেণ্ট ঠিক করে ফেলল। আমি হিসাব নিকাশ করে বের করবো, আপনাদের সম্পর্ক টিকানোর উপায়। কথাটা শুনেই পরাগ বলল, লোকটার বদ মতলব আছে।

ওর কাছে যাওয়ার কোন দরকার নাই। ব্যাটা জ্যোতিষী, ফ্যোতিষী কিছু না, একটা ধান্ধাবাজ। বাজারে ওর নামে অনেক বদনাম আছে। কিন্তু, জয়ার মনে তখন দ্বিধা, দ্বন্দ। ঠিক করলো সে পরাগের অগোচরে যেয়ে দেখে আসবে মান্নান জ্যোতিষী কী বলে।

প্রেমটা টিকানোর একটা ব্যাবস্থা হলে মন্দ কি। পর্দা টেনে দিয়ে রুমটা কিছুটা অন্ধকার করে, মান্নান জ্যোতিষী বলল, দেখি আপনার ডান হাতটা। জয়া নিঃসঙ্কোচে তার হাতটা দিলো। মান্নান হাত নিয়ে একটু অন্য রকম আচরণ করতে লাগল। হাতটা উলটিয়ে, পালটিয়ে দেখতে লাগল।

বলল, আপনার হাততো দেখি একেবারে তুলার মত নরম। তার এক মিনিটের মাথায় জয়ার হাত উল্টিয়ে চুমু দিলো। জয়া এক ঝটকায় হাত ফেরত নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। জয়া বিষয়টা পরাগ থেকে গোপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু, এক দিন পরেই, পরাগ জানতে চাইলো বদমাশ জ্যোতিষী কি আর বিরক্ত করেছে।

জয়া পুরো ঘটনা যখন বলল, তখন পরাগের চিৎকার করে কিছু বলতে ইচ্ছে হল। পরাগ কিছুই বলল না। নীরব হয়ে থাকল। তার কিছু পরে মাঝ দুপর বেলায় আকাশ চমকিয়ে বৃষ্টি আসলো। কিন্তু একটু আগেও আকাশটা ছিল একেবারে নীল, একেবারে পরিস্কার।

আরেকবার, ক্লাসের ফজলু একটা মোটর সাইকেল কিনল। এক এক করে ক্লাসের সব মেয়েকে সে পেছেনে বসিয়ে ঘুড়িয়ে আনল। পরাগ আগেই, জয়াকে না করে রেখেছিল। সে যাতে অন্য কোন ছেলের সাথে মোটর সাইকেলে না ঊঠে। ফজলু যখন জয়াকে আহ্বান করলো, জয়া হয়তো ক্ষণিকের জন্যে পরাগকে ভুলে গেল।

পরাগ অন্যদের থেকে জানলো আর সব মেয়েদের মত জয়াও ফজলুর পেছেনে ঊঠেছিল। জয়ার শরীর কী ফজলু ফাজিলটার গায়ে লেগেছিল। সে কি পুলকিত হয়েছিল। এক দিন সে যে শরীরটাকে ছোঁবে, ধরবে, তা সে খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছে। সেখানে কি অন্য মানুষের কলঙ্কের ছাপ লাগল।

পরাগ জয়াকে একটা কথাও বলল না। মুখ থেকে কিছু আসলো না। না কি রুচি আসলো না। ৮ জয়ার একজন নারী হতে বেশী সময় লাগে নি। বিয়ের এক বছরের মাথায় অনন্যা, তার পরের বছর রতন।

দুটো ছেলে মেয়েকে সে নিজের হাতে মানুষ করেছে। তা ছাড়া সংসারের অন্যান্য কাজ তো আছেই। পরাগ কাজ, অফিস, ট্যুর নিয়ে ব্যাস্থ থেকেছে। কর্ম জীবনের মোটামুটি সফলতা পেয়েছে। প্রথম দিকে অর্থ-কড়ির সমস্যা থাকলেও, পরে চলে গেছে একরকম।

