আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সামাজিক অবক্ষয় রোধে শ্রমের মর্যাদা



সামাজিক অবক্ষয় রোধে শ্রমের মর্যাদা ফকির ইলিয়াস ========================================= মুখে আমরা নীতির অনেক আপ্তবাক্য আওড়াই। সভা, সমাবেশ করি। অধিকারের স্বচ্ছতা চাই। কিন্তু বাস্তবতার কথা ভুলে যাই অবলীলায়। সমাজের সীমাবদ্ধতা ভাঙতে চাই যদিও, কিন্তু সাধ্য নেই।

সাধ্য না থাকার অন্যতম কারণ ধনিকশ্রেণীর রক্তচক্ষু। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা, বৈষম্যের স্তরকে বরাবরই পাকাপোক্ত করে। এর পরিমাপ ক্রমেই বাড়ায়। বাংলাদেশে গেল দুই দশকে আমরা সে প্রমাণ পাচ্ছি কড়ায়গন্ডায়। একটি নব্য ধনিকশ্রেণী তৈরি হয়েছে।

যারা 'কেমন বাজেট চাই' মার্কা শেরাটনমুখী অনুষ্ঠান করে রাষ্ট্রের শোষিতশ্রেণীকে 'টকশো' দেখায়। লুটেরা শ্রেণীর প্রতিনিধিরা পাশাপাশি চেয়ারে বসে মুচকি হাসে। আমাদের ক্ষমতাসীনরা আশার বাণী শোনান। আর বিরোধীরা 'কর্তব্যের খাতিরে' তা খন্ডন করেন কিছুটা। কারণ তারা জানেন, ক্ষমতায় তারাও ছিলেন।

কিছুই করতে পারেননি। আবারও যদি ক্ষমতায় যান তবুও তেমন কিছু করতে পারবেন না। তার কারণ সরকারি ও বিরোধী উভয়দলই ভোগবাদী। সমস্যাটা অন্যখানে। বৈষম্যের এই যে কালো পাথর তা কেউ সরাতে চায় না।

তারা তা রেখে দিতে চায়। স্তর তৈরি করে মানুষের যাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলতে চায়। বাংলাদেশে অর্থের দাপট এখন যে কয়েকটি ক্ষেত্রকে চরমভাবে দখলে নিয়েছে তার একটি হচ্ছে, শিক্ষা ব্যবস্থা। তুলনামূলক প্রতিযোগিতায় এখন প্রাইভেট স্কুল, কলেজ সেক্টরগুলো এগিয়ে গেছে বহু গুণ। ফলে গ্রাম থেকে উঠে আসা, গ্রামের স্কুলের মেধাবী ছাত্রটিও এখন আর টিকে থাকতে পারছে না।

টাকার খেলা, ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে মেধাবীদের স্বপ্ন। বাংলাদেশে আরেকটি নগ্নতম বৈষম্য ও শোষণের মাঠ হচ্ছে শ্রমিকের অধিকার। 'মে দিবস' এলে যে শ্রমিক নেতারা একসময় লম্বা লম্বা বক্তৃতা বিবৃতি দিতেন, তাদের অনেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায়, শিশুশ্রম বন্ধে তারা কতটা কাজ করেছেন কিংবা আন্তরিক ছিলেন। সে প্রশ্নটি আমি গোটা দেশবাসীকে করতে চাই।

বরং খুঁজলে দেখা যাবে, এ মন্ত্রীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাচ্ছে না। শিশুরা তাদের প্রতিষ্ঠানে শ্রম দিচ্ছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাঝে মধ্যেই যে শ্রমিক বিস্ফোরণ ঘটে, তা তো সেই ধারাবাহিকতারই প্রমাণ। খুবই পরিতাপের কথা, গ্রাম্য মাতবর মার্কা কুটচালে পারদর্শী কিছু রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশের কর্মজীবী মানুষের শ্রমের মর্যাদাকে সমুন্নত হতে দিচ্ছে না। আমার মনে পড়ছে, শেখ হাসিনা যখন 'ওরা টোকাই কেন' বইটি লিখলেন, তখন গ্রন্থটি সুধী সমাজে বেশ আলোড়ন তুলেছিল।

সেই সময়ে এক আড্ডায় কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর নেতা, বাগ্মী পার্লামেন্টারিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তিনি বইটি পড়েছেন কি-না? উত্তরে তিনি বলেছিলেন- 'হ্যাঁ' শুনেছি, কিন্তু গ্রন্থটি পড়িনি। এই হলো সিনিয়র অনেক রাজনীতিকের পঠন পাঠনের বাস্তবতা। এটা খুবই দুঃখের কথা, বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিকই এখন আর সমকালীন বিশ্বের বিষয়াদি নিয়ে পঠন-পাঠনের কথা ভাবেন না। তাদের পাঠ্যভাস নেই বললেই চলে। অথচ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, বঙ্গবন্ধু, ভাসানী, এ নেতারা কারাবরণে গেলেও তাদের সঙ্গে থাকত বই।

তারা গ্রন্থকে কাজে লাগাতেন রাজনৈতিক জীবনে। পাঠ্যভাসের কথাটি এজন্য তুললাম, কারণ শুধু পাঠের সমৃদ্ধিই একজন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সমাজসেবকের অন্তর্চক্ষু খুলে দিতে পারে। তাই,-না জানলে, ব্যাপকতার বিশালতা অনুধাবন করা যাবে কীভাবে? কীভাবে বুঝা যাবে সমকালীন বিবর্তনের পরিধি। বাংলাদেশে এসব অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত অকাল কুষ্মান্ডরাই রাজনীতির নিয়ামক। এরা যে কীভাবে চরম মৌলবাদীদের মিত্র হিসেবে কাজ করছে তা তারা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারছে না।

