আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি শিশু শ্রমের পক্ষে, কারন...


ওলে আমাল সোনা মনি, আমাল যাদু, আমাল জানের জান, আমাল চাঁদ, আমাল কলিজার টুকলা... বাচ্চারা আসলেই কি যেন একটা যাদু। নইলে অমন করে ভালোবাসা আসে কেমন করে নিজ সন্তানের জন্য বা কোন শিশুর জন্য। আমি হাজার কথায় লিখে বোঝাতে পারবো না যে কি সেই গোপন রহস্য যার জন্য আমরা আমাদের সন্তানদের এত্তো ভালোবাসি! অদ্ভুত একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে আমাদের সন্তানের সাথে। বড় হতে থাকে সন্তানরা আমাদেরই চোখের সামনে দিনে দিনে ক্ষনে ক্ষনে। বেশ অনেকদিন ধরেই একটু অনিয়ম হয়েছে আমার লেখায়।

আজ বলতে চাইছি যে শিশু শ্রমের পক্ষে আমি। আমি জানি অনেক পাঠকই আমার লেখা পড়া বন্ধ করে দেবেন শুধু এই জন্যই যে, আমি শিশু শ্রমের পক্ষে। কিন্তু আমার এও বিশ্বাস আছে যে আপনারা আমার পুরো লেখাটা অবশ্যই পড়বেন। কারন টাইটেলে যা বলি তা বিস্তারিততে নাও থাকতে পারে। ইদানিং দেখেছি আমরা আমাদের সন্তানদের কেমন যেন অদ্ভুত এক জীবনের লক্ষ্য নিয়ে বড় করছি।

আমরা ওদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিত করি। আমরা নিশ্চিত করি ওরা যেন সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কোচিং এ পড়ে। ওরা যেন নানা ধরনের সাংষ্কৃতিক অংগনে জড়িয়ে থাকে। চেষ্টা করি ওরা যেন multi-dynamic হয়ে গড়ে উঠে। যখন আত্নীয়দের সাথে দেখা হয়, আমরা সন্তানের ভালো রেজাল্ট নিয়ে কথা বলতে আনন্দ বোধ করি (করারই কথা), যখন কোন প্রাগ্রামে যাই, আমরা চাই আমার সন্তান যে কিছু একটা performance দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।

ভালো কথা, আমি কিন্তু এগুলির বিপক্ষে নই। অবশ্যই এগুলি ভালো কাজ। কিন্তু অবশ্যই শুধু মাত্র এগুলিই একমাত্র ভালো কাজ নয়। এবং সন্তানকে নিয়ে আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এটাই হতে পারেনা। আমি এমন অনেক পরিবার দেখেছি যেখানে মা-বাবারা শুধু এটাই নিশ্চিত করছেন যে তার সন্তান সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাবার আগ পর্যন্ত যা কিছু করছে তা শুধুমাত্র লেখাপড়া কেন্দ্রিক কিনা।

তারা সন্তানের স্কুলের result দিয়ে বিচার করছেন যে সন্তান সঠিক দিকে যাচ্ছে কিনা। যদি result ভালো তো সব ভালো, no tension. আর যদি result ১৯-২০ হয়, তো সন্তানের কপালে মাইর আছে। বিশেষ করে মায়ের কাছে কড়া করে পিটুনি খাবেই খাবে। আমি মায়ের কথা উল্ল্যেখ করলাম এই জন্য যে, মায়েরা এই সকল বিষয়ে ইদানিং একটু বেশী sensitive হয়েছেন। যাই হোক, বিষয়টি অবশ্যই এতো ছোট নয় যে আমি সামান্য এই ব্লগ পোষ্টে প্রকাশ করতে পারবো।

তবে আজ আমি শিশু শ্রমের পক্ষে (অবশ্যই সেই শিশু শ্রম নয় যা আমরা জাতীয় পর্যায়ে বোঝাই) কিছু কথা বলবো। আচ্ছা, আপনার সন্তানের বয়স কি ৩-৪? আপনি কিন্তু অনায়াশেই আপনার এই তুলতুলে ৩-৪ বছর বয়সের শিশুটিকে দিয়ে পরিশ্রম করিয়ে নিতে পারেন। মনে মনে হয়তো বলছেন, "শিবলী ভাই, সবকিছুর একটা মাত্রা থাকা উচিত। ৩-৪ বছর বয়সের বাচ্চাকে দিয়ে ঘরের কাজ করাবো! শিবলী ভাই, আপনি আসলেই একটা পাগল আর সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। " এখনও যারা পড়ছেন এই পোষ্ট তাদের বলি, আপনি যদি মা হন আর যদি ৪-৫-৬-৭ বছরের সন্তান থাকে তবে ঘরের নানা কাজগুলি করাতে পারেন।