ছেলে মেয়েরা যত বড় হয়েছে, জয়া তত বাইরের জগতের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে জড়িত করেছে। কয়েকটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংঘঠনের সক্রিয় সদস্য। বাসার কাজ করার পরে, বাকী সময়টুকু এই সব কাজে যায়। এক সময়কার তার যে ভালবাসা শুধু ছিল পরাগের জন্যে, এখন তা অনেক ধারায় ভেঙ্গে বিভক্ত হয়েছে। পরাগের কথা অবচেতন মনে থাকলেও, আগের মত তার সাথে সময় কাটানো হয় না।

কাজের শেষে পরাগ বাড়ী ফিরে আসলেও, জয়ার ব্যস্ততা রাতে ঘুমানো পর্যন্ত। জয়া বুঝে, পরাগ তার থেকে এখনো একা তার সবটুকু সময় দাবী করে। কিন্তু সংসারের কাজের পরের সময়গুলো জয়া যখন অন্যদের দেয়, পরাগ নীরব হয়ে যায়। কোন পুরুষ মানুষ এর মধ্যে থাকলে তার নীরবতা আরো বেশী হয়। অনেক সময়, ছুটির দিনগুলো পর্যন্ত ওদের এক সাথে কোথাও বের হওয়া হয় না।

জয়ার সামাজিক অনুষ্ঠান থাকে। বিয়ের কয়েক বছর পরে, তিন দিনের ট্যুরে পরাগ গিয়েছিল বরিশাল। কিন্তু দু দিনের মাথায় সন্ধ্যার দিকে ট্যুর সংহ্মিপ্ত করে ফিরে আসলো। একমাত্র কারণ ছিল জয়াকে অবাক করে দেয়া। পরাগ বাসায় এসে দেখল, জয়া সেজে গুঁজে বাইরে বের হচ্ছে।

কপালে আবার বড় একটা টিপ। পরাগ কোন কথা না বলে নীরব হয়ে গেল। আরেকবার, লেডিস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে আসলো বিখ্যাত একজন নায়ক। মহিলাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা পড়ে গেল, কে কত অন্তরঙ্গভাবে তার সাথে ছবি তুলতে পারে। জয়া সেই প্রতিযোগিতায় হয়তো খুব ভালো করে ফেলল।

ছবিটা যখন হাতে আসলো, মনে হল একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ছবিটা বাথরুমে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলার জন্যে গেল। ঠিক ওই সময় আসলো ফোন কল। আসলে জয়া কলটার জন্যে অপেক্ষায় ছিল। যার নামে টিকিট বিক্রি করা হয়েছে, সেই গানের শিল্পী পলি মোহসিন বলছে, সম্মানী আরো না বাড়ালে, তার পক্ষে গান গাওয়া সম্ভব না।

কথাটা শোনা মাত্র, জয়ার মাথায় যেন বাজ পড়ল। বেমালুম ভুলে গেল বাথরুমের ছবিটার কথা। বাসায় ফিরে দেখল, ছবিটা বিছানার উপরে পরে আছে। পরাগ ভীষণ ধরনের নীরব হয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। পরাগ কিছু জিজ্ঞাসা করলে, জয়া হয়তো বলতে পারত ঘটনাটা ছিল নিছক দুষ্টামি।

কিন্তু, পরাগ এখন নীরবতায়। জয়া বুঝার চেষ্টা করলো, ছেলেরা কি কখনো বড় হয় না। এই পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সে এসেও টিন এজার মানসিকতা। জয়ার সবকিছু আগলে রাখতে চায়, নিজের একান্ত সম্পদ মনে করে। ৯ অধ্যাপক এম এ রশিদ নিশ্চিত করলেন, রোগটার নাম ফূলমোনারি ফাইবরোসিস (Pulmonary Fibrosis)।

ফুসফুসের রোগ। কোন প্রতিকার নাই। আধুনিক বিজ্ঞান কোন চিকিৎসা এখনো বের করতে পারে নি। অধ্যাপক সাহেব আমেরিকায় অনেক দিন ছিলেন। তিনি কোন রাখঢাক না করে সরাসরি বললেন, আমি আপনাকে ছয় মাসের বেশী বলতে পারছি না।

তবে আল্লাহ অনেক সময় মিরাকল করেন। সে রকম হলে অন্য কথা। আপনি আজকেই আপনার পরিবারকে জানান। ১০ অনন্যা, রতন মাকে প্লান করে খালার বাসায় পাঠিয়েছে। তারাই খালাকে বলেছিল মাকে ফোন করে ডাকতে।