সম্প্রতি রাজবাড়ীতে বাউল সম্প্রদায়ের উপর যে নির্মমতম আক্রমণ করা হয়েছে, এটা কোন শ্রেণীর পাষন্ডের কাজ হতে পারে! প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এসব আক্রমণকারী হায়েনারা বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক কিংবা কর্মী। প্রকারান্তরে এই আক্রমণকারীরা যে রাজাকার মৌলবাদী গোষ্ঠীর পারপাস সার্ভ করেছে তা কী তারা ভেবে দেখেছে? যদি ভাবতো তাহলে এমনটি হতো না। তারা এমন ঘৃণ্যতম কাজ করতে পারত না। অথচ মরমিবাদ, বাউলতত্ত্ব সমাজে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে পরম শান্তির চর্চা বলেই বিবেচিত। এই সামন্তবাদী রাজনীতির চেলা চামুন্ডারা গোটা সমাজের জন্য কতটা যে ভয়াবহ তা তারা বাউলদের উপর আক্রমণ করে আবারও প্রমাণ করেছে।

দুই. সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সমাজের মানুষের কর্মের মূল্যায়ন করতে হবে। শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে। মে দিবসের ঘটনাটি ঘটেছিল আমেরিকার শিকাগো শহরে। অথচ আমেরিকায় মে দিবস ঘটা করে পালিত হয় না। কিন্তু শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন আমেরিকানরা ঠিকই করে নিয়েছে।

প্রতি ঘণ্টা মজুরি, প্রতি সপ্তাহান্তে বেতন নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। নূ্যনতম ঘণ্টাপ্রতি মজুরি সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়াচ্ছে ফেডারেল ইউএস গভর্নমেন্ট। আর আমরা বাংলাদেশে ডাকহাঁক দিয়ে 'মে দিবস' পালন করছি। কিন্তু আমাদের দেশে নূ্যনতম বেতনের স্কেল অত্যন্ত নড়বড়ে। তা কেউ মানছে, কেউ মানছে না।

অনেক কোম্পানি মাসে মাসে বেতনও দিচ্ছে না তাদের কর্মচারীদের। সমাজের বিবেকদর্পণ বলে পরিচিত যে সাংবাদিক সমাজ, মাসের পর মাস তারাও বেতন ভাতাহীন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। এমন সংবাদও আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি। ধনতান্ত্রিক ধারায় কর্পোরেট বিজনেস হাউজগুলো সংবাদ মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করছে। আবার সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা না দিয়ে মিডিয়া বন্ধও করে দিচ্ছে।

তাদের এই যে মানসিকতা, তা তো সামাজিক চরম অবক্ষয় মাত্র। আর এসব অনৈতিকতা, যে কোনভাবে লুটপাটের মানসিকতা গোটা রাষ্ট্রের নৈতিক অবকাঠামোকে ক্রমশ দুর্বল করে ফেলছে। প্রজন্ম পরিশুদ্ধ মননের চর্চা করার সুযোগ না পেয়ে 'বৈধ কিংবা অবৈধভাবে হোক' সস্তা টাকাকড়ির পিছু হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। বেনিয়া গোষ্টী কখনোই চায় না শ্রমজীবী মানুষ কাজকর্ম করে নিজ পায়ে দাঁড়াক। তারা চায় না মজুর, চাষি, কুলি, মালী, তাঁতি, জেলে, কামার, কুমারের মতো নিম্ন কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পেশার মানুষেরা শ্রমের প্রকৃত মর্যাদা পাক।

এর কারণ হলো বুর্জোয়া শ্রেণী সবসময়ই শ্রমিক শ্রেণীকে ভয় পায়। তাই তারা মনে করে এই শ্রেণী যদি মেরুদন্ড শক্ত করে উঠে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে তো সমাজের অলিখিত 'দাসপ্রথা' বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাংলাদেশের কাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। দুঃখের কথা, বাংলাদেশে একটি শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় থাকলেও শ্রমিকের ন্যায্য বিচার পাওয়ার জন্য শ্রম আদালত নেই। অথচ উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে ফ্যামিলি কোর্ট এর মতো লেবার কোর্টও একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা।

যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, একজন শ্রমিক কাজ করে বেতন পাননি এমন অভিযোগ ইউএস লেবার কোর্টে করার সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি আমলে নিয়ে আদালত খুব দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে শক্তিমান বুর্জোয়া শ্রেণী, দরিদ্র শ্রমিকের টুঁটি এমনভাবে চেপে ধরে, যাতে তারা কথা বলারও সাহস না পান। তাই মে দিবসের কর্মসূচিকে বক্তৃতা বিবৃতি, র‌্যালি, সমাবেশে সীমাবদ্ধ না রেখে গণমানুষের শ্রমের মর্যাদা দিতে কার্যকর ভূমিকা সরকারকেই নিতে হবে। শ্রমিক যদি তার সঠিক মজুরি ও মর্যাদা পায় তবে কোন সেক্টরেই অসন্তোষ দেখা দেয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। আবারও বলি সামাজিক অবক্ষয় রোধ করতে হলে মানুষকে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করতে হবে।

কাজ দিতে হবে। কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। নিউইয়র্ক, ২৭ এপ্রিল ২০১১ ------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ২৯ এপ্রিল ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- জি . টি.

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.