রান্নার সময় সন্তাকে একটু দুরে বসিয়ে রেখে কিছু কাজ দিন। যেমন এক গামলা মটরশুটি দিয়ে ছিলতে বলুন। কিংবা কোন শাকের পাতা ছিঁড়তে বলুন। এক গামলা মটরশুটি ছিলতেই হয়তো ওর ঘন্টা লেগে যাবে। যতোক্ষণ ওরা মটরশুটি ছিলতে চায় ছিলুক।

যতক্ষণ ছিলছে, আপনি একটু করে খেয়াল করুন আর মাঝে মাঝে বলুন, "বাহ্‌! খুব সুন্দর করে ছিলতে পারছো তো তুমি। জানো, আমি আমার ছোট বেলায় এমন সুন্দর করে ছিলতে পারতাম না। " পাঠক আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না যে এই ধরনের সামান্য প্রশংসা ও বানানো মিথ্যা কথা ওর জীবনের জন্য কতোটা প্রয়োজন। এবং আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না যে এই সামান্য কথাটা বলে কতো উপকার করলেন আপনার সন্তানের। যখন দুপুরে বা রাতে তরকারী খাবেন, পরিবারের অন্যদেরকে বলুন যে আপনার সন্তান মটরশুটি ছিলেছিলো।

দেখবেন সেও গর্বিত বোধ করবে। যখন কাপড় চোপড় গোছাবেন, আপনার বাচ্চার কাপড়গুলি সব ওর দিকে ছুঁড়ে দিন। আপনি বড়দেরগুলি গোছান আর ওকে ওরগুলি গোছাতে বলেন এবং সাথে এও বলেন যে আপনিও ছোট বেলায় নিজের জামা-কাপড় নিজেই গোছাতেন। কিন্তু যখন আপনার সন্তান গোছাবে, তখন বলুন যে আপনি ছোটবেলায় এমন সুন্দর করে গোছাতে পারতেন না। আপনার সন্তানকে দিয়েই তার খেলনা গুছিয়ে নিন।

ওকে বোঝান যে ওগুলি ওর খেলনা। অন্য কারো নয়। বাসার আর কেউ ওর খেলনা দিয়ে খেলেনা। সুতরাং ও যদি ওর খেলনা না গুছিয়ে রাখে তবে ওকে আর নতুন খেলনা দেয়া হবেনা। আবারো বলি force করার কিছু নেই।

৫-৬ বছর বয়সের শিশু আমাদের সকল কথা মানবেই এমন কথা নেই। কিন্তু আপনাকে ধৈর্য্যশীল হতে হবে। এবং একই কথা বারবার বলতে হবে। দেখবেন এই সামান্য ৪-৫ বছর বয়সের শিশুটিও যেন সব বুঝতে পারবে ও সেই মতো কাজ করবে। যদি সে খেলনা নিয়মিত না গুছিয়ে রাখে তবে একদিন ওর খুব পছন্দের একটা খেলনা আপনি লুকিয়ে রাখেন।

ও খেলনাটা খুঁজে পাবেনা। তখন তাকে বলুন যে, সে যদি গুছিয়ে রাখতো তবে হারাতো না। প্রয়োজনে ২-৩ ঘন্টা বা পুরো একটা দিন ওই খেলনাটা লুকিয়েই রাখেন। তারপর হঠাৎ আপনি নিজেই বের করে তাকে বলুন যে অমুক জায়গায় খুঁজে পেয়েছেন এবং আবার তাকে বলুন যে, সে যেন ভবিষ্যতে গুছিয়ে রাখে। যদিও আপনার শিশুর বয়স ৪-৫ তবুও ঘরের কোন একটা নির্দিষ্ট কাজ তার জন্য বরাদ্ধ করে দিন এবং তাকে সেই অনুভুতি দিন যে সে ছাড়া ঐ কাজটা আর কেউ ভালো করে করতে পারছেনা/পারেনা বা সে খুবি সুন্দর করে করতে পারছে বলেই তাকে দ্বায়ীত্ব দেয়া হয়েছে।

যেমন আমার ৫ বছরের জমজ বাচ্চাদুটির কাজ ঘুমাবার আগে কাঁথা বালিসগুলি বিছানায় যার যার জায়গা মতো গুছিয়ে রাখা। মানে আমার কাঁথা বালিশ আমার জায়গায়, ওদের আম্মুর কাঁথা বালিশ আম্মুর জায়গায়, ওর নিজের কাঁথা-বালিশ ওর নিজের জায়গায় আর ওর বোনের কাঁথা বালিশ ওর বোনের জায়গায়। এভাবে ওরা দুজন পালা করে এই কাজগুলি করে। এবং ওরা এও জানে যে ঐ কাজটি ওদেরি কাজ। যদি আপনার এলাকা নিরাপদ হয়ে থেকে থাকে তবে খুব কাছের দোকানেও পাঠাতে পারেন ছোট খাটো কেনাকাটার জন্য।