এই দিকে যাতে কিছুটা সময় পাওয়া যায়, ঘরবাড়ী গুছিয়ে সাজানোর জন্যে। বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধব এসেছে সাহায্য করতে। বাবা-মার বেড রুমকে বাসর ঘর সাজানোর কাজ চলছে। বাড়ির সামনে আলপনা আঁকা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এলাহি কান্ড।

হৈ চৈ হচ্ছে অনেক। কোনার এক কামরায় বসে পরাগ পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করছে। কালকে সারা রাত ঘুমাতে পারে নি। শ্বাস কষ্ট সামাল দিতে পারছিল না। হয়তো ডাক্তার সাহেবের কথাটাই ঠিক।

হাতে সময় নাই। চারিদিকে এত শব্দ আরো বেশী অস্থির করে তুলছে। কিন্তু তার পরেও, জীবনের প্রতিটা শন্দ জীবনের জয় গান হয়ে কানে আসছে। কি যে মধুর লাগছে! কিছু দিন পরে, পরাগ যেখানে যাবে; সেখানে কোন শব্দ নাই, আলো নাই। যতটুকু পারি, উপভোগ করে যাই না কেন।

পরাগ ঠিক করলো, আজকে সে জয়াকে কথাটা বলবে। সব অনুষ্ঠানের পরে, বাসর রাতের মুহূর্তগুলো শেষ হয়ে যাবার পরে। তবে তার আগে মনের সেই ইচ্ছেটা পুরন করবে, চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেবে......। ঠোট কিন্তু রক্তাক্ত হতে দেয়া যাবে না। ছেলে-মেয়েরা বড়, তারা দেখলে কি মনে করবে।

যদি কাশি চলে আসে, শ্বাস কষ্ট আরম্ভ হয়ে যায়। বিধাতা নিশ্চয়ই আজকে কিছুটা সময়ের জন্যে নিষ্কৃতি দিবেন। পরাগ-জয়ার কত না স্মৃতি। কিন্তু একই কিছু ঘটনা, তার বারে বারে মনে আসে। সে জয়াকে প্রথম যে দিন দেখেছিল, ঠিক সে রকমই এখনো ভালবাসে।

তার ভালবাসা, ধ্যান-ধারনা একটা বিন্দুকে কেন্দ্র করে। আর সেই কেন্দ্রটা সব সময়ই জয়া। এতটা সময় পার হয়েছে, তার পরেও মনে হয় এইতো মাত্র হল। কষ্টগুলো বুকের মধ্যে একেবারে তরতাজা। সুখের স্মৃতি তার থেকে অনেক অনেক বেশী আছে।

জয়ার সাথে প্রেম, বিয়ে, অনন্যা, রতনের বাবা হওয়া তো সবই তো প্রচন্ড সুখের ব্যাপার। চলে যেতে হবে তো, তাই কষ্টগুলোই বেশী করে কঠিনভাবে নাড়া দেয়। পরাগ একেবারে নিশ্চিত, পৃথিবীতে তার প্রায় পঞ্চাশ বছরের অবস্থান তাকে সীমাহীন অমর ভালাবাসা দিয়েছে। তা নিয়ে নির্বিঘ্নে; জয়া,অনন্যা আর রতনের জন্যে অনন্তকাল অপেক্ষায় থাকতে পারবে পরকালে। ১১ পরাগকে খবরটা অন্য কাওকে দেয়ার প্রয়োজন হয় নি।

বেডরুম গোছানোর সময় রতনের চোখ যায় বাবার মেডিকেল রিপোর্টগুলোর দিকে। তার বুঝতে বেশীক্ষণ সময় লাগে নি। পরে একজন সিনিওর ডাক্তারের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়। অনন্যা, রতন মাকে খবর দেয় পরের দিন সকালে। পরাগ ফুটে ফুল হয়েছিল কিনা তা বলাটা কঠিন।

তবে সে এখন চুড়ান্ত নীরবতার জগতে। আর জয়া, তার এখন পরাগ বিহীন পৃথিবী। যেখানে ফুলের রং আছে, সৌন্দর্য নাই; পাখির গান আছে, সুর নাই; হাসিতে শব্দ আছে, আনন্দ নাই। ০৪/২৪/১১ http://www.lekhalekhi.net

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।