আর যদি এমনটি হয় যে তাকে একা পাঠানো উচিত হবে না, তবে আপনার সাথে নিয়ে যান। বাজারের একটা ব্যাগ ওর হাতেই দিন বহন করতে। আচ্ছা ভালো কথা, স্কুলে যাবার ও ফেরত আনার সময় কি আপনার সন্তানের ব্যাগ আপনি/ড্রাইভার বহন করেন? আপনার সন্তানের ঘাড়েই চাপিয়ে দেন না। ভয় পাবেন না, ও মানুষের বাচ্চা, সব পারবে। আমার বাচ্চাদুটির আরো অনেক কাজের ভেতর আরেকটা নির্দিষ্ট কাজ আছে।

যখনি আমরা সবাই বাসা থেকে কোথাও বেড়াতে যাই, ওদের দুজনের কাজ এটা নিশ্চিত করা যে, সকল লাইট, ফ্যান বন্ধ কিনা। টয়লেটে অযথা পানি পড়ছে কিনা, কোন জানালা দরজা বন্ধ কিনা এবং সব শেষে রান্না ঘরের জানালাটা একটু খোলা কি না। যদি কোন কিছুর ব্যাতিক্রম পায় তবে আমাকে রিপোর্ট করবে। যদি ৪-৫-৬ বছর বয়সও হয়, আপনার বাচ্চার জুতা ওকে দিয়েই পরিষ্কার করিয়ে নিন। কাপড় চোপড় ধোয়ার কাজটা আরো বড় হলে করানো যেতেও পারে।

তবে আপনার কাজ হবে ও যেন সঠিক ভাবে ওর জুতা পরিষ্কার করতে পারে সেই আয়োজন করে দেয়া। যদি ৪-৫ বছর বয়স হয়, তবে আপতত স্কুল ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বের করে দেয়াটা ওর কাজ বানিয়ে দিন। টিফিন বক্স ধোয়ার কাজটা আরো বড় হলে করানো যেতে পারে। যদি ১০-১২ বছর বয়স হয়ে গিয়ে থাকে তবে ওর জামার ছিঁড়ে যাওয়া বোতামটা কিভাবে লাগাতে হয় শিখিয়ে দিন। এভাবে বড় হবার সাথে সাথে কাজের ধরন পাল্টে দিন।

একটা পর্যায়ে ঘরের ছোট খাটো ইলেক্ট্রিক কাজও করতে পারবে আপনার কিশোর/কিশোরী সন্তান। আপনার কাজ হবে, ও যেন সঠিক ভাবে করতে পারে সেটার গাইড দেয়া ও safety-র বিষয়টি নিশ্চিত করা। মটরশুটি ছিলার কথাটা পড়ে হয়তো কেউ কেউ বলবেন, "শিবলী ভাই, মটরশুটি ছিলা জীবনের জন্য আহা মরি কোন কাজ নয়। বড় হলে এই সব কাজ এমনি এমনিই শিখবে। তারচেয়ে বরং আমি যখন রান্না করবো তখন ওদেরকে একটা ডিভিডি ছেড়ে দেবো।

বসে বসে শিক্ষনীয় ডিভিডি দেখবো আর অনেক কিছু শিখবে। " প্লিজ অমনটি করবেন না। বাচ্চাদেরকে cd/dvd ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজে লিপ্ত থেকে ভাববেন না যে আপনার শিশুর খুব বড় উপকার করছেন। মোট কথা, আপনার শিশুকে দিয়ে শুধুই লেখাপড়া নয়, নানা কাজে লিপ্ত করান, তাকে এই উপলব্ধী দিন যে তার জীবন শুধু লেখাপড়া আর খেলাই নয়। পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে সংসারের নানা কাজে তার অবদান দরকার সেটা তাকে বুঝতে হবে এবং একদম শিশু থেকেই নানা ধরনের অতি হালকা কাজের মাধ্যমেই আমাদের শিশুদের সেই শিক্ষা আমরা দিতে পারি একদম ৩-৪-৫ বছর বয়স থেকেই।

আর এই অনুভুতি থেকেই বলেছি যে শিশু শ্রমের পক্ষে আমি। মূল লেখা এখানে প্রকাশ পেয়েছে। শিশুদের বিষয়ে আরো জানতে এখানে ভিজিট করুন।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.